পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সারা রাজ্য এমনকি দেশেও উথালপাতাল চলছে। তা চলারও কথা। শিক্ষামন্ত্রীর অতিঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’র কাছ থেকে অর্ধশত কোটি টাকা উদ্ধার, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের শীর্ষ পদাধিকারী এবং তৃণমূল বিধায়কের নামে বেনামে বিপুল সম্পত্তির হদিশ এসব মিলিয়ে শাসক দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষকরাই সমাজ গড়েন তাই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ফলে সমাজে অশিক্ষা ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে এমন জনপ্রিয় চর্চা সর্বত্র শুরু হয়ে গিয়েছে। মিম তৈরি হয়েছে, রসিকতা চলছে চেহারার সৌন্দর্য এবং/বা কুরূপ নিয়ে। কিন্তু কেউ বলতে চাইছে না বা খুঁজতে চাইছে না আদতে এই দুর্নীতির উৎস কোথায়।
বেসরকারি ক্ষেত্রে অতি মুনাফার জন্য শ্রমিক শোষণ, কাজের সময়ের কোনো ঠিকঠিকানা না থাকা, পান থেকে চুন খসলেই ছাঁটাই, ট্রেড ইউনিয়ন না করতে দেওয়া, স্থায়ী নিয়োগের বদলে ক্রমাগত অস্থায়ী নিয়োগ করা এসব কি দুর্নীতি? না এগুলো দুর্নীতি নয়-কোনো পরিভাষাতেই নয়। কেননা, দুর্নীতির সংজ্ঞায় মূলত অর্থ বা উৎকোচের বিনিময়ে সুবিধা প্রদান, চাকুরি বা কন্ট্রাক্ট বা ঋণ পাইয়ে দেওয়া অন্তর্ভুক্ত। উপরে বর্ণিত সর্বত্র বিরাজমান দুষ্কর্মগুলি তো তেমনটা নয়। কিন্তু ওই কাজগুলির ফলে তো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী মালিকের মুনাফা বাড়ে। ফলে অর্থ ওখানেও ওই দুষ্কর্মগুলি করার চালিকাশক্তি। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের তো ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার উপায় নেই বললেই চলে। ফলে দেশের কেবল ১০ শতাংশের মত শ্রমিক কর্মচারির ট্রেড ইউনিয়ন করার উপায় আছে। কিন্তু সংগঠিত বেসরকারি ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ২ কোটির উপরে হলেও তার অর্ধেকও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নয়। তার মূল কারণ মালিক ও ম্যানেজমেন্টের রক্তচক্ষু, ইউনিয়ন করতে গেলেই ছাঁটাইয়ের হুমকি। যাই হোক, মালিকপক্ষের এসব গুন্ডামি ধমক চমকতো দুর্নীতি পদবাচ্য নয়। অতএব তা আলোচনা থেকে বাদ।
বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা সমস্ত সরকারি কর্মচারির অর্ধেকের বেশি হবে বলে আন্দাজ করা যেতে পারে। আন্দাজ বলছি এই কারণে যে, ভারত সরকারের শ্রম ও নিয়োগ মন্ত্রক ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মীদের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মধ্যে ভাগাভাগি করে প্রকাশ করত। ওই বছরে সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ ছিল ১.৭৬ কোটি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে ১.২ কোটি। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ ক্রমাগত কমেছে, ১৯৯৬-৯৭ সালে ১.৯৬ কোটি থেকে কমে ১.৭৬ কোটিতে এসেছে, বেসরকারি ক্ষেত্রে তা ৮৭ লক্ষ থেকে বেড়ে ১.২ কোটি হয়েছে। তাই ২০১৯-২০ সালে যখন সংগঠিত ক্ষেত্রে সামগ্রিক নিয়োগের সংখ্যাটি ৪.২৪ কোটি, এবং সরকারি ক্ষেত্রকে ধারাবাহিকভাবে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে তখন ধরাই যেতে পারে বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মী সংখ্যা সরকারি ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
যাই হোক, প্রশ্নটা ওই কমবেশির নয়, প্রশ্নটা নিয়োগের, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের, নিয়োগে দুর্নীতির। বেসরকারি ক্ষেত্রের নিয়োগ সেই সংগঠনের নিজস্ব রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী হয়। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পোদ্যোগের নিয়োগেও জনসাধারণের থেকে দরখাস্ত চাওয়া হয় বলে জানা নেই আমার। কখনো ওএনজিসি, ইন্ডিয়ান অয়েল বা বিএসএনএলএর করণিক নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেখিনি। হতে পারে তার জন্য কোম্পানির দফতরে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়, এবং এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে নাম কা ওয়াস্তে নাম জোগাড় করা হয়। বড় বড় বেসরকারি কোম্পানিগুলি, যেমন টাটা, রিলায়েন্স, আদানি, ইউনিলিভার, আইটিসি ইত্যাদি কোম্পানিগুলি কীভাবে কর্মী, বিশেষত নন-ম্যানেজারিযাল কর্মী নিয়োগ করে? অবশ্যই গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে ‘মেধা’র ভিত্তিতে নয়। তাহলে অগণিত বেকারের মধ্য থেকে কোন জাদুবলে তারা কতিপয়কে নিয়োগ করে? নিশ্চিতভাবে পরিচিতজনের মধ্য থেকে করে বা অন্য কোনো ভিত্তিতে করে। ফলে ‘মেধার’ ভিত্তিতে সর্বজনের মধ্য থেকে তালিকা প্রস্তুত করে করার প্রক্রিয়া সেখানে অনুপস্থিত। একে কি ‘স্বজনপোষণ’ বলা হবে, এটা কি দুর্নীতি হিসেবে ধরা হবে? না, কারণ এই বড় কোম্পানিগুলি পাবলিক লিমিটেড হলেও সরকারি নয়, তাই দেশের আইনবলে তাদের এরকম নির্বাচনের অধিকার আছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্বিক স্বচ্ছতা, ‘মেধা’র ভিত্তি এসব কর্মী ও কোম্পানির দক্ষতার সঙ্গে সমার্থক নয়। বহমান ব্যবস্থায় সংগঠনের নিম্নস্তরের কর্মীদের খাপ খাইয়ে নেয় তারা।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল শিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগের আবাহনের সঙ্গে ‘দুর্নীতি’র যোগ। বর্তমান শতাব্দীর গোড়া থেকেই বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজের ব্যবসা শুরু হয়েছে। তা বহরে বেড়েই চলেছে। ওই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিজ্ঞাপনের অন্যতম বিষয় হল ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট। সারা দেশের বাণিজ্যিক শিক্ষার জগতে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট অতীব কাঙ্খিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান যত বেশি ক্যাম্পাসে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির করা পরীক্ষা ও সাক্ষাতকারের মাধ্যমে ছাত্রদের চাকুরি দিতে পারবে তত বেশি সেই প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আসন ভর্তি করা কঠিন হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের প্রলোভন তাদের ইউএসপি। ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট অবশ্যই সমস্ত ইঞ্জিয়ারিং গ্রাজুয়েট বা ম্যানেজমেন্ট উত্তীর্ণদের সাধারণ পরীক্ষার ভিত্তিতে নেওয়া হয় না। সুতরাং সকলে ওই সমস্ত চাকুরির আবেদনকারী হতে পারে না। সমস্ত কোম্পানি সব কটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যায় না । তাহলে এক্ষেত্রে ‘মেধা’র ভিত্তি কীভাবে নির্ধারিত হয়? অবশ্যই অর্থ অনেকাংশেই এখানে মেধার ভিত্তি হয়ে ওঠে। সাধারণত যে প্রতিষ্ঠান যত আকর্ষণীয় সেখানে পড়াশোনার খরচা তত বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠান কোম্পানিগুলির কাছে প্লেসমেন্টের জন্য তদ্বির করে। এবং সেই তদ্বির কীভাবে কার্যকরী হয় তা কেবল ধারণাই করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনো অনৈতিক কিছু হয় না তা বলা যায় কি? অবশ্য তেমনটা হলেও তাতো দুর্নীতি নয়, কারণ ওগুলি তো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়।
শিক্ষণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রমরমা শুরু হয়েছে। যেহেতু সরকারের বিভিন্ন দফতরে চাকুরি প্রায় নেই বললেই চলে তাই শিক্ষিত যুবতী যুবকের কাছে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা চাকুরি হিসেবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু শিক্ষকতা করতে গেলে বিএড বা ডিএলএড পাশ করা আবশ্যিক। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ টিচার্স এডুকেশন (এনসিটিই) তেমনটাই নিয়ম করেছে। আগেকার মত শিক্ষকতার চাকুরি পাওয়ার পরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিলে চলে না। এখন শিক্ষকতার চাকুরির জন্য দরখাস্ত করার আগেই বিএড বা ডিএলএড পাশ করতে হবে। ওই যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ করে দিতে সারা দেশেই রাজ্যে রাজ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলার বন্দোবস্ত করা হয়। এরাজ্যে প্রায় ৬ শত অনুরূপ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিএলএড পরার কোর্স ফি লাখ খানেক ও বিএডের জন্য লাগে দেড় লাখ টাকা। দুটি কোর্স মিলিয়ে লক্ষাধিক হবু শিক্ষক ফি বছর চাকুরি প্রার্থী হয়ে আসে। তারপরে তারা টেট বা এসএলএসটি পরীক্ষায় বসে শিক্ষকতার চাকুরি পাওযার জন্য। উল্লেখযোগ্য যে শহুরে মধ্যবিত্তরা তাঁদের সন্তানদের যে সব বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান সেই সব বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতায় ডিএলএড বা বিএড আবশ্যিক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়। তাছাড়া, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো গণবিজ্ঞপ্তি জারিও করা হয় না, কোনো ‘মেধা’র ভিত্তিতে নিয়োগও করা হয় না। যেহেতু সরকারি নয় তাই এসব নিয়োগ দুর্নীতির বাইরে থাকে ও শিক্ষাক্ষেত্র কলুষিত হয় না; বিদ্যালয়গুলিও সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলির তুলনায় বার্ষিক ১ হাজার গুণ ফিস নিয়ে থাকে।
বেসরকারি বিএড বা ডিএলএড প্রতিষ্ঠানগুলিও বাণিজ্যিক ভিত্তিতেই চলে। কিন্তু সেখানে ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের কোনো বন্দোবস্ত নেই। সেই খামতি পূরণ করতে উপস্থিত হয়েছে দালাল ফড়েরা। যদি পূর্বের ন্যায় ইচ্ছুক উচ্চমাধ্যমিক পাশ , স্নাতক বা স্নাতকোত্তর যুবতী যুবকরা সকলেই উপরোক্ত টেট/এসএলএসটি পরীক্ষায় বসার জন্য আবেদন করতে পারত তাহলে দালাল বা ফড়েদের উৎকোচ দিতে ইচ্ছুক প্রার্থী খুঁজে বের করার জন্য যে ঝামেলাটুকু পোয়াতে হত সেটিকেও সহজ করে দিয়েছে এই বিএড/ডিএলএড প্রতিষ্ঠানগুলি। উৎকোচ দিতে ইচ্ছুক এমন লোককে খুঁজতে কেবল ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠরতদের মধ্যে বেছে নিলেই হবে। অর্থাৎ দালাল/ফড়েদের জন্য ক্যাপটিভ অডিয়েন্স যোগাড় করে দিয়েছে বেসরকারি শিক্ষণ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি। সেই বন্দোবস্তের সূত্রপাত এনসিটিই-র শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ ও শিক্ষণ শিক্ষার বেসরকারিকরণ।
সাধারণ ডিগ্রি কলেজে পড়ার জন্য এরাজ্যে যেখানে ৩ বছরে ১৫-২০ হাজার টাকাও লাগে না, উচ্চ মাধ্যমিকে সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ২-৩ হাজার টাকা লাগে বিভিন্ন খাতে, সেক্ষেত্রে বিএড/ডিএলএডের জন্য অত অর্থ ব্যয় করতে হয় কেন? ওই প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই মুনাফার জন্য নয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করলেও তাদের উদ্দেশ্য মুনাফা করা, এটা সর্বজন বিদিত। ওই প্রতিষ্ঠানগুলির অনুমোদন ও তাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এসবেই যথেষ্ট অর্থের লেনদেন হয় এমনটা ধারণা করা কি অমূলক?
শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বেসরকারিকরণের ফলে শিক্ষা ব্যবসায়ীতে শিক্ষা জগত ভরে গেছে। ওই বন্দোবস্তে সঙ্গত করেছে কেন্দ্র রাজ্য সমস্ত ধরণের সরকারগুলি। যাঁরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন, কেবল সরকারি স্তরে দুর্নীতি নিয়ে মাথা ঘামান, তাঁরা বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্নিহিত দুর্নীতিগুলিকে দেখতে পান না, কারণ সরকারি কাজে ঘোটালা বা ব্যাঙ্কের অর্থ তছরূপ জাতীয় কাজ না করলে ওইসব দুর্নীতি দুর্নীতি নিরোধক আইনের আওতায় আসে না। কিন্তু ওই ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেই রয়েছে দুর্নীতির উৎস, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিও কোনো ব্যতিক্রম নয়।
ছবি ঃ ত্রিয়াশা লাহিড়ী