পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সরকার মানে কিন্তু অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল

  • 28 May, 2020
  • 1 Comment(s)
  • 3046 view(s)
  • লিখেছেন : মহাশ্বেতা সমাজদার
সারা দেশের গালে একটি বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় অজান্তেই মারল একটি টলমলে শিশু , বিহারের মুজফ্ফরপুর স্টেশনের এক প্ল্যাটফর্মে শুইয়ে রাখা তার মরা মায়ের গায়ের চাদর দিয়ে বোধহয় মায়ের সঙ্গেই টুকিটুকি খেলার চেষ্টা করছে। অফ দ্য পিপল , বাই দ্য পিপল , ফর দ্য পিপলের মধ্যে কিন্তু ঐ টলমলে দুধের শিশু আর তার মরা মায়েরও থাকার কথা ছিল

আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমাদের টানাটানির সংসার ছিল। যদিও মনে সেই দৈন্যের কোনো রেশ থাকত না। মনে আছে কোনো কিছু পেতে ইচ্ছে হলেও চাইতাম না। খুব যদি চাইতে ইচ্ছে হতো , খেয়াল করতাম সময়টা মাসের শেষ কিনা। যদি তা না হতো, তাহলে ফিসফিস করে খুবই কুন্ঠা নিয়ে মাকে বলতাম যদি সেটা দেওয়া যায়। না বললে আর দ্বিতীয়বার সেটা চাইবার কথা মনে হত না। এইভাবে যথেষ্ট আনন্দ করেই আমরা বড় হয়েছি, আমরা মানে আমাদের সব বন্ধুবান্ধবরাই। এর মধ্যে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় দেশ ভয়ানক দারিদ্রের সম্মুখীন হয়, এবং তারপর অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কুশলী আর্থিক নীতির ফলে আমরা অনেকেই মধ্যবিত্তদের মধ্যেও বেশ উচ্চস্তরে অধিষ্ঠান করি। তাই কেমন একটা ধারণা হয়েছিল, সরকার এমনভাবেই দেশ চালাবে যাতে অতি দরিদ্ররা ক্রমশ দরিদ্র, দরিদ্ররা মধ্যবিত্ত, এবং মধ্যবিত্তরা ক্রমশ উচ্চমধ্যবিত্ত স্তরে আরোহণ করবে। তাছাড়া পাঠ্য বইয়েও পড়েছিলাম সরকার মানে অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। তাই সরকার সম্বন্ধে একটা কল্যাণকামী কর্তৃপক্ষ , এই ধারণাটি অক্ষুণ্ণ ছিল ২০১৪ পর্যন্ত। ২০১৪ থেকেই এই ধারণা ক্রমশ নস্যাৎ হয়ে যায়।

এখানে বলে রাখা ভালো, যে আমি বলতে চাই না যে এর আগে দুর্নীতি বা দরিদ্র শোষণ হয়নি। হয়েছে, নিশ্চয় হয়েছে, কিন্তু গত ছয় বছরে যে পরিমাণ শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার ও দুর্নীতি হয়েছে, তার কাছে গত এতগুলো বছরের সব অত্যাচার শিশু, একেবারে হামাগুড়ি দেওয়া শিশু।

আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায় ২০১৪ পর্যন্ত ভারত আর্থিকভাবে গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলছিল, এবং সেই গতির ভরবেগেই ভারত ২০১৪-র পরেও বিশ্বের দ্রুততম বাড়তে থাকা আর্থিক শক্তিতে পরিণত হয়।


আবার যদি সার্বিক কল্যাণের নিরিখে বলি , তাহলে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলেই চালু হয়েছিল খাদ্যের অধিকার, কর্মের অধিকার, তথ্যের অধিকার ইত্যাদি কল্যাণকামী আইনগুলি।


যদি দুর্নীতির কথা ধরি, তাহলে বলতে হয় ইউপিএ টু-র আমলে যে টুজি থ্রিজি কোলগেট কেলেঙ্কারির অভিযোগে গগন বিদীর্ণ হচ্ছিল এবং যে কারণে জনগণের মাইনে পাওয়া সাংসদরা সংসদ অচল করে রাখতেন দিনের পর দিন, তার কোনো সারবত্তা আদালতে প্রমাণ করা যায়নি। একমাত্র প্রমাণিত দুর্নীতি ছিল কমনওয়েলথ গেমস আয়োজনে, তার তদন্ত শেষ করে দোষীকে শাস্তি দেওয়াও শুরু হয়েছিল। যিনি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির কথা বলে আকাশ ফাটাচ্ছিলেন, তাঁর নাম বিনোদ রাই, তৎকালীন ক্ম্পট্রোলার অডিটর জেনারেল, তিনি এখন ঠিক কতটা সম্মানে আর আদরে আছেন আর প্রতিদিন তাঁর তৎকালীন নাট্যাভিনয়ের সাম্মানিক প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছেন, তা তার এই আমলে পাওয়া সম্মানরাশি ও মর্যাদা পাঠক ইন্টারনেট সার্চ করে খুঁজে নিন।

তা যা বলছিলাম। এই সরকার দেশের ত্রিশ শতাংশ মানুষের সমর্থনে এসেছিল আচ্ছেদিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এইবার এক এক করে দেখে নেওয়া যাক কেমন সেই আচ্ছেদিনের নমুনা।

প্রথম যে নমুনাটি মনে পড়ছে, তা হল বুরহান ওয়ানি হত্যা।

২০১৬র জুলাই মাসে হঠাৎ একুশ বছরের জঙ্গি যুবককে ভারতীয় সেনা ঘরে ঢুকে মেরে ফেলল। তার অপরাধ? সে ইন্টারনেটে ভারতবিরোধী উসকানি দিত এবং সে কাশ্মীরি যুবসমাজে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল, যে তার কথা শুনে নাকি কাশ্মীরী যুবকরা দলেদলে জঙ্গিদলে নাম লেখাচ্ছিল। কোনোদিন বন্দুক ধরার অভিজ্ঞতা যে তরুণের হয়নি, তাকে বিচার না দিয়ে, সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে ভারতীয় সেনা মেরে ফেলল। নিহত তরুণের শবযাত্রায় লক্ষ মানুষের ভিড় হল, ভারতীয় সেনা সেই ভিড়ে গুলি চালিয়ে শোকাচ্ছন্ন মানুষ মেরে কাশ্মীরীদের ভারতের ঘোষিত শত্রুতে পরিণত করল। এরপর কাশ্মীরি কিশোর যুবকরা পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ জানালে তাদের নির্বিচারে চোখে পেলেট গান ছুড়ে অন্ধ করা চলল। কত শিশু যে সরকারের রোষের শিকার হল , তার ইয়ত্তা নেই। তবে আগেই বলেছি, সব অন্যায়ই আগে থেকেই চলছিল, বিজেপি এসে শুধু তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা হিসেব বলে ২০১০ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পেলেট গান শিকারের সংখ্যা কুড়ি হাজারের বেশি।


এরপর এল সেই ভয়ংকর দিন ৮ নভেম্বর , ২০১৬। প্রধানমন্ত্রী মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে দেশের পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করে দিলেন। দেশের ৮৬% মুদ্রা বাতিল হয়ে গেল। সারা দেশ কাজকম্ম ছেড়ে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এক অলীক স্বপ্ন আর কুটিল প্রতিশোধস্পৃহা বুকে নিয়ে। দেশের অনেক অনেক মানুষ স্বপ্ন দেখল এই নোট বাতিলের পর দেশে আর কালো টাকা থাকবে না, জঙ্গিহানা থাকবে না , জালনোট থাকবে না। কীভাবে এই সবকিছুর মূলে আঘাত না করেই এই সব বিপদ চিরতরে কেটে যাবে সেটা যদিও সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝে ওঠা যায় না, তাও কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আর একদল বড়লোকদের বাড়িতে থরে থরে জমিয়ে রাখা টাকা সব অচল হয়ে গেল বলে নিজের পেটে কিল মেরে পরম সুখী হল। অবর্ণনীয় কষ্ট হল দিন আনা দিন খাওয়াদের আর বীজ কিনতে না পারা চাষীদের । আর কত লোক যে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মারা পড়ল, তার কোনো হিসেব হল না। কেউ একটিবার তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমাও চাইল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে জানা গেল, প্রায় পুরো নগদ টাকাই ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। অর্থাৎ যে কালো টাকা অর্থনীতিতে ফিরবে না বলা হয়েছিল, সে টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকে মালিককে সুদ পর্যন্ত দিয়েছে। তবে নোটবন্দির ফলে
নাভিশ্বাস উঠল ছোট মাঝারি নগদনির্ভর ব্যবসায়ীদের।


তবে নাভিশ্বাসেই তো মৃত্যু নিশ্চিত হয় না, তাই সেই মৃত্যুনিশ্চিতকারী গলাটিপুনি এল আরো আট মাস পর। ১ জুলাই , ২০১৭ চালু হল জি এস টি। এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়মকানুনের জালে নিঃশ্বাস বন্ধ হল অসংখ্য ছোট ব্যবসার। এর মধ্যে রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা ভোট হচ্ছে, আর ভোটের আগে আগে লাগছে দাঙ্গা, যাতে হিন্দুরা মুসলমানকে ভয় পেয়ে হিন্দুভোট ভাগ হতে না দিয়ে বিজেপিকে জেতায়। আর যে সব জায়গায় অল্পের জন্য বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না, সেখানে কোথাও রাত থাকতে রাজ্যপালকে তুলে, কোথাও বিধায়ক কেনাবেচা করে বিজেপি ক্ষমতাসীন হয়েছে, যেখানে ভোটে বিজেপি হেরেছে, সেখানে শাসক দলের বিধায়ক কিনে সরকার ফেলে একের পর এক রাজ্যে চলছে বিজেপির জয়যাত্রা। এমনকী কাশ্মীরে বিজেপির পরম শত্রু পিডিপির সঙ্গেও জোট বেঁধে সরকার গড়ল বিজেপি। এইসব কার্যকলাপের মধ্যে কোথাও উচ্চারণ নেই আচ্ছে দিনের, কোথাও চিহ্ন নেই আর্থিক অগ্রগতির। ইতিমধ্যে জনধন যোজনা করে যে বিপুল সংখ্যক জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্কে, তার উপর রাতারাতি মিনিমাম ব্যালেন্সের নিয়ম প্রয়োগ করে দরিদ্রতম মানুষের সঞ্চিত অর্থ স্টেট ব্যাঙ্ক হজম করতে লাগল। আর দেশের ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগল বিজয় মালব্য, মেহুল চোকসি আর নীরব মোদীর দলবল। এর মধ্যে ভক্তমনে চনমনে ভাব জিইয়ে রাখতে লাগাতার চলেছে একের পর এক গণপিটুনিতে মুসলমান হত্যা। এবং সেই হত্যাকারীদের জামিনে মুক্তি পেলে জুটেছে সম্বর্ধনা। ২০১৮ শুরুই হল ভীমা কোরেগাঁও সন্ত্রাস দিয়ে। ইঙ্গ-মারাঠা সংঘর্ষের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক বিশাল জমায়েতকে কেন্দ্র করে শুরু হল প্রবল সংঘর্ষ। তবে এই ঘটনাকে নিংড়ে বিজেপি যে অভূতপূর্ব নির্যাস বার করেছে, তার ফল ভোগ করছেন দেশের প্রথম সারির পণ্ডিত ও সমাজকর্মীরা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, অধ্যাপক সোমা সেন, অধ্যাপক তেলতুম্বে , গৌতম নভলাখা কারাবাস ভোগ করছেন, এবং কিছুতেই জামিন পাচ্ছেন না।

এর মধ্যেই ইতিহাসে প্রথমবার দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সরব হলেন সুপ্রিম কোর্টের চার বরিষ্ঠ বিচারপতি এবং তাঁরা ভারতের জনগণকে জানালেন দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন। এই সব করতে করতেই চলে এল ২০১৯। আবার লোকসভা ভোট।আচ্ছেদিনের কোনো প্রতিশ্রুতি তো পূরণ হয়ইনি, উল্টে লোকে কেঁদে বলেছে আগেকার মন্দদিন ফিরে আসুক। কোনো অবস্থাতেই যখন বিজেপির জিতে আসার আর কোনো উপায়ই নেই, তখন অযাচিত বা যাচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল পুলওয়ামা। সাধারণের বোধের অতীত কোনো কারণে ভয়াবহ বিপদে ফেলা হল ভারতীয় সেনার কনভয়কে এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল চল্লিশেরও বেশি ভারতীয় সেনা, যার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এবং তদন্ত শুরুরও আগে ভারত সার্জিকাল স্ট্রাইক করে বসল পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের বালাকোটে সেভাবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হল কিনা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও ভারত নিজেদের একটি সেনাচপারে আঘাত করে ছ'জন চপার আরোহী ও একজন অসামরিক ভারতীয় নাগরিককে মেরে ফেলল। পাকিস্তানের হাতে বন্দি হলেন ভারতীয় এয়ারফোর্স পাইলট অভিনন্দন বর্তমান। পাকিস্তানের অসীম কৃপায় সে যাত্রা রক্ষা পেলেন বর্তমান, কিন্তু ভারতীয় কেনা মিডিয়া পুলোয়ামা অধ্যায় নিয়ে বলিউডি ঢংয়ে এত যাত্রাপালা করল, এবং প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নির্বাচনী বিধিনিষেধ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের শহীদের নাম করে ভোট চাইতে লাগলেন, যে আবেগী ভারতবর্ষ তাঁকে নিরাশ করল না। মোদীজিও অবশ্য কোনো পাথরই না উল্টিয়ে রাখেন না, তাই নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী যখন তাঁর মৌন থাকার কথা, তখন তিনি ক্যামেরা ক্রুয়ের দল নিয়ে কেদার যাত্রা করলেন আর মৌন হয়ে তপস্যা করলেন আর বিক্রি হয়ে যাওয়া ভারতীয় মিডিয়া লোক ঠকানোর সব রকম আয়োজন করে তা কাভার করতে লাগল। নির্বাচনী বিধি অবশ্য নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহ বারবার ভেঙেছেন, কিন্তু তাতে দোষ দেখেনি নির্বাচন কমিশন। তিন কমিশনারের মধ্যে একজন কমিশনার অশোক লাভাসা অবশ্য বারবার আপত্তি জানাচ্ছিলেন, কিন্তু বাকি দুজন সেই আপত্তি ধোপে টিঁকতে দেননি। খবরে প্রকাশ, সস্ত্রীক অশোক লাভাসা দ্বিতীয় মোদী সরকারের নানা হয়রানিতে নাজেহাল হয়ে আছেন।


সে যাই হোক, ২৩মে ২০১৯ বিজেপি একটিও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি না পালন করে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এল। এবং এসেই আর এস এসের যে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের শতবর্ষ-প্রাচীন অ্যাজেন্ডা তা পূরণ করতে একটি মুহূর্তও নষ্ট করল না। প্রথমেই যে ধারার বলে কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করল ৫ অগাস্ট এবং ৩১ অক্টোবর জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজিত করল। এই পুরো প্রক্রিয়াটায় সমগ্র কাশ্মীরে চলল লাগাতার কার্ফু, এবং নেট , ফোন বন্ধ করে কাশ্মীরের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলা হল। অতি সম্প্রতি আইন করে কাশ্মীরের বাসিন্দা হলেই জমি কেনার অধিকার এবং কাশ্মীরের সরকারি চাকরিতে বাকি দেশের চাকরিপ্রার্থীদের অধিকার কায়েম করা হয়ে গেছে। এর ফলে কাশ্মীরের জনবিন্যাসকে ঘেঁটে দেওয়া সহজ হবে।


ইতিমধ্যে ভারতের বিচারব্যবস্থাকে এতটাই নমনীয় করে ফেলা গেছে, যে কাশ্মীরের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার আবেদনে বিচারপতি বলেছেন , এখন ও সব দেখার সময় নেই, আমাদের রামমন্দিরের বিচার দিতে হবে। ৯ নভেম্বর এল সেই রামমন্দিরের রায়। ঐতিহাসিক এক অস্বাক্ষরিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বিচার দিল যে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙাটা যদিও খুবই অন্যায় হয়েছে, তাও যা আছে, সেটা এবার আদালতের নির্দেশে ভেঙে ফেলতে হবে এবং সেই পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন ইমারত ভেঙে ফেলে গড়া হবে নতুন রামমন্দির, যেহেতু এখানে মহাকাব্যের চরিত্র রাম জন্মেছিলেন বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। বাবরি মসজিদের জন্য পাঁচ একর জমি কোথাও একট দিয়ে দিলেই হবে। এর পর ১১ ডিসেম্বর আইনসভায় পাশ হল সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, যা আদ্যন্ত অসাংবিধানিক। তার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। দেশের ছাত্রসমাজ সেই আন্দোলন শুরু করলে এবং ছাত্রদের উপর পুলিশি জুলুম শুরু হলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকসমাজ সে আন্দোলনে পথে নামলেন। ইতিমধ্যে মুসলমান পুরুষকে সে আন্দোলনে দেখা গেলেই উত্তরপ্রদেশ কর্নাটকে গুলি চলল। কাশ্মীরের বাইরেও দেশের নাগরিক মরল পুলিশের গুলিতে। আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠলেন শাহীনবাগ পার্কসার্কাসের দাদীরা। মুসলমান গৃহিনীরা।

ইতিমধ্যে চলে এল নতুন বছর । ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি ভোট। বিজেপি পর্যুদস্ত। শুরু হল বিজেপির মদতে দিল্লি দাঙ্গা। সে দাঙ্গা শুরুর আগের মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চলে এসেছেন করোনা সঙ্গে নিয়ে। মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লক্ষ লোকের সমাগম দেখাবেন। ফলে করোনার আদানপ্রদান হল যথেচ্ছ। ইতিমধ্যে করোনার থাবা চিন পেরিয়ে ইটালি ফ্রান্সেও হানা দিয়ে এদেশেও প্রকাশ পাচ্ছে, তাও মধ্যপ্রদেশে সরকার ফেলার তাড়নায় সংসদ চালু রইল। চালু রইল আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবাও। ফলে আরো করোনা এল বিমানযোগে।হঠাৎ ১৯ মার্চ মোদীবাবু বললেন আগামী বাইশে মার্চ জনতা কার্ফু। সেদিন দোকান বাজার ইস্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে এবং বিকেল পাঁচটায় সবাই যার যার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তালি থালি বাসন বাজিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহিত করবে। জনতা তাই করল। এর পরের পরের দিন, অর্থাৎ ২৪ মার্চ , রাত আটটায় মোদীজি বললেন আজ রাত বারোটা থেকে টোটাল লকডাউন। মহাভারতের যুদ্ধ আঠেরো দিনে শেষ হয়েছিল, এই করোনাযুদ্ধ একুশদিনে শেষ হবে। বলা মাত্র সব দোকানবাজার, ব্যবসাপাতির ঝাঁপ বন্ধ হল। মোদীজির যাদের কথা একেবারেই মনে ছিল না তারা হল ভিনরাজ্যের শ্রমিক। এক রাজ্য থেকে যারা অন্য রাজ্যে কাজ করতে যায়। তাদেরও কাজ বন্ধ হল, আয় বন্ধ হল। বাড়িওলা বলল টাকা দিতে না পারলে চলে যাও। এদিকে ট্রেন বন্ধ, বাস বন্ধ। ফলে বাড়ি ফেরা, খাওয়াশোওয়া সব বন্ধ। একুশদিনের মাথায় মোদীজি সকালে টিভিতে মুখ দেখিয়ে বললেন লকডাউন তোলা হবে না। এদিকে শ্রমিকরা তো আরো সকালে ট্রেনের টিকিট কাটতে স্টেশনে ভিড় জমিয়েছে, তারা তো আর জানে না মহাপ্রভু এর মধ্যে টিভিতে কী বলে গেছে। ফলে তারা টিকিট কাটতে ব্যস্ত হল, ওদিকে টিকিট তো নেই। পুলিশ দেশের খেটে খাওয়া সৎ নাগরিকদের লাঠিপেটা করল।তারপর উপায়ান্তর না দেখে সারা ভারতের সব শ্রমিক রাস্তা ধরে ট্রেনলাইন ধরে চলতে লাগল।কেউ কেউ সবজির লরিতে উঠল। কেউ লরিচাপা পড়ল, ষোলজন তো ট্রেনলাইনেই পিষে গেল। তাও সরকারের শ্রমিকদের জন্য ট্রেন চালানোর কথা মাথায় এল না। এদিকে লকডাউন এক, দুই , তিন পেরিয়ে চারে পড়ল। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে হাজার বাস যোগাড় করা হল, কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের সরকার নানা হয়রানি করিয়ে সেই বাস ফেরত পাঠাতে বাধ্য করল। ইতিমধ্যে বিদেশে আটকে পড়া পোষাকুকুর সমেত বড়লোকদের ফেরাতে প্লেন গেল। এবং সারা দেশ যখন কেন দেশনির্মাতারা অনাহারে অল্পাহারে হাঁটতে বাধ্য হবে বলে বেজায় চেঁচামেচি লাগিয়েছে, তখন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু হল। সেই ট্রেন মহারাষ্ট্র থেকে উত্তরপ্রদেশ যাবে বলে রওনা হয়ে পথ ভুলে ওড়িশা চলে গেল। এবং আবার উত্তরপ্রদেশে ফিরতে সাতদিন লাগাল। আর একটি ট্রেন গুজরাট থেকে বিহার যাবে বলে রওনা হয়ে কর্নাটক চলে গেল। শোনা যাচ্ছে এরকম চল্লিশটা ট্রেন যেখানে যাবার কথা সেখানে না গিয়ে অন্যখানে চলে গিয়ে আবার ঘুরে ঘুরে গন্তব্যে আসছে। দুমাসের উপর ঠিকমতো আহারনিদ্রা ছাড়া , ট্রেনেও খাদ্যাভাবের সঙ্গে ঘরে ফেরার উৎকন্ঠার উপর বাড়তি এই রেল কোম্পানির রসিকতা অনেকেই সইতে না পেরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। আজ সাতাশ মে সারা দেশের গালে একটি বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় অজান্তেই মারল একটি টলমলে শিশু , বিহারের মুজফ্ফরপুর স্টেশনের এক প্ল্যাটফর্মে শুইয়ে রাখা তার মরা মায়ের গায়ের চাদর দিয়ে বোধহয় মায়ের সঙ্গেই টুকিটুকি খেলার চেষ্টা করছে।
তাই যা বলছিলাম , সেই অফ দ্য পিপল , বাই দ্য পিপল , ফর দ্য পিপলের মধ্যে কিন্তু ঐ টলমলে দুধের শিশু আর তার মরা মায়েরও থাকার কথা ছিল।

1 Comments

Partha Banerjee

28 May, 2020

খুব ভালো লেখা। তবে, একটানা না লিখে ১, ২, ৩, ৪, ৫ করে ভাগ ভাগ করে ও সাবহেডিং দিয়ে লিখলে আরো ভালো হতো। এবং ক্রমাগত লিখে যেতে হবে বিভিন্ন মিডিয়ামে। এখন আবার "সন্ত্রাস ও যুদ্ধের" আবহাওয়া তৈরির চেষ্টা চলছে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল ও তাদের মিডিয়া থেকে। যা প্রত্যাশিত। সে ব্যাপারেও লেখা ও কথা বলা দরকার।

Post Comment