পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কি চেয়েছিল তাঁরা?

  • 29 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1844 view(s)
  • লিখেছেন : সন্দীপন নন্দী
বেকারত্ব কুড়ে খাবার এক পূর্বাভাস ঝড়ের মত বয়ে আসছে। তাই আগামী দিনে যে, নতুন নিয়োগের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে,তা নিশ্চিত।ফলে লাফিয়ে বাড়বে স্কুলছুটের সংখ‍্যা।পড়াশুনো বন্ধ করে দেবে এক বিরাট ছাত্রসমাজ।তাই "লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে" বলেও শিশুমনকে পড়াশুনোয় উৎসাহিত করা যাবেনা আর।হয়তো সবশুনে শিশুরাও বলবে,কি হবে লেখাপড়া করে?কাজই তো নেই।এতদিন জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে তারা যা বুঝতো,সময় তাদের শেখাল এই কথা কতটা অর্থহীন।

ওদের সাথে আর হয়তো দেখা হবে না কোনদিন।লকডাউনের পর সবকিছু স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও না। হলদিডাঙা, কুসুমতারা,চকচন্দন,ভায়োর থেকে গাড়ি ধরে শহরে ছুটে আসা একদল ছেলেমেয়ে এরা। দেশের খবর নয়,কাজের খবরের সন্ধানেই এ ছুটে আসা। কর্মখালির মাসিক বিজ্ঞাপনপত্র কিনতেই ওদের এই গাড়িসফর।চৈত্রের গনগনে দুপুরেও কয়েক দল,গাছের তলে কী মনোযোগে পৃষ্ঠা উল্টে যেত। রোজগার করবে বলে।কত স্বপ্ন।বাড়ির ছাদ দেবে।দাদুর বন্ধকের কৃষিজমি ফিরিয়ে দেবে মাসমায়নায়। সে এটিএমের বেসরকরি গার্ড হোক বা হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়।সুইপার, ক‍্যাম্পের নাপিত বা ধোপা।যেকোন একটা কাজ পেলেই হল।ওরা বলত আজকের বাজারে লটারি পাওয়া যায়,চাকরি পাওয়া যায়না।আসলে এরা সকলেই জানত,তাদের সীমাবদ্ধতা কতটা। ঘুষ দিয়ে যে চাকরী নেবে, সে অর্থ নেই। মেধাও মধ‍্যবিত্ত। তাই গ্রামফেরত এ ছেলেমেয়ের দল কোনদিন ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়র, মাস্টার হতে চায়নি।বরং জীবনের প্রথম দিন থেকেই বেছে নিয়েছিল, সমাজের একদম নিম্ন আয়ের জীবিকার উৎসকে। শুধু ডালেভাতে, খেয়েপরে বাঁচার একটু বন্দোবস্ত চেয়েছিল তারা।কিন্তু এখন তো গাড়িও নেই‌। এদিকে সবাই বলছে,টিভিতেও দেখাচ্ছে কোথাও কাজ নেই। বরং যাদের কাজ ছিল,তারাও নাকি কাজ হারাতে শুরু করেছেন। সেখানে নতুন চাকরির আশা করা তো এক আকাশকুসুম কল্পনা। তাই আপাতত এ ছেলেমেয়ের দল বাধ‍্য হয়ে ঘরে ফিরে গেছে।ওরা বুঝেছে এজীবনে চাকরির আশা হয়তো আর নেই। অথচ ওরা অবাক হয়েছে। দেশজুড়ে অর্থনীতিবিদ,পন্ডিতরা যখন সকলের কাজ হারাবার ভয় নিয়ে চিন্তিত,তখন যারা ওদের মত চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল,তাদের কথা কোথাও বলা হলনা। কোন পরিসংখ‍্যান এলো না টিভিপর্দায়। কেননা কাজ হারাবার ভয়ের থেকেও নতুন কাজের সুযোগ তৈরি না হওয়াটা দেশের পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর। বেকারত্ব কুড়ে খাবার এক পূর্বাভাস ঝড়ের মত বয়ে আসছে। তাই আগামী দিনে যে, নতুন নিয়োগের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে,তা নিশ্চিত। ফলে লাফিয়ে বাড়বে স্কুলছুটের সংখ‍্যা।পড়াশুনো বন্ধ করে দেবে এক বিরাট ছাত্রসমাজ। তাই"লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে" বলেও শিশুমনকে পড়াশুনোয় উৎসাহিত করা যাবেনা আর। হয়তো সবশুনে শিশুরাও বলবে,কি হবে লেখাপড়া করে? কাজই তো নেই। এতদিন জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে তারা যা বুঝতো,সময় তাদের শেখাল এই কথা কতটা অর্থহীন। ফলে অভিভাবকরাও ক্রমশ নিরুত্তর হয়ে যাবেন সন্তানদের কাছে। এতে ভেঙে পড়বে শিক্ষাব‍্যবস্থা। ভেঙে যাবে চাকরির বাস্তুতন্ত্র। অথচ সেখানে ড‍্যামেজ কন্ট্রোলের একমাত্র রাস্তা ছিল নিয়োগ।কিন্তু সে আর হল না আমাদের দেশে। যে দেশে এমনিতেই বেকারত্বের হার মাত্রাছাড়া।জিডিপি লুকোতে লুকোতে সরকার একরকম নিঃস্ব।এমনকি উচ্চশিক্ষা সহ বিভিন্ন গবেষণায় বরাদ্দভাগেও কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচি চালাতে চালাতে আজ কানাকড়িই উচ্চশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীদের সম্বল।সেখানে দাঁড়িয়ে চাকরির বাজার বন্ধ‍্যা হলে দেশে তরুণ প্রজন্মের হতাশা বাড়বেই। বাড়বে অবসাদ।

আবার যে ছেলেগুলো জানতো ভোররাতে তেপান্তরে মাঠপেরোনো চারশোমিটার সফলদৌড় আর একটু দৈর্ঘে লম্বা হলেই কার্গিল,দ্রাস,পুঞ্চ সেক্টরে যুদ্ধের চাকরিটি বাধা ।কিন্তু তারাও এখন হতাশায় বন্ধ করেছে দৌড়।ওরা জানে এ চাকরিতে বয়স একটু বেড়ে গেলেই সব শেষ।ফলে বিএসএফ,সিআরপিএফের মত এক অল্পবিদ‍্যার কাজের সুযোগও ভ্রষ্ট কুসুমের মত নষ্ট হয়ে গেল ধীরে ধীরে।যে ছাত্ররা সামান‍্য এইট পাশ করেও চাকরির আশায় ছুটে যেত,সেও এখন ব‍্যর্থ পুরুষের মত ফিরে গেছে ঘরে।লঙ্কার চাষ করছে।কারণ কর্মখালির বিজ্ঞাপন নেই। চাকরির র‍্যালি নেই।এক অদ্ভুত বিপন্নতা জুড়ে যাচ্ছে নবীন প্রজন্মের জীবনে।তাই আদাজল খাওয়া ছাত্রজীবনগুলোতেও ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে প্রশ্নচিহ্নের ছায়া। সে তিমির সত‍্যিই হয়তো আর মেটার নয়।কথাপ্রসঙ্গে ত্রিশবছর ধরে সংবাদপত্র ফেরি করা রমেন জোয়াদ্দার জানালেন,সব বাড়িতে সংবাদপত্র দিতে গেলেই এখন তরুণ মুখগুলোর জন‍্য বড় মায়া হ য়।চাতক পাখির মত বারান্দায় বসে থাকে । কর্মখালির বিজ্ঞাপনপত্রের আশায়। রমেন বাবু রোজ মাথা নেড়ে ফিরে আসেন। তাই আপাতত দেশের এই বেকার ছেলেমেয়েদের জন‍্য সরকার যে চিন্তিত নন,তা ভোরের আলোর মত পরিষ্কার। কারণ মন্দা মোকাবিলায়, ছাঁটাইকেই যখন একমাত্র হাতিয়ার ভাবা হচ্ছে,তখন নতুন কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবাটা সরকার মনে করেছেন এক হঠকারী সিদ্ধান্তেরই নামান্তর। নইলে কদিন আগেই দেশের অন‍্যতম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন ছাত্র বহুজাতিক বিদেশি সংস্থায় অনলাইন ইন্টারভিউ দিয়ে নিয়োগপত্র হাতে পাবার পরও তাদের বরখাস্তের চিঠি ধরিয়েছে সংস্থা‌। না কোন প্রতিবাদ হয়নি। এও যে এক মেধার অকালপ্রয়াণ,আমরা স্বীকার করিনি। কোথাও বিক্ষোভ হয়নি। দাবির আগুন জ্বলেনি। আসলে নিজেদের সমস‍্যা নয় বলে এড়িয়ে গেছেন সকলে।তবে কিসের শিক্ষা,কিসের চেতনা। উত্তর খোঁজেননি দেশবাসী।

ফলে অসংখ‍্য যুবকযুবতীরা এগিয়ে চলেছে এক সামাজিক খাদের ধারে। যেখানে কাজের কোন সুযোগ নেই। বঞ্চনার ধারাবিবরণী চলছে অনর্গল । তাই আপাতত কর্মখালির বিজ্ঞাপন এক অলীক সংবাদ হতে চলেছে এদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে।শিকে ছেঁড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই । তবে এই ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন নিয়েও যারা রোজ রাতে ঘুমতে যেত,তাদেরই একমুখ ঊনচল্লিশের তোজো। আর একবছর । তারপর যারজন‍্য সব সরকারি চাকরীর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে ।ভেবেছিল এবছর একটা শেষ চেষ্টা করে দেখবে।আড্ডা ,টিউশন বন্ধ করে করোনা আক্রমণের অনেক আগেই তাই তোজো কোয়ারিন্টাইনে চলে গিয়েছিল। নিজেকে নিজের জন‍্য সরিয়ে নিয়েছিল সমাজ থেকে ।কিন্তু সেই তোজোকেই আর ঘরে রাখা যাচ্ছেনা।ডিপ্রেশনে চলে গেছে হেমিংওয়ের লেখা পড়ে বড় হওয়া এক যুবক। তাই স্বপ্ন আর সে দেখে না। এখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমতে যায় রোজ।স্কুলই বন্ধ।আর ওকে স্কুলের চাকরী কে দেবে? এই ভেবে চলেছে অহরহ। সুশোভন,দীপতরু, শর্মিষ্ঠা,অঙ্কিতারাও ভাবা প্রাকটিস করছে। তোজোর মত তারাও ঘরে ঢুকে গেছে সেই কবে। কেউ জানেনা পৃথিবী করোনাশূন‍্য হলেও তারা বেরোবে কিনা। আসলে কিছু একটা করে দেখানোর তাগিদ ছিল এদের । হলনা। পরিবারের ঘাড়ে নিজেকে বোঝা মনে হয়,বলেছিল দীপতরু। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত,কিছু হল?সে ই হওয়াতে আপাতত স্থগিতাদেশ দিয়েছে সময়। কিন্ত্ত শর্মিষ্ঠার গল্প একটু অন‍্যরকম। দেখতে রূপসী নয়।বাবার পণ দেবার সাধ‍্য নেই।তাই কোন চাকরী জুটিয়ে পাত্রপক্ষের নজরকাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল মেয়েটা। অথচ চাকরি নেই।যেমন বাবার পেনশন আর টিউশনে সংসার চলা সুশোভনও স্বপ্ন দেখতো। সরকারি অফিসার হবে। দুমাস হল আর কিচ্ছু দেখেনা। মাঝে মাঝে পাগলের মত ভাইরাস খুঁজতে ছাদে চলে যায়।ওর জীবনকে তছনছ করে দেওয়া এক অদৃশ‍্য জীবনের সন্ধানে। বলেছিল,খুঁজে পেলেই বদলা নেবে। একমাস হল মানসিক হাসপাতালে অ্যাডিমিট হওয়া সুশোভন রবিঠাকুরের জন্মদিনে বেডে শুয়ে শুয়ে "বিপদে মোরে রক্ষা কর,এ নহে মোর প্রার্থনা",শুনিয়েছিল ফেরার আগে।দরাজ গলা।আর অঙ্কিতা জৈবরসায়নে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পোস্টডক্টরেটের কাজ শুরু করেছিল। দিনরাত একাকার করে ল‍্যাবে পড়ে থাকা এক মেয়ে। সেও কদিন ধরে বলে চলেছে,আর যাবেনা ল‍্যা বে।কি হবে গিয়ে? কলেজে পড়ানোর স্বপ্ন দেখা এক মেয়ে। কাল হয়তো লকডাউন উঠে যাবে। গাড়ি চলবে। সেই আশায়, সুশোভনকে বলেছিলাম ভাল থেকো। তোজোকে বললাম ভাল থেকো। দীপতরুকে বললাম ভরসা রেখো। আর শর্মিষ্ঠাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। অঙ্কিতাকে বলেছিলাম আশা ছেড়ো না। আর গ্রামের ছেলেগুলোকে বললাম,কাল থেকে ভোরে উঠে আবার দৌড় শুরু করো। রমেনদা পজিটিভ কিছু বললে নিশ্চয়ই জানাবো।

0 Comments

Post Comment