দিন আসে দিন চলে যায়। ঠিক মানুষদের আসা যাওয়ার মতোই।সকাল থেকে পুরোনো সকাল, তরুণ দুপুর, মাঝলা জোয়ান দুপুর,এজেড বুড়ো বাহাত্তুরে বাহুল্যে,থপথপে বুড়ো বিকেল,সাঁঝেলাবুড়ো বিদায়।ঠিক এমনই বিষণ্ণ বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটি দিন,গোটা গোটা রাত।পলাশের দিন শেষ হলো,আকাশে অনেক আগেই বর্ষার মেঘ।এবারে বুঝতেই পারছিনা যে গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে গেছে কুড়িকুড়ি সালের জন্য।বর্ষা এসে গেছে আষাঢ় চলে যাচ্ছে, তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আসবে শ্রাবণ। কত্তদিন পরে আমাদের গ্রামে এত্তগুলো দিন রাত সূর্য ওঠা,সূর্য ডোবা সব দেখতে পাচ্ছি। সেই শৈশবের দিন রাত খুঁজতে বেরোই এই গ্রামে।এপাড়া ওপাড়া প্রতিদিন যাই। লকডাউন ঘোষণা হলো।সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষের মনে কত প্রশ্ন।লকডাউন কী?এতে কী হবে?করোনা ক্যার নাম? উঃ এদ্যেশ্যে এসে কী করব্বে গো?দেশের হ্যালচ্যাল ভাল্যো বুইচি না বাপ্যু।এই সব লকডাউনে কী যি হব্ব্যে?
জানি না,আর পাঁচজন মানুষের মতো আমিও জানি না।মানুষেরা ঘরে ঢুকে গেছে, মেয়েরা তো ঘরেই থাকে।কেবল ঘরে আসতে পারেনি নামালে কাজে যাওয়া বালকেরা, বুড়োরা।মায়েরা খুব চিন্তা করছে। কি জান্যি বাপ্যু! খুকারা গর্যে ফিত্তে পারব্বে কি না!
কেউ যি মুনিশ ডাক্যে নাখো!কাম প্যাট না পেল্যে প্যাটে থুবো ক্যি?
হাগ্যো ল্যোকড্যাউয়ন কাক্যে বল্যে?ই শব্দ জেবণে শুনিনি।ইয়ার মানে ক্যি?
হার্যে করুনা করুনা কচ্চিস, সিত্যো কুন তিপান্তরের উপাশে আচ্যে। ইতা কুত্যা পাব্যি,করুনা?চ্যোল ভাই চ্যোল মাট্যের মাট্যিতে ঘড়্যের সগুল্যি ট্যাক্যা পয়স্যা ফেল্যিন দ্যিঁইচি।খুবই বিপ্যোদ গ্যো ,ই কুন আপ্যোদ এস গ্যাল্যো আমাদের এই পাঁচমুড়ো পাহাড়্যের তলায়!
শুনছি ,শুনে যাচ্ছি।প্রশ্ন উত্তর ।শুনে যাচ্ছি তাদের আপন আপন পালা গান।আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।আমিও জানি না লকডাউন কাকে বলে? প্রায় চার মাস হয়ে গেছে লকডাউন কাশ্মীরে।সেখানের মানুষদের মারার এক কল আবিষ্কার করেছে স্বাধীন ভারতের সরকার।যাকগে সে তো কাশ্মীরিদের জন্য।আমাদের জন্য তো নয়।কাশ্মীরিদের কোনো কান্না আমাদের ঘরে বাতাসে বয় না।আমরা দেশদ্রোহী হতে চাই না। মরুক তারা। কিন্তু তার পরেই শুরু হয়েছিলো এন আর সি নিয়ে উত্তাল শাহিনবাগ এবং ছড়িয়ে গেলো হাজার শাহিনবাগে।ভারতের মাটিতে ঝুঁকতে ঝুঁকতে সেজদায় বসে পড়লো জাফরাবাদ।ভারতের মাটিকে রক্ত দিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে সে মাটিকে চুমতে চুমতে মাটির সঙ্গে একাত্ম হতে থাকলো সীতার পাতাল প্রবেশের মতোই।তাতে আমার কী? সেতো দিল্লিতে।আমাদের ভয় নেই।আমরা নিরাপদে আছি। কিন্তু গ্রামে এই মানুষগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে তার দরজায় বাঘ এসে গেছে। এই বাঘ গুলোকে তাদেরই তাড়াতে হবে। যতই বলো যতোই চিৎকার করো বাঘ বাঘ । তারা বলে আমাদের তো দাদা আছে, কখনো বলে দিদি আছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি মানুষগুলোর দিকে। যখন বললাম আপনার ষাট বছরের কাগজ আছে?আপনি ভারতীয় এর প্রমান কী করে দেবেন!
ওরা কেবল হাসে,আর আমাকে বলে,কেনে গ্যো তুমাকে দেখেই তো বুজা যেচ্ছে, যি তুমি আমাদের এই বীরভূমের বুন জঙ্গলের মানুষ। তুমার হাতে শুকনো সিকুটি দিয়ে আঁক কেটে দিলে লালচে মুড়ামের ধুলো বেরেবে।ই মুড়াম সারা পিতিবি ধুড়লে পুয়া যাবে না।ওরা নিজের মাথার ঝাঁকড়া কোঁকড়া অবিন্যস্ত চুল কপালের দিকে টেনে ধরে বলে,এই দ্যেক্যো এমুন চ্যুল আমাদেরি আচ্যে।এতো মুট্যা চ্যুল আমাদের ছাড়া ক্যেদ্যের আচ্যে?
আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি।ওদের উত্তর শুনে মাটি থেকে পা ওঠে না।চোখে জল ভরে আসে।চোখের জলে দেখতে পাইনা পথ।পালাবো না। কোথাও পালাবো না। কোথায় যাবো! এই যে কাঁকুরে লাল মুড়াম মাটির ঘরের দেওয়াল,আমার গা গতর সব এই মুড়াম মাটিকে কেটে ছেঁটে পচিয়ে ল্যাচিয়ে তবে আমাকে বাড়াতে পেরেছে আমার দ্যেশ।আমার কাগজ লাগব্যে কেন্যে?
কারো কোনো কাগজ নেই।ভারতীয় বলার বড় প্রমাণ আমার শরীর,শরীরের গঠন,আমার চলন বলন আমার খাওয়া দাওয়া।আমি তো এই ভারতের বাতাস থেকে, মাটি থেকে ,খনিজ পদার্থ থেকে জীবনের সমস্ত উপাদান নিয়েছি।আমাদের জীবন বিজ্ঞানের মাষ্টারমহাশয় দীনবন্ধু গোস্বামী বলতেন,থাকো খাও বড়ো হও তার পর মরে গেলে নিজেকে পুড়িয়ে দিয়ে নিজেকে পচিয়ে দিয়ে এই মাটিকে এই বাতাসকে সব ফিরিয়ে দিয়ে তবে রক্ষে।
সেই এন আর সি নিয়ে বেশি কিছু বলি নি।ওরা বলেছিল এই ভারতের মাটি থেকে নিয়েছি এখানে মরে এই মাটি বাতাসকে সব দিয়ে যাবো।কপালে যা ল্যেখ্যে এনেছ্যি তা তো হব্ব্যেই। তা যদ্যি মুদীর লাথে মরণ ল্যাখ্যা আচ্যে ভ্যাল্যে তো মত্তে হবে।
কিন্তু এবার যে সব ভাসিয়ে সবকে ছাপিয়ে লকডাউন এসে হাজির হল্যো ঘরের আঙিনাতে।কাউকে কিছু বলা যায় না।যারা যারা ট্র্যাক চালক,গাড়ি চালক তারা ফিরে গেছে তাদের গাড়ি নিয়ে।গাড়ির মালিক তাই বলে দিয়েছে।
তার পর হাহাকার শুরু হল্যো।কাজ নাই,ঘরে খাবার নাই, টাকা আছে চাল নাই , সবজি নাই।আমি গ্রামে আছি। গ্রামের চারিদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ।কিন্তু শুধু ধান লাগান আছে।সবজী চাষ তারা কেউ করে না।এতো সময় কোতা হে। গ্রামে বাস করেও মাছ আসে অন্ধ্রের।চাল আসে মিলের,মুড়ি ভেজে দেয় মুড়ি কারখানার মালিক।চিনের মুড়ি খুব চালু।এই মুড়ি যত সস্তা আর কেউ দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত এত সস্তায়।লুল্লুড়ি ভাজা,কুড়কুড়ে ভাজা,আলুর চিপ্স,কোল্ডিংস সবগুলি এই গায়েই পুয়া যায়। কেনে যাব্বো শহরে লগরে!
এই ভাবেই চলে যাচ্ছি গ্রামের মানুষদের সঙ্গে।এর পরে এলো দলে দলে দূরের গ্রামের আদিবাসী মানুষগুলো রাতের অন্ধকারে গ্রাম থেকে বেরিয়ে ভোরে এসে হাজির আমাদের অফিসে।এ দাই আমাদের গাঁওতা খুব খেরাপ । কুনু খাবার নাই। চ্যাউলি দ্যাল বানুয়া।কাম্মি বানুয়া।হাড়াম্বাবা গজকিদায়া।(চাল ডাল নেই,কাজ নেই,বড়োবাবা মারা গেছে)।
অফিসের ত্রাণের দপ্তর আছে।রাতেই বেরিয়ে গেছি,পুলিশের হাতে মার খেয়েছি,মোটরবাইক কেড়েছে পুলিশ।আরো রাতে বেরিয়ে গেছি।মানুষের খবরাখবর নিতে দিতে।গ্রাম থেকে গ্রামে চলেছে এক আকস্মিক হাহাকার।কি জানি আমরা কোনো কিছুর জন্য তৈরি নই।ওই যে বলেছি সকলেই বলে আমাদের দাদা আছে আমাদের দিদি আছে,সেই সব কিছু ঠিক কর্যে দ্যেব্যে।
গ্রামের পর গ্রাম একই অবস্থা,কোন্ মানুষের সঙ্গে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলব্যো!ভেবে কুল কিনারা পাইনা।মানুষের বাচ্চারা দূরের দেশে কাজের জন্য গেছে।তারা যে কেউই ফিরতে পারেনি।এবার কি হব্বে!আবার মানুষ আসে,হ্যাগো দ্যিদ্যি আমাদের ছ্যালে গুলান সিই চ্যান্নায়ে,ক্যের্যেল্যাতে,পড়ে আছে গো।উয়োরা বল্যেচ্যে ঘর ভাড়া লাগব্যে।কাজ নাইখ,খাব্বে কি গো?আবার টেরেন,ব্যাস চল্যে নাখ।ছ্যালেরা আসব্যে ক্যি কর্যে?এবার গ্রাম জুড়ে এক আতঙ্ক।
ছ্যালেরা হাঁটে হাঁটে ঘর্যে আচ্চে।অত দূর্যের কুল্যি কি কর্যে আত্তে পারব্যে?
ফোনের পরে ফোন।মা বাবা ঘরে পাগল হয়ে আছে।তার উপরে করোনার তাড়া।গ্রামগুলো নিঝুম হয়ে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে।
দ্যিদ্যি তুম্যি কিচু কত্তে পারব্যে না?অগো উয়োরা খাব্ব্যে ক্যি?ঘর থেকে তাড়্যান দিচ্যে গো।ছ্যালের আমার হব্ব্যে ক্যি!
তার পর তিলপাড়া বেরেজের কাছে এসে ট্রাকে ধাক্কায় পাঁচ জনের মৃত্যু।বাড়ির কাছে এসে বাচ্চাদের অপঘাতে মৃত্যু।
বারবার মনে পড়ে,ওই মৃত ছেলেদের মায়ের কান্না। ছালেরা যকুন বল্যেছেলো মাগো ঘর থেকে যাতে মুন হয় না। তখন কতু কামপ্যাট ছেলো না।কাজ ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে কি করে যি সিড়িক পিয়ে যেল্যো ক্যার্যাল্যার।কুতা সি দ্যাশ?ছ্যালেরা যকুন হাতলড়ি পার্যা হল্যো তক্যুন কামপ্যাটের লেগ্যে যেল্যো,ঘড় আস্ত্যেই চাইন্যা।বছরে একবার আস্যে।যত্যই বল্যি ,অর্যে খুকা একব্যার আয় বাবা ঘর্যে,খুকা বল্যে,ঝখুন থাক্ত্যে চায়ে কেঁদ্যে ছিল্যাম মা,তখ্যুন বল্ল্যি ঘর্যে থেকে খাব্ব্যি কি? বাইর্যে ঝা বাবা, বোন্যের বিয়ে দিত্যে হব্যে। প্যোণ ধেক লাগব্যে। ঝা ঝা না হল্যে সুমাজে ম্যুক দিক্যাইতে লারব্যো। আর আজ বলছ্যিস ঘর্যে আয় একবার।আকুন যাব্ব্যো নাখ।সেই পূজো কড়ান্যি কর্যে ঘরে যাব্ব্যো গো মা। আকুন খুব ক্যাজ হচ্যে। আর আজ দেশ্যে কি হল্যো ছেলেদের আমার হাঁটে হাঁটে ঘর পাঠ্যিন দিচ্চ্যে। হায় গো আমাদের ছ্যালে সারা রাস্তা হেঁটে জল কাদা মাকতে মাকতে শেষে ঘর্যের দুয়োর্যে এমুন কর্যে লাশ হয়ে ঘর ঢুঁকল্যো!
এমুন দেশ্যে জন্মালছি বাবারে আমার তুকে প্যাটের দায়ে লাশ কর্যে দিল্যাম বাবার্যে আমার!
চোখ ভিজে যায়। শেষকৃত্য শেষ করে আসি ওদের সঙ্গে।খবরের কাগজ পড়ি না, টিভি ছেড়ে দিয়েছি।এতো মানুষের দেশ ভারত এতো বৈচিত্রের দেশ ভারত । ঝলসানো রুটিতে রক্ত দিয়ে মানচিত্রের আউটলাইনে আমাদের কাছে প্রেম চায়।
চারি দিকে কাজের হাহাকার।সকলেই বাড়ি ফিরলো কেউ লাশ হয়ে , কেউ সন্তানের কবর নাজানা রাস্তার পাশে দিয়ে।এবার করোনা নিয়ে শুরু হল্যো পুলিশের মার। এই গ্রাম গুলোতে সিভিকরা পুলিশ সেজে বেশ মার দিলো।শত্রু নিধন করলো কেউকেউ।
হাট বাজার এক প্রকার খোলাই রইলো।বাড়ির পুরুষদের খুব কষ্ট হচ্ছে। তারা ছাড়া গরুর মতো ঘুরছিলো,কিন্তু দফায় দফায় পুলিশের তাড়া খেতে থাকলো।ঘর তো একটা,সদস্য সাতজন।না না বেশি সন্তান নিয়ে নয়।হাম দো হামারা দো মা বাবা আর শ্বশুর ঘরের শালা নয়তো শাশুড়ি অথবা আর একজন। কাকে তাড়াবে ঘর থেকে।এখন যে খুব বিপদ।
মুশকিল ঘরে ঘরে।করোনা নেই কিন্তু বাইরের গরু গোয়ালে এসেছে,এবার মুখোমুখি।কী হবে?কিছুই লুকোনো যায় না। ভালোই গ্রাম জুড়ে পরকীয়া বিদ্যমান।একি!এমন গ্রামের ভিতরে কত স্বামীর কত প্রেমিকা!আবার কতো বউ-এর কত আশিক।
গ্রাম জুড়ে আশিক আর মাসুকা দেখা যাচ্ছে। এতা ভালোই লাগছে।কিছু করার নেই। তাহলে অন্তত বৃন্দাবলের নীল যমুনা আর যমুনায় জল আনতে যাওয়া দেখি। সময় নেই আবার মাকু হেম্রম এসে বলল, দিদি হিরাপুরের যে শ্রমিক গুলো ফিরেছে তাদের জ্বর আর ঠান্ডা।শুনে ভয়ে তো কপালে ঘাম। যাব কী করে?নেইনেই করে হলেও পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর।তবুও ভটভটি রেডি করা হলো।রাতের আধারে ডেউচা গিয়ে ঘাপ্টি মেরে বসে থাকলাম।তার পরে আরো রাতে হীরাপুরের জ্বরে ভোগা মানুষদের হাসপাতালে রাখা। দেখা গেলো জ্বর ভালো হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরে এলাম রাতের আঁধারে।
কি হবে দিদি মুরারই ১ পানিয়াড়া বাহাদুরপুর,গোপালপুরের অনেক শ্রমিক মাঝ রাস্তায় আটকে।তাদের মধ্যে একজন মারা গেছে না খেতে পেয়ে।বসিরহাটের এক জন স্বর্ণকার ফোন করেছে সে বাড়ি ফিরতে চায় , তার কাছে কোনো টাকা নেই। ওরা বারোজন পার টিকিট ১২০০ টাকা। ব্যাবস্থা করার চেষ্টা করেছি মাত্র। লকডাউন কাকে বলে?আচমকা করোনার গল্পের নাম লকডাউন।ট্রাম্পের ভারত ভ্রমনে করোনা আসে না, এর নাম লকডাউন।ট্রেনলাইনে একঝাঁক ফিরতি পথের শ্রমিকদের রক্তাক্ত রুটির উপরে ছেঁড়াখোঁড়া লাশের নাম লকডাউন।ঘরের দুয়ারে এসে ট্রাকের মুখোমুখি ধাকায় শ্রমিকদের মৃত্যুর নাম লকডাউন।সিলেবাস পাল্টে দেবার নাম লকডাউন।কাফিলখানকে বন্দী করে রাখার নাম লকডাউন।সফুরাকে বন্দী রাখার নাম লকডাউন।শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের খাবার যোগান দেবার অপরাধে শিখভাইকে বন্দী করার নাম লকডাউন।বিরোধী কন্ঠ রুদ্ধ করার নাম লকডাউন।বিচারের দরজা বন্ধ রাখার নাম লকডাউন।এইতো মোক্ষম সুযোগ দেশকে ভালোবাসার।করোনা মুসলমান হয়ে ভারতের ঘরে ঘরে নাকি হামলা করছে।দেশের শিক্ষার মান কমে গেছে,বিপিএলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই লকডাউনে দেখতে পাচ্ছি গরিবদের মাঠের সস্তা শ্রমিকের খাবার খোঁজা আর স্কুল শিক্ষকদের দুটো করে ইন্দিরা আবাস পাওয়া।হাইস্কুলের শিক্ষকের বিধবা স্ত্রী বিধবা ভাতা পাচ্ছে,বস্তাবস্তা চাল তুলে আনছে রেশন ডিলারের কাছ থেকে, ময়দার প্যাকেট তারা ১৩টাকায় বিক্রি করছে।আর গরিব শ্রমিকের বিধবা স্ত্রীর কোনো ভাতা নেই। তাদের এখনো বয়স হয়নি।
আমি এখন প্রতিদিন এই গ্রামে বসে কেবল এই দেশপ্রেম দেখে যাচ্ছি।মসজিদের মাইক ব্যবহার কমছে,বা মাইকের আওয়াজ কমছে। ওদিকে হিন্দু গ্রামে সকাল সন্ধ্যা ঠাকুর অনুকুল বা বাবা ভুইফোঁড়ের কীর্তন নতুন করে চলছে দুইবেলা। তার সাউন্ড এতো বেশি দেওয়া যে আশপাশের গ্রামগুলো আপন বাড়ি থেকেই শুনতে পায়।জানিনা তাদের ঘরে কোনো রুগী আছে কিনা!তাদের ঘরে কোনো পড়ুয়া আছে কি না!
ভালোই লাগছে , গ্রামে বসে বসে এই সব দেখে যাচ্ছি। এরই মাঝে লকডাউনে বিয়ে হচ্ছে। মোটর সাইকেলে বর তার বোনকে নিয়ে বিয়ে করতে আসছে সঙ্গে আর একটি মোটর বাইক।বিয়ে এক ঘণ্টাতে শেষ। লোকজন নেই, ভারি কোনো খরচ নেই। বিয়ে শেষে মেয়েটি বেনারসী পরে কপালে টায়রা ঝুলিয়ে বৌ সেজে নিলো নিজেনিজেই।তার পর মোটর সাইকেলের পিছনে বৌ বসে চললো নতুন গ্রামে।নদী পার হতে গিয়ে পুলিশ সেই বৌকে আর বরকে ধরে ফেললো,আবার বাবার বাড়িতে ফেরত দিয়ে যায় বউকে, কারন এখন লকডাউন, কোথাও বেরোনো যাবে না। আমি বসে আছি আমার ঘরে ,এই বারান্দা থেকে সূর্য ওঠা এবং সূর্য ডোবা দুটোই দেখছি।বড়ো বিষণ্ণ আমি।কত্তোদিন পরে এই গ্রামে বসে আছি কর্মঠ মানুষ কর্মহীন হয়ে, দিনদিন সস্তার মুনিশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কোনো কাজ নেই,কিন্তু গ্রামগুলো সাম্প্রদায়িকতার আগুনের জ্বালানি যোগাড় করছে দেখতে পাচ্ছি।হয়তো নজরুলের স্বাধীনতার পোড়া বার্তার মতোই পড়ে থাকবে আমাদের মাটির গ্রামগুলো।