নির্বাচন শেষ, ফলাফল হাতে চলে এসেছে। ৩০০-র বেশি আসন নিয়ে বিজেপি বা বলা ভালো মোদী আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। বাংলাতেও তারা ১৮টি আসন জিতেছে। যেই আসনগুলোতে জেতেনি সেই গুলোতেও তারা দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বামেদের ভোট প্রায় ২২ শতাংশ কমে সাতে এসে ঠেকেছে। এই বিষয়ে এখনও অবধি বামেদের তরফ থেকে কোনও সরকারী ঘোষণা বা পর্যালোচনার খবর যদিও আসেনি, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে বাম ভোটের একটা বড় অংশ এবার রামের দিকে গেছে। এই কথাটা বললে হয়তো অনেক বামকর্মী বিরোধিতা করবেন কিন্তু এটা কি সত্যি নয় যে এই বামের ভোট রামে যাওয়ার ফলেই কি বাংলায় বিজেপির এতো বাড়বাড়ন্ত হল না? অনেকে বলতে পারেন যে বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ নীচুতলায় তৈরি হচ্ছিল তারই ফলশ্রুতিতে এই ভোট। কিন্তু বিষয়টার আরও একটু পর্যালোচনা প্রয়োজন।
সারা দেশে যেসব ইস্যুতে ভোট হয়েছে বাংলায় কি তা নিয়ে ভোট হয়েছে? বাঙালি কি হঠাৎ এতো সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল নাকি সে প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক ছিল। অনেকে সেটা দেখেও না দেখার ভান করেছেন? পুলওয়ামা বা তার পরবর্তীতে বালাকোটে আক্রমণ কি বাংলায় এতো প্রভাব ফেলল যে নির্বাচনের ফল এতোটা ঘুরে গেল? সারদা কেলেঙ্কারি, নারদ কেলেঙ্কারি কিংবা অন্য যেকোনো দুর্নীতি কি নোটবন্দী এবং আধারের মতো দুর্নীতির থেকেও বড় হয়ে গেল? যে নোটবন্দীতে সারা দেশে ১০০ র ওপর মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যে নোটবন্দীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন সেটা কি কখনও সারদার সমান হতে পারে? যে জিএসটিতে ছোট ব্যবসায়ীরা কাজ হারাচ্ছেন আজও সেই জিএসটি কি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দলের দুর্নীতির থেকেও বড়? নাকি আরও কিছু আছে? অনেকেই রাস্তাঘাটে বলা শুরু করেছেন বা হয়তো আগেও বলছিলেন যে মমতা বন্দোপাধ্যায় মুসলমানদের তোষণ করেছেন। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে মুসলমানদের তোষণ করেছেন, তার বাহ্যিক কি প্রমাণ আছে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ বলবেন কেন ইমাম ভাতার ব্যবস্থা করেছেন, মুসলমানদের উৎসবে মাথায় কাপড় ঢাকা দিয়েছেন। তাঁকে যদি উল্টে প্রশ্ন করা হয়, আমাদের চারপাশে প্রচুর মুসলমান কি চাকরি পেয়েছে? কিংবা উচ্চশিক্ষায় প্রচুর মুসলমান ছেলেমেয়ে আসছে? উত্তর কিন্তু না-ই হবে। আসলে এটা একটা সংগঠিত প্রচার। এই প্রচারটা খুব সচেতন ভাবেই করা হয়েছে এবং এর পিছনে আরএসএস এবং বিজেপির আইটি সেলের প্রভাব ভয়ঙ্কর ভাবে আছে। সারা রাজ্যের যেকোনও প্রান্তে গেলেই এই আওয়াজটা বারবার উঠে এসেছে, মুসলমানেরা সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে এবং এই বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুপ্রবেশ এবং মমতা এই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের মদত দিচ্ছেন। অথচ যাঁদের কাছে এই প্রচারটা গেছে তাঁরা কিন্তু এটা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি কথাগুলো সত্যি কিনা। এমনিতেই ইদানীং ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের সময়ে মানুষ সমস্ত কিছু অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন আর এই ধরনের সংগঠিত ভুল প্রচারকে কিভাবে দেখবেন সে বিষয়ে কিন্তু কোনও ধারনাই তাঁদের নেই। সেই জন্যই কি মানুষ বাংলাতেও ঢেলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে? এটা জানা সত্ত্বেও যে, আসামে নাগরিকপঞ্জিকরণের নামে কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের নামে শুধুমাত্র মুসলমানেরা নয় হিন্দুরাও সমানভাবে ভুগছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আবার বামেদের ভুমিকায় ফেরত যেতে হবে।
এই নির্বাচনে বাম বা সঠিক অর্থে বললে সিপিএমের ভুমিকা কি ছিল?
এই নির্বাচনে সিপিএমের মূল শ্লোগান ছিল ‘বিজেপি হারাও দেশ বাঁচাও, তৃণমূল হারাও রাজ্য বাঁচাও’। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে দেখলে কি এই শ্লোগান কি আদৌ যৌক্তিক ছিল? আসলে সিপিএম মুখে এটা বললেও মনে মনে চেয়েছে যে তৃণমূলকে প্রাথমিক ভাবে হারাতে তাই তার আক্রমণ বেশীরভাগ সময়েই থেকেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ফল যা হবার তাই হয়েছে মানুষ মনে করেছেন যে তৃণমূলের মতো শক্তিকে হারাতে আপাতত যেহেতু বামেরা সক্ষম হবেন না তাই বিজেপিকে দিয়ে তৃণমূলকে হারিয়ে পরে সিপিএমকে ফিরিয়ে আনবেন। এখানে সিপিএম কর্মীরা যে বড় ভুলটা করলেন যেটা বলা অত্যন্ত জরুরী, বিজেপি কিন্তু অন্য যেকোনো দল নয় , বিজেপির পিছনে একটা মতাদর্শ আছে তা হল সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ যে মতাদর্শ মানুষে মানুষে ঘৃণার উদ্রেক করে, বিদ্বেষ ছড়ায়। সিপিএমের কর্মীরা এই তৃণমূল এবং বিজেপিকে এক করে দেখার এই রাজনীতিকে তফাৎ করতে পারলেন না। ফল যা হবার তাই হল যে বাংলা এতদিন শ্লোগান তুলেছিল ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম’ কিংবা ‘লড়াইয়ের আর এক নাম সিঙ্গুর, ভাঙ্গড়, নন্দিগ্রাম’ সেই বাংলায় হঠাৎ শোনা যেতে লাগল ‘জয় শ্রী রাম’।
এরপর কি ?
সময় থেমে থাকে না, রাজনীতিও না। হয়তো বা বাম রাজনীতি এক নতুন মোড় নেবে তা হয়তো সময় বলবে। কিন্তু আপাতত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে সত্যি করে বাংলার মানুষ তৃণমূলের গরম তাওয়ার থেকে বিজেপির জ্বলন্ত উনুনকে বেছে নিয়েছেন, কিন্তু এটা কি শেষ কথা হয়ে যাবে? হয়তো নাগরিক আন্দোলন নতুন চেহারা নেবে, হয়তো বাম আন্দোলন আবার নতুন উদ্যমে ফিরে আসবে, নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। কিন্তু ততদিনে আরও দেরি হয়ে যাবে না তো? তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যারা ভেবেছিলেন বিজেপিকে দিয়ে তৃণমূলকে শায়েস্তা করা নিজের পায়ে নয় নিজের মাথায় কুড়ুল মারার সামিল হয়েছে।
তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, বামেরা রাজনীতির আঙিনা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে বেশীদিন থাকবেন না... আবার কোনও নকশালবাড়ি, আবার কোনও তেভাগা আবার কোনও তেলেঙ্গানা কিংবা কৃষক লং মার্চ নিশ্চিত বামেদের আবার লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে আনবে।
0 Comments
Post Comment