পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিজেপির শাসনে কালো টাকাও নেই, কালো টাকার বিদেশ গমনও নেই

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 207 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
রাজপাটে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসার পরে কেনই বা দুধেল গাইদের বিদেশে গচ্ছিত টাকা নিয়ে টানাটানি করা হবে? কখনো কখনো তাঁরা দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবেন, সেই বন্দোবস্ত রাখতে হবে বৈকি। তাঁরা তো নির্বাচনী তহবিলে নামে বেনামে টাকা দেন, নির্বাচনী বন্ডও কিনেছেন। তাই এখন কালো টাকাও নেই, কালো টাকার বিদেশ গমনও নেই। কিছুদিন পরে কি আমাদের এটাও জানানো হবে, যে ভারতে বিদেশী বলেই কেউ নেই, কিংবা এই SIR এর পরে যাঁদের বিদেশী বলে বলা হচ্ছে, সেটাও অত্যন্ত নগণ্য?

কালো টাকা আর কালো নেই। সব চূণকাম করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের আগে যা কালো ছিল তাহা ফর্সা হয়ে গেছে, নন-বায়োলজিক্যাল নরেন্দ্র অবতারের অপার কৃপায়। প্রবাসে আর কোনো কালো টাকা গচ্ছিত নেই, অন্তত রাজন্যবর নরেন্দ্র মোদির দরবারি হিসাবরক্ষকের নিকটে প্রবাসে কালো টাকা সংক্রান্ত আর কোনো তথ্য নেই। 

যদিচ পরম সনাতনি ও হিন্দু ধর্মের রক্ষক ভারতীয় জনতা পার্টি তাহাদের ২০১৪ সনের নির্বাচনী ইশতাহারে সারা দেশের সম্মুখে ঘোষণা করেছিল যে, ““দুর্নীতির সুযোগ কমিয়ে আমরা কালো টাকা সৃষ্টির পরিমাণ হ্রাস নিশ্চিত করব। বিদেশি ব্যাংক এবং অফশোর অ্যাকাউন্টে লুকিয়ে থাকা কালো টাকার হদিস বের করে তা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে বিজেপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই উদ্দেশ্যে আমরা একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করব এবং বিদ্যমান আইনে সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করতে বলব। বিদেশে থাকা যে কালো টাকা ভারতেরই, তা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু করা হবে। আমরা কালো টাকা সম্পর্কিত তথ্য আদান–প্রদানে সহায়তার জন্য বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হব।”

তথাপি, সাড়ে এগারো বছর রাজ করার পরে, গত ১ ডিসেম্বর সংসদে মোদি সরকার, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মালা রায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে যে, আয়কর আইনে বা কালো টাকা (লুকোনো বিদেশি আয় ও সম্পদ) এবং কর আরোপ আইন, ২০১৫-য় কালো টাকা বলে কোনো বিষয় নেই। ওই আইনে যে ৩ মাসের স্বেচ্ছা ঘোষণার ছাড় দেওয়া হয়েছিল তাতে ৪,১৬৪ কোটি টাকার বিদেশি সম্পদ ঘোষিত হয়েছে, ২,৪৭৬ কোটি টাকার কর ও জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ৩০ জুন, ২০২৫ পর্যন্ত ১,০৮৭টি কর এ্যাসেসমেন্ট সম্পূর্ণ হয়েছে, ৪০,৫৬৪ কোটি টাকার কর ও জরিমানা চাওয়া হয়েছে, মাত্র ৩৩৯ কোটি টাকার কর ও জরিমানা আদায় হয়েছে। গত দশ বছরে দেশ থেকে কত টাকার লুকোনো সম্পদ বিদেশে গিয়েছে বা বর্তমানে কত লুকোনো সম্পদ বিদেশে গচ্ছিত আছে তার কোনো হিসেব বা অনুমান সরকারের কাছে নেই

উপরের প্রথম ও তৃতীয় অনুচ্ছেদ দুটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির তুলনা করলেই বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি, এনডিএ এবং মোদি সরকার কত দ্রুত ভোল পাল্টাতে পারে। যেহেতু পোষা প্রচার মাধ্যম প্রভুর কথায় ওঠাবসা করে তাই ওই গিরগিটির মত রঙ পাল্টানো মোদিজি ও তাঁর সরকার অসংখ্যবার নিজেদের অবস্থান বদল করলেও তা তেমন সামনে আসে না।  আরেকটু খতিয়ে দেখলে পরিস্কার হয়ে যায় যে, বিজেপি কালো টাকা বিষয়ে নিজেদের কথা নিজেরাই বারবার গিলে ফেলেছে। নির্বাচনে জেতার স্বার্থে বহু বিষয়ের মত কালো টাকাকেও ব্যবহার করেছে আর ক্ষমতায় এসেও তাকে কিছুদিন ব্যবহার করার পরে এখন তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছে।

২০১১ সালের জানুযারি  মাসের ৩১ তারিখে বিজেপির তৎকালিন উপ-সভাপতি ও সাংসদ শান্তা কুমার এক প্রেস বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে সুইস ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখা কালো টাকা উদ্ধারে ভারত সরকার মোটেই গুরুত্ব দেয় না । তিনি বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাদের কষ্টার্জিত টাকা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, অসাধু ব্যবসায়ী ও আমলারা লুট করে নিয়েছে, তাদের জানার অধিকার আছে যে কেন ইউপিএ সরকার এই অর্থ ফেরত আনতে অযথা দেরি করছে।

শ্রী শান্তা কুমার বলেন যে সুইস সরকারের কালো টাকার বিষয়ে অবস্থান নিয়ে সুইস অর্থসচিবের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ভারত সরকার দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (DTAA)-এর অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি বিলম্বিত করছে। তিনি বলেন, DTAA গত বছর আগস্ট মাসে স্বাক্ষরিত হলেও এতদিন ভারত সরকার তাকে অনুমোদন করেনি— যার কারণ কেবল তারাই জানে। এই তথ্য দাভোসে সুইস অর্থসচিব প্রকাশ করেছেন।

শ্রী শান্তা কুমার বলেন, সরকারকে বারবার DTAA এবং জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন (UN Convention Against Corruption) অনুমোদনের জন্য বলা হয়েছে, যা কর ফাঁকিদাতা ও কালো টাকা সংক্রান্ত তথ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি আইনি উপায়।

শ্রী শান্তা কুমার বলেন, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনই করস্বর্গ দেশগুলো থেকে অর্থ ফেরত আনার একমাত্র আন্তর্জাতিক আইনি উপকরণ। এই চুক্তি ১৪৮টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এবং ১২৬টি দেশ অনুমোদন করেছে। অনুমোদনের পর কিছু দেশ পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। সুইজারল্যান্ডও এই চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে। ভারত এই চুক্তি অনুমোদন করলেই সুইস সরকার কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।

শ্রী শান্তা কুমার গত বছর রাজ্যসভায় এই বিষয়টি উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন কেন সরকার এই কনভেনশন অনুমোদন করছে না। তিনি ২০ অক্টোবর ২০১০ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এই বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনার সময় সুইস প্রতিনিধি মি. মিথাই বাখমান স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে তাদের দেশ ওই অর্থ ফেরত দিতে আগ্রহী। ভারতে ফিরে এসে শ্রী শান্তা কুমার প্রধানমন্ত্রীকে আবার চিঠি লিখে সুইস প্রতিনিধির বিবৃতির সরকারি অনুলিপি পাঠিয়ে চুক্তি অনুমোদনের অনুরোধ জানান। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তার কোনো জবাব দেননি।

শ্রী শান্তা কুমার বলেন, এখন পরিষ্কার যে বর্তমান সরকার নামগুলো প্রকাশ করবে না, কারণ নাম প্রকাশ পেলে সরকার একদিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। মনে হয়, শাসক দলের কিছু রাজনীতিবিদ এই বৃহত্তম লুটের সঙ্গে জড়িত, এবং এখনই সময় দেশকে একজোট হয়ে ইতিহাসের এই লুট— যা আমাদের দেশের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার প্রধান কারণ— বন্ধ করার।

২৩ এপ্রিল, ২০১৪, লোকসভা নির্বাচন চলাকালিন বিজেপির তৎকালিন জাতীয় মুখপাত্র শ্রীমতী নির্মলা সীতারামনের জারি করা প্রেস বিবৃতিটি বিবেচনা করা যাক:

“ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার “গুরুতর আদালত অবমাননা” করেছে। ২০১১ সালের ৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল, ভারত সরকার তিন বছরে তা মানতে ব্যর্থ হয়েছে।

তখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে লিশটেনস্টাইনে থাকা বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলির বিবরণ প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিল। আদালত পরিষ্কার ভাষায় বলেছিল, “অবিলম্বে প্রকাশ করুন”। কিন্তু তিন বছর পরেও সরকার এখনো প্রকাশ করেনি। সরকার সুবিধামতো তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত বিশেষ তদন্ত টিমের (SIT) জন্য অপেক্ষা করার পথ বেছে নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত সময় দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আরও মন্তব্য করেছে যে সরকারি সচিবরা তাদের নির্দেশ “ঠান্ডা ঘরে” তুলে রেখেছে। কেন্দ্র ৪ জুলাই ২০১১-এর রায় পুনর্বিবেচনার যে আবেদন করেছিল আদালত তা প্রত্যাখ্যান করেছে। রেকর্ডের জন্য উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট শুধু পুনর্বিবেচনার আবেদন প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং ব্ল্যাক মানি এবং হাসান আলির কর ফাঁকির মামলার তদন্ত নিজেই হাতে নিয়ে একটি বহু-সংস্থা বিশিষ্ট বিশেষ তদন্ত টিম (SIT) গঠন করেছে।

ভারত সরকার দাবি করেছিল যে সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত বেশিরভাগ নথিই জাল, যদিও সেগুলো হাসান আলি খানের কথিত সহযোগীর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

ভারত ও জার্মানির মধ্যে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (DTAA) অনুযায়ী ভারত সরকার লিশটেনস্টাইনে অ্যাকাউন্টধারী ভারতীয়দের নাম প্রকাশে অপারগ—সরকারের এ যুক্তিও সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে।

রেকর্ডের জন্য আরও বলা জরুরি, জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশন ১৪ ডিসেম্বর ২০০৫ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। কর ফাঁকি রোধে তথ্য বিনিময় তারপরে সম্ভব হয়েছে, এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার এই বিষয়ে শুধু ভারতের জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। দীর্ঘ বিলম্ব ও চাপের পর ইউপিএ সরকার এই কনভেনশন অনুমোদন করেছে ২০১১ সালের মে মাসে।

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে ব্ল্যাক মানি ফিরিয়ে আনবেন। গুরুত্বপূর্ণভাবে, সুইস সরকার “রিটার্ন অব ইলিসিট অ্যাসেটস অ্যাক্ট, ২০১১” পাস করেছিল, যা তাদের সরকারকে আমানতকারীদের উৎস দেশে কালো টাকা ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা দেয়। ফ্রান্স ও জার্মানি এই আইন ব্যবহার করে তাদের অর্থ ফিরিয়ে নিয়েছে।

২০১২ সালের মে মাসে ভারত সরকার কালো টাকার বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, যেখানে কার্যত কিছুই বলা ছিল না। শুধু সুইস ব্যাংকে ভারতের কালো টাকার পরিমাণ সম্পর্কে অনুমান করা হয়েছিল।

বিজেপি বেশ কয়েকটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়েছিল; সকল সাংসদকে বিদেশে থাকা অ্যাকাউন্টের শপথনামা জমা দিতে বাধ্য করেছিল। বিজেপি একটি  টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল, যা কালো টাকা চিহ্নিত করে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিল

এই বিষয়ে সরকার সম্পূর্ণভাবে মুখোশহীন হয়ে গেছে। কালো টাকা ফেরত আনা তো দূরের কথা, দেশে কর ফাঁকিদাতাদের বিরুদ্ধেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেবে না।

বিজেপি দেশের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এবং প্রত্যেক কংগ্রেস সরকারের সময় দুর্নীতি, কালো টাকা এবং মুদ্রাস্ফীতির যোগসূত্রটি বোঝার আহ্বান জানাচ্ছে। কংগ্রেসের শাসনামলে কালো টাকা ফুলে-ফেঁপে ওঠা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়।“

২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর নেটওয়ার্ক ১৮ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন:

“আমরা দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানো কালো টাকা রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি পরিবর্তন করেছি। যারা এখনো মূলধারায় আসতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। আমি প্রকাশ্যে বলেছি যে ৩০শে সেপ্টেম্বরই তোমাদের শেষ তারিখ। তোমরা যেকোনো উদ্দেশ্যে ভুল করে থাকতে পার — ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত — এটি তোমাদের সুযোগ। মূলধারায় ফিরে আসো। মানুষের যেন রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম হয়, সেই ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা আমার আছে। সবাইকে এটি গ্রহণ করতে হবে। এবং ৩০ তারিখের পর আমি কঠোর সিদ্ধান্ত নিলে কেউ যেন আমাকে দোষ না দেয়। এই টাকা দেশের গরিবদের। এটাকে লুট করার অধিকার কারও নেই। এটি আমার অঙ্গীকার। আমি সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছি এবং এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।“

এর ৬৭ দিন পরে তিনি ‘কঠোর’ সিদ্ধান্তটি নেন এবং কালো টাকা ধ্বংসের লক্ষ্যে পাঁচশ ও হাজার টাকার নোট বাতিল করেন। ৮ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে তিনি রাত ৮ টার সময় যে ভাষণ দিয়ে নোট বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, সেই বক্তৃতায় ১৭ বার “কালো টাকা” শব্দবন্ধটি উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু কী যাদুই না দেখলাম,  ১ ডিসেম্বর সংসদে জানানো হল, আয় কর আইনে বা কালো টাকা (লুকোনো বিদেশি আয় ও সম্পদ) এবং কর আরোপ আইন, ২০১৫-য় কালো টাকা বলে কোনো বিষয় নেই। অর্থাৎ আইনে যে ধারণাটিই স়ংজ্ঞায়িত নয় তার উপর ভর করে, সেই শব্দবন্ধ বারবার ব্যবহার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, না তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় নয়, প্রশাসনিক ঘোষণায়। কী বিচিত্র এই দেশ, কী বিচিত্র এই প্রধানমন্ত্রী!

যদিও, ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঘোষিত নোটবন্দি ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাজারে ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোটের পরিমাণ ছিল মোট ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা—যেগুলিকে  বাতিল করা হয়। এই টাকার প্রায় সবটাই, মাত্র ১৬,০০০ কোটি বাদে, ব্যাংকে ফিরে আসে। ওদিকে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক নোটবন্দি ও পরবর্তী নতুন নোট মুদ্রণের জন্য ২১,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করে। ফলে, ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়েছিল। নোট বাতিল থেকে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হয়েছিল।  

বিজেপি বিভিন্ন সময়ে দুধ দোয়ানোর জন্য বিবিধ গাই স্টকে রেখেছে। ২০১১ সাল থেকে দুর্নীতি ও কালো টাকার গাইদের থেকে যথেষ্ট দুধ দোয়ানো হয়েছে, এখন সেই গরু দুগ্ধবতী হওয়ার সময়কাল পেরিয়েছে, তাই তার আর প্রয়োজন নেই, তাকে গোপনে হত্যা করা হয়েছে (কারণ এ দেশের রাজধানীতে গাভীহত্যা বেআইনি)

আগেই বলা হয়েছে যে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত বিজেপি কালো টাকা, বিশেষত বিদেশি ব্যাঙ্কে কালো টাকা গচ্ছিত থাকার বিষয়ে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারকে ঘিরে ধরতে প্রবল সক্রিয় ছিল। একদা বিজেপির সাংসদ ও আইনমন্ত্রী প্রয়াত রাম জেঠমালনি ও আরো কয়েজনের করা রিট দরখাস্তের উপরে দাঁড়িয়েই সুপ্রিম কোর্টে বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ভারতীয়দের কালাো টাকা সংক্রান্ত কেসের শুনানি শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট সেই সংক্রান্ত বিশেষ তদন্ত দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দেয়। সেই সিট এখনো বজায় রয়েছে। তবে তাদের রিপোর্ট মুখবন্ধ খামে জমা পড়ে। ফলে, কেউই কিচ্ছু জানে না।

২০১১ সালের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলে কেন লিচটেনস্টাইন ব্যাঙ্কে কালো টাকা রাখা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। আদালত বলে যে সরকারকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ—যা অবৈধভাবে বিদেশি ব্যাঙ্কে জমা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়—সম্পর্কিত সব তথ্য জনগণের সামনে আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা উচিত।

২০১১ সালের ৪ জুলাই, সুপ্রিম কোর্ট প্রাক্তন বিচারপতি বি.পি. জীবনেরেড্ডির নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্ত দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দেয়, যা কালো টাকা সংক্রান্ত তদন্তের ওপর নজরদারি ও পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবে। এই সংস্থা সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট দেবে এবং অন্য কোনো সংস্থা এতে জড়িত থাকবে না। দুই বিচারপতির বেঞ্চ মন্তব্য করে যে কালো টাকা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা সরকারের দুর্বলতা ও নমনীয়তার ইঙ্গিত বহন করে।

বিদেশে নাগরিকদের এবং অন্যান্য আইনি সত্তার অঘোষিত অর্থের বিষয়টি জনগণের কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিমাণ রাষ্ট্রের দুর্বলতার সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে—অপরাধ দমন ও কর আদায় উভয় ক্ষেত্রেই। এই ধরনের অর্থের পরিমাণ ও এর উৎপত্তি ও পাচারের সংখ্যা রাষ্ট্রের দুর্বলতার মাত্রা প্রকাশ করে।”
 বিচারপতি বি. সুদর্শন রেড্ডি এবং বিচারপতি এস.এস. নিজ্জর, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ভারত সরকার (ইউপিএ) জার্মান কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লিচটেনস্টাইনের ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট থাকা ২৬ জন ভারতীয়ের নাম সুপ্রিম কোর্টে জমা দেয়। ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর, সরকার বিদেশি ব্যাঙ্কে কালো টাকার অ্যাকাউন্ট থাকা তিনজনের নাম হলফনামার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেয়।কিন্তু পরের দিনই সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে নির্দেশ দেয় যে তাদের কাছে জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত সব নাম প্রকাশ করতে হবে। আদালত আরও জানায় কেন্দ্র তদন্তে জড়াবে না— শুধু নামগুলো আদালতে জমা দেবে, আদালতই পরবর্তী তদন্তের নির্দেশ দেবে। ওই সময়ে সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগি সুপ্রিম কোর্টে বলেন যে, সমস্ত নাম প্রকাশে অসুবিধে আছে। তাতে ব্যক্তি বিশেষের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে

পরে ২৭ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দাখিল করা হলফনামার ব্যখ্যা প্রকাশিত হয়। বলা হয় যে জার্মানি ও ফ্রান্স সরকার থেকে প্রাপ্ত তথ্যসহ সমস্ত কেস ও সরকারের পদক্ষেপের বিবরণসহ সম্পূর্ণ তালিকা ২৭ জুন কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর পর্ষদ (CBDT) জমা দিয়েছিল। এও বলা হয় যে সিবিডিটি কর্মকর্তারা সিটকে মামলার অগ্রগতি, তথ্যের উৎস, সুইস কর্তৃপক্ষের তথ্য না দেওয়া, সরকারের সীমাবদ্ধতা এবং অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়ার বিকল্প উপায় সম্পর্কেও জ্ঞাত করেছিল। অর্থাৎ, সামগ্রিকে মোদি সরকার আদালতে সব নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে

২০১৫ সালের ১২ মে, রাম জেঠমালানি অভিযোগ করেন যে মোদি সরকার নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিলেও কালো টাকা ফেরত আনতে ব্যর্থ হয়েছে।আন্তর্জাতিক কর আইনজীবী আশীষ গোয়েলও মত প্রকাশ করেন যে মোদি সরকার বিদেশি ব্যাঙ্কে জমা কালো টাকা ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।

২০১৫ সালের ২ নভেম্বর, এচএসবিসির হুইসলব্লোয়ার হার্ভে ফালসিয়ানি জানান যে তিনি ভারতীয় তদন্ত সংস্থাগুলোর সাথে কালো টাকা তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তবে তার “সুরক্ষা” প্রয়োজন। হার্ভে ফালসিয়ানি এনডিটিভিকে বলেন যে তদন্তকারীদের জন্য “হাজার গুণ বেশি তথ্য” উপলব্ধ রয়েছে এবং বহু ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া এখনও তাদের সামনে উন্মোচিত হওয়া বাকি। তিনি বলেন, “এটা সম্পূর্ণই ভারতীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে। তারা চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।” প্রশান্তভূষণ ও যোগেন্দ্র যাদব ২১ আগস্ট ২০১৫ তারিখে ফালসিয়ানির লেখা একটি চিঠি সিটের প্রধান বিচারপতি (অব.) এম. বি. শাহ-এর কাছে জমা দেন। ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর প্রশান্ত ভূষণ ও যোগেন্দ্র যাদব আয়োজিতএকটি প্রেস কনফারেন্সে ফালসিয়ানি বলেন যে ভারত বিদেশি ব্যাঙ্কে অবৈধভাবে কালো টাকা লুকিয়ে রাখা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থাকা তথ্য ব্যবহার করেনি, এবং এখনও লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

ভারত সরকার বারবার আদালতে যুক্তি দেখিয়েছে যে তারা নাম প্রকাশ করতে পারে না। আরও বলা হয়েছে যে তথ্য প্রকাশ করলে ব্যক্তিদের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে। এই যুক্তিগুলি মূলত কিছু বিশেষ ব্যক্তির নাম প্রকাশ রোধ করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি নেতা ড. সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বলেছেন যে ডিটিএএ ভারতীয়দের বিদেশি ব্যাঙ্কে থাকা অ্যাকাউন্টের নাম প্রকাশ না করার বৈধ কারণ নয়। ডিটিএএ চুক্তি হল ঘোষিত সাদা আয়ের বিষয়ে— যাতে একটি দেশ বা অন্য দেশ কর আরোপ করতে পারে, কিন্তু দু’ জায়গায় কর না লাগে। কালো আয় তো দুই দেশেই ঘোষণা করা হয় না, তাই দ্বৈত কর আরোপ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এছাড়া, এই আয়ের তথ্য দুই দেশের কেউ-ই পায় না, ফলে আদান–প্রদানের বিষয়ও নেই। এ কারণেই আজ পর্যন্ত যেসব দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি হয়েছে, তাদের কেউই ভারতে কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি। সংক্ষেপে, DTAA সাদা আয়ের জন্য— কালো আয়ের জন্য নয়। তাই বলা যে নাম প্রকাশ করলে ভবিষ্যতে আমাদের তথ্য দেওয়া হবে না— তা বিভ্রান্তিকর।

এটা দেখা গিয়েছে যে, বিভিন্ন অজুহাতে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় সরকারই সিট এর কাজ বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছে। এখনো সিট বজায় রয়েছে, যদিও সরকারের সংসদে দেওয়া উত্তর অনুসারে কালো টাকা বলে কোনো বস্তুই নেই।

অবশ্য এখন এসবই অতীত হয়ে গিয়েছে। রাজপাটে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসার পরে কেনই বা দুধেল গাইদের বিদেশে গচ্ছিত টাকা নিয়ে টানাটানি করা হবে? কখনো কখনো তাঁরা দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবেন, সেই বন্দোবস্ত রাখতে হবে বৈকি। তাঁরা তো নির্বাচনী তহবিলে নামে বেনামে টাকা দেন, নির্বাচনী বন্ডও কিনেছেন। তাই এখন কালো টাকাও নেই, কালো টাকার বিদেশ গমনও নেই। 

 

0 Comments

Post Comment