পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চব্বিশে বিষ হটাও, বাঁচুক চৈতন্য

  • 25 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1243 view(s)
  • লিখেছেন : সুমিত দাস
"এবার ভোটে মহাপ্রভু, লালন, রবীন্দ্রনাথকে বাঁচানোর লড়াই" মনসুর ফকিরের এটাই আবেদন। তিনি আরো বলেন "আসন্ন ভোটে ভারতবর্ষ বাঁচাও" পারবো না আমরা মনসুর ফকিরের এই আবেদনে সাড়া দিতে?

কর্তাভজা সম্প্রদায়ের 'সরস্বতী' হলেন সতীমা। যাঁর নামে কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলা। বিশ্বাসীদের মতে গোরা মানে গৌরচাঁদ, মানে শ্রীচৈতন্যের অবতার সদ্যজাত আউলচাঁদকে শান্তিপুরের কাছে উলাগ্রামের পানের বরজে কুড়িয়ে পান। সালটা ১৬৯৪। এই আউলচাঁদের শিষ্য রাধাশরণ পালের দ্বিতীয় স্ত্রী সরস্বতীর সন্তান দুলালচাঁদ। দুলালের লাল, আর চাঁদ, মানে শশী। লাললশী। প্রারম্ভিক এই গল্পের ধরতাই দিয়েছিলেন মনসুরদা। ২০০৭ সালের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে লালশশীর গান গাইতে গাইতে মনসুর বললেন, 'শোনা যায়, লালশশীকে নাকি শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে ডাকা হয়েছিল। আর, দুলালচাঁদ, মানে লালশশী মরে ভূত হয়ে যাবার পর পৌঁছালো চিঠি!' গল্প, বিশ্বাস আর বাস্তবতার আবেশে গানটির কথা আর সুর ছিল - ভুবন ভোলানো। সে কালের বাংলার মাঠঘাট, গাঁ-গঞ্জ বা মোকামে ভাব ফিরি করা কোনও মাধুকরের উচ্চারণ! 'ভাইরে, মগ ফিরিঙ্গি ওলন্দাজ/ হিন্দু মুসলমান/ এক বিধাতায় গড়েছেন বস্তু/ তাই তো সব দেহ সমান।' এতকাল পার করে এসে আজো কি ভীষণ সমকালীন এই ম্লেচ্ছগান! মনসুর ফকির মঞ্চে মঞ্চে এই গান ধরেন। অবলীলায় লালন ফকির হয়ে আজো তাঁর পরিবেশনা ভবা পাগলায় মেশে। 'এখনো সেই বৃন্দাবনে, বাঁশি বাজে রে/ শ্যামের বাঁশি শুনে বনে বনে ময়ূর নাচে রে।' দোহারি হয়ে এ গান ক্রমেই হয়ে উঠবে নামসংকীর্তন। 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে...।' এ গান হিন্দুর? বৈষ্ণবের, লোকধর্মের? উপধর্মের? মুসলমানের? শাশ্বত বাংলার? অন্তজ বাংলার? গৌরচাঁদের? লালশশীর? মনসুরের? কার তবে?

বিশ্বভারতীর আয়োজনে পৌষমেলা বন্ধ হয়েছে। সে মেলায় বাউল আর ফকিরদের আলাদা থাকার জায়গা থাকতো। কে বা কারা বানাতেন এই বিভাজিত বিশ্রামাগার? রবীন্দ্রনাথ তো উল্টো পথের ছিলেন। তাহলে? ২০১৪ সালের পর, বাংলার বাউলদের মধ্যেও বিভাজন স্পষ্ট।  বাউল-ফকির সংঘ নামের একটি সংগঠন, - বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে চিন্তিত হলেও, ভারতের সংখ্যালঘু নিধন, দলিত নিধন, শিল্প-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ নিয়ে তারা তেমন চিন্তিত না। নানান আখড়ায় কান পাতলে শোনা যায়, কে আমিষ ছেড়ে নিরামিষ হলেন, বা কে নানা রঙের তালি দেওয়া বহুত্বের প্রতীক জোব্বা ছেড়ে গেরুয়া হলেন, তার গল্প।

না, মনসুর অন্যধাতুর। পরম্পরায় যোদ্ধা, কুষ্টিয়া-নদিয়ার সীমান্ত গ্রামে যারা গৌরাঙ্গ আর লালনে বিলীন হলেন, তাদের উত্তরসূরী।  ফারাক কেবল, মনসুর ইতিহাস জানেন। সচেতন ভাবে মানেন। যে ইতিহাসে জাতপাত-বিরোধী চৈতন্যে বিলীন হন ধর্মীয়-বিভাজন বিরোধী লালন। আর এই চৈতন্য বা গোরাচাঁদ বা গৌরাঙ্গের নামে, তাঁর গাঁয়ের নাম গৌরভাঙা। এ নামের গর্ব তাই একটু বেশিই!

 


বহুকাল পর ফোনে কথা হল মনসুরদার সঙ্গে। ভাল আছেন। রোজই, বাবা আজাহার ফকিরের মাজারে গানের আসর বসে। কেউ না কেউ আসছেনই। বর্ষায় গাইয়ে বাজিয়েরা জমিতে কৃষিকাজে ব্যাস্ত। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, - কেমন বোঝো আজকাল?

"চাদ ছোঁয়ার আনন্দ, বিভাজনে ধাক্কা খায় গো!" মনসুরের বক্তব্য খানিক রূপক হলেও, ফকির সোজাসুজি ফিরলেন আসন্ন নির্বাচনে। সাফ বললেন, - ' চব্বিশের নির্বাচন আসলে বিভাজন বনাম ভারতবর্ষের লড়াই।' কথায় কথায় প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ স্পষ্ট হয়।  প্রবীন ফকির ভাবে ফেরেন, ফেরেন পরম্পরায়। বললেন, - ''শ্রী চৈতন্য খুন হয়েছিলেন যাদের হাতে, তারা বিভাজনবাদী। আজ রূপ বদলেছেন। লালন হেনস্তা হয়েছেন রোজ। ধর্মের নামে ভাগ হওয়া দেশে আজো সীমান্তের দুপারে হেনস্তা হচ্ছে লালনের ভাবধারা।  আরেকজন আছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ।  যাকে কেন্দ্র করে এই সবাইকে নিয়ে বাঁচা যায়! এখনও এক উঠোনে বসানো যায় সমস্ত ভাবনার মানুষকে। অথচ দেখো, চৈতন্য, লালন আর পঁচিশে বৈশাখ - গত নয়-দশ বছরে কেবলই আক্রান্ত। প্রকৃত চৈতন্যকে বদলে ফেলা হচ্ছে। সামনের ভোটটা, কঠিন লড়াই, এ লড়াই চৈতন্য, লালন আর রবীন্দ্রনাথকে বাঁচানোর লড়াই।"

বললাম, তবুও তো বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়ছেন বহু মানুষ। বিভাজনের শক্তি তো হারতেই পারে। ফকির মনসুর খানিক রূপকে জবাব দিলেন।" তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি বেঁধে রান্না করলে - হাঁড়ি গরম হবে? এটা মিডিয়ার যুগ। ওরা সব মিডিয়া কিনে নিল। আমাদের স্রেফ সম্প্রীতির আকাঙ্খা ভরসা!"

বেলা গড়াচ্ছিল বিকেলের দিকে। আখড়ায় তখন খাওয়ার সময়। দ্রুত কথা শেষ করে আনতে আনতে মনসুর মনে করালেন, হয়তো সবাইকে বা নিজেকেই, কথাগুলো যেন বিড়বিড়! যেন জীবনের সিংহভাগ সময় পার করে আসা বাংলার এক গাইয়ে ফকিরের বিষণ্ণ উচ্চারণ, - "মহান ভারতবর্ষে শান্তির পতাকা উড়ুক, অশান্তি চাই না, একতারাতে বিনা সুতোর মালা পরে চব্বিশ বিষ নামাতে না পারলে বিপদ! সাম্য চাই, শান্তি চাই, প্রেম আর ভালবাসায় বিলীন হতে চাই। যে ভাবে আমার শ্রী চৈতন্যে বিলীন মহম্মদ।"

সাথে থাকলো মনসুর ফকিরের গান -

https://youtu.be/WtRbnal5mQc?si=Kki5mrePJDso6ohu

0 Comments

Post Comment