পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অবয়ব দেওয়াই কাজ

  • 16 March, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1164 view(s)
  • লিখেছেন : বর্ণালী মুখার্জী
পুঁজি যেখানেই যাক, রাষ্ট্র হাতের নাগালেই থাকবে। এই বছর মার্কসের মৃত্যুদিনে অর্থাৎ ১৪ই মার্চ ২০২৩, শ্রদ্ধার্ঘ। নতুন কিছু শব্দ আসছে, তাই নতুন কিছু ভাবনার যদি উদয় হয়।

           

লুডাইট আন্দোলনের কথা আমরা জানি। কিন্তু মার্কস বললেন মেশিন কেন ভাঙছেন? ওগুলো আপনাদের শত্রু নয়। আসল শত্রু ‘M-C-M'— (টাকা পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে আর সেই পণ্য মুনাফা সহযোগে বর্ধিত টাকা হচ্ছে), কী বিপদ!! শ্রমিকরা এবার ফাঁপরে। এতক্ষণ তারা শত্রু দেখতে পাচ্ছিলেন--- মেশিন, যেগুলোর জন্য তাদের কাজ চলে যাচ্ছিল। শত্রুর অবয়ব পাচ্ছিলেন। কিন্তু এ তো অবয়বহীন একটা কিম্ভুত ফর্মুলা। আজকের ভাষায় বললে fictitious! আজন্মকাল অবযবহীন দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কস তাই এই অবয়বহীন ‘M-C-M’-এর সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ দেখালেন। শ্রমিকরা হাতে চাঁদ পেলেন। শত্রুর অবয়ব আবার পাওয়া গেল।

একবিংশ শতকের পুঁজি, যা ক্রমেই আরো অবয়বহীন হচ্ছে, তার সাথে যদি রাষ্ট্রের যোগাযোগ দেখতে ও দেখাতে না পারি তবে সেটা আর যাই হোক মার্ক্সবাদ না। মহামতি এঞ্জেলসেরই কথা শিরোধার্য, উপরিকাঠামো দেখতে পাওয়া যায়, ভিত্তিটা নয়।

একবিংশ শতকে এসে পুঁজির সাথে রাষ্ট্রের যোগাযোগ বা রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কি কমেছে? তেমন জ্ঞাত হচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন যে, চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ছাড়া অন্যত্র রাষ্ট্রের ভূমিকা নগন্য। আবার তারাই বলতে চাইছেন যে চীনের পুঁজিবাদে মুনাফার হার নাকি কমছে না, যেমনটা অন্যত্র হচ্ছে। তবে সেটাই যদি সত্যি হতো তবে চিনকে বিশ্বজয়ে বেরতে হতো না। আভ্যন্তরীণ বাজার, আমদানি রপ্তানি করেই উন্নতি ঘটাতে পারতো সে। 

যাই হোক, আলোচনা হচ্ছিল অবয়বহীন পুঁজিকে অবয়ব দেওয়া প্রসঙ্গে।

ধরা যাক, তথ্য পুঁজি। এটাই হাল ফ্যাশন। তথ্যের চাহিদা তুঙ্গে। চারিদিকে consultancy firm। ব্যবসার সাফল্যের জন্য একচেটিয়া কোম্পানিগুলো এদের শরণাপন্ন হন।একচেটিয়া হলেও প্রতিযোগীর শেষ নেই। যদিও সেই সরকার, রাষ্ট্রের সাহায্যে সেটা কমানোর প্রচেষ্টা অবিরাম চলে। উপরন্তু পুঁজিবাদ চলে ধ্রুপদী নিয়মেই। বাজার ক্ষুদ্র। পরামর্শদাতা কোম্পানিদের কাজই হল শয়ে শয়ে প্যারামিটার ঘেঁটে একটা গড় হিসেব করা। যে হিসেব করবে কৃত্রিম বুদ্ধি, তথ্যের জাল ছাড়িয়ে। ফলে তথ্যের চাহিদা যত বাড়বে ততই সেই পরামর্শের দাম বাড়বে। এককালে গাড়ির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। অটো পুঁজি দুনিয়া শাসন করেছে। আজ না হয় চাহিদা data-র। তাতে কি হল? রাষ্ট্র অনপেক্ষ হয়ে গেল সেই পুঁজি? 

তথ্য নামক পণ্যটি শুধু বহুজাতিকরাই নয়, জনগণও কেনে। সাধারণভাবে সেই ক্রয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রকে কাঁচা টাকার যোগান দিতে হয় অনবরত, দান খয়রাত করতে হয় দুনিয়া জুড়ে (যেহেতু চাকরি দিতে পারে না)। যা করতে না পারলে সেই ব্যবসাতেও সংকট আসবে। রিয়াল এস্টেটের মতোই হবে। বাড়ির কাগজ এহাত থেকে ওহাত হচ্ছে অথচ তাদেরই কাছে মর্টগেজ রাখা সত্যিকারের বাড়িগুলো বিক্রি করে টাকা উদ্ধার করতে পারছে না ব্যাংক গুলো। 

সকলেই দেখছেন, আমেরিকা জুড়ে পয়লা নম্বর ব্যাংকগুলোর পতন হচ্ছে। ফেডারেল ব্যাংক এই সংকট মোকাবিলায় কী কী চেষ্টা চালালো গত কয়েক মাস সেটা নেট খুললেই দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই 5G নিয়ে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে হিংস্র বাদানুবাদ চলেছে। চিনা কোম্পানি হুয়াই-এর উত্থান রুখতে মার্কিন ট্রাম্প সরকার কতরকম চেষ্টা চালালো। অন্য পক্ষ চিন সরকার। আবার দেখুন, দুটি দেশের সরকারের মধ্যে ব্যবসায়িক বা বিনিয়োগের চুক্তি হয়, একটি দেশ বিনিয়োগ করবে অন্যটিতে, সেই চুক্তি। বিনিয়োগকারী দেশ কোন শিল্পপতিকে দেবে সেই বরাত, সেটা সেই নির্ধারণ করে। শ্রীলঙ্কা সরকারের পক্ষে বিবৃতি এসেছে যে আদানি কলম্বো বন্দরে বিনিয়োগ করলেও তাদের দুশ্চিন্তা নেই, কারণ চুক্তি হয়েছে দুটি সরকারের মধ্যে। এদিকে গ্লোবাল পুঁজি যখন রাষ্ট্র নির্ভর, তখন কোন্ রাষ্ট্রের উপর সে নির্ভর করে, প্রশ্ন আসবেই। লেম্যান ব্রাদার্স, জেনারেল মোটরস, AIG যখন বিপদে পড়ল সে bail out চাইলো। অর্থাৎ সরকার তাদের টাকা দিয়ে, শেয়ার কিনে বাঁচাক। কিন্তু গ্লোবাল বলে জাপান সরকারের কাছে চাইলো না। চাইলো সেই মার্কিন সরকারের কাছেই।

সবচেয়ে বড় কথা যুদ্ধ। এই যে পুতিন একটা স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণ করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিল, চীন-ভারত-ইরানকে নিয়ে একটা নতুন লবি বানাতে চাইছে, এর ফলে দুনিয়ার অর্থনীতি এক নতুন মোড় নিল যা দশ বছর আগেও অনেকেই কষ্ট কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। যেনবা ব্রেটন উডস ফিরে আসছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা আবার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, নির্দিষ্ট হারে মুদ্রা আদান প্রদান হবে। রাশিয়ার সাথে ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য হতে শুরু করলো। শোনা যাচ্ছে ৩৬ টা দেশ নাকি সম্মত হয়েছে। সোনা জমানো শুরু হয়েছে। রুশ আস্ফালনের মূল টার্গেট ইওরোপ জুড়ে একটি আগ্রাসন, প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলোর পুনর্দখল। পুতিন ভেবেছিলেন খুব দ্রুতই তারা ইউক্রেন দখল করতে পারবেন। সেটা তো হলোই না, এখন তারা ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছে।  ফলে কিছু প্রতিশ্রুতি তাকেও কার্যকর করতে হবে বা অন্তত যুমলাবাজি করতে হবে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর  মার্শাল পরিকল্পনার টাকা দিয়ে (খেয়াল করুন এখানেও রাষ্ট্র) ইয়োরোপীয় পুঁজি ও সাধারণভাবে পুঁজিবাদকে রক্ষা করেছিল মার্কিন সরকার। সেদিন ডলার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, আজ রুবল ইউয়ান সাম্রাজ্যের আশায় এটুকু লোভ পুতিনকে দেখাতেই হবে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মধ্য দিয়ে সংকট থেকে বেরিয়েছে পুঁজিবাদ। গাড়ি পুঁজি যুদ্ধে বিনিয়োগ করেছে। আজ তথ্য পুঁজি উদীয়মান রুশ চিনা যুদ্ধবাজ লবির পক্ষে দাঁড়াবে কি না জানা নেই, কিন্তু শেষমেশ জাতি রাষ্ট্রের উপর তারাও নির্ভরশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ছোট আংশিক যুদ্ধ যেমন korea, Vietnam, Iraq যুদ্ধ করেও ডলার নিজেকে সামলেছে। মুক্ত মুদ্রা বাজারের নামে ব্রেটন উডস ব্যবস্থা ভাঙ্গা হয়েছিল, কিন্তু তার মানে মুদ্রা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ, ডলারের দাম বাড়ানো কমানো বন্ধ হয়নি। তেল পুঁজির উত্থান দুনিয়াকে এদিকে ওদিকে করে দিয়েছিল, ডলার সাম্রাজ্যের সুস্থতার জন্য সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিভাজন ও পুনর্বিভজনের দরকার ছিল।

আবার সেই রাষ্ট্রের ভূমিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের খুব প্রয়োজন ছিল তাদের, জমিও তৈরি ছিল। যুদ্ধ হল পরে, আগে গৃহযুদ্ধ হল। যুগোস্লাভিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, নারকীয় যুদ্ধের পর পুর্ব ইয়োরোপের বাজার দখল ও ভাগাভাগি করে পুঁজিবাদ বাঁচলো। সোভিয়েত ব্লকের দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাজার কব্জা করতে হলে বিশ্বায়নের নীতি বিশেষ ভাবে তাদের দরকার ছিল। এদিকে আফ্রিকা দখল পুনর্দখলের জন্য অনবরত যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ চলছে।

আর গত সপ্তাহে চিদম্বরম বললেন, বিশ্বায়নের যুগ শেষ। তারা নাকি যেটা ভেবেছিলেন সেটা হয়নি। অর্থাৎ সম্পদ এমনভাবে চুঁইয়ে নামেনি যার সাহায্যে আভ্যন্তরীণ বাজারের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে ভারত। কিংবা দান খয়রাতিটাই বাজার স্থিত রাখার একমাত্র সমাধান হবে না। চাকরিও হবে। কিন্তু সেটা হয়নি।

তাহলে? 

বিকল্প সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নেই। সুতরাং ফ্যাসিবাদী মডেল দুনিয়াজুড়ে। নতুন অক্ষ গড়ে তুলছে। Oligarchy হল এই মুহুর্তে ফ্যাসিস্ট মডেল। এক কথায় একচেটিয়াদের দুই একটা কে রেখে বাকিগুলো ধ্বংস করা। ফ্যাসিবাদের এটাই ধ্রুপদী সংজ্ঞা। জাতীয় পশু, জাতীয় ফুলের মত জাতীয় পুঁজিপতি। দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ায় পুঁজিবাদী অর্থনীতি তিন দশক আগে এই 'জাতীয় পুঁজিপতি'র সাহায্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলি যেমন, ভারত সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে এখানে আদানিকে জাতীয় বানিয়া করতে হলে লাখ লাখ ছোট মাঝারি এবং বড় পুঁজির বিপদ। ফলে রাজনৈতিক oligarchy বা ফ্যাসিবাদ ছাড়া সেটা হবে না। 

ইউক্রেনেও oligarchy ছিল, কিন্তু এখন তারা আত্মরক্ষাত্মক যুদ্ধ করছে। ফলে oligarchy নীতি থেকে তাদের সরতে হয়েছে। এই oligarchy মডেল শুধু অর্থনীতি নয় রাষ্ট্রতেও। 

যেমন ভারতের আদালত।

 কলকাতা হাইকোর্টে এখন কয়েকজন বিচারপতি হলেন সততার প্রতীক। আদালত মাত্রেই পুঁজিবাদের ঘুঘুর বাসা।কিন্তু ক্রমেই oligarchy-র জন্ম হচ্ছে। পার্থ চ্যাটার্জীকে খাটে শুতে দেবে না! কে? ইডি! কী দুঃসাহস! চাপ দিয়ে তাকে দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করবে। ইডি সন্ত্রাসে দেশ গণতন্ত্র জেরবার। এমনিতে কোটি কোটি মামলার কোনো মীমাংসা হয়না। NBSTC শ্রমিকদের মমলা চলছে এগারো বছর ধরে। আদালত, গড়ে তিন বছর অন্তর রায় দিয়ে বলেন, শ্রমিকরা ঠিকই বলেছেন! ব্যাস! কিন্তু টাকা উদ্ধারের, চাকরির কোনো নির্দেশ নেই। চাকরি থেকে ছাঁটাই করে যে দুর্নীতি সরকার করেছে তার থেকে পার্থ চ্যাটার্জির অপরাধ বেশি! 

আজ পুতিনের আগ্রাসী যুদ্ধ দেখে মার্ক্সবাদীদের মধ্যে একটা মতামত প্রবল হয়ে উঠেছে। ডলার সাম্রাজ্য ভাঙুক আগে, পরেরটা পরে দেখা যাবে।

১৯২৪ থেকে ১৯৩৪, কমিন্টার্ন দশ বছর ধরে এভাবেই অপেক্ষা করেছিল। নির্যাতিত জার্মান বড় পুঁজি যখন দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত পাউন্ড সাম্রাজ্য ভাঙছিল, ইয়োরোপের কম্যুনিস্টরা wait and see করছিল। আগে প্রতিষ্ঠিত সরকারি দলগুলো হারুক, হিটলার, মুসোলিনিদের পরে সামলানো যাবে। তার ফল দুনিয়া দেখেছে। ১৯৩৪ সালে দিমিত্রভ বললেন অত্যাচারীদের সাথেই জোট করে ফ্যাসিস্ট দের হারাতে হবে। কিন্তু তার আগেই যা সব্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে।।

আজও আমরা কি সেটাই করবো?

0 Comments

Post Comment