পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সোনিয়া সকাশে অধীরের ক্রন্দনপ্রায় কৈফিয়ত

  • 30 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 714 view(s)
  • লিখেছেন : কল্যাণ সেনগুপ্ত
২০১৯ সালে দিলীপ ঘোষকে ম্যানেজ করে বিজেপির ঘরের যে ভোটটা গতবার অধীর চৌধুরি পেয়েছিলেন এবার সেই ভোটটা বিজেপির ঘরে ফিরে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটলো। কার্তিক মহারাজের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা ও অধীরকে 'গুড হিউমার'এ রেখে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার ক্ষেত্রে তার সক্রিয়তাও এর একটা বড় কারণ। এবার দেখা, কংগ্রেস নেতৃত্ব কী করে?

অধীর চৌধুরীর উপর খুব ভরসা করেছিলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, পুত্র ও মাতা। তাঁরা ভেবেছিলেন, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত মমতার বিরুদ্ধে অধীর ও সেলিমের জোট ত্রিমুখী লড়াইয়ে বেশ কিছু আসনেই ভালো ফল করবে। আর অধীর সহ সেলিমের জয়ও একপ্রকার সুনিশ্চিত। এই ত্রিমুখী লড়াইয়ের ফলে যে মমতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপিরও অনেক আসনে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, সেসব চিন্তাকে মাথাতেই আনতে চায়নি মোদী বিরোধী আন্দোলনের মূল কান্ডারী কংগ্রেসের  নেতৃত্ব। কারণ, মনের কোণে আশা ছিল যে মমতা কিছুটা দুর্বল হলে হয়তো তাদের খানিক রাজনৈতিক সুবিধা হবে। অধীর এদের চিন্তা ভাবনাকে এতখানিই আচ্ছন্ন বা প্রভাবান্বিত করতে সমর্থ হয়েছে যে, একটা লোকদেখানো জোট প্রচেষ্টা শুরু হলেও অধীরের বিরোধিতায়  তা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। কথায় আছে - অনিচ্ছুক ঘোড়াকে জোর করে জলাশয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু জোর করে জলপান করানো যায়না। ফলে তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে কোন জোট গড়ে উঠতে পারলো না, পারলে বিজেপি আরও অনেক কম আসন পেত। ২/৩টি আসনতো বেশ স্বল্প ব্যবধানেই জিতলো বিজেপি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কংগ্রেস নেতৃত্ব এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বলেই বিজেপি ১২টা আসন পেয়ে গেল এরাজ্য থেকে। এমনটা না হলে লাভ হোত জোট ইন্ডিয়ারই।

অধীর একটা বিষয়ে সফল যে, কংগ্রেস রাজ্য নেতৃত্বের কোন অংশ বা কোন নেতা তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পক্ষে মুখ খোলেনি। তৃণমূলের প্রতি এদের বিদ্বেষভাব এতটাই তীব্র যে, মমতাকে সবক শেখানোর অভিপ্রায়ের কাছে জাতীয় রাজনীতির স্বার্থ বা মোদী বিপদের তাৎপর্যও গুরুত্বহীন। নির্বাচন এলেই এদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে, যেনতেন প্রকারেন মমতাকে আগে হারাও। সেকারণেই এরাও সিপিএম নেতাদের গোপন মন্ত্র - "আগে রাম পরে বাম"এর কৌশলকেই আত্মস্থ করেছে। কিন্তু এদের রাজনৈতিক কান্ডজ্ঞান এতটাই জমিনী বাস্তব বিরোধী যে, একের পর এক নির্বাচনে জমি খোয়াচ্ছে শুধু নয়, দলের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখে একের পর এক নেতা সুযোগ পেলেই দল ছাড়ছে এবং সেকারণেও তৃণমূলের উপর রাগ আরও বাড়ছে। কিন্তু নিজেদের ভুল নীতি বা কোন দোষ ত্রুটি দেখছেনা। বেশ কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদ জেলার এক উপনির্বাচনে সবাই মিলে মহাজোট করে তৃণমূলকে হারিয়ে এক কংগ্রেস প্রার্থী জিতলো। তিনি আদতে ব্যবসায়ী, তাই জেতার মাসখানেক বাদেই তৃণমূলে গিয়ে ভিড়লেন নিজের স্বার্থ চিন্তা করে। এখানেও কি তৃণমূলের দোষ? এরা তৃণমূলের সাথে চূড়ান্ত শত্রুতা করে যাবে আর তার প্রত্যুত্তরে তৃণমূল বন্ধুর মতো আচরণ করবে, এমন প্রত্যাশা কি বাস্তবসম্মত? নিজের নাক কেটে তৃণমূলের তথা মমতার যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে এখনতো প্রায় গর্দান কাটা যাবারই জোগাড় অধীরের। এরাজ্যে কংগ্রেসের স্বাভাবিক মিত্র কে হওয়া উচিৎ, সিপিএম না তৃণমূল? অন্ধ বিদ্বেষে যুক্তি বুদ্ধি লোপ পাওয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব এবিষয়টা নিয়ে ভেবেছে কখনো?

অধীরের পরাজয় ছিল কল্পনার অতীত তার নিজের  এবং দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছেও। এরাজ্যের ফল বেরোবার পর সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী বুঝলেন যে, বাংলার বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অধীর বর্ণিত পরিস্থিতির সঙ্গে আদৌ কোন মিল নেই। সেকারণেই ভোটের ফল প্রকাশের পর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খার্গে অধীরের বিরুদ্ধে রীতিমতো খড়গহস্ত হয়ে বলে দেন যে, উনি দলের নীতিনির্ধারক নন সেটা স্থির করি আমরা, দলের নীতির সাথে যিনি  সহমত না হবেন তিনি দল ছেড়ে চলে যেতে পারেন। অধীরের বিরুদ্ধে এমন কড়া মনোভাব যদি এরাজ্যে জোট গড়ে আসন সমঝোতার সময় কংগ্রেসের উচ্চ নেতৃত্ব নিতে পারতেন তাহলে জাতীয় ক্ষেত্রেও তার সদর্থক ফল হতো ব্যাপক। এমনকি বিজেপি হয়তো ২৪০এও পৌঁছতে পারতোনা এবং মোদীও আবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিটি দখলে পেতনা। মূলতঃ অধীরের কারণেই রাহুলের সম্পর্ক মমতার সাথে সহজ বা স্বাভাবিক হতে পারলোনা। যদিও মমতার দিক থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলনা।

অধীর সোনিয়াকে বলেছেন যে, তৃণমূলের চক্রান্তেই হার হয়েছে তার। কিন্তু ২০১৯এ বিজেপির চূড়ান্ত সুদিনেও তিনি যে জিতেছিলেন কার শুভ চক্রান্তে(!), সেটিও কিন্তু অনেকেই জানে। কংগ্রেসের নেতা আব্দুল মান্নানের একটি ভিডিওতে তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, সেসময়কার অবিসংবাদী বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের সৌজন্যেই অধীর জিতেছিলেন। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে সোস্যাল মিডিয়া থেকে সেটি উদ্ধার করা যাবে। সেবার পরিস্থিতি কি ছিল একটু খতিয়ে দেখা যাক। সেবার বামেদের সঙ্গে জোট না হলেও সিপিএমের তরফে ঘোষণা করা হোল, বহরমপুরে বামফ্রন্টের পক্ষে আরএসপি প্রার্থী থাকলেও তারা অধীরকেই সমর্থন করবে। এবার ময়দানে রইলো বিজেপি আর তৃণমূল।দেখা গেল আশ্চর্যজনকভাবে বিজেপি এমন একজন এলেবেলে প্রার্থী দিল যা কার্যত ওয়াকওভার দেবারই সামিল। ভোটের আগে কাগজে বিজেপির প্রার্থী পরিচিতিতে বেরোলো যে তিনি দিলীপ ঘোষের গৃহ প্রবেশের পুরোহিত ছিলেন এবং তিনি বিজেপি দফতরে এসে দু দশ টাকার বিনিময়ে সবার হাত দেখে দিতেন। এমন একজনকেই বিজেপির প্রার্থী করা হোল অধীরের বিরুদ্ধে এবং তার হয়ে কোন বড় নেতা প্রচারেও এলেন না। অর্থাৎ প্রায় সব পক্ষকেই ম্যানেজ করে শুধুমাত্র তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ে জিতলেন অধীর '১৯র ভোটে। দুর্মূখেরা বলে থাকে, এরপরই তাঁর বিজেপিতে যোগদান ঠেকাতে তড়িঘড়ি তাঁকে সংসদে দলের নেতা নির্বাচিত করা হোল অধিক যোগ্য ও বরিষ্ঠ নেতাদেরকে বঞ্চিত করে।

অধীর অভিযোগ করেছেন, তাঁকে হারাতে এক পরিচিত মুসলিম মুখকে উড়িয়ে আনা হয়েছে এবং প্রার্থীকে মসজিদে মসজিদে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে এতদিন দাদাকে ভোট দিয়েছেন এবার এই ভাইকে ভোট দিন। মসজিদে ঘোরানো বা প্রার্থীকে ভোট দিতে বলার মধ্যে অন্যায় কোথায়, এটা কোন গুরুতর অভিযোগ হোল! মন্দিরে মসজিদে তো সবদলেরই প্রার্থীরা যাচ্ছে প্রার্থনা করতে, দোয়া মাঙতে। আর পরিচিত মুসলিম মুখকে উড়িয়ে আনা কি নৈতিক অপরাধ? কীর্তি আজাদ বা শত্রুঘ্ন সিনহাও তেমনই এসেছেন জয়ের আশায়, এমন অভিযোগতো ওঠেনি। আর মুসলিম প্রার্থী দেওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? তাহলে আগের উত্তর কলকাতা বা রায়গঞ্জে না দাঁড়িয়ে  মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে এসে মোঃ সেলিম কেন দাঁড়ালেন এবং অধীর সমর্থন করলেন? এসব যুক্তি কি হাস্যকর নয়?
 
তবে আর একটি অভিযোগ বেশ গুরুতর। যথা, তাঁকে হারাতে পরিকল্পিত ভাবে  গোষ্ঠী সংঘর্ষ ঘটানো হয়েছে তাঁর এলাকায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনার পরে তিনি কি এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, নাকি মনে মনে অন্য হিসাব কষছিলেন? এসবের হোতা কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন তো তৃণমূল নেত্রী এবং ঘটনার সময় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সংঘর্ষ বিশেষ ছড়াতে পারেনি। নেত্রী মুখ খোলার পর অবশ্য তাতে সায় দিয়েছিলেন অধীর। কিন্তু তিনি আগে এবিষয়ে মুখ না খোলায় এবং ভোটে হারার পরে এখন সেসব বললে সেই অভিযোগের কোন গুরুত্ব  থাকে কি? তাঁর আরও অভিযোগ - দিল্লিতে ইন্ডিয়া মঞ্চের একতার প্রশ্নে কংগ্রেস ও তৃণমূল কাছাকাছি এলেও পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল ধারাবাহিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, ফলে কংগ্রেস কর্মীরা বিভ্রান্ত। এ অভিযোগের কোন সারবত্তা         নেই, এটা নেহাতই জোট না করার অজুহাত বৈ আর কিছু নয়। কারণ, দীর্ঘ ৩৪ বছর সিপিএমের হাতে চূড়ান্ত অত্যাচারিত কংগ্রেস কর্মীরা তাহলে কিভাবে সিপিএমের সাথে হাত মেলায়! মমতার সাথে জোট করতে তাঁর অনিহা সর্বজনবিদিত। তিনি সগর্বে বলেছিলেন, মমতার কোনরকম দয়ায় তিনি জিততে রাজী নন। জেতার বিষয়ে তিনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, জোরগলায় বলেছিলেন, ভোটে হেরে গেলে আমি রাজনীতি ছেড়ে বাদাম বেচবো।

আসলে '১৯এ দিলীপ ঘোষকে ম্যানেজ করে বিজেপির ঘরের যে ভোটটা গতবার তিনি পেয়েছিলেন এবার সেই ভোটটা বিজেপির ঘরে ফিরে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটলো। কার্তিক মহারাজের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা ও অধীরকে 'গুড হিউমার'এ রেখে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার ক্ষেত্রে তার সক্রিয়তাও এর একটা বড় কারণ। এমনটা যে ঘটতে পারে সেটা তার আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল নাকি? তার পরেও জোটে রাজী না হওয়াতো আত্মহত্যারই সামিল। তাই অবুঝ বাচ্চাদের মতো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে এখন নাকিকান্না কাঁদলে কোন লাভ হবে কি এবং সেটা তাঁর অতীত দাপুটে ইমেজের সাথে মোটেও মানানসই হচ্ছে না। পরশ্রীকাতরতা থেকে উৎপন্ন ক্রোধের ফলে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পায় এবং সেটাই পতনের কারণ হয়ে ওঠে। নইলে খানিক শুভবুদ্ধির উদয় ঘটলে অনায়াসেই এমন বিপর্যয়কর পরিণতি এড়ানো যেত। এর থেকে শিক্ষা লাভ করে মমতা বিদ্বেষের বাতাবরণ থেকে অধীর চৌধুরী নিজেকে মুক্ত করতে পারলে সম্ভাবনাময় আগামীদিনে দল ও দেশের মঙ্গল সুনিশ্চিত।
                    

0 Comments

Post Comment