এডওয়ার্ড এস হারমান ও নোয়াম চমস্কির লেখা বিখ্যাত বই "ম্যানুফাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিকাল ইকনমি অফ দ্য মাস মিডিয়া"। রাষ্ট্র ও কর্পোরেটরা কিভাবে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে তার আধুনিক প্রোপাগান্ডা মডেলটা এই বইতে বলা আছে। হারমান ও চমস্কি তাদের লেখা এই বইটিতে ব্যাখ্যা করে বলেছেন সাধারণত পাঁচটা ফিলটার দ্বারা সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই পাঁচটা ফিল্টারের মধ্যে শেষ এবং পঞ্চম ফিল্টারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল "ইডিওলজি অফ অ্যান্টি কমিউনিজিম" অর্থাৎ কমিউনিজম বিরোধী আদর্শ। জনসম্মতি উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্র সবসময়ই কিছু শত্রুকে সামনে রাখে। আমেরিকার সাপেক্ষে তখন কমিউনিজমকে শত্রু হিসেবে দেখানো হয়েছিল। হারমান ও চমস্কির এই প্রোপাগান্ডা মডেল কে যদি বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে পঞ্চম ফিল্টারটা হতে পারে 'ইসলামোফোবিয়া'। বহুদিন ধরে এই ইসলামোফোবিয়ার ভিত্তি হয়ে আসছে পাকিস্তান। অর্থাৎ পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে দেখিয়ে ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু মানুষের সম্মতি নিজেদের স্বার্থে আদায় করে আসছে আরএসএস ও বিজেপি পরিচালিত ভারত রাষ্ট্র। আদানি, আম্বানিদের দুর্নীতি, বেকারত্ব, গরিব মানুষের পেটে লাথি এইরকম একাধিক ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও এক দশকের ওপর ভারত রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে আছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের আইকন ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদি। তার অন্যতম কারণ দালাল সংবাদমাধ্যমগুলোকে দিয়ে ইসলাম এবং পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে দেখিয়ে সংখ্যাগুরু মানুষের মনে একটা ভয় তৈরি করা হয়েছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে আরএসএস ও বিজেপির এজেন্ডা ইতিমধ্যেই সফল হয়েছে। ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম এবং ত্রিপুরার পর পূর্ব ভারতের দুই রাজ্য বিহার ও উড়িষ্যাও তাদের দখলে। এখন তাদের পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গ। বহুবার চেষ্টা করেও তারা এখনও পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে পারেনি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা নিঃসন্দেহে তাদের কাছে 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার' মতো একটা ইস্যু হিসাবে হাজির হয়েছে। ইতিমধ্যেই অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক টিভি সহ একাধিক ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশ ইস্যুটাকে হারমান ও চমস্কির প্রোপাগান্ডা মডেলের পঞ্চম ফিল্টার হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে। প্রোপাগান্ডা এবং ফেক নিউজ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানুষের মনকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলছেন এই মিডিয়া হার্মাদরা।
সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্র জনতা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে। ছাত্র জনতার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের ফলে ৫ ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। সূত্র মারফত যেটা জানা যায় এখনও হাসিনা ভারত সরকারের আশ্রয়ই আছেন। গত তিন মাসের ওপর বাংলাদেশে মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটা অন্তবর্তীকালীন সরকার চলছে। নিঃসন্দেহে সেই সরকার দুর্বল। বিভিন্ন টালবাহানা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চলছে। গত তিন মাসে মাজার ভাঙ্গা ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ সহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত মঙ্গলবার ইসকনের এক প্রাক্তন সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশ সরকার। সেই ঘটনার পর পরই বাংলাদেশে ওই সন্ন্যাসীর সমর্থক সংখ্যালঘু হিন্দুরা তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং এই ঘটনাটি বারুদের আকার ধারণ করে। ঠিক ওই দিনেই সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবীকে খুন করা হয়। এই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারত এবং বাংলাদেশে এখন ফেক নিউজের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তীব্র হিংসা ও ঘৃণার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং হিন্দুদের ওপর বাংলাদেশে আক্রমণ হচ্ছে সেটাকে দেখিয়ে ভারতীয় মিডিয়া তীব্র বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। ঘটনাটি কে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে মাঠে নেমে পড়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। আইনজীবীকে হত্যার ঘটনায় যখন বাংলাদেশ উত্তপ্ত তখন রিপাবলিক টিভি, ফাস্ট পোস্ট, ইন্ডিয়া টুডে গ্লোবাল, ইকোনমিক টাইমস, জি নিউজ, এশিয়ানেট নিউজ এর মত ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রচার করতে থাকে হত্যা হওয়া সাইফুল ইসলাম হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় দাসেরই আইনজীবী ছিলেন। এই সংস্থাগুলি আরও দাবি করে পুলিশের গুলিতেই সাইফুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এইটা বোঝানো হয় যে সাইফুল ইসলাম চিন্ময় দাসের মুক্তির জন্য সওয়াল করতে গিয়েছিলেন তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। রয়টার্স এর মত বিশ্ব বিখ্যাত নিউজ এজেন্সিও সাইফুলকে চিন্ময় দাসের আইনজীবী হিসেবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যদিও বিশ্বস্ত ভারতীয় ফ্যাক্ট চেক সংস্থা "অল্ট নিউজ" বলে সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় দাসের অ্যাডভোকেট বলে যে প্রচার চালানো হয়েছিল সে সবগুলি অসত্য এবং ভুয়ো। অল্ট নিউজ দাবি করে চিন্ময় দাসের অ্যাডভোকেট ছিলেন শুভাশিস শর্মা। অল্ট নিউজ সূত্রে এটাও জানা যায় যে সাইফুল ইসলামের মৃত্যু পুলিশের গুলিতে হয়নি। বরং যারা চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন তারাই অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামকে হত্যা করেছেন। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই পুলিশ অনেক জনকে আটক করেছে কিন্তু বিশেষভাবে কারা ঠিক সাইফুল ইসলামের হত্যার সঙ্গে জড়িত সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অতি পরিচিত সংবাদ মাধ্যম সংস্থা প্রথম আলো এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ফ্যাক্ট চেক সংস্থা 'রিউমার স্ক্যানার' এর দেওয়া তথ্যকে হাতিয়ার করেই এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। রিউমার স্ক্যানারও দাবি করেছে সাইফুল ইসলাম কে চিন্ময় দাসের অ্যাডভোকেট দাবি করে যেসব খবর ইন্ডিয়ান সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সব কটি ভুয়ো এবং অসত্য। "স্বাধীন বাংলাদেশ নিউজ" নামের একটি পোর্টালের তরফে দাবি করা হয় সাইফুল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় যে পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে চারজন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য এবং একজন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। ফ্যাক্ট চেক সংস্থা "রিউমার স্ক্যানার" এই পোর্টালের তথ্যকেও ভুয়ো বলে দাবি করেছে। সাইফুল ইসলাম হত্যার পর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা খবর পরিবেশন করে এটাও দাবি করা হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করা হচ্ছে এবং তাঁদের মৃত্যুর সংখ্যাও উল্লেখ করা হচ্ছে, যদিও রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে এসব তথ্য মিথ্যা সাইফুল ইসলাম ছাড়া আর কোন মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এদিকে চিন্ময় দাসের সম্পর্কেও বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। সেখানে বলা হয়েছে চিন্ময় স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন, শিশু বলাৎকারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসকনের এক সদস্য প্রবীরচন্দ্র পালের নাম করেও মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। 'সময় টিভি' এবং 'চ্যানেল ২৪' এর লোগো ব্যবহার করে দুটো ফটো ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ফটো কার্ডের প্রথমে দাবি করা হয়েছে প্রবীর চন্দ্র পাল নাকি ফেসবুকে লিখেছেন " প্রভুকে মুক্তি না দিলে আরো লাশ পড়বে। ৩ কোটি সনাতনী মাঠে থাকবে এবং ইসকন নিষিদ্ধ করতে চাইলে পুরো বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করে দেবে ভারত"। রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে উপরের সমস্ত তথ্য গুলি মিথ্যা। প্রবীর চন্দ্র পাল এমন কোন স্ট্যাটাস দেননি। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের একটি ভিডিও বের করেও সেটা সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে, ভিডিওটি ভারতের "বাবা বালকনাথ" নামের এক ধর্ম গুরুকে নিয়ে করা। চিন্ময় দাসের সম্পর্কে আরেকটি মিথ্যে তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তিনি নাকি ডিবি (ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ) এর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন "শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারলে চট্টগ্রাম আমাদের দেওয়া হবে। আমার কোন দোষ নেই, আমাকে যা বলতে বলা হয়েছিল বাধ্য হয়েই তা বলেছি।" রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে এই সমস্ত তথ্যই ভুয়া এবং মিথ্যা। ওই ঘটনার পরপরই বিধানসভার বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী তার এক্স হ্যান্ডেলে একটি ভিডিও শেয়ার করে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। শুভেন্দু অধিকারী যে ভিডিওটি শেয়ার করেন সেটাকেও মিথ্যে বলে রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে, ভিডিওটি ঢাকার তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের দৃশ্য এটি হিন্দু নির্যাতনের কোন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
কিন্তু যেই চিন্ময় দাসকে নিয়ে এত সমস্যা তার আসল পরিচয় কি সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক। আসল নাম চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। চিন্ময় দাস কে ইসকনের সন্ন্যাসী বলে এখনো প্রচার করা হচ্ছে। যদিও বর্তমানে ইসকনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ইসকন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন বহু দিন আগে । এই ব্যাপারে ইসকনের তরফে সম্প্রতি বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে চিন্ময় দাসের বর্তমান কার্যকলাপের কোন দায়ভার ইসকন নেবেনা। বর্তমানে চিন্ময় দাস হলেন 'বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের' মুখপাত্র এবং পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে যথেষ্ট পপুলার। তিনি বাংলাদেশের হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ৮ দফা অধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হয় জাতীয় পতাকা অবমাননার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায়। চিন্ময় দাসের এই গ্রেফতারি, ভারত রাষ্ট্র সহ বিজেপি ও আরএসএস এর মতো হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নতুন করে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করে কৌশলগতভাবে এবং এবং কূটনৈতিকভাবে ভাবে বাংলাদেশ সরকার ঠিক করেনি বলেই মনে হয়। চিন্ময় দাসের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থাকলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তিনি সমর্থক ছিলেন। আবু সাঈদকে তিনি শহীদ বলেই বর্ণনা করেছেন। এহেন চিন্ময় দাস কে উপনিবেশিক আইন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার করে বাংলাদেশ সরকার ঠিক কাজ করেন নি। ভারত রাষ্ট্রও প্রগতিশীল এবং সংখ্যালঘু, দলিতদের এই ভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে জেলের মধ্যে বন্দী করে রাখে। চিন্ময় দাসের নেতৃত্বে যে দাবি নিয়ে হিন্দুরা আন্দোলন করছিল সেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারতো।
চিন্ময় দাসের গ্রেফতারি এবং তারপর সাইফুলের মৃত্যু বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে সেটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। এবং সেটাকে কেন্দ্র করে যেভাবে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হিংসা এবং বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে হিন্দুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সেটাও অনভিপ্রেত। এটা বুঝতে হবে বাংলাদেশ যতটা হিন্দুর ততটা মুসলমানের, ততটা বৌদ্ধর এবং ততটা খ্রিষ্টানের। বাংলাদেশে যেই সরকারই থাকুক না কেন সম্প্রীতির বাংলাদেশে সম্প্রীতি বজায় রাখা উচিত। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বর্তমানে বাংলাদেশে এক কঠিন পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হয় বাংলাদেশ এখান থেকে নজির সৃষ্টিকারী একটা দেশ হিসাবে পরিণত হবে, নয়তো একদম তলিয়ে যেতে পারে। একটা নজির সৃষ্টিকারী গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশের সামনে এখন অনেক বাধা। সেই বাধা যেমন অভ্যন্তরীণ, পাশাপাশি বৈদেশিক বাধা আছে। সমস্ত বাধাকে টপকে একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে যদি নিজের দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে তারা তাদের কাছে টেনে নিতে পারেন। সরকার, রাষ্ট্র তারা তাদের কাজ করবে। সরকার, রাষ্ট্র বাদ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাংলাদেশিকেই সংখ্যালঘুদের পাশে টেনে নেওয়ার দায়িত্বটা নিতে হবে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিসাবে ইসকনের কার্যক্রম নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। এই ইস্যুতে অনেকে ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলছে। ইসকন কে নিষিদ্ধ করা হলে সেটা আরো বেশি রাজনৈতিক কৌশল এবং কূটনীতির দিক থেকে ভুল হবে। ইসকনকে নিষিদ্ধ করলে সেটা আরো বেশি ভারত রাষ্ট্র এবং বিজেপি আরএসএস-এর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। এটা ঠিক আদর্শগত দিক থেকে ইসকনের কার্যকলাপ চৈতন্যের দর্শনের বিরোধী। চৈতন্যের আদর্শকে বিকৃত করে উত্তর ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্বের সংস্কৃতি দুই বাংলাতেই প্রচার করছে ইসকন। কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা বাংলাদেশের সমাজেরই অংশ। বৈশ্বিক শক্তের নিরিখে ইসকন নিঃসন্দেহে একটা আধিপত্যবাদী শক্তি। যে কোন দেশেই সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটা ' সাইকি ' কাজ করে, সেটা হলো নিরাপত্তাহীনতা। সেই নিরাপত্তা হীনতার জায়গা থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের একটা বিরাট অংশ আধিপত্যবাদি শক্তি ইসকনের আশ্রয় নিয়েছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। এটা ঠিক ইসকন উগ্র হিন্দুত্ববাদ এর প্রচার করে। উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। কিন্তু যদি বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করেন গায়ের জোরে তাদের দমন করে রাখবে সেটা কিন্তু সম্ভব নয়। কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক কৌশলগত ভাবেই সেটা ভুল হবে। এটা মনে রাখতে হবে সামরিক শক্তির নিরিখে, অর্থনৈতিক বলে, সংবাদ মাধ্যমের আধিপত্যে এবং গোটা বিশ্বে লবির নিরিখে ভারত অনেক বেশি শক্তিশালী। গত দু দশকের ওপর ভারতে একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি শাসন করছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে তার প্রভাব যেমন ভারতে পড়বে, পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি আরএসএস এবং বিজেপি এটাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। ইসকন যতই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হোক না কেন, তারা বাংলাদেশের সমাজেরই অংশ। তাই তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করাটাই যুক্তিপূর্ণ। যত তাদের সঙ্গে ডায়ালগ করা হবে তত তারা বাংলাদেশকে নিজেদের মনে করতে শুরু করবে। সাধু চিন্ময় দাস বাংলাদেশ সরকারের কাছে হিন্দুদের যে আট দফা দাবি রেখেছিলেন সেই দাবি তারা রাখতেই পারেন। সেই দাবি মানবে কি মানবে না সেটা সরকারের ব্যাপার। কিন্তু একটা আলাপ আলোচনা দরকার ছিল। সে আলোচনা থেকেই হয়তো হিন্দুদের অধিকার নিয়ে বেশ কিছু সমাধান বের হতো। সেই আলোচনায় না গিয়ে যেভাবে চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা নিন্দনীয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও বাংলাদেশের পক্ষে নয়, বরং অনেকাংশেই বিপক্ষে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ঘৃণা এবং হিংসা পরিত্যাগ করতে হবে। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এবং সহনশীলতার সঙ্গে এবং দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধদের সঙ্গে নিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদের মোকাবেলা করতে হবে। মুসলিম জাতীয়তাবাদ, পরিচয়বাদী রাজনীতি দিয়ে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু ভাই বোনদের তরফ থেকেই চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবি তোলা উচিত। যত চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবি তোলা হবে, যত ওখানকার হিন্দুদের অধিকারের পক্ষে সংখ্যাগুরু মুসলমানরা আওয়াজ তুলবেন ততোই ভারত রাষ্ট্র, বিজেপি, আরএসএস-এর অস্ত্র ভোতা হবে। ভারত যতই অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে বাংলাদেশের থেকে শক্তিশালী হোক না কেন, অনেক বিষয়ে ভারতের জনতা বাংলাদেশের জনতার থেকে পিছিয়ে আছে। চিরাচরিতভাবেই বাংলাদেশর জনতা একটা বিপ্লবী জনগোষ্ঠী। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশিরাই বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে বিপ্লবী জনগোষ্ঠী। বিপ্লবী চেতনায় বাংলাদেশের মানুষের থেকে অনেক পিছনে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা ভারত বর্ষ। রাষ্ট্র চালনায় যেই থাকুক এবং জামাতের মত উগ্র ইসলামপন্থী দল সমাজে থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিহাসগতভাবে কোন ঘৃণা নেই। বাংলাদেশের মানুষ ভালোবাসতে জানেন। তারা কতটা অতিথি পরায়ণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা বাংলাদেশে গেছে তাদের মুখেই সেটা শোনা গেছে। উল্টোদিকে কলকাতায় আজও বহু জায়গায় মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না ধর্মীয় ঘৃণার কারণে। চিন্তা চেতনায় এবং এবং বাংলা সংস্কৃতির বুদ্ধিভিত্তিক চর্চায় বাংলাদেশের মানুষজন অনেকটাই এগিয়ে। তাই ভালোবাসা দিয়ে হিন্দুদের বুকে টেনে নেওয়া উচিত। কালী পুজো সহ বাংলার যত হিন্দু সংস্কৃতি আছে সেই সংস্কৃতিক উৎসবে বাংলাদেশের মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে হবে । অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের উৎসব ঈদেও সংখ্যালঘুদের সামিল করাটা সময়ের দাবি । তাহলেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি থেকে তাদের অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করা যাবে। হিন্দুরাও বাংলাদেশের একটা শক্তি। তাদের বাদ দিয়ে কোনও ভাবেই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার কাজটা মুসলমানদেরই করতে হবে। ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা জরুরী। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের মানুষকে এক করে দেখলে চলবে না। সেই দিক থেকে দেখলে ভারতবর্ষের জনগণের বিরোধী হয়ে ওঠা ঠিক নয়। বাংলাদেশ যখন আন্দোলন চলছে এবং হাসিনা সরকার যখন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাচ্ছে তখন পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকজন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ। এটা ঠিক বর্তমানে ভারত সহ পশ্চিমবঙ্গের একটা বিরাট অংশের মানুষ বাংলাদেশকে খুব খারাপ চোখেই দেখছে। এর ঐতিহাসিক কারণ আছে। ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশকে এতদিন আওয়ামী লীগের চশমা দিয়েই দেখেছে। তাদের কাছে বাংলাদেশ মানেই আওয়ামী লীগ ছিল। ভারত রাষ্ট্রই এই ধারণাটা তৈরি করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল অংশও বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগের চশমা দিয়েই দেখে। ফলে তারা মনে করে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থাকলে বাংলাদেশ ভালো, অন্য কোন সরকার থাকলে বাংলাদেশ খারাপ। এটা মৃত চিন্তা চেতনার প্রতিফলন। বাংলাদেশের মানুষজন চিন্তা চেতনায় অনেক বেশি সজীব। কিন্তু দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ সমস্ত সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলা, এবং সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলা জরুরী। আর একটা কথা জামাতের মতো বিভেদ কামি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। জামাত কোন গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করে না। এবং ইসলামেরও তারা শত্রু। তাদের জন বিচ্ছিন্ন করাও সমেয়ের দাবি। আশার কথা বাংলাদেশের মুসলমান প্রগতিশীলদের বিরাট অংশ দেশের সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে এবং বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করছে দেশের সম্প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে, অন্যদিকে দেবাশীষ চক্রবর্তী, মেঘমল্লার বসু, প্রীতম দাস, সীমা দত্তের মত হিন্দু ধর্মের প্রগতিশীলদের একটা অংশ বিবৃতি জারি করে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং সম্প্রীতি রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন।
এটা ঠিক হাসিনাকে পুনরায় ফেরাতে না পারলে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তিরা চেষ্টা করবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থার উদ্ভব হোক, হিন্দুরা আক্রান্ত হোক। উগ্র ইসলামপন্থার উদ্ভব হলে এবং হিন্দুরা আক্রান্ত হলে ভারতে তাদের রাজনীতি করতে সুবিধা হবে, ২০২৬ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বাংলাদেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা মেরুকরণের তাস খেলবে। তাই শুধু নিজের দেশকে বাঁচানো নয় প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গকেও হিন্দুত্ববাদী শক্তির হাত থেকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশের সমবেত মানুষের গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করাটা অত্যন্ত জরুরি। শুধু হিন্দু সহ সমস্থ সংখ্যালঘু দের বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে হবে- " বাংলাদেশ যতটা আমার বাংলাদেশ ততটা তোমার "।