পল্টু চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল তারপর নীচু স্বরে বলল, “আমি এখনও নেপাল বর্মনের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি । তক্কে তক্কে আছি অবশ্য । কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করব বললেই তো আর দেখা করা যায়না ।"
“কাজটা তাহলে এগোয়নি ? “নবেন্দুকে একটু চিন্তিত দেখাল । “আমি ওর সাগরেদের সঙ্গে কথা বলেছি । তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম । নেপাল বর্মন খুব ঘাঘু মাল । তাছাড়া এই অঞ্চলে বৌদি খুব পপুলার । ভোটে হারানো ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না । মনে হয় আরো কিছু মাল খসাতে হবে । “
“তোকে অলরেডি তিরিশ হাজার দিয়ে দিয়েছি , “ একটা ঢোঁক গিলল নবেন্দু । পল্টু হাসল । বলল, “ তা দিয়েছ । তবে আরও লাখ দুয়েকের কমে কাজ হবে বলে মনে হয়না । “
কথা শেষ করে পল্টু আর দাঁড়াল না ।
খুব হতাশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসে চায়ের জল চাপাল নবেন্দু । আজ রবিবার । অথচ তাকে গোটা দিনটা একাই থাকতে হয়েছে । ছুটির দিনে নবেন্দুর আজকাল পাগল পাগল লাগে । একসময় সে নিঃসঙ্গ জীবন পছন্দ করত ।
অথচ আজকাল এই ঘরের নৈঃশব্দ্য যেন তাকে কুরে কুরে খায় ।
মিষ্টু এখন হস্টেলে , ঋতু বাড়িতে নেই , কখন ফিরবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই ।
ফাঁকা বাড়িতে বসে মন
মনখারাপ লাগছিল নবেন্দুর । ইদানীং তাকে পুরো সময়টা একা থাকতে হয় । আগে তীর্থের কাকের মতো সে ঋতুর জন্য অপেক্ষা করত । এখন আর করে না ।
তবে ফাঁকা বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে এরকম মনখারাপ তার মাঝেমাঝেই হয় । তখন পুরোনো কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে । অবসরে , নির্জনে পুরোনো স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই নবেন্দু বুঝতে পেরেছিল ঋতু খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে । ওর কথাবার্তা , আচার ব্যবহারে সেটা প্রকাশ পেতো ।জীবনবীমার প্রিমিয়াম থেকে শুরু করে মিষ্টুর লেখাপড়া , সংসারের খুঁটিনাটি সব বিষয় সিদ্ধান্ত ঋতু নিজেই নিত ।
বিয়ের বছর তিনেকের মাথায় সে একবার বলেছিল , “এভাবে সারাজীবন এখানে কাটিয়ে দেবে নাকি ! সংসার এখন বড় হচ্ছে । এভাবে আর কতদিন থাকব ? “একটু অবাক হয়েছিল নবেন্দু । সবে তিনবছর বিয়ে হয়েছে তাদের , এর মধ্যেই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা সে ভাবেনি ।
তাই ঋতুর কথা শুনে আমতা আমতা করে বলেছিল , “এখানে যে খুব অসুবিধা হচ্ছে তা তো নয় । তাই এখনই আলাদা হওয়ার কথা না ভাবলেই বোধহয় ভালো করতে । “ঋতু ঠোঁটের কোণায় একটা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়েছিল । বলেছিল , “কতদিন আর এই একচিলতে ঘরে থাকবে ? তোমার ভাল থাকতে ইচ্ছে করেনা ? “
নবেন্দু আর কিছু বলেনি ।
ততদিনে তার ঋতুর ওপর অগাধ ভরসা জন্মেছে । তাই এভাবে হঠাৎ আলাদা হয়ে গেলে এই বাড়ির সবার সঙ্গে সম্পর্কটা চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে এই ভাবনা তাকে বিচলিত করলেও সে কিছু বলতে পারেনি ।কিছুদিনের মধ্যেই ঋতু আর মিষ্টুকে নিয়ে উঠে এসেছিল নবেন্দু ।
আর ভাল থাকার তাগিদে এবং ঋতুর জোরাজুরিতে সে একটা নতুন চাকরীতে জয়েন করেছিল । নতুন কোম্পানীতে নবেন্দুর ম্যানেজার ছিলেন হরলাল সামন্ত । ভদ্রলোক নবেন্দুকে পছন্দ করতেন । কেন করতেন তা অবশ্য নবেন্দু জানেনা । তবে সামন্ত সাহেবের সঙ্গে তার খাতিরটা খুব তাড়াতাড়ি জমে উঠেছিল ।
প্রায়ই বিকেলবেলার দিকে ঋতুর হাতের চা খেতে চলে আসতেন সামন্ত সাহেব । ঋতু হরদা হরদা করত । তারপর কিছুদিনের মধ্যেই ঋতু আর সামন্ত সাহেবকে নিয়ে অফিসে একটা চাপা ফিসফিস শোনা গিয়েছিল । কথাগুলো নবেন্দুর ভাল না লাগলেও সে তেমন আমল দেয়নি ।
মুখে মুখে খবরটা কিভাবে যেন ছড়িয়ে গিয়েছিল । একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ছোটবেলার বন্ধু অলোকেশ তাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিল , “হরলাল সামন্ত লোকটা খুব সুবিধার নয় । আমি ওকে অনেক আগে থেকেই চিনি । তোদের বাড়িতে প্রায়ই আসে দেখি । একটু চোখ কান খোলা রেখে চলিস । তুই ভালমানুষ , তাই বললাম ।গা চিড়বিড় করে উঠেছিল নবেন্দুর ।
ঋতুর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস । । সে শুধু জানে ঋতু হাতে ধরে তাকে ভাল থাকতে শিখিয়েছে । ঋতুর জন্য অনেক পরিবর্তন ঘটেছে তার জীবনে ।আর সেই কারণেই ক্রমশ ঋতুর ওপর তার ভরসা আর নির্ভরতা বেড়েছে ।
বছরদুয়েকের মধ্যে বদলী হয়ে গিয়েছিলেন হরলাল সামন্ত । আর চলে যাবার আগে একদিন নবেন্দুর খাবার টেবিলে বসে ভাপা ইলিশ দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলেছিলেন , “যাবার আগে তোমার একটা ব্যবস্হা করে দিয়ে যাব নবেন্দু । কোথায় পোস্টিং নিতে চাও বল । “
“ওকে এবার শীতলহাটিতে পোস্টিং এর একটা ব্যবস্হা করে দিন । “নবেন্দুকে অবাক করে দিয়ে ঋতু বিগলিত স্বরে উত্তর দিয়েছিল । তারপর তার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলেছিল ,”তোমার ভাল থাকতে ইচ্ছে করেনা ? শীতলহাটি বর্ডার এরিয়া । ওখানে পোস্টিং নিলে তোমার পুরো মাইনে বেঁচে যাবে । যা উপরি কামাবে পাবে তা দশহাতে খরচ করেও শেষ হবেনা । “
সেবার শীতলহাটিতে আর যাওয়া হয়নি । ঋতু
নিজেই যেতে চায়নি । ততদিনে ভাল থাকার এক নতুন নেশা তার মাথায় চেপে বসেছে । নবেন্দু অফিসে বেরিয়ে গেলে সে তখন পাড়ার প্রতিটা ঘরে ঘুরে বেড়ায় । ।
কার আধারকার্ড নেই ,কার বাড়ির দলিল নেই , কোথায় বধূ নির্যাতন হয়েছে এসব নিয়ে সে রাতদিন ব্যস্ত থাকে ।
ধাপে ধাপে উঠছিল ঋতু । এত নিখুঁত , এত নিপুণ সেই উত্থান যে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছিল নবেন্দু । এরপর হঠাৎ রাজনীতির নেশায় মেতে উঠল ঋতু।
রাজনীতি তখন তার ধ্যান - জ্ঞান । কোথায় মহিলা কমিটির মিটিং , কবে কোন মিছিলে তাকে যেতে হবে এসব নিয়ে রাতদিন তার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো ।
আগে নবেন্দুকে ধরে পড়ত ঋতু । বলত , “দুচার লাইন লিখে দাওনা বাপু । আমাকে বক্তৃতা দিতে হবে ।” নবেন্দু লিখে দিত আর সেইসব মুখস্হ করা লাইনগুলো উগড়ে দিত সে ।
পরে অবশ্য আর সেসব দরকার হয়নি । ততদিনে লোকের মন জয় করার কৌশল ঋতু ভালই রপ্ত করে নিয়েছে । আর ঋতুর মুখে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট , ডেমোগ্রাফিক ডেনসিটি জাতীয় কঠিন শব্দগুলো শুনতে শুনতে চমকে উঠেছে নবেন্দু ।
তারপর মিউনিসিপ্যালিটি ইলেকশনে ঋতুর দাঁড়াবার ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঘটে গিয়েছিল । অস্বস্তি লুকোতে পারেনি নবেন্দু । ভয়ে ভয়ে বলেছিল , “ এসব ছেড়ে দাও ঋতু
। টুকটাক সমাজসেবার কাজ করা আর জনপ্রতিনিধি হওয়া এক কথা নয় । “
ঋতুর গলা আচমকা কঠিন হয়েছিল ।ভ্রূ কুঁচকে বলেছিল , “আমি ভাল থাকার জন্য যা করতে হয় তাই করছি । তবে ভোটে হেরে গেলে আর কোনদিন ওমুখো হবোনা । “ কথাটা শুনে একটা মতলব খেলে গিয়েছিল নবেন্দুর মাথায় ।
ঠিক এই সময় অফিসের একটা কেসে বিনা দোষে ফেঁসে গিয়েছিল নবেন্দু । টাকা নয়ছয়ের অপরাধে তখন চাকরীটা যায় যায় অবস্হা । সোজা নবেন্দুর অফিসে চলে গিয়েছিল ঋতু । ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বলেছিল ,” শুনলাম আপনার মেয়ে মেডিক্যাল পড়তে চাইছে । কোন দরকার হলে বলবেন স্যার । শহরের সেরা কলেজে আমার চেনাজানা আছে । সব ব্যবস্হা হয়ে যাবে । আর আপনার জন্য কিছু করতে পারলে সেটা আমার সৌভাগ্য বলেই মনে করব । “
খুব তাড়াতাড়ি নবেন্দুর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল কোম্পানী ।একটা প্রমোশন হয়েছিল নবেন্দুর । আর তার হাঁ করে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হেসেছিল ঋতু। অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল নবেন্দু । কোন কথা বলতে পারেনি ।
তারপর দিন দিন ঋতু কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল , ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিল । দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল নবেন্দু । কাঁহাতক আর এই অশান্তি সহ্য করা যায় । আজকাল প্রায়ই মাঝরাতে বাড়ি ফেরে ঋতু । পার্টির কাজে ব্যস্ত থাকে , এখানে সেখানে দৌড়ে বেড়ায় । অনেক সময় রাতে বাড়ি ফিরতেই পারেনা । যেসব লোকজন আজকাল তাদের বাড়িতে আসা - যাওয়া করে তাদের দেখে সবসময় যে খুব ভাল লাগে তা নয় ।
মাসকয়েক আগেই একটা চোয়াড়ে মতো লোক ঋতুকে খামে করে টাকা দিয়েছিল । নির্বিকার মুখে খামটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিল ঋতু । পরে নবেন্দু সেই নিয়ে প্রশ্ন করলে হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়েছিল। নবেন্দু ঋতুর চালচলন ঠিক মেনে নিতে পারছিল না । হাজার হোক , ঋতু তার স্ত্রী । শেষমেশ সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে সে পল্টুর সঙ্গে দেখা করেছিল । কাজটা খুব সহজ ছিল না । অত্যন্ত চুপিসাড়ে তাকে সবটা সারতে হয়েছিল । মরীয়াভাবে সে পল্টুকে বলেছিল , “আমাকে একটু হেল্প করতে পারবি ? “
পল্টু এই পাড়ারই ছেলে, লেখাপড়া মাঝপথে ছেড়ে এখন ফুল টাইম পার্টি ওয়ার্কার । নবেন্দুর উল্টোদিকে বসে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বরফ ঠান্ডা গলায় বলেছিল , “বৌদিকে ভোটে হারাতে হলে নেপাল বর্মনের কাছে যেতে হবে । নেপাল বর্মন হল কিং মেকার । ও ঠিক করে দেয় কে জিতবে আর কে হারবে । যে পার্টি হোক না কেন , কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না ।নেপাল বর্মনের কথাই এখন শেষ কথা । তবে মালটা বহুত ঘোড়েল । টাকা , মদ আর মেয়েমানুষ ছাড়া কোন কথাই বলেনা ।”
শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা রান্নাঘরে রেখে জানলাটা বন্ধ করে দিল নবেন্দু । একটা কালো বেড়াল কয়েকদিন হলো খুব জ্বালাচ্ছে । ফাঁক পেলেই ঢুঁকে পড়ছে ঘরে । সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে । রাস্তার আলোগুলো আজ জ্বলেনি । রাস্তাঘাট এখন একেবারেই নিঝুম । চারিদিকে কেমন যেন ছমছমে অন্ধকার ।
হঠাৎ দরজা খোলার মৃদু শব্দে শুনতেই নবেন্দু সেদিকে ঘাড় ফেরাল ।
তুমি ! আজ এত তাড়াতাড়ি ! ঋতু ঘরে ঢুকতেই চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নবেন্দু ।
“চলে এলাম , ভাবলাম অনেকদিন তোমার সঙ্গে বসে কথা বলা হয়নি । “ একগাল হেসে মোবাইলটা টেবিলে রাখল ঋতু। তারপর সটান চলে গেলো পাশের ঘরে ।চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে খাটে এলিয়ে দিল শরীর ।
“তোমার কাজকর্ম কেমন চলছে ? “ ঋতুর
পাশে বসে প্রশ্ন করল নবেন্দু । “ওই যেমন চলে আর কী , “ ঋতু হাত বাড়িয়ে নবেন্দুর হাত ছুঁল । মুখে চপল হাসি ,শাড়ির আঁচলটা সরে গেছে বুক থেকে।
ঋতুর শরীরের উত্তাপে নবেন্দুর শরীর কেঁপে উঠছিল । সে আশ্চর্য হয়ে অনুভব করছিল একটু আগে তার যেমন ঋতুর ওপর রাগ হচ্ছিল এখন আর ততটা হচ্ছে না । বরং একটা অদ্ভুত ভাল লাগার অনুভূতি হচ্ছে মনে । সে আস্তে আস্তে ঋতুর দিকে এগিয়ে গেল । উদ্দাম রক্তের কণা এখন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে , শরীরে মিশে যাচ্ছে শরীর ।
একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল ঋতু। আর ওর ক্লান্ত , পরিতৃপ্ত মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়াল নবেন্দু । একটা অপরাধবোধের কাঁটা যেন পেন্ডুলামের মতো দুলে চলেছিল তাঁর মনে । মনে হচ্ছিল এভাবে গোপনে পল্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করা বোধহয় উচিত হয়নি । ঠিক তখনই আচমকা কানে ধাক্কা মারল শব্দটা । নবেন্দু চোখ তুলে তাকাল । কালো বেড়ালটা এখন আবার দরজার বাইরে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে ।
জানলার সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে ।
রাত বাড়ছে । দেয়ালঘড়ির কাঁটা এখন বারোটার ঘর ছুঁয়েছে । নবেন্দু কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ কানে যেতেই চিন্তায় ধাক্কা লাগল ।
আলগোছে ফোনটা হাতে তুলে নিল সে । তারপর পর্দায় ভেসে ওঠা নেপাল বর্মনের নাম দেখতে দেখতে তাঁর হঠাৎ খেয়াল হলো ফোনটা ঋতুর । ভয়ঙ্কর চমকে উঠল নবেন্দু। নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছিল সে।
কাঁপা হাতে ফোনের পর্দায় আঙুল ছোঁয়াল নবেন্দু । তারপর নেপাল বর্মনের পাঠানো অশ্লীল মেসেজটা পড়তে পড়তে
কেউ যেন একটা ঝাঁকুনি দিল তাঁকে আর তারপরেই স্হির হয়ে গেলো সে। অসহ্য রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ সব একসঙ্গে যেন ঝড় তুলছিল তার মনে । আঙুলের ফাঁকে থরথর করে কাঁপছিল জ্বলন্ত সিগারেট। একটা ঘোরের মধ্যে শোবার ঘরে গিয়ে ঋতুকে ডেকে তুলল নবেন্দু । বলল, “তোমাকে আর ভাল থাকতে হবেনা ঋতু । অনেক নীচে নেমে গেছো তুমি , আর নয় ।আর নিজেকে এই পাকে টেনে নামিও না , “ নবেন্দুর উঁচু গলা ক্রমশ ভেঙে আসছিল ।
সদ্য ঘুম ভাঙা ঋতুর মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল । একটু ঘুমজড়ানো গলায় সে বলল , “কী বলছ ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি যা করেছি ভাল থাকার জন্য করেছি । ভালো থাকতে গেলে অনেক কিছু করতে হয় । “
কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নবেন্দুর । কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না । ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ ।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল নবেন্দু । একটা উৎকট গন্ধ হঠাৎই এসে ধাক্কা মারল নাকে । নবেন্দু দেখতে পেলো তাদের বাড়ির পাশে সরু গলিটাতে রাত্রির অন্ধকারে একটা মরা ইঁদুর নিয়ে এসেছে সেই বেড়ালটা । থাবা দিয়ে চেপে ধরেছে প্রাণপনে ।
নিথর দাঁড়িয়ে ছিল নবেন্দু । একটা নেশাখোর লোক এখন টলতে টলতে সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে ।
নবেন্দু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল । ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবী চেয়ে দেখতে দেখতে তার মনে হলো শুধু ভাল থাকার নেশায় এক ক্লেদাক্ত পথ হেঁটেছে ঋতু । এই ভালো থাকার লোভ তাকে ঠেলে দিয়েছে সত্য থেকে অসত্যের পথে , আলোর পথ থেকে অন্ধকারে। নিজের অজান্তেই দু ফোঁটা জলের সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর । খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ঋতু । দু চোখ বোজা ।
মুখ ফিরিয়ে একবার ঋতুর দিকে তাকাল নবেন্দু । তাঁর দুচোখে এখন ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই ।