পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আদালত ও কয়েকটি রায়

  • 29 February, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 793 view(s)
  • লিখেছেন : সোমনাথ গুহ
আজকের সময়ে বিচারপতিরাও প্রবল চাপে আছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে আজ যখন রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান শাসক দলের কুক্ষিগত হয়ে গেছে তখন বিচারব্যবস্থা তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই নিরপেক্ষতা অনেকটাই গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই শক্তিশালী হওয়ার ওপর নির্ভর করছে।

                    

বিচারব্যবস্থা কি নিরপেক্ষ, না দোদুল্যমান, না পক্ষপাতদুষ্ট? এটা নিয়ে নানা মতামত। এই প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি রায় যাচাই করে দেখতে পারি। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক কয়েকটি রায় বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি শীর্ষ আদালত দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে বেনামে অনুদান দেওয়ার প্রকল্প নির্বাচনী বন্ড বাতিল ঘোষণা করেছে। আদালত এই রায়কে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে। তাঁদের মতে এই আর্থিক অনুদান ব্যবস্থা তথ্য অধিকার আইন এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ (১এ) লঙ্ঘন করে। বিচারপতি ডি.ওয়াই.চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে আদালতের বেঞ্চ বলেন যে এই বন্ড নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রবল ভাবে অসমান করে দিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের তুলনায় কর্পোরেট সংস্থা বা যে কোন ধনশালী ব্যক্তি বিপুল আর্থিক অনুদান দিয়ে যে কোন নির্বাচনকে অভুতপূর্ব ভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ওই রায়ের পাঁচ দিন বাদে শীর্ষ আদালত চন্ডিগড়ের মেয়র নির্বাচনের ফলাফল খারিজ করে দেয়। তাঁরা বাতিল করে দেওয়া আটটি ব্যালট বৈধ গণ্য করেন এবং আপ প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করেন। যে প্রিসাইডিং অফিসার নজিরবিহীন ভাবে ওই আটটি ব্যালটকে কারচুপি করে অবৈধ করে দিয়েছিলেন, আদালত তাঁকে শো-কজ করার নির্দেশ দেয়। তৃতীয় রায়টি বিলকিস বানোর চাঞ্চল্যকর মামলা সংক্রান্ত। ২০২২ এর অগস্ট মাসে গুজরাট সরকারের এক কমিটি নির্লজ্জ ভাবে সমস্ত আইন, রীতিনীতি উপেক্ষা করে এগারো জন যাবজ্জীবন কারাদন্ডে শাস্তিপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি দেয়। এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা দায়ের হয়। গত জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় ওই আসামীদের জেলে ফেরত পাঠানোর নিদান দেয়।

গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে আদালতের এই সক্রিয়তা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য যদিও এর পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আদালতের নজরে আনা হয়েছে সেগুলি সম্পর্কে তাঁরা আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব বা নিস্পৃহ। প্রথমে নির্বাচনী বন্ডের রায়টা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ২০১৭ সালে নির্বাচনী বন্ড চালু হয় এবং শুরু থেকেই কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও নির্বাচন কমিশন এর বিরোধিতা করে। প্রথম দু বছরেই এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এটা কি অদ্ভুত নয় যে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা গণতন্ত্রের মেরুদন্ড নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অন্তর্ঘাত করে সেটা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে আদালত সাত সাতটা বছর কাটিয়ে দিল? যখন দেখা যায় এই দীর্ঘসূত্রতায় সবচেয়ে লাভবান দেশের শাসক দল তখন তো সেটা আরও বিস্মিত করে! এই সাত বছরে বিজেপির ভান্ডার ফুলে ফেঁপে উঠেছে --- মোট বন্ড বিক্রি হয়েছে প্রায় ১২০০০ কোটি টাকা, যার সিংহভাগ ৫৫%, ৬৫৬৪ কোটি পেয়েছে এই দল। আদালত নির্বাচনের ক্ষেত্রে অসমানতা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু এতগুলি বছর তাঁদের নীরব থাকার কারণে ভোট ব্যবস্থায় যে অসাম্য তৈরি হয়েছে সেটার প্রতিকার কী ভাবে হবে? প্রশ্ন এই সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা কেন ফেরত দেওয়া হবে না? সেটা কী ভাবে কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটা একটা জটিল বিষয়, কিন্তু সেটা অসম্ভব নয়। এই বিপুল অর্থভান্ডারের কারণে আসন্ন লোকসভা নির্বাচন শুরুর আগেই  বিজেপি বিরোধী দলগুলির চেয়ে সহস্র যোজন এগিয়ে। তাদের এই অন্যায় সুবিধা পাওয়ার জন্য কারা দায়ী?

উপরোক্ত রায়গুলির পাশাপাশি মহামান্য আদালত ১৯৯১র একটি রায় সম্পর্কে আশ্চর্যজনক ভাবে নিস্পৃহ। ওই বছরের উপাসনাস্থল আইন অনুযায়ী ১৫ই অগস্ট, ১৯৪৭এ কোন মন্দির, মসজিদ, গির্জা, ঐতিহাসিক সৌধ যেখানে যেমন ছিল তেমনটাই রাখতে হবে। বাবরি মসজিদ নিয়ে বিবাদের সময়, উপাসনাস্থলের চরিত্র সংরক্ষণের জন্য এই আইন প্রণীত হয়। তখন এই আইন কোন উপাসনাস্থলের চরিত্র বদলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অয্যোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ। বলা হয়েছিল এই আইন জম্মু কাশ্মীর ব্যতীত সমস্ত দেশের জন্য প্রযোজ্য। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই আইন কোন উপাসনাস্থল পরিবর্তনের জন্য কোন আবেদন, পিটিশন বা মামলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অথচ শুরুতেই এর বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। গত কয়েক বছরে এই আইন অবৈধ ঘোষণা করার জন্য বিভিন্ন পিটিশন জমা পড়েছে। ১৯৯১র আইন অনুযায়ী শীর্ষ আদালত সেগুলি খারিজ করা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা উল্টে সেগুলি গ্রহণ করেছেন যা এই আইন পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা প্রবল ভাবে জাগিয়ে তুলেছে। আদালতের এই নিস্পৃহতা সঙ্ঘ পরিবারকে আক্রমণাত্মক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা এখন বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহি ইদগা দখল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তারা বলছে এই দুটি জায়গায় মন্দির হয়ে গেলেই তারা আর কোনও দাবি করবে না। প্রসঙ্গত একই কথা তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার সময় বলেছিল। যেটা উদ্বেগজনক সেটা হল আদালত তাঁদের নিরস্ত করার জন্য কিছুই করছে না।   

এরকম নানা উদাহরণ দেওয়া যায়। উমর খালিদের বিষয়টা ধরা যাক। চার বছর আগে দিল্লি ‘দাঙ্গা’ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্চ, ২০২২এ দায়রা আদালতে জামিনের আবেদন করেছিলেন, সেখানে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি অক্টোবরে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন। তারপরে যমুনা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। বারবার তাঁর জামিনের শুনানির দিন ধার্য হয়েছে এবং অবধারিত ভাবে তা মুলতুবি করা হয়েছে; অগস্ট, ২০২৩ সালে তাঁর জামিনের আবেদনের শুনানি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বিচারপতি প্রশান্ত কুমার মিশ্র। অবশেষে চোদ্দ বার শুনানি মুলতুবি হওয়ার পর উমর তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাহার করেন, বলেন যে নিম্ন আদালতে তিনি তাঁর ভাগ্য পরীক্ষা করবেন। ভাবুন চার বছরে আদালত একজন প্রতিশ্রুতিমান গবেষকের জামিনের আবেদন শোনার সময় করে উঠতে পারেনি! নিউজক্লিকের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থর কথা ভাবুন! তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অতি গুরুতর তিনি নাকি অর্থের বিনিময়ে চিনা সরকারের হয়ে প্রচার করেছেন। অথচ আজ পাঁচ মাস হয়ে গেল পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোন চার্জশীট তৈরি করে উঠতে পারেনি! আদালত দেরি হওয়ার জন্য পুলিশকে তিরস্কার করেছে। কিন্তু তাতে বাস্তবে কী হল? এই পাঁচ মাস বিনা বিচারে আটকে থাকার মূল্য কে দেবে?

পক্ষে বিপক্ষে এরকম নানা উদাহরণ দেওয়া যায়। আজ দেশে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দক্ষিণপন্থী শক্তি পরাক্রমশালী এবং আক্রমণাত্মক। যে কোন বিরোধী শক্তিকে, মতামতকে তাঁরা যে কোন ভাবে দমন করে। কোন বিচারপতি তাদের বিরুদ্ধে রায় দিলে তাঁকে কুৎসিত ভাবে ট্রল করা হয়, এমনকি সামাজিক ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া তাঁদের নানা ভাবে প্রলোভিত করার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে বিচারপতিরাও প্রবল চাপে থাকেন। এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে আজ যখন রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান শাসক দলের কুক্ষিগত হয়ে গেছে তখন বিচারব্যবস্থা তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই নিরপেক্ষতা অনেকটাই গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই শক্তিশালী হওয়ার ওপর নির্ভর করছে।

 

0 Comments

Post Comment