পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

স্প্যানিশ আর্মাডায় ধ্বংস কোস্টারিকা, উতরে গেল পর্তুগিজ নৌবহরও

  • 25 November, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 719 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস মজুমদার
স্পেন এবং ব্রাজিল, এই বিশ্বকাপে যে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল যে দেখাবে, তার উদাহরণ কিন্তু রেখে গেল প্রথম ম্যাচেই। এই খেলাটি যে একটি দলগত খেলা এবং কোনও একজন মেসি বা নেইমার নির্ভর নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো।

 

ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে খ্রীষ্টিয় চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে আটলান্টিক তোলপাড় করে ফেলেছিল স্পেনীয় আর পর্তুগিজ নাবিকরা। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সপ্তদশ শতকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল স্পেনীয় জলদস্যুরা। সেই মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা যা ইউরোপীয় সভ্য জগতের কাছে আত্মপ্রকাশ পেয়েছিল পঞ্চদশ শতকে কলম্বাসের নেতৃত্বধীন স্পেনীয় অভিযানের দ্বারা সেই কোস্টারিকার ফুটবল দলকে নিয়ে কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে রীতিমতো ছেলেখেলা করল স্পেনীয় ফুটবলাররা। এর আগে ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় দেল বস্কির তিকিতাকা ফুটবলে স্পেন বিশ্বজয় করেছিল। ২০০৮ আর ২০১২ সালে হয়েছিল ইউরো চ্যাম্পিয়ন। তিকিতাকাতে বলের নিয়ন্ত্রণ যত বেশী সম্ভব জাভি, দাভিদ ভিয়া, ইনিয়েস্তা, জেরার্ড পি কে-রা রাখতেন নিজেদের পায়ে। তাই বল নিয়ন্ত্রণ স্পেনের খেলোয়াড়দের কাছে সিংহভাগ সময় থাকলেও গোল সংখ্যা খুব বেশী হত না। কিন্তু বর্তমান স্পেনীয় কোচ ও প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার লুইস এনরিকের পরিকল্পিত ফুটবল ছক আরও ভয়ঙ্কর। একে বোধহয় ‘সুপার তিকিতাকা’ বললে অত্যুক্তি হবে না। বল নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে গোলে শট নেওয়া আর ছন্দবদ্ধ আক্রমণের ঝড় তোলা এই বর্তমান স্পেনীয় দলের ফুটবল রীতির বৈশিষ্ট। এই রীতিতে খেলে কার্যত স্পেনের খেলোয়াড়রা দলবদ্ধভাবে কোস্টারিকার খেলোয়াড়দের বল ছুঁতেই দিলেন না। গটা ম্যাচে কোস্টারিকা একবারের জন্যও স্পেনের গোলে শট নিতে পারেনি। ম্যাচ স্পেন তাদের বিশ্বকাপের মঞ্চে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৭-০ গোলে জিতলেও অনায়াসে ১০-১২ গোল হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। অন্যদিকে কোস্টারিকার এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। ১৯৯০, ২০০২, ২০১৪ এবং ২০১৮-র বিশ্বকাপের মূলপর্বে ইতিপূর্বে তারা খেলেছে। ২০১৪-র ব্রাজিল বিশ্বকাপ ছিল তাদের কাছে স্বপ্নের দৌড়। কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ পররযন্ত নেদারল্যান্ডসের কাছে টাইব্রেকারে পরাজিত হয়ে তাদের সেযাত্রা সমাপ্ত হয়। ১৯৯০-এও ইতালি বিশ্বকাপে গ্রুপের গন্ডি পেরিয়েছিল তারা। এর আগে বিশ্বকাপে কোস্টারিকার সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স ছিল এহসিয়ার মাটিতেই ২০০২ সালে যখন তারা গ্রুপের খেলায় ব্রাজিলের কাছে ২-৫ গোলে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই হারেও ছিল কিছু লড়াই। কিন্তু কাতারে স্পেনের সামনে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে আত্মসমর্পন করল মধ্য আমেরিকার এই দেশ। এইরকম একছত্র ফুটবল দমন পীড়ন এর আগে বিশ্বকাপের ইতিহাসে খুব কমই পরিলক্ষিত হয়েছে, তাই স্প্যানিশ নৌবহর আর্মাদার মতই যে এবারের স্পেন দল বিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহ করবে তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। আলাদা করে যার কথা বলতে হয় সে হল স্পেনের এই তরুণ ব্রিগেডের অষ্টাদশ বর্ষীয় কিশোর খেলোয়াড় গাভির কথা। ফেরান টোরেস দুটি গোল করেছেন কিন্তু নিউক্লিয়াসের মত গোটা দলকে খেলিয়েছেন গাভি। তার ওপর নিজে একটা অত্যন্ত দর্শনীয় গোলও করেছেন।

অন্যদিকে লাল-হলুদ জার্সির স্পেনের প্রতিবেশী দেশ সবুজ-মেরুন জার্সিধারী পর্তুগালও জয় পেল আফ্রিকান সিংহ ঘানার বিরুদ্ধে। সিআর সেভেনের এটা মেসির মতই পঞ্চম বিশ্বকাপ। এদিন ঘানার বিরুদ্ধে গোল করে সব বিশ্বকাপেই গোল করার রেকর্ড করলেন তিনি। মাঝমাঠে ভরসা যোগালেন দলকে। দলকে এগিয়ে দিলেন পেনাল্টি থেকে গোল করেও। তবু বিধ্বংসী হতে পারল না পর্তুগাল। প্রথমার্ধে ছন্দবদ্ধ ফুটবল খেলেও বারেবারে আক্রমণ শানিয়েও গোল পায়নি পর্তুগাল। স্পেন বিশ্বকাপ ২০১০ সালে জিতলেও ইউসেবিও, লুই ফিগো, ডেকো, রোনাল্ডোর দেশের ফুটবল দলের হাতে এখনও ওঠেনি ফিফা বিশ্বকাপ। নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপে সেই খরা কাটাতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাবেন সিআর সেভেন সেটাই স্বাভাবিক। ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড থেকে বিতাড়িত হওয়ার বিতর্ককে পিছনে ফেলে দ্বিতীয়ার্ধে জ্বলে উঠলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কিন্তু পেনাল্টি থেকে রোনাল্ডোর গোলের পরেই তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ শুরু করে ঘানার আক্রমণভাগ ও মাঝমাঠ। বিশেষভাবে নজর কাড়লেন ঘানার মহম্মদ কুদুস আর অধিনায়ক আন্দ্রে আইয়ু। এই দুজনের যুগলবন্দীতেই ঘানা ম্যাচের ৭৩ মিনিটে পেয়ে যায় তাদের সমতা ফেরানোর গোল। এখনও পর্যন্ত কাতার বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশগ্রহণকারী আফ্রিকান দলগুলির মধ্যে ঘানাই প্রথম গোল করতে পারল (মরক্কো, তিউনিশিয়া, ক্যামেরুন নিজেদের প্রথম ম্যাচে গোল পায়নি)। কিন্তু তার পরেই ঘানার কোচ অদ্ভুত সিদ্ধান্তে তুলে নিলেন মাঠে ঘানার সবচেয়ে সপ্রতিভ দুই ফুটবলার আইয়ু এবং কুদুসকে আর তারপরেই খেলার রাশ নিজেদের পায়ে নিয়ে নেয় পর্তুগাল। একের পর এক আক্রমণ আছড়ে পড়ে ঘানার রক্ষণভাগে। বেসামাল ঘানার রক্ষণভাগকে হজম করতে হয় পরপর দুই গোল। জোয়াও ফেলিক্স আর রাফায়েল লিয়াও গোল করে এগিয়ে দেন পর্তুগালকে। কিন্তু রোনাল্ডো মাঠয় ছাড়তেই নড়বড় করতে শুরু করে পর্তুগাল। আক্রমণে চাপ বাড়িয়ে গোল পেয়ে যায় ঘানা। গোল করেন ওসমান বুকারি। বাকি সময় আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে চললেও গোলসংখ্যার কোনও পরিবর্তন হয়নি। ৩-২ গোলে জিতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পর্তুগালের প্রচুর চিন্তা রয়েছে বিশেষ করে তাদের রক্ষণভাগ বেশ অগোছালো।

আরেক এশিয় দল এবং ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশীবার টানা দশবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশগ্রহণকারী এবং দেশের মাটিতে ২০০২ সালে সেমি-ফাইনালে পৌছানো একমাত্র এশিয় ফুটবল দল দক্ষিণ কোরিয়া এদিন গোলশূন্য ফলাফলে আটকে দিল প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক বিজেতা ও দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (১৯৩০ এবং ১৯৫০) উরুগুয়েকে। সুয়ারেজ, কাভানি এখন প্রায় অতীত, তাদের উভয়েরই ধার ও ভার উভয়েই কমেছে। উরুগুয়ে দলকে দেখে খুব একটা চমকপ্রদ বা আশাপ্রদ মনে হচ্ছে না। তবুও লাতিন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবল শক্তি উরুগুয়েকে আটকে দেওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলারদের কাছে বিশেষ কৃতিত্বের বইকি। যদিও খেলায় সিংহভাগ আক্রমাণ ছিল উরুগুয়ের এবং উভয় অর্ধে একবার করে বল বারে ও পোস্টে লেগে ফিরে না আসলে এই খেলার ফল নিশ্চিতভাবেই উরুগুয়ের পক্ষেই যেত। অবশ্য একটি খুব সহজ সুযোগ দক্ষিণ কোরিয়াও নষ্ট করেছে। তবু দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে উরুগুয়ের প্রথম ম্যাচেই আটকে যাওয়া এশিয় ফুটবলের ক্ষেত্রে বিশেষ তাতপর্যপূর্ণ বইকি। এই পারফরম্যান্স যদি পরবর্তী ম্যাচগুলোতেও সৌদি আরব, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়ার মত দলগুলি ধরে রাখতে পারে তাহলে নিঃসন্দেহে এশিয় ফুটবলে নতুন বিপ্লব আসতেই পারে।    

জয় দিয়ে কাতার বিশ্বকাপে তাদের অভিযান শুরু করল ব্রাজিলও। যদিও দীর্ঘকায় সার্বিয়ান রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ব্রাজিলের স্কিলফুল খেলোয়াড়দের যুজতে হল ভালোই। নেইমার কিন্তু সেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেন না। বরং ব্রাজিলের ঝলমলে হলুদ জার্সিতে যারা সপ্রতিভভাবে জ্বলে উঠলেন তারা হলেন রিচারলিসন এবং ভিনিসিয়াস জুনিয়র। যদিও ব্রাজিলের প্রথম গোলের ক্ষেত্রে নেইমারের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। নেইমারের শট সার্বিয়ার গোলরক্ষক ফিরিয়ে দিলে ফিরতি বলকে জালে জড়িয়ে দেন সুযোগসন্ধানী জার্সি নম্বর নাইন ব্রাজিলের রিচারলিসন। তবে তাঁর ও ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটি এককথায় অসাধারণ।  একেই বোধহয় ব্রাজিলসুলভ গোল বলা যায়। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে করা তরুণ পেলের এক্রোবাটিক গোলকে মনে পড়িয়ে দিল এই গোল। অসামান্য তিনটাচে গোল করলেন রিচারলিসন। সার্বিয়ায়ে পেনাল্টি বক্সের দিকে মুখ করে বল রিসিভ করে দ্বিতীয় টাচে জায়গামত বল নিয়ে চকিতে শূন্যে শরীরকে বেঁকিয়ে অনবদ্য নিখঁত ভলিতে বল জালে জড়িয়ে দিলেন রিচারলিসন। এটি এমন একটি গোল যা বহুকাল দৃশ্যত মননে অমলিন থেকে যাবে। জোগো বোনিতোর ঝলক কিন্তু ঝলসে উঠল সেই মুহুর্তে। ব্রাজিল যে পুরোপুরি নেইমার নির্ভর নয়, হলুদ জার্সিতে যে আরও মণিমাণিক্য খচিত আছে তার আভাস কিন্তু প্রথম ম্যাচেই রেখে গেলেন কোপা রানার্স তিতের ছেলেরা।   

0 Comments

Post Comment