বলার মতো কিছু নেই, এমন নয়। তবু হীনম্মন্যতা ঘোচে না। বঞ্চনার শেষ নেই। তবু কণ্ঠ ছেড়ে আওয়াজ ওঠে না। পড়শির উন্নাসিকতায় নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হয়। হেনস্থা হলে, ভীড় সন্ত্রাস হলে, এমনকি দেশদ্রোহী বলে অপবাদেও, আনুষ্ঠানিক বাদ-প্রতিবাদের গাড্ডায় পা মেলানো। সামনে আজ ফ্যাসিবাদী শক্তি দাঁড়িয়ে গেছে। এবার ঘুরে দাঁড়াও, নয় অধ:পাতে যাও।
বাইরের প্রতিকূলতা যখন একটা জাতি বা সমাজের গতি রোধ করে তখন তার ভিতরের শক্তির বলে পথ করে নিতে হয়। সেখানে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা বড় ব্যাপার। ভারতীয় মুসলমান সমাজে সেইটার বড় অভাব। স্বাধীনতার সময় থেকেই সমাজটা নিজেকে খোয়াতে খোয়াতে আজ এই দীনদশায় এসে ঠেকেছে। দশকের পর দশক রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা ও অবহেলা সত্ত্বেও উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনি। বাবরি বা গুজরাতের মতো ক্ষত ভুলে থাকার চেষ্টা আজ দুর্বলতার দৃষ্টান্তে পর্যবসিত। হিন্দুত্ববাদীদের দুরভিসন্ধিতে ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে-- হয় সংখ্যাগুরুর বশ্যতা স্বীকার, নয় দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার শাসানি।
জনজাতি সংগঠনগুলি সামাজিক ন্যায় ও জল-জমি-জঙ্গলের অধিকারের জন্য লড়াই করছে। সাম্প্রতিককালে দলিত সংগঠনগুলির সামাজিক ন্যায় ও মর্যাদার জন্য আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সেখানে তিন তালাক নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চর্চা, দাবি উচ্চগ্রামে উঠে যায়; কিন্তু মুসলিমদের নাগরিক অধিকার, মুসলমান সমাজের প্রগতি নিয়ে চর্চা ভাসাভাসা। এ নিয়ে আন্দোলন তো নয়ই; দাবি-দাওয়া যদি বা কিছু ওঠে, সবই আধাখেঁচড়া ও আনুষ্ঠানিক। এই অচলায়তনের পিছনে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিচ্যুতি একটা কারণ। ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক পশ্চাৎপদতার বিষয় কিছু আছে। কিন্তু বিশাল এই জনগোষ্ঠী, পিছনে স্মরণে রাখার মতো গৌরব ও বর্তমানে হেলাফেলা করার মতো নয় এমন সক্ষমতা সত্ত্বেও সমাজের ভিতর থেকে আলোড়ন ওঠেনি।
মুসলিম পরিচিতির সামাজিক সংগঠন দেশে বহু আছে। কিন্তু সেসব সচরাচর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির ছত্রছায়ায় মাথা গুঁজে সান্ত্বনা লাভে মশগুল। এধরনের প্রায় সব সংগঠন ও ধর্মীয় সংগঠনগুলির চিন্তায় অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে এই বিশ্বাস যে, ঈমান (আল্লাহ্ ও কুরআনে বিশ্বাস ) এবং সুন্নাহ্ ( ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মোহাম্মদের বাণী ও জীবন-প্রণালী অনুসরণ ) মুসলিমদের সব বিপদ দূর করবে। ফলে রাষ্ট্রের বঞ্চনা-অবহেলার প্রতিবাদে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না। সংঘ-পরিবারের হুমকির সামনে সবাই দিশাহীন। কয়েকটি ধর্ম-কেন্দ্রিক মুসলিম পরিচিতির রাজনৈতিক দল আছে। সেগুলির প্রায়শই সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বড় সমস্যা। একটা সাধারণ সমস্যা হ’ল, এইসব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলি ইসলামীয় ভাবধারার মাপকাঠিতে ভারতীয় মুসলিমদের আধুনিক জীবনযাত্রায় মানবসম্পদের বিকাশের ছবি কল্পনা করে। এঁদের থেকে একটা ধর্মীয় ভাব-গম্ভীর এলিট স্তর গড়ে ওঠা মানে জাতে উঠে যাওয়ার মতো ব্যাপার। অন্যদিকে বড় অংশের আধুনিক মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা, আধুনিক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিক্ষার মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজের ক্রমোন্নতি হবে। ফলে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রেখে সমালোচনা ছাড়া এঁদের থেকে আর কিছু মেলে না।
এই বাস্তবতার ভার বয়ে চলেছে মুসলমান সমাজ। তার বঞ্চনা-অবহেলা নিয়ে মর্মবেদনাই সার। বস্তুগত প্রয়োজনে লোকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অনুসারী। সচরাচর ক্ষমতা-বৃত্তের চারপাশে জড়ো হওয়া। সেখানে শুধু কোলাহল। বেঁচেবর্তে থাকা ছাড়া আর কোনো সার্থকতা নেই। এই প্রেক্ষাপটে শাহিনবাগ উপস্থিত বৃহত্তর প্ররিপ্রেক্ষিতের ব্যানার সামনে নিয়ে। সিএএ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে; তখন সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের সমূহ বিপদ। এনআরসি অগণিত দেশবাসীর নাগরিকত্বের চেতনাকে টলিয়ে দিয়েছে, অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে; সেখানে সমগ্র মুসলমান সমাজ হুমকির মুখে পড়েছে। সিএএ নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বহু জায়গায় বহু মুসলমান স্বত:স্ফূর্ত বিক্ষোভে সামিল হয়েছে বটে; কিন্তু সিএএ ও এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদের রাস্তায় শাহিনবাগ সুদূরপ্রসারী সংকল্প ও ধৈর্যের অনন্য নজির রেখেছে।
মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষ বিষয়। কিন্তু অস্তিত্বের সামনে যখন এই বিপন্নতা নেমে আসছে তখন পুরুষতন্ত্রের প্রত্যুত্তর নেই। মাতৃসত্তার অন্তর্নিবিষ্ট প্রত্যুত্তর আছে। বংশপরম্পরা রক্ষা পুরুষালী ভাবনা। এ হ’ল বৈষয়িক আকাঙ্ক্ষা। সেখানে প্রজন্মপরম্পরা রক্ষার তাগিদ মাতৃসত্তার আদি প্রেরণা। মাতৃত্ববোধ তাই সমষ্টির অনুসারী। শাহিনবাগে চলল সেই মাতৃসত্তার উদযাপন। সেই অনুপ্রেরণায় দেশ জুড়ে উদযাপিত। মাতৃসত্তার গুণে নারীশক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে শাহিনবাগের পথে। হিন্দুত্ববাদীদের ফ্যাসিবাদী এজেণ্ডার সামনে পাল্টা গণতন্ত্রের এজেণ্ডা তুলে ধরেছে শাহিনবাগ। শাহিনবাগের পথ ধরে আজ মুসলমান সমাজের পথ চলা শুরু। অভূতপূর্ব বিপন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিস্ট কর্মসূচিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহসিকতা ও পন্থায় মুসলমান সমাজ জড়তা ঠেলে উঠে দাঁড়াবার শক্তি পেয়েছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
এখন নতুন করে সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সামনে হুমকি নামিয়ে আনতে তৎপর দেশের শাসক। লকডাউনের সুযোগে একের পর এক আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। তখন শাহিনবাগের চেতনাকে ধরে রাখতে হবে প্রতিবাদের রূপকল্পে। শাহিনবাগের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখা বেশি করে প্রয়োজন মুসলমান সমাজের প্রগতিকল্পে।