নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি তে ফেডেরালিজমের প্রশ্নটা আবার অনেকের মাথায় নতুন করে উঠছে। বিগত সাত বছরে কেন্দ্র যে ভাবে তার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করেছে সেটা রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে কিছু অসন্তোষ সৃষ্টি করলেও এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক ভাবে এর আগে ওঠেনি।
এটা তো জানাই কথা যে গুড্স এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) থেকে শুরু করে গত বছর অতিমারীর সুযোগ নিয়ে তড়িঘড়ি,অধ্যাদেশের মাধ্যমে যে ভাবে কৃষি ‘আইন’ গুলি জারি করা হলো তাতে রাজ্যগুলির আর্থিক অধিকার সংকুচিতই হয়েছে। শুধু তাই নয় কেন্দ্র সরকারের নিজের তথ্য থেকে জানা যায় যে রাজ্যগুলির পাওনা জিএসটির দুই লক্ষ কোটির বেশি টাকা বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে কেন্দ্র তার কাছেই রেখে দিয়েছে। (সুদেও আসলে সেটা আরো অনেক বেশি দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই অতিমারীর কঠিন অবস্থার মধ্যে যখন কেন্দ্র সমস্ত দায়িত্ব রাজ্যগুলির কাঁধের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে,সেই পরিস্থিতির মধ্যে আর্থিক সাহায্য দেওয়া তো দূরের কথা তাদের কে আরো পঙ্গু করার চেষ্টাই করা হয়েছে।
শুধু যে রাজ্যদের টাকা মেরে তাদের কাজ ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয়েছে তাই নয়, আরো দেখা গেলো যে হাজার হাজার মানুষের জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে কেন্দ্র সরকার অক্সিজেন আর ভ্যাকসিন নিয়েও নোংরা ধরণের রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও আরো অনেক মুখ্যমন্ত্রীরদের এই সব নিয়ে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। এমনকি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কে, অন্য কোনো রাস্তা না পেয়ে, প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের মিটিংয়ের একটি অংশ লাইভ করে দিতে বাধ্য হতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঠিক এই ভয়াবহ সময়ে যখন গোটা দেশ এই অতিমারীর বিপদের মোকাবিলার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে নতুন আইন জারি করে কেন্দ্র সরকার দিল্লি সরকারের ক্ষমতা কেড়ে উপ-রাজ্যপালের হাতে তুলে দিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে নির্বাচন হেরে যাওয়ার পর দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়াতে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তোলা এই একই মনোভাবের লক্ষণ।
সুতরাং গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের প্রশ্ন পটভূমিকা হিসাবে ছিলই - এবং তামিল নাড়ুর ডিএমকে জোট ও কেরালার বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ) রাজ্যের ক্ষমতার বিষয়টা তাদের প্রচারের মধ্যে তুলেছে। ডিএমকের রাজনীতি তে তো রাজ্যের শ্বশাসনের প্রশ্নটি চিরকালই একটা গুরুতবপূর্ণ বিষয় ছিল। এলডিএফ এবং বিশেষ করে সিপিআই (এম) এর ইতিহাসেও এই প্রশ্নটা একটা বিশেষ গুরুত্ব রাখে। বিশেষ করে ১৯৭৭ সালে বাম ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বহু বছর তখনকার কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গ্যে টানাটানি চলতো এবং একটা সময়ে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্গঠনের ব্যাপার তাদের আশু কর্মসূচির একটা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৮২র পরে অবশ্য সিপিএম সেটা বর্জন করে কারণ তাঁরা মনে করতে শুরু করলেন যে তাতে ‘বিচ্ছন্নতাবাদী’ শক্তিগুলির সুবিধা হবে।
সিপিএম-এর এই ধারণাটি সঠিক না বেঠিক সেই আলোচনায় এখানে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা এখন পরিষ্কার যে বিগত সাত বছরের - আর বিশেষ করে গত দুই বছরের - অভিজ্ঞতার ভিত্তি তে বলা যায় যে আজ যদি এটাকে সামনে রেখে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা না হয় তাহলে ভারতবর্ষের চরিত্রটাই পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে। আমাদের সমাজের বৈচিত্র ও অনেকত্ব আমাদের সুদীর্ঘ ইতিহাসে সমৃদ্ধ হতে পেরেছে কেবল এই কারণে যে আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো কখনোই কেন্দ্রীভূত ছিল না। ইতিহাসে দেখা গেছে যে ‘বিচ্ছন্নতাবাদী’ শক্তির আবির্ভাব তখনই হয় যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়। সিপিএম পার্টি হিসাবে এই ব্যাপারে তার মত পাল্টেছে কি না সেটা আসছে মাসগুলিতে বোঝা যাবে।
ইতিমধ্যে যে ব্যাপারটা আশান্বিত করে সেটা হলো এই যে ২০২৪ এর প্রস্তুতি পর্বে খেলাটি পার্টিগুলির আমলাদের হাতে না থেকে তাদের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের চলে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পিনারাই বিজয়ন, এম কে স্টালিন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল দের মতো কতগুলি অ-কংগ্রেসী নেতাদের ক্ষমতায় থাকাতে একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি সামনে এসেছে। এদের প্রত্যেকের সন্বন্ধে আমাদের সমালোচনা থাকতে পারে কিন্তু তারা যে কাজগুলি করেছেন (স্টালিন তার সুযোগ পান নি এখনও) সেগুলি একটা ভবিষ্যৎ কর্মসূচির দিকে ইঙ্গিত করে।
দিল্লিতে কেজরিওয়াল সরকার অন্য কতগুলি ব্যাপারে হতাশ করলেও টানা ছয় বছর ধরে শিক্ষার ওপর তার বাজেটের একচতুর্থাংশ বরাদ্দ করে সরকারি স্কুল শিক্ষার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। তার ফলে কয়েক বছর ধরে সরকারি স্কুলগুলির রেজাল্ট প্রাইভেট স্কুলের থেকেও ভালো আসতে শুরু করে। জন -স্বাস্থ্যর ক্ষেত্রে ও তাদের কাজ উল্লেখযোগ্য ছিল যদিও এখন অতিমারীর চাপে সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো দিল্লিরটাও অনেকটা ভেঙে পড়েছিল। অন্যদিকে পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে কেরালা যে ভাবে দুই দুইটা বন্যা, নিপাহ ভাইরাস এবং এই অতিমারীর সংকট মোকাবিলা করেছে তাতে রাজ্যে অনেকেই এলডিএফ কে এবার আরো বেশি ভোট জয়ী করেছেন। ঠিক এভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের নানান ধরণের জন-কল্যাণ মূলক পদক্ষেপ, মেয়েদের শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে দলিত ও মাইনোরিটি ছাত্রদের জন্য ফেলোশিপ ইত্যাদি একটা পথ দেয় যার ফলে গোটা রাজ্যে বেশ ভালো রকম অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
অ -কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীদের এবং নেতাদের কথা এইখানে এ জন্যও বলা দরকার কারণ দেখা যাচ্ছে যে যেখানে যেখানে কংগ্রেসের সঙ্গ্যে বিজেপির প্রতিযোগিতা সেখানে সেখানেই তার সুবিধা হচ্ছে। কংগ্রেসের পতনের সাথে বিজেপির আবির্ভাব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে। সে কারণে নতুন কোয়ালিশনে কংগ্রেসের প্রধান ভূমিকা না থাকাই ভালো। এমনিতেই দলের অবস্থা ভালো নয়। কয়েক মাস আগে তেইশ জন নেতারা যেভাবে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলেছেন তাতে কিন্তু খুবএকটা ভরসা হয়না। তার প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে এদের মধ্যে কারও জনগণের মধ্যে কোনো সমর্থন নেই আজও যা জনসমর্থন আছে সেটা গান্ধী পরিবারেরই। এদের মধ্যে কাউকে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। হাথরাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় নামতে দেখা গেছে প্রিয়াঙ্কা ও রাহুল গান্ধী কে। কিন্তু একটা ভাঙাচোরা, ঘুনধরা সংগঠনের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় কি করে ? অথচ নিকট ভবিষ্যতে গুজরাট, মধ্যে প্রদেশ ও রাজস্থান প্রভৃতি কয়েকটা রাজ্যে তো কংগ্রেস ছাড়া কোনো গতি নেই। ফলে সর্ব-ভারতীয় কোয়ালিশনে তার উপস্থিতি অবশ্যই থাকা দরকার।
পশ্চিম বঙ্গের এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে তাতে বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় এ কথা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে দেখিয়ে দিয়েছে যে বিজেপির বিপদ কে মোকাবিলা করতে গেলে ব্যাপক কোয়ালিশন গড়ে তোলা প্রয়োজন। কোয়ালিশন মানে নির্বাচনী জোট নয়। অনেক সময় আগেকার দিনে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধের সংগ্রামের প্রসঙ্গে ট্রটস্কির ‘মার্চ সেপারেটলি, স্ট্রাইক টুগেদার’ কৌশলকেও কোয়ালিশনের একটা রূপ হিসাবে ধরে নিতে হয়। আমাদের বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা কার্যকরী করার দরকার আছে।