আকস্মিক তন্দ্রাবসানে কমলাকান্ত স্যর মহা অসন্তুষ্ট হইলেন। কুপিত কণ্ঠে কহিলেন, “এই অসময়ে আমার বিরল সুনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাইলে কেন?”
করজোড় নিবেদন করিলাম, “মহাশয়, পাতকের দুর্বিনীত কর্মকে ক্ষমা করিবেন। এক বিষম আপদে পতিত হইয়া আপনার শরণ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। যদি অনুমতি প্রদান করেন, তবে ---”
মনে হইল, কান্ত মহাশয় কিঞ্চিত শান্ত হইতে সক্ষম হইলেন, কোমল স্বরে বলিলেন, “তাহা বুঝিয়াছি। সুখের দিনে দুগ্ধ দধি লইয়া যে কেহ এই শর্মাকে স্মরণ করে না, তাহা আর বলিতে হইবে না। তোমরা বাঙালিরা সেই সুখের পারাবত দুঃখের সারমেয় বনিয়াই রহিলে। বাঁকাচাঁদ, সূর্যেন্দ্র, শারদশশী, শান্তিনয়ন পাতে কোনো সুকর্মই হয় নাই বলিয়া জানিয়াছি। অনুমতি দিলাম, সংক্ষেপে কহ যাহা বলিবার --- ”
পুনরায় দুই হস্ত বক্ষের উপর যুক্তস্থাপন করিতে হইল, আপনার স্রষ্টাকে অবধি যিনি বক্রাক্ষরে সম্বোধিতে পারেন, তাঁহাকে প্রণতি জানাইতেই হয়, “স্যর, স্যর, বাঙালির সংক্ষিপ্ত বচন নাই। কিঞ্চিতাধিক কালাহারী দৈর্ঘ্য অনুমোদন না করিলে বাচনে অর্থহ্রাস ঘটিবার সম্ভাবনা পূর্ণমাত্রায় সম্ভবে। বক্তব্য সমাপ্ত হইলে দুইটি আম্র নৈবেদ্য প্রস্তুত।”
অধমের হস্ত ’পরে আম্রদ্বয়ের দর্শনে যৎ পরিমাণ অবরোষ ঘটিয়াছিল, উপরোক্ত বচনে উহা প্রাপ্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধির ফলে কমলাকান্ত স্যর ততোধিক রোষমুক্ত হইলেন বলিয়া বোধ হইল। নিমীলিত চক্ষেই মুখপাতে হাস্য মানচিত্র আনয়ন করিয়া দক্ষিণ হস্তের এক বিশেষ মুদ্রায় জানাইলেন, শ্রবণে প্রস্তুত হইয়াছেন।
বলিলাম, “মহাশয়, এক ভয়ানক মেষকাণ্ড ঘটিয়াছে।”
“মেষকাণ্ড? কী কহ? ভারতীয়রা তো গোকুলেই তিষ্ঠে। তোমাদিগের বাঁকাচাঁদ সেই সেইবারে এক গো-মোকদ্দমায় আমাকে ফাঁসাইয়াছিল বলিয়া মনে পড়িতেছে, কিন্তু মেষ, … মেষ, না, স্মরণে আসিতেছে না! আর একটু বিস্তারে বলিতে হইবে।”
“বাঙালির বিশেষ সৌভাগ্য গুণে বড়লাট ভবনে এক অতিশয় মহাশয়ের আগমন ঘটিয়াছে। বাঙালিদিগকে পদ্মপাঠে আপ্লুত করিয়া এক বিশেষ শ্মশ্রূধারী ভজনান্তে স্বর্ণবঙ্গ স্থাপনায় তিনি আপনাকে সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া রাখিয়াছেন। অথচ বঙ্গবাসী তাহা গ্রহণ করিতে সম্মত নহে, কেহ কেহ তাঁহার বাসভবনের সম্মুখের উন্মুক্ত প্রান্তরে কতিপয় মেষ লইয়া বিচরণ করিয়া গিয়াছে।” একটুখানি শ্বাসবায়ু আত্মসাত করিয়া আদি বচন সমাপ্ত করিতে প্রয়াস পাইলাম, “মহাজনকে উত্তমরূপে দর্শাইয়া। ইহাতেই সেই লাটসাহেব প্রচণ্ড কুপিত হইয়াছেন। অদ্যপি তাঁহাকে শান্ত করিতে হইবে। উপায় বলিয়া দিন মহাশয়।”
কমলাবাবু উভয় নয়নের ঊর্ধ্বমুখী উন্মীলন করিয়া কী যেন ভাবিয়া লইলেন। তাহার পর কহিলেন, “সম্বৎসরে মেষ রাশিতে অশুভ কোনো দুর্বিপাক সম্পাতের পূর্বাভাস রহিয়াছে কি?”
“না স্যর, ইহা পাঁজিপুঁথির নির্ঘোষ নহে। এই স্থলে মেষপুঞ্জের দ্বারা মনুষ্যের প্রতিই ইঙ্গিত করা হইয়াছে বলিয়া সঞ্জয়-বালকদিগের অনুমান শুনিতে পাই।”
“তিষ্ঠ, তিষ্ঠ ক্ষণকাল নাশোক দাদাভাই! একবার বলিতেছ মেষ, আবার বলিতেছ মনুষ্য বুঝায়। ইহা কী রূপ রসিকতা?”
মদীয় কর্ণে আপনার “নাশক” নামকরণ শুনিয়া মন বড় অখুশি হইলেও আপাতত সামলাইয়া লইতে বাধ্য হইলাম। বৃদ্ধগণ আপন পৌত্র দৌহিত্রদিগের সহিত এই প্রকার রূঢ় ও নির্মম রসিকতা করিয়া থাকেন। তাহা মানিয়া লইতে না শিক্ষা করিলে সুপরামর্শ প্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটিবার সমূহ সম্ভাবনা। অতঃপর বলিলাম, “মহাশয়ের তো জানিবার কথা। আপনার পুরাতন কালের বিদ্যা দিক্হস্তীগণ ইহাকে আলঙ্কারিক প্রয়োগ নামে আখ্যায়িত করিতেন বলিয়া শুনিয়াছি। মনুষ্য এই স্থলে উপমান; আর মেষ হইতেছে উপমেয়। এই রূপ কথঞ্চিত আলোচনা উত্থিত হইয়াছে।”
মহাশয়ের অধরযুগ্ম কম্পিত হইতে লাগিল, স্ফূরিত হইয়া উঠিল, কিয়ৎকাল পরে বিস্ফারিত হইয়া অনেকখানি ব্যাদান প্রসব করিয়া শমিত হইলে তিনি ক্রোধোন্মত্ত পূর্বক চিৎকারিলেন, “অলঙ্কার? তোমরা আজিকার বালকগন ইহাকে অলঙ্কার বুঝাইতেছ? অলঙ্কার শাস্ত্রের কী জান বাছা? সমগ্র মনুষ্যকুলকে মেষের সহিত উপমিত করিলে উহাতে অলঙ্কার হয় না, মূর্খ! কতিপয় মনুষ্যকে তুলনা করিলে তবেই ---”
“তাহাই, তাহাই” কোনোক্রমে শব্দস্রোতের মধ্যস্থলে স্বল্প বিরতিতে আপন কণ্ঠকে অগ্রসর করিয়া দিলাম, “মহাশয়, কমলা স্যর, অনুগ্রহ পূর্বক শ্রবণ করুন, ইহস্থলেও কতিপয় --- না, না, মাত্র এক সংখ্যক মনুষ্যকেই নাকি মেষ নামক পশুকুলের সহিত একাসনে উপবেশনের ইঙ্গিত করা হইয়াছে। আর তাহাতেই লাট মহোদয়ের মনোদেশে বিস্তর ক্ষোভের সঞ্চার হইতেছে বলিয়া সন্ধ্যার বিশেষ সংবাদ।”
“বুঝিলাম। তাহা হইলে অলঙ্কার সুসিদ্ধ। কিন্তু ---” কান্ত স্যরের মুখাবয়বে শান্ত হাস্যের আভাস প্রত্যাবর্তন করিল। কৌতুক পূর্বক জিজ্ঞাসিলেন, “উঁহার সহিত ঐরূপ আলঙ্কারিক রসায়নের হেতু কী? বিশেষ করিয়া মেষকেই কেন উপমান নির্বাচন করিলে? ইহার দ্বারা উক্ত মহোদয়ের কোন চারিত্রগুণ প্রকাশ প্রাপ্ত হইল?”
পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে আসিয়া গিয়াছে বুঝিয়া আমিও ধাতস্থ হইলাম। সতর্কতা অবলম্বন করিয়া বলিলাম, “একটি অত্যন্ত নিরীহ নির্দোষ গুণ বুঝাইবার প্রয়াস হয় এই উপমানে। আমাদিগের বাংলা লোকভাষায় বলা হইয়া থাকে ভেড়ার পাল। যাহারা বুদ্ধি বিবেচনা অপর কোনো শক্তিমান ব্যক্তির স্কন্ধে পরিস্থাপন করিয়া তাহার পশ্চাদ্দেশ লক্ষ করিয়া দিক্বিদিক্ অখেয়াল পূর্বক পথ চলিতে থাকে, যাত্রাপথের গন্তব্য ও গমন শেষের পরিণাম সম্পর্কে সামান্য মাত্রও চিন্তা করিতে অবকাশ পায় না, তাহাদিগকে ---”
“স্তব্ধ হও, স্তব্ধ হও অবোধ” --- পুনরায় কমলাকান্ত স্যর রোষের বশ হইলেন। “তুমি চারু চপলের এক মহান চলচ্চিত্রের সেই অতি প্রখ্যাত দৃশ্যটিকে বাঙালির ভেড়ার পাল বলিয়া চালাইতেছ? ভাবিয়াছ, অহিসেবন করি বলিয়া আমার জগত জীবন সম্পর্কে কোনো অবধারণা নাই? ওল্ডেন টাইম্সের লোক বলিয়া মডার্ন টাইম্সের খবর রাখিব না? এত ঔদ্ধত্য লইয়া তুমি মদীয় নিদ্রাভঙ্গ করিলে কোন স্পর্ধায়?”
যখন ভাবিয়াছিলাম, প্রায় লক্ষ্যদেশে উপনীত হইয়াছি, তখন অসাবধানতায় কক্ষচ্যুত হইতেছি দেখিয়া আরও শান্ত ভাবান্তর আনয়নের প্রয়াস করিলাম, “না মহাশয়। আপনি জগত সংসারের ত্রিলোকের সংবাদ জ্ঞাত আছেন বলিয়াই তো এই ঘোর সঙ্কট কালে আপনার সানুদেশেই উপস্থিত হইয়াছি। আপনিই তো জানিবেন, আপনিই বলিয়া দিতে সক্ষম হইবেন যে লাটভবনের রাজস্থানী মহোদয়কে আমরা কী রূপে সান্ত্বনা প্রদান পূর্বক ক্ষোভ মুক্ত করিব।”
কমলাকান্ত আবার ক্রোধমুক্ত হইলেন, বলিলেন, “তোমরা কি উঁহাকে মেষপাল ভুক্ত করিতে অনিচ্ছুক? তাহা হইলেই তো এই বিবাদ অন্তর্হিত হয়।”
“আমরা অতিথিকে অনাহুত হইলেও গালি দিতে কিংবা কুকথা কহিতে চাহি না। কিন্তু এই ব্যক্তি যেরূপ আচরণ করিতেছেন তাহা সেই মেষ পুঞ্জের সহিত ভয়ঙ্কর প্রকার তুলনীয়। বাঙ্গালা রাজ্যে কীটাণু-১৯ নামক এক মেগামারীর কালে তাহাদিগের চিকিৎসা ও টীকাকরণের কাজে তিনি ভয়ঙ্কর বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়াছেন সেই শ্মশ্রুধারীর গুপ্ত অঙ্গুলী হেলনে। ইহা অস্বীকার করাও সম্ভব নহে। অতএব ---”
“কর্ণপাত কর বৎস”, কমলাবাবু রৌপ্য পাত্র হইতে কিয়ৎ পরিমাণ আফিম সংগ্রহ করিলেন, তাহার পর কহিলেন, “যে মনুষ্য মেষপালের সহিত উপমিত হইতে সক্ষম, তাঁহার ক্রোধের গভীরতা বাঙ্গালার মুর্শিদাবাদ জেলার সিয়ালমারি নদীর নাব্যতার অপেক্ষা অধিক নহে। যে রাজ্যাধীশ প্রজাদিগের শুভাশুভের কথা না ভাবিয়া আপন জানগুরুকেই অধিক তৈল প্রদান করিতে আগ্রহী, সে সর্বাংশে মেষতুল্য। উঁহার ক্রোধ প্রকাশ দেখিলে তোমাদিগকে উচ্চস্বরে হাস্যকলরব করিয়া যাইতে হইবে। উঁহার যত ক্রোধ তোমাদিগের ততই সুনাদী হাস্য।”
“ইহাতে আমাদিগের বা বাঙ্গালা রাজ্যের কোনো বিপদ নাই তো?”
“আপাতত তো দেখিতেছি না। তবে সেই শ্মশ্রুধারী নাংগা রাজা যদি হাস্যক্রিয়া নিষিদ্ধ করিয়া আইন প্রণয়ন করে, তখন বিপদ হইতেও পারে।”
আম্রদ্বয় হস্তান্তরিত করিয়া বলিলাম, “সম্প্রতি শ্রুতিগোচর হইয়াছে, এক গুজরাতি কবির একখানি কবিতা জনপ্রিয় হইবার পর জাতীয় নিরাপত্তা আইনে নাংগা শব্দটির কাব্য প্রয়োগ নিষিদ্ধ হইতে পারে।”
“বটে বটে?” কমলা স্যর ব্যাপক উৎসাহিত হইলেন, “কী হইয়াছে? কী লিখিয়াছেন তিনি?”
আমি পারুল খক্করের প্রখ্যাত কবিতা হইতে শেষ দুইটি পংক্তি উচ্চারণ করিলাম:
“রামরাজ্যের সুখ বিলাসী রাজা এখন নঙ্গা,
রাম, একবার দেখবে এস শববাহিনী গঙ্গা!” (মূল গুজরাতি কবিতার ছায়ানুবাদ)।।
কমলাকান্ত স্যর বলিলেন, “সাবধানে থাকিও। মেষ পালের পশ্চাতে ব্যাঘ্রও আসিয়া জুটিতে পারে। উহারা বড় দুষ্ট প্রকৃতির হয়। উপমান অলঙ্কার প্রয়োগে উহারাও অতীব পটু। মনুষ্যকে মেষ অবধারণ করিয়াই ভোজনের আয়োজন করিয়া ফেলে।”
কভার ছবি ঃ পার্থ দাশগুপ্ত