‘তেহারি’ খেয়েছেন কখনও? তেহারি, তেহেরি, তেয়ারি নানা নামে ডাকে হয় একে। গুগল সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তেহারি হল নিরামিষ খাবার।
যাঁরা মাংস খান না, তাঁদের কথা মাথায় রেখে এই খাবারের জন্ম হয়েছিল অবধে। আওয়াধ রাজ্যে। সব রাজকর্মী যখন দুপুরে বিরিয়ানি খাচ্ছেন তখন গ্রন্থাগারকর্মীদের কথা মাথায় রেখে অবধ নবাবদের রসুইঘরে এমন খাবারের কথা মাথায় আসে অবধের বাবুর্চির।
অবধের যে নিশাপুরি রাজবংশ তার প্রথম শাসক ছিলেন সাদাত আলি খান (প্রথম)। তাঁর পিতা সৈয়দ নাসির পারস্যের নিশাপুর থেকে ভাগ্যের সন্ধানে ভারতে এসেছিলেন। সাদাত আলি বাহাদুরের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যা সদর-উন-নিসার সঙ্গে বিবাহ হয় সফদর জঙ্গের সঙ্গে। সফদর ব্ল্যাকশিপ তুর্কমেন, কারা ইউসুফের বংশধর। সফদর জঙ্গের পুত্র শুজা-উদ-দৌলার নাম ‘বক্সারের যুদ্ধ’-এর সুবাদে শুনেছেন, বাংলার মীর কাশিমের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। হেরে গিয়ে প্রচুর জরিমানা দিতে হয়েছিল। শুজা-উদ-দৌলা মায়ের থেকে পারসীয় হলেও বাবার দিক থেকে তুর্কি।
শুজা-উদ-দৌলার পুত্র আসফ-উদ-দৌলা অবধের রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে তুলে আনেন লখনউ-তে। বড় ইমামবাড়া, ভুলভালাইয়া, রুমি তোরণ ইত্যাদি নানা কিছু গড়ে তোলেন আসফ-উদ-দৌলা। আসফ গড়ে তুলেছিলেন বিরাট এক গ্রন্থাগার।
অবধের শাসকরা অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী ছিলেন। বিলাসী নবাব আসফ-উদ-দৌলা উর্দু ও ফারসিতে অনেক দিওয়ান লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন সাত খণ্ডে লেখা অভিধান। শুজা-উদ-দৌলার পৌত্র, আসফ-উদ-দৌলার ভ্রাতুষ্পুত্র গাজিউদ্দিন হায়দার “হফৎ কুলজুম’’ নামে দু খণ্ডের ফারসি ভাষা ও ব্যাকরণের অভিধান তৈরি করেন। অবধের শেষ শাসক ওয়াজিদ আলি শাহ আক্ষরিক অর্থে ‘পলিম্যাথ’ ছিলেন। কাব্য, সঙ্গীত, নৃত্য, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি নানা শাখায় তিনি সে প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। তাঁরও ছিল তাক লাগানো বইয়ের সম্ভার। ওয়াজিদ যখন অবধ থেকে কলকাতায় (ইলাহাবাদ, বারাণসী হয়ে) এলেন, তখনও রমজান মাস এবং গ্রীষ্মকাল। সব বইপত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেননি, গ্রন্থাগারকর্মীদেরও রেখে আসতে হয়েছিল। কিন্তু তেহরির রেসিপি সঙ্গে এনেছিলেন। কারাবাস শেষ করে মেটিয়াবুরজে বানালেন সাহাফা। সাহাফা হল ওয়াজিদ আলি শাহ-র ছাপাখানা। বৈঠকখানা বাজারে রাজমুকুটের রত্ন বেচে গড়ে তুললেন নতুন মেটিয়াবুরজ। ওয়াজিদ আলির মেটিয়াবুরজ প্রেসের নিরামাষাশী কর্মীদের দুপুরের খাবার তেয়ারি করলেন বাবুর্চি।
তেহরি।
কুমকুমের সঙ্গে কথা বলছিলাম তেহরি নিয়ে। সে মেটিয়াবুরজের বাসিন্দা। কমল টকিজের পেছনে, শ্যাম লাল রোডের উলটো দিকের রাস্তা দিলওয়ার জাহ লেন দিয়ে একটু হেঁটে গেলে কুমকুমের বাড়ি। দুপুরে সে তেহরি বানিয়েছিল। কিন্তু কেমন করে সে কথা সে বলছে না মোটেই। নবাব রাজার গল্পে তার বেশি আগ্রহ। কুমকুমের বাড়ি গঙ্গার ধারে। বাঁ দিকে একটু হেঁটে গেলে বিচালি ঘাট যেখানে এক কালে জেনারেল ম্যাকলয়েড জাহাজ থেকে নেমেছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। সামান্য ডান দিকে সুরিনাম ঘাট, যেখান থেকে শস্তার শ্রমিক বিদেশে পাচার করত ইংরেজরা। নদীর ওপারে কিড ভাইদের বানানো শাহি বোটানিক গার্ডেন। হরেক রকম মশলার গাছ আছে সেখানে। শোনা যায়, নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য নদীর নীচে একটি সুড়ঙ্গ আছে। ওয়াজিদ আলি শাহ শেকলে বাঘ বেঁধে ওপারে যেতেন প্রাতর্ভ্রমণ করতে। কুমকুম এই সব নানা গল্প একের পর এক বলেই যাচ্ছে। পরনে তার লুঙ্গি, হাফ শার্ট। মুখে সব সময় বিড়ি। বিয়ে করেনি, বোনঝিকে মানুষ করে। বোনঝি এখন ডাক্তারি পড়ে। কুমকুম দর্জির কাজ করে। সে বলল, হলদি হল তেহারির মূল মশলা। আম হলদি তো এখানে পাওয়া যায় না, তা পেতে গেলে তোমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আমি বললাম, দূর! লালগোলার জাহাঙ্গীরের আম বাগানে কত হলুদ! সুমন হলুদ গাছের পাতা দেখে বলেছিল, এই পাতা দিয়ে ঝিঙে রান্না তার প্রিয় পদ। কুমকুম বলল, কেরালার থেকাড্ডি যাও, পাবে। আমের গন্ধযুক্ত হলদি!
হলুদ আম জনগণের মশলা। কিছু নিরামিশ রান্না বাদ দিলে হলুদ পড়ে না এমন ব্যঞ্জন বিরল। অভিধান বলছে, হরিদ্রা জনগণেশের একটি নাম। গণপতি। সে কথা তন্ত্রসারে পাওয়া যায়। আমরা যে হলুদ খাই তা আসলে হরিদ্রামূল।
হলুদের নানা ব্যবহার। তা গায়ে মাখে, খায়, এমনকি কাপড়ও রাঙায়। কেটে গেলে ক্ষতস্থানে চুন-হলুদ লাগানো পুরনো প্রথা। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে হরিদ্রার নানা গুণের কথা আছে। মুরগির ঝিমুনি রোগে মা-মাসিরা হলুদ ভাত খাওয়ায়। এক কালে এই দেশের সাধুরা মাটির বদলে হরিদ্রামূল দিয়ে কাপড় রঙাতেন। অঞ্চলভেদে হলুদের নানা রকম শেড। গেরুয়া হলুদও আছে, দক্ষিণ ভারতে। হরিদ্রয়া পীতবর্ণং বস্ত্রম্--নৈষধচরিতের কথা।
আমাদের দেশে সাধারণত বৈশাখ মাসে হলুদ লাগানো হয়। তোলা হয় পৌষ মাসে। সব জায়গাতে হয়। তবে মাটি দোঁয়াশ হলে ভাল। বেশ লাভজনক। আজকাল বাংলার লোকজন হলুদ চাষ খুব কম করে, তাই হলুদের এত দাম! আমার জেঠু বলেন, হলুদ চাষে ধানের তিন গুণ লাভ। এক কাঠায় কয়েক মণ হলুদ ফলে। হলুদ ভারতের নিজস্ব মশলা। বাইতে থেকে আসেনি।
এই হলুদ হল তেহারির প্রধান মশলা। তেহরি/ তেহারি/ তেহেরি—হিতোপদেশে আছে তি(তে)হরী, যার মানে ত্রিসর-সম্বন্ধী, ত্রিযষ্ঠিক, তেনরী। তেহরি চাঁপার মালা, তেহেরি... মালতীর মালা, তেহেরি... মল্লিকার দাম।
তেহরির প্রধান উপাদান তিনটি—হলুদ, চাল ও পেঁয়াজ। যে কোনও চাল তিন কাপ নিন। ছোটো চামচের এক চামচ হলুদ গুঁড়ো। একটি মাঝারি মাপের পেঁয়াজ।
চাল ধুয়ে নিন। ঠিক তিন বার বার ধোবেন। তার পর ভিজিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। ছ কাপ জল চাপিয়ে দিন হাঁড়িতে। ফুটতে দিন। নামিয়ে হলুদ ও নুন মেশান, আবার জল ফুটতে দিন। পানি ঝরানো চাল মেশান ফুটন্ত জলে। চাল সেদ্ধ হয়ে গেলে ফ্যান গেলে দিন।
এই বার একটি ছোটো কড়াইয়ে তেল গরম করুন। গরম তেলের ধোঁয়া উঠতে দেখলেই আগুন নিভিয়ে দিন। গ্যাসের চুলো না হলে কড়াই নামিয়ে নিন। মিহি করে কাটা পেঁয়াজ মেশান তেলে। আবার উনুনে দিন কড়াই। ঢিমে আঁচে সোনালি করে ভেজে নিন পেঁয়াজ। এই বার ঝরঝরে ভাতে বেরেশতা (ভাজা পেঁয়াজ) খুব ভাল করে মেশান যাতে প্রত্যেকটি ভাতের গায়ে তেল লাগে।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ--তেহারি এমনি এমনি খেতে হয়। সঙ্গে আলাদা কোনও পদ যুক্ত হবে না।
(রেসিপির অংশটুকু নেওয়া হয়েছে Marryam H. Reshii-র বই The Flavour of Spice থেকে, প্রকাশক—Hachette India, 2017)