আঠারো দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আই এস এস) কাটিয়ে ভারত মহাকাশ যাত্রার আগাম স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভারতের গর্ব লক্ষ্মৌয়ের শুভাংশু শুক্ল যেদিন দেশের মাটিতে ফিরলেন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে সেদিনই ভারতের অন্য এক প্রান্তে উড়িষ্যার বালাসোরে ফকিরমোহন অটোনমাস কলেজের অগ্নিদগ্ধ নির্যাতিতা ছাত্রী টানা দুদিনের জীবন মৃত্যুর কঠিন লড়াইয়ে মৃত্যুর কাছে হার স্বীকার করে শবদেহ হয়ে ভুবনেশ্বর এইমস থেকে বাড়ি ফিরল! একটি সফল অবতরণ আর অন্য একটি অবনমন ও মৃত্যুর অনুসরণ, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’র সেই অনুরাগী ‘মন কি বাত’কে কতখানি পল্লবিত অথবা লজ্জানত করে দিল তা ভাবলে আমাদের সুষুম্নায় একটি ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় সন্দেহ নেই!এ লেখা যখন লিখতে বসেছি তখন উড়িষ্যায় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া মঞ্চের বন্ধ পালিত হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে চলছে প্রতিবাদ। জঘন্য ঘটনার বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন দেশের নাগরিক সমাজ। একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে যে ধরণের ভাষা প্রয়োগ করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সংঘটিত করা যায় তাই করছেন বিরোধী দল সহ দেশের ছাত্র ছাত্রী সমাজ। কিন্তু কেন এ মৃত্যু! কেন এমনতর ঘটনা ঘটল ঐ অটোনমাস কলেজে। কেন কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের (সমীর কুমার সাউ) উপর্যুপরি বেশ কয়েকমাস ধরে যৌন হেনস্থায় বিপর্যস্ত ঐ ছাত্রীকে অধ্যক্ষের কাছে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে লিখিত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করার পরও কোন হিরন্ময় নীরবতায় তিনি আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। একদিকে নির্যাতিতার ‘কেরিয়ার খেয়ে’ দেওয়ার হুমকি অন্য দিকে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে নানা সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এবং সবশেষে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করার মতো ঘৃণ্য কাজ করেও ঐ মহান মানুষটি কিভাবে কলেজে থেকে যান তা সততই আশ্চর্যের। আরও আশ্চর্যের ঐ ছাত্রী কলেজের গ্রিভান্স রিড্রেসাল সেলে ঐ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে নালিশ জানালেও কিছু কাজ হয় না। সব শেষে অধ্যক্ষের কাছে সমীর কুমার সাউয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়ে যখন কোনো সদুত্তর পায়নি সে তখনই অধ্যক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে রাগে ঘৃণায় ও ক্ষোভে নিজের শরীরে আগুন দেয়। সহপাঠীরা বাঁচানোর চেষ্টা করার আগেই তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যায়। ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত সমীর কুমার সাউ গ্রেপ্তার ও কলেজের অধ্যক্ষকে সাসপেন্ড করা হলেও ছাত্রীর শরীরের আগুনে তখন পুড়ছে উড়িষ্যার শিক্ষা প্রশাসন সহ গোটা সরকার। প্রতিবাদে ফুটছে গোটা রাজ্য। ইতিমধ্যে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে যে, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সরকারী প্রশাসন ঐ অভিযুক্ত অধ্যাপককে আড়াল করার খেলায় নেমেছে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতা নবীন পট্টনায়কের একটি ওজনদার বার্তা তখন পৌঁছে গেছে সারা রাজ্যের পথে প্রান্তরে-“…গায়ে আগুন দিয়ে এক পড়ুয়ার আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত একা ধারে বীভৎস ও দুঃখজনক।….কতৃপক্ষ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনই রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ করা উচিত। নির্যাতিতা যাতে বিচার পান তা নিশ্চিত করা উচিত।” কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এই ঘটনা শুধু অমানবিক বা লজ্জাজনক নয়, এটা আমাদের গোটা সমাজের মৌলিক কাঠামোর উপর আঘাত।
কাক কাকের মাংস খায় না বলে যে প্রবাদ আছে তার ঊর্ধ্বে গিয়ে বিজেপির আশীর্বাদধন্য অধ্যাপক যৌন হেনস্থা এমন একজনকে করলেন যে কলেজ পড়ুয়া এবিভিপির সদস্যা। কিন্তু পড়ুয়ার রাজনৈতিক দর্শন যাই থাক তার ওপরে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা নিন্দারও অযোগ্য। অবক্ষয় যখন শিক্ষার অঙ্গনকে কলুষিত করে তখন এক ঘোর অন্ধকার যে গোটা সমাজকে গ্রাস করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নইলে গত ১লা জুলাই ঐ নির্যাতিতা কলেজের গ্রিভান্স রিড্রেসাল সেলে অভিযোগ করলেও তাঁর সেই অভিযোগে আমল না দিয়ে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে তদন্ত কমিটি। যাবতীয় ঘটনার বিবরণ ঐ ছাত্রী তার এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে এবং তা ফরোয়ার্ড করে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান (উড়িষ্যার বাসিন্দা), মুখ্যমন্ত্রী মোহন মাঝি সহ স্থানীয় বিধায়ক ও সাংসদ সহ প্রশাসনিক স্তরের কর্তাব্যক্তিদের। কোথাও কোনো উত্তর না পেয়ে মানসিক নির্যাতনের চরম শিখরে পৌঁছে তাকে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে। নির্যাতিতার বাবা কলেজ কর্তৃপক্ষ ও আইসিসিকে দুষে এই অভিযোগ করেছেন যে, তাদের জন্যই মেয়েকে তারা হারিয়েছে। আই ওয়াশ করার অছিলায় রাজ্য প্রশাসন ঐ কলেজের সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক ও অধ্যক্ষকে সাসপেন্ড ও গ্রেপ্তার করাতে বাধ্য হয়েছে। মেয়ের গ্রাম বালাসোরের ভোগারাই শোকে বিহ্বল কিন্তু প্রতিবাদে মুখর। সারা দেশেই নারী নিরাপত্তা যে বিপদের মুখে তার আরও একটি প্রমাণ এই ঘটনা।ভেতরে ভেতরে গর্জাতে থাকা মন ফিরে যায় রবীন্দ্রনাথে,“ ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা /হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে/যেন রসনায় মম সত্য বাক্য ঝলি ওঠে খরখড়্গসম তোমার ইঙ্গিতে….।”
লেখার শিরোনামে আর একটি ঘটনা যা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে ও প্রতিবাদী আঙিনায় লাইনে এনে দাঁড় করায় তা হল আমাদের রাজ্যে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণের ঘটনা; যেখানে আইন পড়ানো হয় অথচ সেই ‘সাপের ঘরে ঘোগের বাসা’য় আইনের পাঠ নিয়ে বেআইনি ও অমানবিক ঘটনা ঘটে যায় ইউনিয়ন রুমে। অনির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী বানিয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে আমাদের ছাত্রীটিকে যখন ‘ম্যাঙ্গো বাহিনী’ নির্জন ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে এবং তাতে ছাত্রীটি অসুস্থ হয়ে পড়লে পাশের ওষুধের দোকান থেকে ইনহেলার কিনে এনে তাকে কিছুটা সুস্থ করে আবার ধর্ষণ করা হয় তখন আইনের পাঠ্যক্রমের সবকটি অধ্যায় যেন ধর্ষণের শিকার হয় এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় যখন ‘লার্নিং’র বেসাতি করে তাকে উৎপাটিত করে গাঁজার চাষে ইন্ধন জোগায়, ইউনিয়ন রুমগুলো অসামাজিক কাজকর্মের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় এবং ‘থ্রেট কালচার’র সূতিকাগার হয়ে দাঁড়ায় তখন যে শাসকদলের বদান্যতায় ও আশকারায় ইউনিয়ন রুমে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের দু নম্বরের ছবি দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেপিস্ট প্রাক্তনী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কলেজের প্রথম বর্ষের পড়ুয়াকে গণধর্ষণ করে তার ছবি ভিডিও করে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখায়,সেখানে আর যাই হোক ‘লার্নিং’র ‘ল’ থাকেনা-থাকে শুধু অন্ধকার! তখন আমরা কী শিখছি বা কী শেখাচ্ছি বা কী শিক্ষা দপ্তর চালাচ্ছি তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা জীবিত থাকলেও আমরা এই অন্ধকারকে কিভাবে মেনে নিতে পারি!কেন ছেলেমেয়েদের শেখাতে হবে,‘সাবধানে কলেজে থাকবি,সকাল সকাল বাড়ি ফিরবি,একসঙ্গে থাকবি, একসঙ্গে ফিরবি’র মতো সাবধানী কথা! সংবাদে এসেছে নির্যাতিতা ছাত্রী ও ম্যাঙ্গো বাহিনী একই দলের। কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতিকে সে জেঠু বলে। সহকারী অধ্যক্ষ তথাকথিত মনোজিৎকে দেখিয়ে নিয়ে সব নোটিশ ছাড়ে। কলেজের যাবতীয় নির্মাণ কার্য সহ অর্থনৈতিক লেনদেনের একটা বড়ো অংশ তার হাত দিয়ে হয়। তিনি আবার পেশায় রেজিস্টার্ড (শোনা যায় তা বাতিল হয়েছে) আইনজীবী। অন্যদিকে কলেজের ৫০০ টাকার অস্থায়ী সাফাইকর্মী। সিভিক ঝাড়ুদার। তার হাতে কলেজের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তথাকথিত জেঠু ও সহকারী অধ্যক্ষ দিব্বি চালিয়ে যান। সেই আস্কারা পেয়ে মনোজিতেরা সারা রাজ্যের অনির্বাচিত ছাত্র সংসদের অবৈধ জি এস হয়ে তোলা তোলে,সিন্ডিকেট চালায়, ক্লাশ থেকে ছাত্রী তুলে এনে মনোরঞ্জনের নিদান দেয়। সেই সঙ্গে লোহার রড, হকি স্টিক, মদের বোতল সঙ্গে নিয়ে টেবিলে পা তুলে মস্তি করে। দেরীতে হলেও স্বস্তির যে কোলকাতা হাইকোর্ট সরকারকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন করছে না তা জানতে চেয়ে দু-হপ্তা সময় দেয়। কলকাতা হাইকোর্টের স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ এই যে, যে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে স্থায়ী উপাচার্য ও অধ্যক্ষ রয়েছেন সেখানে ছাত্রভোট করতে অসুবিধা কোথায়। সেই সঙ্গে আরও একটি ওজনদার মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট যে, পরিচালন সমিতিতে শিক্ষাবিদদের রাখার উদ্যোগ নিতে হবে রাজ্যকে। হাইকোর্টের নির্দেশের এই ক্রমপরিণতি রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ঘটে চলা যাবতীয় অসংসদীয় ঘটনার ফলশ্রতি।
বছর দুই আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দলীয় ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা করার সময় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেন, “পুজোর পর আপনাদের ছাত্রসংসদ নির্বাচন হবে। শান্তিপূর্ণভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে। আমরা যেমন শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করি আপনারাও তেমনভাবে করবেন।” আবার গত বছরই আর জি কর আন্দোলনের সময় জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, মার্চের (২০২৫) মধ্যে মেডিকেল কলেজ গুলিতে ভোট করিয়ে দেবেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলেছেন কিনা জানা নেই, তবে বিগত ১৪ বছরে যে দুবার ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে অশান্তির সাক্ষী থেকেছে ক্যাম্পাস।যদিও যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে দুবছর অন্তর যে নির্বাচন হয়েছে তাতে অশান্তির খবর নেই। ‘ছাত্রানাং অধ্যয়ণং তপঃ’ এই আপ্তবাক্যের উপর ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাসী করে তোলার দিন গিয়াছে। বাস্তবতায় আমাদের ফিরে যেতেই হয় তা হল মৌলিক প্রশ্ন তোলার বয়সে রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করা যেমন তাদের দায়িত্ব তেমনই রাষ্ট্র পরিচালকের শিক্ষার অভিমুখের বিপদের দিকগুলিকে চিহ্নিত করতে সেমিনার, মিটিং মিছিল ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ছাত্র সমাজকে সচেতন করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ছাত্ররা কেন সংসদ নির্বাচন চাইবে বা তারা কেন ছাত্র রাজনীতি করবে এ ধরণের প্রশ্ন তুলে পরিণত ছাত্রজীবনে স্থিতাবস্থার পক্ষে যাঁরা মত পোষণ করেন তাঁদের জেনে রাখা দরকার যে, ষাট সত্তরের ছাত্র আন্দোলনের যে অভিমুখ ছিল তারই পথ ধরে সমাজ বদলের পরম্পরা অব্যাহত থাকলেও আজকের রাজনীতি পরিচর্যার অভাবে দিকভ্রান্ত সন্দেহ নেই। ছাত্ররা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সবকালেই। বিধানসভা, লোকসভা, কর্পোরেশন, সমবায়, লাইব্রেরী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গুলিতে যখন নিয়মিত ভোট হচ্ছে তখন কী কারণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন তা সকলের জানা গুপ্ত বিষয়! যদি লিংডো কমিশনের সুপারিশ মেনে এ নির্বাচন করতে হয় বা ২০১৭ সালে সরকার নির্বাচনের যে বিধি সরকার তৈরি করেছে সেই বিধি মেনে তার ব্যবস্থাটা অন্তত করুক রাজ্য সরকার। সমস্ত দায় যখন ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতার উপর ও বায়বীয় সামাজিক অবক্ষয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমরা দায় ঝেড়ে ফেলছি তখন তাদের এই অপকর্মগুলি করার সুযোগ যাঁরা তৈরি করে দিচ্ছেন নিজেদের আখের গোছাতে তাঁরাও কি কম অপরাধী!