পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নিত্য-প্রয়োজন ও নিত্য-প্রয়োজনীয়

  • 18 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2908 view(s)
  • লিখেছেন : সুদেষ্ণা দত্ত
নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে গেলে নিত্য যেটি প্রয়োজন তা হল কাজ আর অর্থের যোগান। কারণ এই অতি সাধারণ মানুষগুলির নিত্য খাদ্য তালিকার মধ্যে যা যা লাগে তার অনেকটাই বাজার নির্ভর। খাদ্য ও অর্থ সুরক্ষার সামঞ্জস্য না থাকলে বজবজ-মহেশতলা অঞ্চলের এইসব অনিত্য-প্রয়োজনীয় শিল্পের সঙ্গে যুক্তশ্রমজীবি মানুষগুলি ভাত ফুটোবে কী উপায়ে?

অমুকদা আমাদের বাড়ির কাছে শেখ পাড়ায় থাকেন। পেশায় রং মিস্ত্রী।আজ সকালবেলা তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, ধার চাইতে। সবেবরাতের আগেও আরেকবার এসেছিলেন। এপ্রিলের শুরুতে ওনার আশা ছিল যে, ১৪ তারিখের পরে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর তাঁর কাজ চালু হবে। আরতখন এই ধার মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। সেই আশায় ছাই দিয়ে লকডাউন বেড়েছে তেসরা মে অবধি।পুনরায় ধার নেওয়ার আগে অমুক দা জানিয়ে যান যে, তিনি আর সংসার চালাতে পারছেন না। ধার নেওয়ার পরে আশ্বাস দিয়ে যান যে- এই টাকা তিনি মেরে দেবেন না। “কাজ চালু হলেই………”।

তমুকদি আমাদের পাড়ায় দশ বাড়িতে কাজ করেন। তেইশ বছরের এই দিদি আট বছর বয়স থেকে পরিচারিকার কাজ করে আসছেন। তাঁর স্বামী দর্জির কাজ জানেন। পুজোর আগে থেকেই ওস্তাগরের কাছ থেকে দিদির বরটি আর কাজ পাচ্ছেন না। সংসারের সুরাহার জন্য তমুকদি বাড়ি ফিরে বাজি তৈরি করেন। তাঁর পাড়ার বেশিরভাগ প্রতিবেশী বাজি তৈরি করার কাজে যুক্ত। এই লকডাউনের ফলে বাজির কাজ বন্ধ। বেশির ভাগ বাবুর বাড়ি তমুকদিকে লকডাউনের তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই পুনরায় কাজে ফিরে আসতে বলেছে। এই মাগ্যি-গন্ডার বাজারে তমুকদির কাছে বাবুদের বাড়ির কাজ বেঁচে থাকার খড়-কুটো।

“পাড়ার কী অবস্থা রে”? উত্তরে তিনি বলেন-“পেটে গামছা বেঁধে শুকোচ্ছে”। যার নিহিতার্থ হল, অনাহারে বা অর্ধাহারেদিন-যাপন শুরু হয়ে গেছে।

জনৈক দাদা যিনি পঞ্চায়েত এলাকায় থাকেন এবং চট্টা বাজার থেকে কাটা কাপড় এনে সেগুলি সেলাই করে, সম্পূর্ণ তৈরি মাল জমা দিয়ে রোজগার করেন, বাইশে মার্চের পর থেকে তাঁর কাজ বন্ধ। যে টাকাটা তিনি মজদুরি হিসেবে এখনও পান, তার পুরোটা ওস্তাগরের কাছ থেকে যোগাড় করতে পারেন নি। জামা-কাপড় নিত্য-প্রয়োজনের তালিকায় পড়ে না বলে, চট্টার বাজার বন্ধ। তাই বিক্রিও বন্ধ। ফলস্বরূপ ওস্তাগরের মজুরি দেবার উপায়ও বন্ধ। দাদা ধার করে কোনোক্রমে চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার ধার করতেগেলেও তো বাইরে বেরোতে হবে। ওদিকে পুলিশের রক্তচক্ষুর ভয়।

“কাজ শুরু হলেই চালিয়ে নিতে পারব…”।-আশা-ভরা গলায় বলেন তিনি।

“আর যদি লকডাউন চলে”?

“তাহলে আর কী! ছেলে-পিলে নিয়ে ঘরে শুকিয়ে মরব”।– আবার সেই অনাহারের রক্তচক্ষু।

আমি থাকি বজবজ অঞ্চলে। পোশাক তৈরি, বাজি তৈরি, জুতোর বিভিন্ন অংশ তৈরি -ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট-শিল্পের দৌলতে হাজার সংসারের ভাতের হাঁড়ি উনুনে ওঠে। এইগুলির কোনোটাই নিত্য-প্রয়োজনের জিনিস নয়। কিন্তু সেই জিনিসগুলি থেকে যা রোজগার হয়, তাতে বাড়ির নিত্য-প্রয়োজন মেটে।

এনাদের মধ্যে ডিজিটাল রেশন কার্ড যাঁদের আছে, তাঁরা চাল আর আটা পেয়েছেন।কিন্তু এনারা জানেন না ঠিক কত কেজি খাদ্য-শস্য তাঁর জন্য বরাদ্দ। আবার এনাদের বেশিরভাগের হয় রেশন কার্ড নেই বা থাকলেও তা রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা-২ এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিনা মূল্যে কার্ড পিছু দু কেজি চাল আর তিন কেজি গম পাওয়ার সুবিধা থেকে এনারা বঞ্চিত। অবস্থার প্রেক্ষিতে এনাদের অনেকেই এখন অন্তত রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা-১ এর আওতা ভুক্ত হবার যোগ্য। যাদের রেশন কার্ড নেই, তাঁরা যে জেনেরাল রিলিফ এর আওতায় সংশ্লিষ্ট থানা, বিডিও অফিস, বোরো অফিস বা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এক ইউনিট (১২ কেজি) চাল পাওয়ার হকদার, তাই বা ক’জন জানেন?

এনাদের মধ্যে যাঁদের ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই, তাঁরা ফুড-কুপনের মাধ্যমে একই মাপের চাল -গম পাবেন, সেই তথ্যও সাধারণ খেটে খাওয়া এই মানুষগুলির অজানা।

এম.পি কোটায় ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা অঞ্চলে চালু হয়েছে কমিউনিটি কিচেন। সেখান থেকে প্রতিদিন চল্লিশ হাজার অভুক্ত মানুষের বাড়ি খাবার পৌঁছে দেবার কথা।বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে বাড়ি থেকে ফোন করে নিজের নাম নথিভুক্ত করাতে পারলেই কেল্লা ফতে। ফোনের মাধ্যমে সেই চল্লিশ হাজারের সীমারেখার মধ্যে ঢুকতে পারছেন না অনেকেই।

এমনকি যদি তর্কের খাতিরে মেনেই নিই যে, সবাই খাদ্য-সুরক্ষা দপ্তর নির্দেশিত অতিরিক্ত খাদ্য-শস্য পেয়ে যাচ্ছেন, তা বাদেও অন্য অনেক কিছুর জন্য এনাদের বাজারে যেতে হয়।আলু, তেল, নুন আর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হাত ধোয়ার সাবানের যোগান দেওয়ার দায়ভার নেবে কে? স্বেচ্ছাসেবকদের ক্ষমতার বিন্দু দিয়ে বিপুল নিম্নবিত্তের চাহিদার মরুভূমিতে আধখানা কেন সিকিভাগ মরুদ্যান গড়ে তোলাও সম্ভব নয়।

নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে গেলে নিত্য যেটি প্রয়োজন তা হল কাজ আর অর্থের যোগান। কারণ, এই অতি সাধারণ মানুষগুলির নিত্য খাদ্য তালিকার মধ্যে যা যা লাগে তার অনেকটাই বাজার নির্ভর। খাদ্য ও অর্থ সুরক্ষার সামঞ্জস্য না থাকলে বজবজ-মহেশতলা অঞ্চলের এইসব অনিত্য-প্রয়োজনীয় শিল্পের সঙ্গে যুক্তশ্রমজীবি মানুষগুলি ভাত ফুটোবে কী উপায়ে?

0 Comments

Post Comment