ভারতীয় জনতা পার্টি এক দেশ, এক আইন, এক নির্বাচন, এক ব্যবস্থার ওকালতি করে। সেই ওকালতি বাড়তে বাড়তে এখন এক দেশ একটাই সরকারে পরিণত হচ্ছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কখনোই সম্পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ছিল না। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কেন্দ্রের হাতে, রাজ্যগুলির হাতে অল্প কিছু অবশিষ্ট ছিল। ৮০ এর দশকে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবীতে সারকারিয়া কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। বহু রিপোর্টের মতই সেই রিপোর্টকে ময়লার বাক্সে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিশনের কাছে তৎকালিন বিজেপি রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবীতে সোচ্চার হয়েছিল। ক্ষমতায় ভালভাবে গেড়ে বসার পরে এখন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবশিষ্ট ছিটেফোঁটাকে খতম করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। অবশ্য এটা বিজেপির স্বভাব ধর্ম। ক্ষমতায় আসার আগে আধার-জিএসটির বিরোধিতা করেছে, পেট্রল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে, টাকার মূল্য পড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আর ক্ষমতায় এসে ঠিক উল্টো কাজ করেছে।
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্যতম পরীক্ষা হল রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার থাকার সম্ভাবনা, যে সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের থেকে পৃথক অন্য কোন রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। কেন্দ্রে যে দলের সরকার আছে সেই দলের সরকার রাজ্যে থাকলে রাজ্য সরকারের সুবিধে হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। যদি কেন্দ্রে রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার থাকলে কেবল সেই কারণে রাজ্যে কোন অসুবিধে সৃষ্টি হয় বা একই দলের সরকার থাকলে রাজ্যটি কোন বিশেষ সুবিধে পায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস হবে। এতদসত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে জিততে মরিয়া মোদী-শাহের বিজেপি রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের গল্প ফাঁদছে। বলছে রাজ্যে ও কেন্দ্রে একই দলের সরকার থাকলে রাজ্যের উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত হবে। এটি বলা অনৈতিক। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি কবেই বা নীতির ধার ধারে?তাদের মহা মহা মন্ত্রী শান্ত্রীরা ‘সুনার বাঙ্গালা’ গড়ার জন্য ‘সোঙ্কোল্পো’ গ্রহণ করেছেন, এবং সে’জন্য ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করে বেরাচ্ছেন। ডাবল ইঞ্জিন বলতে রাজ্য ও কেন্দ্রে একই শাসক দলের হাতে ক্ষমতা। ঠিক একই যুক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়তে সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত, পুরসভা, মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনসমূহ কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো টাকার জোরে, কখনো গায়ের জোরে দখল করেছিল (যার চূড়ান্ত রূপ ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিডিও এবং পরবর্তীতে এসডিও অফিসের সামনে তাবু খাটিয়ে অপর দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দখল করতে না দিয়ে ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জেতা)। অবশ্য সেই কারচুপি, সন্ত্রাস, দখলের তৃণমূলী কারিগরদের একটা বড় অংশ, শুভেন্দু, মুকুল, অর্জুনরা এখন বিজেপিতে। রাজ্য ও স্থানীয় সংস্থায় সম দলের শাসন থাকলে কী উন্নয়ন হয় তা এখন মমতা ব্যানার্জী সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেন বোধহয়।
এটা মানতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে ভারতবর্ষের বড় ১০টি রাজ্যের পিছনে রয়েছে। কিন্তু তার জন্য কেন্দ্রে ও রাজ্যে ভিন্ন সরকার থাকাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, যা বিজেপির অঙ্গের ভূষণ। ২০১৮-১৯ সালের (২০১৯-২০’র তথ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে সব রাজ্যের জন্য নেই) তথ্য অনুযায়ী, ওই আর্থিক বৎসরে পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় ১,০১,১৩৮ টাকা যা সারা ভারতের গড় ১,২৬,৫২১ টাকার তুলনায় বেশ খানিকটা, প্রায় ২০শতাংশ কম। ওই সময়ে বা তার কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত বিজেপির শাসনে থাকা রাজ্যগুলির দিকে চোখ ফেরালে বোঝা যাবে যে ওই ডাবল ইঞ্জিনের গল্পটি অন্য বহু ভুয়ো প্রচারের মতই ফেক। যেমন ধরা যাক বিহার। প্রায় ১৩ বছর বিজেপি জেডিইউর সঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ওই রাজ্যটির ২০১৮-১৯ এর মাথাপিছু আয় ৪০,৯৮২ টাকা, সারা ভারতের গড় আয়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম। আসাম, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় যথাক্রমে ৭৩, ১৫৫ টাকা, ৮২,৮৩৭ টাকা, ৯০,১৬৫ টাকা ও ৯২,৪১৩ টাকা। কেবল তাই নয়, ২০১৩-১৪ সালে গুরাটের মাথাপিছু আয় ছিল ১,১৩,১৩৯ টাকা যা ওই বছর সারা দেশের মাথাপিছু আয় ৭৯,১১৮ টাকার তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশী। লক্ষ্যণীয় ওই সময়ে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ও গুজরাটে বিজেপি সরকার ছিল। ২০১৮-১৯ সালে বড় রাজ্যগুলির মধ্যে মাথাপিছু আয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ রাজ্য ছিল যথা ক্রমে কেরালা, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু যেগুলির কোনোটিতেই তথাকথিত ডাবল ইঞ্জিন সরকার প্রায় কোনদিনই ছিল না।
কেবল জাতীয় আয় বাড়লেই তো ‘সুনার বাঙ্গালা’ গড়া হয়ে যাবে না। সুশাসনের অন্যন্য সূচকগুলির কয়েকটিকে একটু খতিয়ে দেখা যাক। ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে (এনএফএইচএস ৪), এখন অবধি প্রকাশিত শেষ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে এনডিএ শাসিত বিহারে ৫৯ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌছেছিল (পশ্চিমবঙ্গে ৯৪ শতাংশ, কেরালায় ৯৯ শতাংশ)। যথাযোগ্য পানীয় জল ছিল এনডিএ শাসিত ঝাড়খন্ডে ৭৮ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৮৫ শতাংশ, গুজরাটে ৯১ শতাংশ বাড়িতে (পশ্চিমবঙ্গে ৯৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ)। শৌচালয়ের সুবিধে ছিল এনডিএ শাসিত ছত্তিশগড়ে ৪১ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৪৩ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭১ শতাংশ, গুজরাটে ৭১ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গ ৭৫ শতাংশ, কেরালা ৯৯ শতাংশ) বাড়িতে। পাকা বাড়িতে বাস ছিল বিহারে ২৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩৬ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৭৩ শতাংশ ও গুজরাটে ৭৭ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গে ৪৭ শতাংশ ও কেরালায় ৮৯ শতাংশ) নাগরিকের। কোনদিন বিদ্যালয়ে যায়নি (৬ বছরের অধিক বয়স্ক) এমন ব্যক্তিদের অনুপাত এনডিএ শাসিত বিহারে ৪৩ শতাংশ, ঝাড়খন্ডে ৩৯ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৩৬ শতাংশ, ছত্তিশগড়ে ৩২ শতাংশ, হরিযানায় ৩০ শতাংশ, গুজরাটে ২৮ শতাংশ ( পশ্চিমবঙ্গ ২৬ শতাংশ, কেরালা ৪ শতাংশ)। শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির পরিস্থিতি তথৈবচ। ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) মধ্যপ্রদেশে ৬৫, ছত্তিশগড়ে ৬৪, বিহারে ৫৮, ঝাড়খন্ডে ৫৪, রাজস্তানে ৫১, গুজরাটে ৪৪ ( পশ্চিমবঙ্গ ৩২, কেরালা ৭)। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা ৫ এর সব রাজ্যের তথ্য এখনো প্রকাশিত হয় নি। ৫ বছরের কম বয়স্ক শিশু মৃত্যু হারের ক্ষেত্রে ক্রমানুসারটি তেমন পাল্টায় নি। প্রতি হাজার শিশুজন্মে তা বিহার- ৫৬, ত্রিপুরা- ৪৩, গুজরাট- ৩৮, কর্ণাটক-৩০, হিমাচল- ২৯, মহারাষ্ট্র- ২৮, পশ্চিমবঙ্গ- ২৬ ও কেরালা-৫। শিশুদের প্রতিষেধক প্রদানের ক্ষেত্রেও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির অনেকগুলিই পিছিয়ে আছে; গুজরাটে ৫০ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৫৪ শতাংশ, রাজস্থানে ৫৫ শতাংশ, বিহারে ৬২ শতাংশ ঝাড়খন্ডে ৬২ শতাংশ, হরিযানায় ৬২ শতাংশ ( পশ্চিমবঙ্গ ৮৪ শতাংশ, কেরালা ৮২ শতাংশ) শিশুকে প্রতিষেধক দেওয়া হযেছে। শিশুদের বামনাকৃতি বা খর্বাকৃতি হওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই দেখা যায়; , বিহার, ঝাড়খন্ড, গুজরাট, রাজস্তান, মহারাষ্ট্র এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পিছিয়ে আছে, এবং কেরালা এক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে।
নিতি আয়োগের সাসটেইনেবেল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেঁকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সংক্রান্ত সূচকের (২০১৯-২০) নিরিখে এনডিএ শাসিত বহু রাজ্যের অবস্থান নীচের দিকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিরিখে গোয়া ২৮ তম, ত্রিপুরা ২৬তম, উত্তর প্রদেশ ২৫ তম, হরিয়ানা ২৩ তম, গুজরাট ২১তম। উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের সূচকের নিরিখে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৫তম, উত্তর প্রদেশ ২৩ তম, হরিয়ানা ১৮তম, ত্রিপুরা ১৫তম, মধ্যপ্রদেশ ১৫তম, গুজরাট ৯ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৩তম, কেরালা ১ম)। দারিদ্র নিরসনের নিরিখে ঝাড়খন্ড ২৮তম, বিহার ২৭তম, উত্তর প্রদেশ ২৪ তম, মধ্যপ্রদেশ ২৪তম, হরিয়ানা ১৯তম, গুজরাট ১৯তম, আসাম ১৭ তম, ত্রিপুরা ২য়(পশ্চিমবঙ্গ ১৪তম, কেরালা ৭ম, তামিলনাড়ু ১ম)। সুস্বাস্থ্য সুস্থ জীবনযাপনের নিরিখে উত্তর প্রদেশ ২৭ তম, বিহার ২৫তম, মধ্যপ্রদেশ ২৩তম, ঝাড়খন্ড ১৯তম, হরিয়ানা ১১তম, গুজরাট ৮ম, (পশ্চিমবঙ্গ ৭ম, কেরালা ১ম)।উচ্চমানের শিক্ষাপ্রদানে অগ্রগতির ভিত্তিতে বিহার ২৮তম, ঝাড়খন্ড ২৬তম, আসাম ২৫ তম, গুজরাট ২৩তম, উত্তর প্রদেশ ২২তম, মধ্যপ্রদেশ ১৭তম (পশ্চিমবঙ্গ ২১তম, কেরালা ১ম)।লিঙ্গসাম্যের অগ্রগতির সূচকের ভিত্তিতে আসাম ২৫তম, ঝাড়খন্ড ২২তম, গুরাট ১৯তম, বিহার ১২তম, উত্তর প্রদেশ ১০ম, মধ্যপ্রদেশ ৮ম (পশ্চিমবঙ্গ ১৫তম, কেরালা ২য়)
‘ডাবল ইঞ্জিনে’ চলা সরকারগুলির শাসনাধীন রাজ্য ও শহরগুলির অপরাধের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে অপরাধীরা সেখানে দুধেভাতে আছে।২০১৯ সালে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা সবথেকে বেশী যোগীর উত্তরপ্রদেশে (৩,৫৩,১৩১), প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় খুনের হার সর্বোচ্চঝাড়খন্ডে (৪.৩), দ্বিতীয় স্থানে হরিয়ানা (৩.৯), যুগ্ম তৃতীয় ত্রিপুরা (৩.৬) ও আসাম (৩.৬)। ধর্ষণের সংখ্যায় সবার উপরে রাজস্থান (৫৯৯৭), দ্বিতীয় উত্তরপ্রদেশ (৩০৬৫), তৃতীয় মধ্যপ্রদেশ (২৪৮৫) যেখানে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে (১০৬৯), তবে সেটাও যথেষ্ট খারাপ।
অসত্য ভাষণ ভারতীয় জনতা পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বের, এমনকি উচ্চতম নেতৃত্বের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এমনটা নয় যে, এনডিএ বা বিজেপি শাসিত সমস্ত রাজ্যগুলিই উন্নতির সমস্ত সূচকের নিরিখে পিছিয়ে আছে, এমনটাও নয যে সমস্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে সেগুলি অনন্য হয়ে উঠেছে। বরং সমস্ত সামাজিক উন্নয়নের সূচকের নিরিখেই কেরালা সামনের সারিতে আছে, সেদিক দিয়ে কেরালা অনন্য, তাই উদাহরণ দিতে হলে সেই রাজ্যকেই সামনে আনা প্রয়োজন, যেখানে না ডাবল ইঞ্জিনের সরকার আছে না বিজেপি কোনদিন শাসন করেছে।
৫ বছর আগে আসাম নির্বাচনের সময়েও ‘সোনার আসাম” তৈরীর সঙ্কল্প নিয়েছিল বিজেপি, সেই হাতছানিতে সাড়া দিয়ে আসামের মানুস বিজেপিকে জিতিয়েছিল। বুঝতে পরেছেন তাঁরা সে ছিল বিজেপির সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন ফেরি করে নির্বাচন জেতার কল। এখন বেরোতে চাইলেও আস্টেপিস্টে বেঁধে রাখতে মরিয়া বিজেপি। ডাবল ইঞ্জিন আসলে দু’দিক দিয়ে চাপ দিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠানোর প্রকল্প।