পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মহাকাব্যে বিরিয়ানি

  • 08 February, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 4943 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
শুধু কৌরব নয়, পাণ্ডবরাও পলান্ন খেতেন। এবং তা বৈদিক যুগের খাদ্য বলেই বিবেচিত। পলান্ন কী? পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন—মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। ভারতচন্দ্র লিখছেন, সঘৃত পলান্নে পরিপূর্ণ রত্নহাতা। পল হল মাংস।  বিরিয়ানির ইতিহাস নিয়ে একটি লেখা



রাজেন্দ্র ধৃতরাষ্ট্র যুবরাজ দুর্যোধনকে সভাপর্বে বলছেন, তুমি দামি প্রাবার (উত্তরীয়) পরিধান করো, সুস্বাদু পলান্ন (বিরিয়ানি) খাও, তা সত্ত্বেও তুমি এত কৃশকায় হচ্ছ কেন?
শুধু কৌরব নয়, পাণ্ডবরাও পলান্ন খেতেন। এবং তা বৈদিক যুগের খাদ্য বলেই বিবেচিত। পলান্ন কী? পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন—মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। ভারতচন্দ্র লিখছেন, সঘৃত পলান্নে পরিপূর্ণ রত্নহাতা। পল হল মাংস।
পল পল দিল কি পাস তুম রহতে হো। হ্যাঁ, পল সময়ের এককও। দণ্ডের ষষ্টিতম অংশকে ‘পল’ বলে।
কিন্তু পল-এর প্রাথমিক অর্থ মাংস—মুক্তাফলায় করিণং হরিণং পলায় (হস্তি)।
অভিমন্যুর বিবাহ বাসরে নানা রকমের মদ ও মাংসের সঙ্গে ঢালাও পলান্নের আয়োজন ছিল। মাংস মিশ্রিত অন্ন, ঘিয়ে পাক করা। মহাভারতের পাকশাস্ত্র ঘাটলে সহজেই এই সুখাদ্যের হদিস মিলবে।
রাজা নলের কথা সকলেই শুনেছেন। নল-দময়ন্তীর কাহিনি মহাকাব্যের পাঠকমাত্র অবগত। নল ছিলেন দক্ষ পাচক বা সূদ। তিনি খুব ভাল পলান্ন বা বিরিয়ানি রাঁধতে পারতেন। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম হল ‘পাকদর্পণ’। সেই পাকদর্পণে তিনি বিরিয়ানি রাঁধার কৌশল শেখাচ্ছেন।
কে এই নল? তিনি নিষধরাজ্যের নৃপতি, অশ্বতত্ত্বজ্ঞ, অক্ষক্রীড়ায় দক্ষ, রূপবান, বিরাট অক্ষৌহিনী সৈন্যের অধিপতি। বনপর্বে যুধিষ্ঠিরকে নলোপাখ্যান কাহিনি শোনাচ্ছেন বৃহদশ্ব মুনি। দ্যুতক্রীড়ার নিমিত্ত নল ও দময়ন্তীর বিচ্ছেদের পর দুই সন্তানের জননী দময়ন্তীর স্বয়ম্বর সভা বসেছে। রাজা ঋতুপর্ণ এসেছেন সেই সভায়। বিকৃত চেহারার নলও এসেছেন সেখানে রাজার রথচালক হয়ে। রথচালকের রান্না করা মাংস খেয়ে দময়ন্তী বুঝতে পারলেন কলির প্রভাবে ওই রথচালকের রূপহানি হলেও ওই ব্যক্তিই নল, এ বিষয়ে দময়ন্তী নিশ্চিত। নল ছাড়া এই রেসিপি ভূভারতে কেউ জানেন না। রাজ্যহারানো রাজা, রূপহারানো পাচক নল ও বিদর্ভের রাজকুমারী দময়ন্তীর পুনর্মিলন হল। রান্না কি না করতে পারে!
সুসিদ্ধ পলান্নের গুণাবলি প্রসঙ্গে রাজা নল ‘পাকদর্পণ’-এ ‘মাংসোদনস্য গুণাঃ’-তে বলছেন, ইদং রুচিকরং বৃষ্যং পথ্যং লঘুবলপ্রদম্। ধাতুবৃদ্ধিকরত্বাচ্চ ব্রণদোষান্ প্রশাম্যতি। মাংসদন বা পলান্ন অর্থাৎ বিরিয়ানি হল সুস্বাদু, পুষ্টিকর, রতি-উদ্দীপক, উপকারী, হালকা, শক্তিবর্ধনকারী। শরীরের কোষজনিত কারণে যে ক্ষত তৈরি হয় তার নিরাময় করে বিরিয়ানি বা পলান্ন।

biriyani

কীভাবে তৈরি করবেন এই স্বাস্থ্যরক্ষাকারী বিরিয়ানি? নল জানাচ্ছেন, লাবুকমাংসদন নির্মাণবিধি। লাবু এখানে লাউ নয়, কোয়েল পাখির মাংস। চিকেন ধরে নেওয়া যেতে পারে। মাংস চালের দানার মতো টুকরো টুকরো করে নিয়ে ভাল করে ধুতে হবে। অর্থাৎ, মাংসকে কিমা করতে হবে। জল ঝরিয়ে গরম ঘিয়ের সঙ্গে মেশাতে হবে। খুব ভাল করে ভেজে কিমা তুলে নিয়ে পড়ে থাকা ঘিয়ে চাল ভেজে মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করতে হবে। পুটলি মশলার কথা বলা আছে। কী থাকে সেই পুটলিতে? নানা রকমের ভেষজ। পানের শেকড় থেকে সুগন্ধী নানা কিছু। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচকের উপর মশলার ব্যাপারটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। কিমা দিয়ে পলান্নের কথা, তাও আবার মুরগির মাংস দিয়ে, এমন রান্না প্রাচীন সাহিত্যে প্রায় বিরল। কুক্কুটমাংস দিয়ে পলান্নের কথা আছে নলের ওই গ্রন্থে। সেই বিরিয়ানি নাকি পেটের রুগিদের জন্য উপকারী। এই রান্নায় তিনটি মশলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে—সৈন্ধব লবণ, হিং ও তিলের তেল।
সবাই তো আর পেটের রুগি নন। তাই লাল গোস্ত—ছাগল বা ভেড়ার মাংস দিয়ে পলান্নের কথা বেশি স্বীকৃত। বিরাট রাজার গৃহে যখন অজ্ঞাতবাস করছিলেন পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদী, তখন পাচকের ছদ্মবেশে ছিলেন ভীম। তাঁর নাম ছিল বল্লব। বল্লব মানে পাচক। বল্লভ নয়, বল্লব। ওদিকে যুধিষ্ঠির অক্ষবিশারদ কঙ্ক নাম নিয়ে পাশা খেলছেন রাজার সঙ্গে, দ্রৌপদী বিউটিশিয়ান হয়ে সাজাচ্ছেন বিরাটগৃহিনী সুদেষ্ণাকে, নকুল-সহদেব গরু-ঘোড়ার দেখভাল করছেন আর বৃহনল্লা অর্জুন নাচগান শেখাচ্ছেন উত্তরাকে। বিরাট রাজার বিশাল রসুইঘরে ভীম রান্না করছেন বিরিয়ানি। চারদিক গন্ধে ম ম। সেই রান্নার গন্ধে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন যুধিষ্ঠির। না, খাদ্যের লোভে নয়; তাঁর চিন্তা, এমন বিরিয়ানির গন্ধ না কৌরবদের কাছে পৌঁছে যায়! তাহলে তো দফারফা। তাঁদের অজ্ঞাতবাস জ্ঞাত হলে আবার বারো বছর বনবাস হবে। তিনি ভীমকে ডেকে মশলাপাতি একটু কম দিতে বললেন।
সেই বিরিয়ানির প্রভাবে কিনা কেউ জানে না, বিরাট রাজার শ্যালক কীচক অতীব কামাতুর হয়ে দ্রৌপদীকে অন্যায়ভাবে কামনা করেন এবং বল্লবের হাতে কীভাবে নিহত হন তা সকলের জানা।
মহাকাব্যের এই বিরিয়ানির উৎস সন্ধান করতে করতে বৈদিক সাহিত্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন হাজরা বৃহদারণ্যক উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের অন্তর্গত চতুর্থ ব্রাহ্মণের অষ্টাদশ শ্লোক উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, যদি কোনও ব্যক্তি বেদজ্ঞ, জ্ঞানী, বাক্যবিশারদ পুত্রের ইচ্ছা করেন তাহলে তাঁকে এক বছর বা তার বেশি ষাঁড়ের মাংসের বিরিয়ানি খেতে হবে। (দ্রষ্টব্য—সহপেডিয়া, দ্য হিস্ট্রি অব বিরিয়ানি, নীলাঞ্জন হাজরা)। ওই প্রবন্ধে বিরিয়ানির ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।
নল যেমন শুধু পাকদর্পণ লিখেছেন এমন নয়, তিনি নিজে ছিলেন দক্ষ পাচক, তেমনি নীলাঞ্জন হাজরা শুধু খাদ্যের ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন এমন নয়, তিনি নিজে একজন দক্ষ সূদ বা শেফ।
ভীষ্ম পিতৃপুরুষের উদ্দেশে প্রদত্ত হবি প্রসঙ্গে অনুশাসনপর্বে বলছেন, নিরামিষ হবি পিতৃপুরুষকে এক মাস তুষ্ট করে, মৎস্য হবি দুই মাস, ভেড়ার মাংস তিন মাস, খরগোশ চার, ছাগল পাঁচ, বরাহ ছয়, হংস সাত, পৃষত আট মাস, রুরু নয় মাস, গবয় দশ, মহিষ এগারো এবং গোমাংস বারো মাস তুষ্ট করে। বাধ্রীণস (বৃহৎ ষাঁড়) বারো বছর, গণ্ডারের মাংস চিরদিনের জন্য। তিলের সঙ্গে যে কোনও খাদ্য পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে দিলে তা অক্ষয় হয়।
পেটের রুগিদের জন্য রাজা নল নির্দেশিত বিরিয়ানির মশলা হল সৈন্ধব লবণ, হিং ও তিলের তেল।
(ছবিঃ নীলাঞ্জন হাজরা)
0 Comments

Post Comment