স্মৃতি শক্তির ওপর এমনকি মৃদু চাপও আজ আমরা, বাঙ্গালিরা সইতে পারি না। নির্বাচনের এই মরসুমে আমরা সামনের দিকে কেবল নিজেদের নাকের ডগা আর পেছনে, উড়ন্ত পাঞ্জাবির অংশ দেখতেই অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। এই বাজারে, ক্রিকেটের রমরমায়, এমনকি অনতি-অতীতের কথা মনে করে “কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে”? তবে দোসর পুঁজির কারসাজি বুঝতে আমাদের যেমন সামনে তাকাতে হবে, তেমনই তাকাতে হবে ফেলে-আসা-দিনগুলোর দিকেও।
দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মাঝামাঝি সময়ে দেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত ছিল “ টু-জি কেলেংকারি”-র কথায়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় ভারতের বর্তমান পরিযায়ী প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি এই “ভ্রষ্টাচার” রোখার মহান ধর্মযুদ্ধে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে সারাক্ষণ দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়িয়েছেন। এই “ভ্রষ্টাচার”-এর “বিরুদ্ধে” আওয়াজ তুলে তিনি গুজরাট দাংগার পর গুজরাটে জিতে এসেছিলেন এবং তাঁর এবং তাঁর সাংগপাংগোদের বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলা খারিজ করে আদালত থেকে “ক্লিন চিট” আদায় করেছিলেন। সে এক ভিন্ন কাহিনি, সেই দিকে আমরা যাচ্ছি না। আমাদের এখন আলোচনার বিষয় ২০১০ সালে ঘটে যাওয়া এক বিরাট আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে, যাকে “টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি” বলে সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছে।
ঘটনাক্রম সংক্ষেপে এই রকমঃ
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে ভারতের কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল বা সিএজি ভারতের টেলিকম বিভাগের ২জি মোবাইল পরিষেবার লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে বলে যে এই লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ায় একেবারে জলের দরে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভারতের অর্থকোষ ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, যে সব সংস্থা এই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নয়, এই প্রক্রিয়ায় তারাই এই লাইসেন্স পেয়ে গেছে। সিএজি আরও অভিযোগ করে যে এই অন্যায্য বরাত পাওয়ার পর বা তার সামাণ্য আগে এই সব কোম্পানিগুলি তাদের শেয়ারের এক বড়ো অংশ অন্যান্য ভারতীয় এবং বিদেশী সংস্থার কাছে চড়া দামে বেচে দিয়েছে। যেসব সংস্থা চড়া দামে তাদের শেয়ার বা “স্টেক” বেচে দিয়েছে, সেই পরিমাণ অর্থ হলো এই “স্পেকট্রাম”-এর আসল দাম! যদি একটি মুক্ত এবং ন্যায্য নিলাম প্রক্রিয়ায় এই “স্পেকট্রাম” ছাড়া হতো, তবে এই পরিমাণ অর্থ ভারতের অর্থকোষে জমা পড়ত।
এই নিলামটি পরিচালনার ক্ষেত্রে সেই সময়কার টেলি-কম মন্ত্রী শ্রী এ রাজা, এই নিলামের জন্য ভারতের চালু আইন পরিবর্তন করেন, অবশ্যই বে-আইনি পথে, পাশাপাশি তিনি এই নিলামে অংশগ্রহণের জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন, সেই যোগ্যতার শর্তাবলীও বদলে দেন, যাতে তাঁর পেয়ারের সংস্থাগুলি এই নিলামে অংশ নিতে পারে। রাজা সাহেবের মন্ত্রক একতরফাভাবে নিলামের শেষ দিন আচমকা এগিয়ে আনে। এই এগিয়ে আনা নতুন দিনক্ষণ নিলামে যোগ দিতে ইচ্ছুক অনেক সংস্থাকে বিপদে ফেলে। টেলি-কম দপ্তর এরপর সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, আগে-এলে-আগে-পাবে ( First-come-First-Serve) ভিত্তিতে এই নিলামটি সম্পন্ন করে! যোগ্যতা সম্পন্ন অনেক সংস্থাই অভিযোগ করে যে টেলি-কম মন্ত্রক তার কাউন্টার নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে বন্ধ করে দেয়, ফলে বেশ কয়েকটি ইচ্ছুক সংস্থা যথাসময়ে হাজির থেকেও এই নিলামে অংশ নিতে পারে নি!
মন্ত্রী মহাশয় শ্রী রাজা যখন এই সব কান্ড ঘটাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে ভারতের টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা, “ট্রাই” (TRAI) এবং ভারতের অর্থ মন্ত্রক এই সব বে-আইনি কাজ করতে নিষেধ করে।
ফলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দাঁড়ালো এই রকমঃ সোয়ান নামক সংস্থার শাহেদ বালোয়া “কালাইগ্নার প্রাইভেট লিমিটেড” নামে যে সংস্থাটি চালাতো সেটি এক বিরাট বরাত পায়। এই সংস্থা চালাতো ডিএমকে দলের সুপ্রিমো-করুণানিধির পরিবার। বলাই বাহুল্য, রাজা সাহেব এই ডিএমকে দলের সাংসদ। করুণানিধি-র কন্যা, কানিমজি দেখা গেলো এই কালাইগ্নাত টিভি সংস্থাটি খুলেছেন আর এই সংস্থাটি রাজা-র সৌজন্যে এক বড়ো বরাত পেয়ে বসে আছেন। পরে সিবিআই সূত্রে আরও জানা যায় যে রাজা নাকি এই লেন-দেন মসৃণ ভাবে সম্পন্ন করার জন্য ৩০০০ কোটি টাকা পেয়েছেন! তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং রাজা-কে ২ নভেম্বর, ২০০৭-এ লেখা এক চিঠিতে স্পষ্ট করে বলেন যে এই নিলামে যেন সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকঠাক দর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী ঘটনা দেখিয়েছে যে টেলিকম মন্ত্রী রাজা সাহেব প্রধানমন্ত্রীর সেই উপদেশ মানেন নি। নভেম্বর ২২, ২০০৭ ভারতের অর্থ মন্ত্রক এই নিলামে যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানায়। পরবর্তীকালে এই কেলেংকারির কথা যখন জানাজানি হয়ে যায়, তখন অক্টোবর ২১, ২০০৯-এ সিবিআই একটি এফআইআর রুজু করে, এবং ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজা, কানিমোজি সহ অনেককে তিহার জেল-এ পাঠানো হয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার কেন্দ্রে আসীন হয় এবং ডিসেম্বর ২১, ২০১৭ সালে রাজা, কানিমোজি সহ প্রায় সব অভিযুক্তরাই বেকসুর খালাশ পেয়ে যায়! সিবিআই অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছে, কিন্তু সেই মামলার অগগতি হচ্ছে ধীর গতিতে। এটি মামলার অনেক দিকের একটি দিক মাত্র।
সিবিআই-এর অভিযোগপত্রে নাম ছিল “রিলায়েন্স এডিএ” গোষ্ঠীর, মালিক কে বা কারা হতে পারে, তা রিলায়েন্স নাম দেখেই মালুম হচ্ছে। অনিল আম্বানির রিলায়েন্স এডিএ গোষ্ঠী, কর্পোরেট জগতের যে চালু অনুশীলন, অর্থাৎ একটি কম্পানির আওতায় আরও গাদা কোম্পানি খুলে, সব বরাত বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, যার ফলে কাউকেই নির্দিষ্ট করে ধরা মুশকিল, সেই পরিচিত পথই গ্রহণ করে। দেখা যায় যে তারা একটি কোম্পানিকে টাকা দিয়েছে এই বরাতে অংশ নিতে ( এই কোম্পানিটি, বলাই বাহুল্য, আম্বানি গোষ্ঠীর, শুধু অনিল আম্বানির পরিবর্তে এখানে নীতা আম্বানি মূল মালিক!), এই টাকা সে আবার অন্য একটি আম্বানির কোম্পানিকে দিয়েছে, এর মধ্যে কয়েকটা বিদেশি কম্পানিকে তার জুটিয়ে এনেছে, ইত্যাদি। রিলায়েন্স এডিএ-র বিরুদ্ধেও সিবিআই মামলা করে।
যে কম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রকৃত ন্যায় বিচারের স্বার্থে মামলাতে তার স্থান হওয়া উচিৎ অভিযুক্ত পক্ষে। কিন্তু আমাদের এই হবুচন্দ্র রাজার দেশে আইন-কানুন সবই উলটো। সিবিআই এই মামলায় অভিযোগকারী, তারা রিলায়েন্স কম্পানির কর্ণধার শ্রী অনিল ধীরুভাই আম্বানি, যাঁর ন্যায্যত স্থান অভিযুক্ত পক্ষে, তাঁকে অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে স্বাক্ষ্য দিতে ডাকে। অর্থাৎ, এখন অনিল আম্বানিকে, তাঁর বিভিন্ন কম্পানির বিভিন্ন আধিকারিকদের আর্থিক নয়ছয়ের বিরুদ্ধে কোর্টের কাছে হলফ করে সত্যি কথা বলতে হবে! এই না হলে দোসর!
স্বভাবতই, সিবিআই অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে “উৎকোচ” নেওয়া সংক্রান্ত কোনও স্বাক্ষ্য আদালতে পেশ করতে অপারগ বলে জানায় এবং অনিল আম্বানিকে এই মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়।
এইবার আমরা ফিরে আসি অতীত থেকে বর্তমানে, কোভিড-কাল শুরুর ঠিক আগের সময়ে, যখন মোদি সরকার নিজেকে কেন্দ্রে এবং বেশ কয়েকটি রাজ্যে নিজেদের সংহত করতে পেরেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের শেষে এসে দেখা যায় যে মুকেশ আম্বানি এই চার বছরে নিজের ঐশ্বর্য প্রায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১৪ সালে তাঁর ঐশ্বর্যের পরমাণ ছিল ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর ২০১৯-এর মার্চে দেওয়া কোম্পানির নিজস্ব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে তা বেড়ে হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই তথ্য আমাদের আরও একটি চিত্তাকর্ষক তথ্যের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়। ধীরুভাই আম্বানি যখন তাঁদের ব্যবসার পত্তন করে আজ থেক আন্দাজ ৬০ বছর আগে, সেই সময় থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এই আম্বানি গোষ্ঠী ব্যবসা করে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে যতো ঐশ্বর্য বাড়িয়েছে, মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরেই তারা তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে! মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে আম্বানি গোষ্ঠী দিনে গড়ে ১২২ কোটি টাকা কামিয়েছে। এই বিষয়ে অনিল এবং মুকেশ আম্বানি বারম্বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিতে ভোলেন নি।
এই ভেলকি কীভাবে ঘটতে পারলো? সেপ্টেম্বর ২০১৬, মোদি সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। আম্বানি-র রিলায়েন্স জিও প্রকল্প চালু হলো। নরেন্দ্র মোদি তাঁর সহাস্য মুখ দিয়ে রিলায়েন্সের বিজ্ঞাপনে উপস্থিত হলেন, তাঁর পরণে রিলায়েন্সের লোগো-ওয়ালা কুর্তা! ২০১৮ সালে এসে দেখা গেলো যে জিও-র গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে রকেটের গতিতে, কেননা কেবলমাত্র জিও-র জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে এবং অন্যদের দাম বাড়াতে বাধ্য করে রিলায়েন্স-কে অন্যায্য সুবিধে করে দেয় “ট্রাই” সংস্থা, তার বিতর্কিত “ট্যুইকিং পলিশি” মারফৎ। জিও-র বাণিজ্যিক পরিষেবা শুরু হওয়ার একমাসের মধ্যেই “ট্রাই” তার নীতি ঘোষণা করে বলে যে অতঃপর জিও ফোন থেকে অন্যান্য পরিষেবা প্রদানকারী ফোনের গ্রাহকদের ফোন করলে অন্যান্য মোবাইল সংস্থার চেয়ে ৫০ শতাংশ কম খরচা পড়বে। ফল দাঁড়ালো, যে সমস্ত পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলি সরকারকে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে তাদের পরিষেবার মুল্য নির্ধারণ করেছিল, সেই সন সংস্থার গ্রাহকদের গ্রাহকদের এখন জিও, কম খরচার লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনতে পারবে এবং তা পারবে পুরোপুরি সরকারি সহযোগিতায়। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো সরকারের, কেননা এখন জিও সংস্থা, প্রায় বিনা পয়সায় সরকারি সংস্থা, বিএসএনএল-এর পরিকাঠামো ব্যবহার করতে শুরু করলো এবং জিওকে বাধ্যতামূলক পরিষেবা দিতে গিয়ে বিএসএনএল-এর পরিষেবার মান কমতে থাকলো ক্রমশ, তাদের বিপুল গ্রাহক এখন গিয়ে ভীড় জমালো জিও-র দরজায়। তাই আজ আমরা সহজেই বুঝতে পারি, বিএসএনএল-এর মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকে এমন দক্ষ একটি সংস্থা কেন উঠে যাওয়ার মুখে। আর একটা কথা বলা বোধহয় এখানে নেহাৎ অপ্রাসংগিক হবে না। বিএসএনএল-কে কোনও স্পেক্ট্রাম নিলামেই সরকারের পক্ষ থেকে অংশ নিতে দেওয়া হয় নি, যদিও যে সব সংস্থা এই “নিলাম”-এ অংশ নিয়েছে, প্রযুক্তিগত ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বিএসএনএল ছিল সবচেয়ে সেরা। ২০১৬ সালে জিও যে প্রকল্প বাজারে আনতে চলেছিলো, সেটি তখনও ছিলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে। জিও যখন সেই পরীক্ষার স্তরে, তখন “ট্রাই” আচমকাই এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে যে অন্যান্য মোবাইল কোম্পানিগুলি জিও-কে তার কাজ চালানোর জন্য “যথেষ্ঠ পরিমাণে সংযোগ-বিন্দু দিচ্ছে না, ফলে জিও-র ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। অতএব, এখন এই সব মোবাইল কোম্পানিগুলিকে জিও-র বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ৩০০০ কোটি টাকার জরিমানা দিতে হবে”। এখানে মনে রাখা দরকার যে অন্যান্য মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে সরকারের মধ্যস্থতায় জিও-র সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তার ফলে আগামী ৯০ দিন জিও-র যতগুলি সংযোগ-বিন্দু পাওয়ার কথা, সেগুলি সবই তারা পেয়েছিল। কিন্তু “ট্রাই” তার এই জরিমানা চাপায় চুক্তিমতো ৯০ দিন পার হওয়ার আগেই! দোসর পুঁজি হওয়ার সুবাদে রিলায়েন্স জিও সরকারের কাছ থেকে এই অন্যায্য মদত এবং সম্পূর্ণ বেআইনি আর্থিক সুবিধা পায়। কিন্ত দোসর পুঁজির মোদি সরকারের কাছ থেকে চাহিদা ছিল আরও বেশি, নির্বাচনের সময় তারা এক বিপুল অঙ্কের টাকা এবং অন্যান্য পরিকাঠামোগত সুবিধা তো ব্যক্তিগতভাবে মোদি-কে এমনি এমনি দেয় নি। মোবাইল ক্ষেত্রে জিও-কে একচেটিয়া করার দাবি নিয়ে এরপর আম্বানিরা মোদি-র কাছে যায়। এই কাজ করার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল “ট্রাই”-এর “মার্কেট পাওয়ার” নির্ধারণ করার নিয়মাবলী। সরকারের চাপে “ট্রাই” এই নিয়মের ঠিক সেই সব পরিবর্তন করে, যা রিলায়েন্স জিও-কে বাড়তি এবং অন্যায্য সুবিধা দেবে। জিও-র “ভলিউম অফ ট্র্যাফিক”, বা কী পরিমাণে তথ্য তার নিজস্ব পরিকাঠামোর মাধ্যমে বিনিময় হচ্ছে এবং “ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা”, এই দুই বিষয়ে জিও তার প্রতিযোগীদের ধারে-কাছেও পৌঁছয় নি। এই দুই বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট মান না ছুঁতে পারলে কোনও মোবাইল কোম্পানি অন্যদের তুলনায় একতরফাভাবে তার “কল”-এর দাম ইচ্ছামতো নির্ধারণ করতে পারে না। “ট্রাই” দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই দুই উপাদানকে অতঃপর হিসেবের বাইরে রাখা হলো বলে ঘোষণা করে, এবং জিও, অন্যান্য মোবাইল সংস্থার থেকে সরকারের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পেতে থাকে, যেমন রিলায়েন্স যখন সরকারি সংস্থা বিএসএনএল-এর সংযোগ-বিন্দু ব্যবহার করবে, তখন জিও তা ব্যবহার করবে বিনা পয়াসায়, কিন্তু বিএসএনএল যখন রিলায়েন্সের সংযোগ-বিন্দু ব্যবহার করবে, তখন বিএসএনএক-কে অন্যান্য মোবাইল সংস্থাকে এই বাবদে যত পয়সা দিতে হয়, জিও-কে তার থেকে বেশি দিতে হবে। এছাড়া বিএসএনেল-কে মাসে বাধ্যতামূলকভাবে বেশ কিছু ঘণ্টা জিও-কে এই সুবিধা দিতে হবে এবং জিও থেকেও বাধ্যতামূলকভাবে দিনের বেশ কিছু ঘন্টা জিও-র থেকে সুবিধা নিতে হবে! মনে রাখা দরকার, বিএসএনএল-এর দুর্গতি শুরু হয় ২০১৮ থেকে, যখন সরকার বিএসএনএল-কে বাধ্য করে তার নিজের ক্ষতি করে জিও-র লাভ বাড়ানোতে সাহায্য করতে! মুকেশ আম্বানির এমন চিত্তাকর্ষক উত্থান যে মোদির সহায়তা ছাড়া ঘটতে পারতো না, তা আম্বানির মুনাফার দিকে নজর করলেই বোঝা যায়। ২০১৪ থেকে ২০১৬, এই দু বছরে আম্বানির “নেট ওয়ার্থ” বা মূল আর্থিক সামর্থ মোটেই বাড়ে নি, তা স্থির ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। এরপর মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও ব্যবসায়িকভাবে কাজ শুরু করে। প্রথম দু বছরেই সেই আর্থিক সামর্থ বেড়ে হয় ৫৫ বিলিয়ন ডলার, দু বছরে বাড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলার!
শুধু যে আম্বানি এই সুযোগ নিয়েছে তাই নয়। রাশিয়ার জারের পত্নীর যেমন ছিল “সন্ত রাসপুটিন”, আমাদের মোদির তেমনি আছেন “বাবা রামদেব”। তাঁর আর্থিক সাম্রাজ্যও মোদির আমলে বেড়েছে হু হু করে। জাতি-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাশাপাশি অবৈজ্ঞানিকতাকে তোল্লাই দিয়ে “বাবা”-র বিলিওনিয়ার হওয়ার ঘটনাটিও ঘটেছে এই মোদি আমলেই, যা দোসর পুঁজি-র এক অন্য রূপ বলা যায়। অন্যদের ক্ষেত্রে যদিও ব্যবসা-বাণিজ্যের যত দুর্নীতিগ্রস্ত ঘরানাই হোক না কেন, একটা ঘরানা তবু ছিল। কিন্তু বাবা রামদেব এই ক্ষেত্রে একেবারেই ভুঁইফোড়, তিনি দোসর পুঁজি হয়ে উঠেছেন এই মোদির আমলেই! ফিরে যাই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আসন্ন দিনগুলিতে। সারা ভারতের, বিশেষত দেশের হিন্দি চ্যানেলগুলিতে বাবা রামদেব-এর “যোগাভ্যাস” ও “তার ভারতীয়ত্ব ও মুনি-ঋষিদের পরম্পরার কথা” ২৪ x ৭ প্রচারিত হয়েছে। এদেশের “ধর্মপ্রাণ” নাগরিকবৃন্দ সেই প্রচারে আপ্লুত হয়ে রামদেবকে আধুনিক ঋষি ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। এ হেন রামদেব হিন্দি বলয়ে প্রবল বিক্রমে ( কু-লোকে বলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ মদতে) “ মোদি সরকার এইবার” প্রচারে সারা দেশ চষে বেড়াতে লাগলেন। সভার আগে যোগাভ্যাস, সভার মধ্যে ভুল সংস্কৃত ভাষায় “আয়ুর্বেদ” উচ্চারণ এবং যোগাভ্যাস দিয়ে সভা ভঙ্গ। এই ঘটনা চললো পুরো নির্বাচনের সময় জুড়ে। বাবা রামদেব যে বিজেপি-র নির্বাচনী প্রচারের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি দিল্লির সিংহাসন দখলের পর শ্রী আমিত শা মহাশয় বাবা-কে ধন্যবাদ দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিজেপি-র এই বিজয়ের পেছনে বাবা ‘contributing significantly to the formation of the Narendra Modi government at the centre’. রামদেব-এর অধ্যত্ম-সম্পৃক্ত হিন্দুত্ব, এবং বিজেপি-র আগ্রাসী হিন্দুত্ব যেন দুটি বিভাগকে পাশাপাশি সামলানোর “রণ-কৌশল”! এরপর রামদেব দেশে “হিন্দুত্ব”-র উথানকে তাঁর নিজের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য নির্মাণের কাজে লাগান। শুরু হয় সরকারি মদতে “পতঞ্জলি” ব্র্যান্ড-এর আবাহন।
এই “পতঞ্জলি” ব্র্যান্ডের উদ্গাতা রামদেব, যার বর্তমান “মালিক”, অবশ্যই বকলমে, রামদেব-এর সৈন্যবাহিনির যিনি সেনাপতি, সেই “আচার্য বালাকৃষ্ণ”। আম্বানির ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি, একটার পর একটা কোম্পানি খুলে আম্বানিরা কে মালিক আর কে অধীনস্থ তা বোঝার জো রাখে নি, ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কে মূল অপরাধী তা ধরার বিষয়টি গুলিয়ে দিয়েছে, “পতঞ্জলি” সংস্থাটিও দোসর পুঁজির এই বৈশিষ্ট্যটি, বরং বলা যায়, “পরম্পরা”-টি বহন করছে। “পতঞ্জলি” ব্র্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় ৩৪টি সংস্থা, তিনটি ট্রাস্ট। এই সব ট্রাস্ট ও সংস্থার “বেনিফিসিয়ারি” বা সুবিধাভোগী আসলে একজন ব্যক্তি, তিনি রামদেব-এর ভাই এবং অবশ্যই “আচার্য বালাকৃষ্ণ”। রামদেব-এর ভাই লাভের ভাগ বা “ডিভিডেন্ট” পান ৬০ শতাংশ হারে! অবশ্যই রামদেব-এর লিখিত নির্দেশ ছাড়া “পতঞ্জলি” সংস্থার কোনও কাজই হয় না।
মোদির উত্থানের আগে আমাদের খাদ্য বাজারে পতঞ্জলি-র উপস্থিতি শতাংশের হারে নির্ধারণ করা যেত না, কেননা যাকে “মার্কেট শেয়ার” বলে, ভারতে রামদেব-এর পতঞ্জলি-র স্থান ছিল ০.০১৯ শতাংশ! ২০১৪ থেকে ২০১৮, এই সময়সীমায় তা বিলিয়ন ডলার ব্যবসায় পর্যবসিত হয়। এই সময়কালে “পতঞ্জলি”-র “নেট ওয়ার্থ” গিয়ে দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন ডলার! ২০১৪ সালের আগে সংস্থাটি “আয়ুর্বেদিক” উপাদান হিসেবে জটি-বুড়ি আর ফলের জেলি বেচতো। মোদির প্রথমবারের মন্ত্রীত্বের আমলে কোম্পানি দাঁত মাজার পেস্ট, গায়ে-মাখা ও কাপড়-কাচার সাবান, আটা, গম, চাল, মধু, ভোজ্য তেল ইত্যাদি সব খাদ্য সম্ভারের বিশাল ডালি এনে ফেলেছে, রয়েছে বেবি পাউডার, বিস্কুট, কর্ণ-ফ্লেক্স। তালিকা বিরাট। সম্পূর্ণ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সংস্থাটি ভারতের খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, “ফাসি”-র কাছ থেকে ছাড়পত্র জোগাড় করেছে। পতঞ্জলি-ব্রান্ডের খাদ্যে ভেজাল সহ অনেক ক্ষতিকর জিনিসের অস্তিত্ব ধরা পড়া সত্ত্বেও সরকারি মদতে পতঞ্জলি তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে! সম্প্রতি পতঞ্জলি “ভারতীয় সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে” রদ্দি মার্কা জিন্স বাজারে এনেছে, বিজেপি মন্ত্রীসভার একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ঘোষণা করেছেন, সরকারের যে সব অনুষ্ঠানে এতদিন খাদি ব্যবহৃত হতো, সেখানে ক্রমে ক্রমে এই “ভারতীয় সংস্কৃতি-উদ্বুদ্ধ” পতঞ্জলি জিন্স ব্যবহার করা হবে! আমরা জানি যে হিটলার তাঁর আত্মজীবনী সব সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁর প্রকাশকের কাছ থেকে কিনে বিতরণের ব্যবস্থা করেন, ফলে গ্রন্থস্বত্ত্ব থেকে তাঁর লাভের পরিমাণ ছিল বেশ কিছু লক্ষ জার্মান মুদ্রা মার্ক, প্রতি মাসে! আম্বানি যেমন মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলির “মার্কেট শেয়ার” গিলে নিয়েছে, পতঞ্জলির জন্য সেই একঈ কথা প্রযোজ্য।
এখন ( কোভিড কালের আগের বছর গুলিতে) মোদি সরকার সংসদের রান্নাঘরে পতঞ্জলি-র জিনিশ কেনা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। সরকারি ভোজসভায় পতঞ্জলি-র কাছে থেকে খাবার আসে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিপনন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে পতঞ্জলি-র ছাড়া অন্য ব্র্যান্ড সুলভ নয়, সামরিক ক্যান্টিনে এবং সামরিক বাহিনির জন্য “ন্যায্য মূল্যের” দোকানে ৭০ শতাংশ জিনিশ পতঞ্জলির!
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে এবং দিল্লিতে ২০১৫-র গোড়া থেকে ২০১৯ এর শেষ পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে এই পতঞ্জলি সংস্থা তার “দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কারখানা করার জন্য” সর্বমোট ২০০০ একর জমি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিনা পয়সায় এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি বিঘা-পিছু ১ থেকে ১০ টাকা দামে দীর্ঘকালীন লীজ বা জলের দরে দিয়ে দিয়েছে। পতঞ্জলি-র কারখানাগুলি পাহারা দেয় সিআইএসএফ, যাদের কেবল সরকারি সংস্থায় পাহারা দেওয়ার কথা। এই সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকার পতঞ্জলি সংস্থার কাছ থেকে কোনও অর্থ নেয় না, খরচ মেটানো হয় সরকারি অর্থকোষ থেকে। সরকারি অর্থ ব্যয় করে হরিদ্বারে একটি ফুডপার্ক গড়ে সেটি পতঞ্জলি সংস্থাকে স্রেফ “দান” করে দেওয়া হয়েছে, এই ফুডপার্ক যাবতীয় সরকারি বরাত পায় কোনও টেন্ডার ছাড়াই!
অন্য কোনও সময়ে আমরা আরও অনেক দোসর পুঁজির মালিকদের অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বলবো। ২০১৪ থেকে “স্বদেশিয়ানা” ও “হিন্দুত্ব”-র নামে যে সংগঠিত লুঠপাট চলছে, তাকে বেপর্দা করা সহজ নয়। তথ্য গোপন, ভুল তথ্য দেওয়া, তথ্য জানতে চাইলে স্রেফ হত্যা করা, এই সব ধূম্রজাল ভেদ করে নোংরা কাজ-কারবার বেপর্দা করার কাজটি দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়ছে, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দোসর পুঁজির রমরমা!