প্রথম অধ্যায় পড়ুন
ফ্যাসিবাদ - দর্শন, আদর্শ ও অনুশীলন
অধ্যায়-২
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিপ্লবী বস্তুবাদী মতাদর্শকে সংহত করে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিরুদ্ধে উন্মত্ত সংগ্রামে পশ্চিমা দর্শন ক্রমাগত আরো বেশি বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির দার্শনিক অবদান হেগেলিয় মতবাদে এসে মেশে। এই মতবাদ আধুনিক ধ্রুপদি দর্শনকে পরম ভাববাদের চরম বিন্দুতে এনে ফেলে। সেখান থেকে যথারীতি তার পতন হয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অমোঘ নিয়মে। ঐতিহাসিকভাবে এবং দ্বান্দ্বিকভাবে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সদর্থক দার্শনিক ফসল হল বস্তুবাদ যা উন্নততর সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরি করে; এবং ভাববাদ থেকে বস্তুবাদে আধুনিক দর্শনের উত্তরণের পর্বের প্রতিনিধিত্ব করেন হেগেল।
উদীয়মান শ্রেণী হিসেবে বুর্জোয়ারা বস্তুবাদী দর্শনের বিপ্লবী হাতিয়ারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল ধর্মকে মোকাবিলার জন্য; ধর্ম সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাজতান্ত্রিক সমাজের অনুমোদন দেয়।
ক্ষমতা দখল করার পর বুর্জোয়ারা এই হাতিয়ারকে নাকচ করে দেয়। কারণ এই হাতিয়ার যে কোনও ধরণের নিপীড়নের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। ধর্ম এবং অতীন্দ্রিয়বাদ ও আধ্যাত্মবাদের সাথে যুক্ত সমস্ত অন্ধবিশ্বাসী আচারানুষ্ঠান বস্তুত শোষণের ভিত্তিতে চলা যে কোনও সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য বেশ কার্যকর হাতিয়ার। তাই শাসক শ্রেণী হিসেবে বুর্জোয়ারা যে নিজেদেরই এক সময়কার প্রচারিত বিপ্লবী দর্শনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শুধু তাই নয়, তারা নতুন আধ্যাত্মবাদের এবং “বৈজ্ঞানিক” অতীন্দ্রিয়বাদের পৃষ্ঠপোষকও হয়ে ওঠে। তারা ইতিহাসের ঘড়িটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। তারা তাদেরই শ্রেণীর মহান সব দার্শনিকদের শিক্ষাকে অস্বীকার করতে শুরু করে। হেগেলের শিষ্যরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। জ্ঞানায়তনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ দেওয়া হয় সর্বগ্রাহী-সর্বেশ্বরবাদী-অতীন্দ্রিয়বাদী শেলিংকে। আর ফয়েরবাখ, যিনি ছিলেন ধ্রুপদি দর্শনের সর্বশেষ প্রতিনিধি, তিনি ভাববাদের আধুনিক যুক্তিবাদী সদর্থক ফলাফলকে দৃঢ়তার সাথে সামনে এনে ভাববাদকে লঘু করে দিয়েছিলেন ও এইভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের রাস্তা সুগম করেছিলেন বলে, তাঁকে সারা জীবন দারিদ্র্যে নিক্ষেপ করা হয়।
হেগেলের পর পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতার দর্শন এক পশ্চাদগামী পথ খুঁজে বের করে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে এমন এক কর্তৃত্বের খোঁজে কান্টের দরবারে কান পাতে। নব্য কান্টিয় মতবাদ কান্টের দর্শনের বিপ্লবী দিকগুলিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ফিরিয়ে আনে অতি-ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়াতীগ সত্যের কিম্ভুত কঙ্কাল, যাকে পরীক্ষানিরিক্ষামূলক বিজ্ঞান অনেক আগে খিল্লির বিষয় করে তুলে রেখেছিল বাতিল দেরাজে। এই পুঁজিবাদী সভ্যতা বলতে থাকে যে, বস্তুবাদ ইন্দ্রিয়াতীগ বা অতীন্দ্রিয় বর্গসমূহের দুনিয়ার অস্তিত্ব ব্যাখা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, এ’কথা তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে অতি-ইন্দ্রিয়জ সংবেদন আসলে বিশ্বাস অবিশ্বাসের বিষয়: যুক্তির নিয়মনীতিতে তার কোনও বৈধতা নেই।
সময়ের গতিপথে কান্টের দর্শনের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের এই কদর্য রূপদান পুঁজিবাদী সমাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যর্থ হয়; পুঁজিবাদী সমাজ তার নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বে টলমল করছিল। দার্শনিক হিসেবে কান্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ময়দানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দর্শনকে হয় গ্রহণ করতে হবে বা বর্জন; এবং যদি তার কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান করতে হয় তাহলে অতি-ইন্দ্রিয়জ সংবেদন সংক্রান্ত যে অ-দার্শনিক অংশটি কান্টিয় তত্ত্বব্যবস্থার মূল প্রেক্ষিতকেই বিরোধ করে সেই অংশটিকে বাতিল করতে হবে। উত্তর-হেগেলিয় দর্শনের পশ্চাদমুখী আন্দোলন তাই নিছক কান্টেই থেমে থাকল না। ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের স্বার্থসেবায় দর্শন তার মধ্যযুগিয় “বিশুদ্ধতায়” প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজন ভীষণভাবে অনুভব করতে শুরু করল। একে হতে হবে আপোসহীনভাবে আধ্যাত্মিক। যুক্তিবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে অতীন্দ্রিয়বাদ দিয়ে। সর্বাত্মক অধিবিদ্যা ও ধর্মীয় অতীন্দ্রিয়বাদের হাতিয়ার দিয়ে বিপ্লবের মতাদর্শকে অতি অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধের জ্ঞানায়তনিক পশ্চিমা দর্শনের নানান ঘরানার সবগুলিতে খলাখুলিভাবে বা কিছু আড়াল রেখে এই অভিমুখে এগিয়ে চলে, যদিও জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্রুতগতি বিকাশ এই আধ্যাত্মিকতাবাদী বাড়াবাড়ি ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াকে যৌক্তিক ও দার্শনিক ভাবে অসম্ভব করে তুলছিল। সেই কারণে, ঘটনাক্রমে, প্রতিক্রিয়ার প্রক্রিয়াটিকে শেষ পর্যন্ত যুক্তিবাদের সব ভণিতা ঝেড়ে ফেলে ধর্মের সাথে খোলাখুলি সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হয়েছিল।
এই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছিল সেই ১৮৭৬ সাল থেকেই। “রাজনীতিতে যেমন আমরা নেশনকে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যেতে দেখি, বিজ্ঞানেও তেমনি দুটি সাধারণ অংশে বিভাজিত হতে দেখি—এক হল অধিবিদ্যাবিদ আর অন্যটি পদার্থবিদ বা বস্তুবাদীরা। অন্তর্বর্তীকালীন আন্দোলনগুলি, এবং নানান ভিন্ন ভিন্ন উপনামের সমঝোতাবাদী হাতুড়েরা—আধ্যাত্মবাদী, সংবেদনবাদী, বাস্তববাদী ইত্যাদি ইত্যাদি—সকলেই এই স্রোতে ভেসে যায়। এক বৈজ্ঞানিক পুরোহিততন্ত্রের উত্থান ঘটেছে যা ধর্মীয় পুরোহিততন্ত্রকে সহযোগিতা ও পোষণ করছে। প্রকট কুসংস্কারকে সহজেই ধ্বংস করা যেত যদি দ্বৈতাচারি বিভ্রান্তি বিজ্ঞানের ফাঁকফোঁকর খুঁজে তার শেকড় বিস্তার না করত। এই ফাঁকফোকরগুলি বেশি করে দেখা যায় জ্ঞানতত্ত্বের পরিসরে। চাটুকারিত্বের স্নাতকেরা তাদের নির্লজ্জ ভাববাদকে ব্যবহার করে জনতাকে অজ্ঞানতায় ডুবিয়ে রাখতে। মহান ঈশ্বর যেমন শয়তানের মধ্যে তার প্রতিপক্ষ পায় তেমনই ভক্ত প্রফেসরেরা তাদের প্রতিপক্ষ খুঁজে পায় বস্তুবাদীদের মধ্যে। (জোসেফ দিয়েৎসগেন, “ফিলসফিকাল এসেইজ”)।
ক্রমবর্ধমান মাথাব্যাথা রূপে বস্তুবাদের বিকাশকে প্রতিরোধ করার জন্য নব্য কান্টিয় মতবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস আর তেমন কার্যকর না হওয়ায়—ভাববাদের নানান মুখপোরা ঘরানাগুলোও উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হওয়ায়—ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকের ইউরোপের চর্চায়তনিক দর্শন হেগেলের ভুতকে আবাহন করতে শুরু করে। নব্য হেগেলিয় মতবাদ দর্শন জগতের ফ্যাশন হয়ে ওঠে; এবং নব্য হেগেলিয় মতবাদ মানে হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিকৃতি ও বিকার, যার স্বপ্রকাশ উদ্দেশ্য হল অধিবিদ্যা ও অতীন্দ্রিয়বাদকে এক ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক আচ্ছাদনে উপস্থিত করা। নব্য-হেগেলবাদের বিকারগ্রস্ত দ্বন্দ্বতত্ত্ব কালক্রমে জগাখিচুড়িবাদ বা একলেক্টিসিজমে পর্যবসিত হয়, যা সমস্ত নীতিবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতার দার্শনিক অনুমোদন প্রতিষ্ঠা করে। ফ্যাসিবাদের দার্শনিক ভিত্তি পরিপূর্ণভাবে স্থাপিত হয়।
অতীন্দ্রিয়বাদী শপেনআওয়ার ফ্যাসিবাদের প্রাজ্ঞ পিতা। আর, নির্মম প্রতিক্রিয়াশীল নীৎসে হলেন তার ঘোষক অগ্রদূত। কিন্তু ফ্যাসিবাদী দর্শনের বুনিয়াদি নীতিমালা সূত্রায়িত করার কৃতিত্ব বার্গসনের। বার্গসন ছিলেন বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের বিখ্যাত দার্শনিক। “বিজ্ঞানের ভনিতা”-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে তিনি দর্শনের ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং ধর্ম, বিশ্বাস, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রত্যদেশ প্রাপ্তির ‘উচ্চতর সত্যের’ অবস্থানবিন্দু থেকে বিজ্ঞানের সমালোচনা করার কর্তব্য গ্রহণ করেন। (এইচ বার্গসন, “দ্যা ক্রিয়েটিভ এভল্যুশন”)। শতাব্দীর শেষ লগ্নে “ভৌতবিদ্যার তত্ত্বগুলির সংকট” থেকে তিনি এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু তারও অনেক আগে পুরোহিত আর প্রফেসরেরা উল্লসিতভাবে এই সংকট নিয়ে খুব হইচই করেছিলেন, এবং শেষে বোঝা গেছিল যে এই সংকট ছিল বিকাশপথের স্বাভাবিক সংকট মাত্র। কোনো স্থিতধী দার্শনিকই তাঁর মতবাদকে আকাশকুসুম কল্পনার ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পারেন না। সুতরাং সময়ের গতিতে বার্গসনকেও তাঁর দার্শনিক আধ্যাত্মিকতাবাদের সাথে বিজ্ঞানের প্রয়োগলব্ধ ফলাফলের একটা মেলবন্ধন খুঁজতে হয়।
বস্তুজগতকে মায়া বলে নাকচ করে দিয়ে আবার নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক দার্শনিক হিসেবে দাবি করা যখন আর সম্ভব হয়ে উঠছে না তখন বার্গসন নিজেকে, বলতে গেলে, আইনসিদ্ধ করার প্রয়াস নেন। বস্তুজগৎ নিয়ে কেউ ভাবিত হতেই পারে, কিন্তু তা করতে হবে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের উচ্চতর জগতের অধীনে। ঠিক যেমন প্রাচীন ভারতের সংহিতা প্রণেতা ব্রাহ্মণেরা ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ উপভোগকে জায়েজ করেছিল একমাত্র তা ‘ধর্ম’-র অধীনে হলে, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয়-সামাজিক বিধান এবং এক অন্তঃসারশূন্য ‘মোক্ষ’-র অধীনে হলে। বুর্জোয়ারা এই দুনিয়ায় নিজেদের প্রভুত্ব স্থাপনের কালপর্বে স্বাধীনতার নীতি আউড়েছিল। পরবর্তীতে যখন তাদের ক্ষমতা সুবিধা ভোগ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল তখন তারা এই দুনিয়ায় জীবনের সমস্ত কার্যকলাপকে এক কল্পিত আধ্যাত্মিক আদর্শ ও অধিবিদ্যক মূল্যবোধের অধীনস্ত করে দিল। ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র। এবং তার সমস্ত রকম বীভৎস সামাজিক-অর্থনৈতিক মতবাদ এই দার্শনিক প্রতিক্রিয়া দ্বারা সীমাবদ্ধ।
পুঁজিবাদে বিজ্ঞান শোষণের এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে; কিন্তু একই সাথে তা গণ মানসে এক মহান বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে আপাত এক সাদৃশ্য বজায় রেখে আধ্যাত্মিকতাবাদের পুনরুত্থান বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেকে বস্তুগত সুবিধা নিতে বুর্জোয়াদের সাহায্য করবে এবং একই সাথে বিজ্ঞান যে আত্মিক মুক্তিদায়ি প্রভাব ফেলে তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এরকমটা প্রত্যাশা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে জীবনকে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়—একটি বস্তুজগৎ সম্পর্কিত, আর অন্যটি আধ্যাত্মিক বাস্তবায়নে নিবেদিত। এই ইচ্ছেমাফিক বিভাজনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতাবাদ বিজ্ঞানের সাথে তার অসম্ভব লড়াই থেকে সরে আসে। সে নিজের জন্য এক শান্ত গৃহকোণ দাবি করে, আশা করে যে সেখানে অবস্থান করে সে দুনিয়ার ওপর আধিপত্য করবে। বিজ্ঞানকে তার নিজের সত্যে থাকতে দাও; কিন্তু আধ্যাত্মিক সত্য তার ঊর্ধ্বে। জীবনের ভৌত বস্তুগত বাস্তবতার ঊর্ধ্বে এক উচ্চতর বাস্তবতা আছে। বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়ার এক আপাত ন্যায়সঙ্গত দর্শন সূত্রবদ্ধ করার প্রয়াসে বার্গসন তাকেই অস্বীকার শুরু করেন যাকে তিনি সমর্থন করতে চেয়েছিলেন। “যদি অতীন্দ্রিয়বাদ মানে সদর্থ বিজ্ঞানের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া বোঝায় তাহলে আমি শেষ পর্যন্ত অতীন্দ্রিয়বাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতবাদকেই সমর্থন করব”। (লিণ্ডসে, “দ্যা ফিলসফি অব বার্গসন”।)
বার্গসন এতটাই বাস্তববাদী যে তিনি বুঝতে পারেন যে অতীন্দ্রিয়বাদ বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে আর খাড়া থাকতে পারে না। সেই কারণে তিনি তাকে এই কলহের ঊর্ধ্বে নিরাপদ স্থানে স্থাপন করতে চান। অতীন্দ্রিয়বাদকে বিজ্ঞানবিরোধী হলে চলবে না; একে অবশ্যই হতে হবে ‘বিজ্ঞানোর্ধ্ব’। সুতরাং ফ্যাসিবাদী দর্শন ঠিক সেখান থেকে শুরু হয় যেখান থেকে ভারতীয় দর্শনও তার যাত্রা শুরু করে বলে বলা হয়—বুদ্ধিবৃত্তিক অনুভবের নাগালের ঊর্ধ্বে, যুক্তির আওতার বাইরে, মননবৃত্ত পেরিয়ে, এবং আরো ঊর্ধ্বে কল্পনার জগতে অধিবিদ্যক অবাস্তবতার ধোঁয়াশাময় উচ্চমার্গে তার বিচরণ, পরম সত্যের সন্ধানে। এই পরম সত্য যেকোনও পরম বর্গের মতই নিছক মরিচীকা মাত্র, এবং তা প্রতিষ্ঠিত সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী শক্তির বিরুদ্ধে হামলা নামাতে যে কোনও পন্থা নেওয়ার নির্বিকার অনুমোদন জোগায়।
ভৌত অস্তিত্বকে অধীন বর্গে ফেলে, বৈজ্ঞানিক সত্যকে কেবল ব্যবহারিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বেলাগাম পুঁজিবাদী শোষণের লাইন পরিস্কার করা হয়; কিন্তু জীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হল—এই শোষণের শিকার যারা তাদের জন্য—সব সময় আবশ্যিকভাবে আধ্যাত্মিক আরাধনা। বস্তুজগতের বাস্তব প্রভুরা বিজ্ঞানের নিম্নমার্গের সত্যের সুযোগসুবিধা পরিপূর্ণ ভোগ করে। তাদেরকে উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক আদর্শ প্রচার করতে নেমে কোনো কিছুই হারাতে হয় না। কিন্তু জনতাকে এই আধ্যাত্মিক মরীচিকার পেছনে ছুটতে হয় বস্তুগত জীবনের সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ অর্থহীন অবাস্তবতা স্যাক্রিফাইস করে।
বার্গসনের দর্শনের (ফ্যাসিবাদী) আরেকটি চিত্তাকর্ষক সাদৃশ্য দেখা যায় তার সাথে যাকে ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ উৎকৃষ্টতা বলে দাবি করা হয়। তা হল, পরস্পরবিরুদ্ধ ও বিরোধাভাসপূর্ণ উপাদানগুলির আত্মতুষ্ট সংশ্লেষণ করার ক্ষমতা। অবশ্য ভারতের সংশ্লেষণবাদী জিনিয়াসেরা যা করেছেন তার তুলনায় বার্গসন আরেকটু বেশি ‘দার্শনিক’ কসরৎ দেখিয়েছেন। তিনি হেগেলিয় দ্বান্দ্বিকতার আশ্রয় নেন, এবং সেই বিপ্লবী মতাদর্শগত হাতিয়ারকে বদলে নিতে চান প্রতিক্রিয়ার হাতিয়ারে।
দ্বন্দ্বতত্ত্বকে হেগেল সবিস্তারে দর্শন ও ইতিহাসে প্রয়োগ করে থাকলেও দর্শন যত পুরনো দ্বন্দ্বতত্ত্বও ততটাই। প্রাচীন গ্রীসে হেরাক্লিটস মনে করতেন যে দ্বন্দ্বই হল অগ্রগতির চালিকা শক্তি। হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বৌদ্ধ দর্শনেরও (হীনযান) অঙ্গ ছিল। জৈন দর্শনে দ্বন্দ্বতত্ত্ব খুবই পরিস্ফুট। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর সঠিকতা পরীক্ষানিরিক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞানেও প্রতিষ্ঠিত। চিন্তন প্রক্রিয়া সহ অস্তিত্বের সমস্ত দশার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া পুরাতনের সাথে দ্বন্দ্বে নতুন উপাদানের উত্থানের মধ্যে দিয়ে এগোয়। কালক্রমে নতুন পুরাতনকে ধ্বংস করে। এর মধ্যে দিয়ে সেই নতুন তার নেতিবাচক চরিত্র হারায় এবং ফলশ্রুতিতে নিজেকে নতুন ইতিবাচকে বদলে নেয়। এটাই হল অস্তিত্বের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী যা বাস্তবে হয়ে ওঠার এক গতিশীল প্রক্রিয়া।
প্রকৃত সংশ্লেষণ তাই পরস্পর বিরুদ্ধ উপাদানগুলির মধ্যে সমঝোতা ঘটিয়ে হতে পারে না। হলে তা কখনই অগ্রগতি হবে না। সেটা হয়ে যাবে প্রতিক্রিয়া। কারণ এরকম যে কোনও আপস বাস্তবে হয়ে যাবে নতুনের ক্ষয় ঘটিয়ে পুরানোকে জায়গা করে দেওয়া। পুরাতনের নেতিকরণ কার্যকর করেই বিকাশ ঘটে –এই সত্য প্রমাণ করে যে পুরাতনের টিকে থাকার কারণ আর থাকে না। যতক্ষণ একটি প্রাকৃতিক, মানবিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক উপাদানের বস্তুগত যথার্থতা থাকে, যতক্ষণ তা তার পরিমণ্ডলের সাধারণ পরিসরে উপযোগি থাকে, ততক্ষণ তার বিনাশ ঘটানোর শক্তি বিকশিত হওয়াকে বলবিদ্যার কার্যকারণ নিয়মই বাধা দেয়। যে কোনও কিছু ঘটার পেছনে কিছু না কিছু কারণ থাকে। ঘটা জরুরি না হয়ে উঠলে কিছুই ঘটে না। পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা, পুরনো অবধারণাগুলিকে বিলুপ্ত করা, অথবা পুরানো মূল্যবোধগুলিকে মুছে ফেলা –এই সবকিছুই ঘটে কোনো না কোন প্রয়োজনের তাগিদে। তাই আপসের অর্থে “সংশ্লেষণ”, তা সে সমাজে হোক বা রাজনীতিতে কিংবা দর্শনে, আসলে স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে বিনাশক উপাদানগুলিকে দমন করা এবং যে উপাদানগুলির বস্তুগত অস্তিত্ত্বের সম্ভাব্যতা শেষ হয়ে গেছে তাদের সংরক্ষণ করা। প্রকৃত সংশ্লেষণ কখনই সন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের মধ্যে আপোস মীমাংসা নয়। প্রকৃত সংশ্লেষ হল নতুন গতিময় বল হিসেবে উদ্ভূত প্রতিসন্দর্ভের দ্বারা স্থানু হয়ে পরা পুরাতন সন্দর্ভের বিনাশ, এবং সেই নতুনের নেতিবাচক ও বিনাশক চরিত্র শেষ হয়ে নতুন সন্দর্ভ রূপে তার প্রতিষ্ঠা। প্রকৃত সংশ্লেষ হল, হেগেল সংজ্ঞায়িত করেন, “নেতির নেতিকরণ”।
এটা এক সদর্থক অর্থে বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গী। কারণ এটা অস্তিত্বের সব দশাতেই বিপ্লবের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা দেখায়; বলতে গেলে, বিপ্লবকে আইনসিদ্ধ করে তলে। তার ফলে এই ভয়ানক হাতিয়ারটিকে, যা কি না একজন ভাববাদীর দ্বারা সুচারু রূপ পেয়েছিল, বিপ্লবী বস্তুবাদী দর্শনে গ্রহণ করা হয়।
নব্য কান্টিয় মতবাদ ও অন্যান্য নানান রূপের বিকৃত ভাববাদে আশ্রয় নিয়েও বিপ্লবী সামাজিক দর্শনের উত্থান প্রতিহত করতে না পেরে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের সরকারি দর্শন নিজেকে শক্তিশালি করতে দ্বন্দ্বতত্ত্বের সাহারা নিতে চায়—অবশ্য সেটাও এক বিকৃত হীনবল রূপে। এই বিকৃত দ্বন্দ্বতত্ত্ব নতুন ও পুরাতনের মধ্যে সমঝোতাকে সংশ্লেষণ বলে ব্যাখ্যা করে। নতুনের নেতিকারক ক্রিয়ার চূড়ান্ত অকাট্য ভূমিকাকে অস্বীকার করে দ্বন্দ্বতত্ত্বকেই মিথ্যা করে দেওয়া হয়।
নব্য হেগেলবাদীদের মত অনুসারে সংশ্লেষণ মানে নতুন সন্দর্ভ হিসেবে প্রতিসন্দর্ভের প্রতিষ্ঠা নয়, বরং তা হল প্রতিসন্দর্ভের ক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পুরনো সন্দর্ভের সংরক্ষণ; তা হল ক্ষয়ে যাওয়া পুরানোকে স্টাইনাকের কায়দায় পুনরুজ্জীবিত করা যেখানে রক্তক্ষরণ করা হয় নতুনের।
এরকম বিকৃতরূপ দ্বন্দ্বতত্ত্বে মূল কৃতিত্বটি বার্গসনের প্রাপ্য। তিনি এই পথে আধ্যাত্মবাদকে বিজ্ঞানের সাথে মেলাতে চান, ঠিক যেমনটা অনেক আধুনিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবী করে থাকেন। এরা অবশ্য তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং অত্যাবশ্যক দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াই এটা করেন। বার্গসন বিজ্ঞানকে কোনও দার্শনিক স্বাধীনতা না দেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মহানুভবতার সাথে তিনি বিজ্ঞানকে সম্মান দেন পুঁজিবাদী ইমারত টিকিয়ে রাখার জন্য, আর সেইসাথে আধ্যাত্মবাদের বংশীবাদক হিসেবে। এই অধীন অবস্থানকে মেনে নেওয়ার প্রণোদনা হিসেবে বিজ্ঞানকে তার জন্য বরাদ্দ করা ময়দানে পূর্ণ স্বাধীনতার আশ্বাস দেওয়া হয়। এর ফলশ্রুতি হল প্রয়োগবাদ। “শিস্নোদর দর্শনের এই কদর্য উপযোগবাদ” আধ্যাত্মবাদকে রক্ষা করে। প্রায়োগিক বস্তুবাদের সবচেয়ে কদর্য বিকৃত ধরণকে, আইনসিদ্ধ করে ফেলা ডাকাতিকে, সুসভ্য নরখাদক পন্থাকে মহান মতাদর্শ বানিয়ে বিশ্বাস ও ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ফ্যাসিজম হল এই প্রয়োগবাদের অনুশীলন।
বার্গসন হেগেলিয় দ্বন্দ্বতত্ত্বকে বিকৃত করেন নেতিকরণের ধারণায় চিরস্থায়িত্ব আরোপ করে। দ্বন্দ্বতত্ত্বের মৌলিক নীতি হল যে কোনও পরিঘটনা স্থিতপক্ষ ও প্রতিপক্ষের সংশ্লেষণে ঘটে। নেতিকরণ সেই অর্থে কোন ক্রিয়া নয়। এটা পুরাতনের জায়গায় নতুন স্থিতপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম মাত্র। সুতরাং নেতিকরণের প্রক্রিয়াকে বৈপ্লবিক বলে প্রশংসা করার পরও সমগ্র প্রক্রিয়ার মূল উপাদানটি ইতিবাচকই থাকে। নেতি ছাড়াও প্রতিপক্ষের থাকে ইতিবাচক তাৎপর্য; এবং এই ইতিবাচকতা হল স্থায়ি (আপেক্ষিক অর্থে) তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রতিপক্ষের অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত ইতিবাচকতাতেই থাকে তার প্রগতিশীল তাৎপর্য, এবং নেতিকরণের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তা নতুন স্থিতপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বার্গসন দেখেন একপাক্ষিক এক প্রক্রিয়া হিসেবে—নেতিকরণের এক অন্তহীন শৃঙ্খলা হিসেবে। পরিবর্তন এক পরম ধারণা রূপে হাজির হয়। এই ধারণা অবশ্য তার নিজস্ব প্রকৃতির কারনেই ধ্বংস হয়ে যায়। নেতিকরণ থেকে ইতিবাচক কোনওকিছুই আর বেরিয়ে আসে না। এক নেতিকরণ আরেক নেতিকরণকে নিয়ে আসে। তারপর তা আবার নেতিকৃত হয় আরেকটি দ্বারা। এরকমই চলতে থাকে। ইতিবাচক কোনও কিছু উৎপন্ন না করেই এই নিরর্থক নিরন্তর পরিবর্তন চলতে থাকে। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর এই বিকার, যা প্রয়োগবাদের বনিয়াদ তৈরি করে, একদম সঠিকভাবে নিম্নোক্তরূপে ধিক্কৃত হয়েছে: “বিবর্তনকে দেখা হয় এক অযৌক্তিক, বেসামাল প্রক্রিয়া হিসেবে, যা কখনই আগে থেকে বোঝা যায় না, ধরা যায় না; যেন ইতিহাস কোনও নিয়ম জানে না, সব রকম জরুরি তাগিদ থেকে মুক্ত, কার্যকারণ সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করে যায়। এ হল, ইতিহাসের যে নিয়ম পুঁজিবাদকে বিলুপ্তির নিয়তিতে নিক্ষেপ করে তার থেকে কল্পনায় মুক্ত হওয়া— এমন এক মুক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়া যা এক নিরন্তর মিরাকল, যেখানে কাল্পনিক মুক্তির দশায় যে কোনও গজব যে কোনও সময় ঘটতে পারে”। (এ তালহাইমার, অ্যাপেন্ডিক্স টু দ্যা “হিস্টরি অব ফিলসফি” বাই ফ্রান্স মেরিং)।
ফ্যাসিবাদের দর্শন প্রয়োগবাদ হল এক অন্তহীন উপায়ের দর্শন। জীবন সেখানে অন্ধকার হতাশার হাতছানি। কোনও নীতি বা নিয়ম নাই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই একমাত্র পথপ্রদর্শক; সব ঘটনার পেছনেই আছে অভিসন্ধি। এই বিন্দুতে এসে অতিপ্রাকৃত, সংবেদন-বহির্ভূত, আধ্যাত্মিক বর্গ এই দর্শনকে আধিপত্য করতে হাজির হয় যা, ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে, নিজের যুক্তির টানে, বিকৃত বস্তুবাদী মূলনীতি অনুসরণ করে—যে যার নিজেরটা বুঝে নাও, নইলে হতভাগা হয়ে পেছনে পড়ে থাকো। এই আপ্তবাক্য উচ্চশ্রেণির জন্য কোন মাত্রার সুবিধ তৈরি করতে পারে তা তো আর ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হবে না; ক্ষমতা যাদের হাতে আছে তারা তো নিজেরটা বুঝে নিতে পারেই, অধিকন্ত তারা নিজেদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিতে পারে জনসাধারণকে দাসত্ব, দারিদ্র, অজ্ঞানতা, দুর্দশা ও অবক্ষয়ের পশ্চাদপদতায় নিক্ষেপ করে।
সভ্য নরখাদকদের এই ইন্দ্রিয়লালসাময় দর্শন তার ইন্দ্রিয়সর্বস্ব প্রকৃতির কারণেই অতিমাত্রায় আধ্যাত্মিকতার চরিত্র লাভ করে। ব্যক্তিক্রিয়ায় চালিকাশক্তির মতবাদ অনিবার্যভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক পূর্ব উদ্দেশ্য থাকার ধারণার দিকে পরিচালিত করে। প্রকৃতপক্ষে, এই আধ্যাত্মিক ধারণাটিই চালিকাশক্তি মতবাদের আগ্রাসনে নৈতিক অনুমোদন যোগায়। অন্তহীন অভিজ্ঞতার পূজা সত্য ও নৈতিকতার অন্যান্য ধারণাকে স্বজ্ঞামূলক বিভাগে পরিণত করে। যেহেতু ব্যক্তিজীবনে চলার একমাত্র গাইড হলো ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা, তাই সর্বোচ্চ সত্যও যেন সেই উৎস থেকেই আসতে বাধ্য। স্বার্থান্বেষী প্রেরণায় চালিত ব্যক্তিরা যেহেতু জীবনের প্রতিটি ঘটনা, ইতিহাস ও সমাজকে ব্যক্তিনিষ্ঠ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে তাই প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার পিছনে তারা একটি বুদ্ধিদীপ্ত উদ্দেশ্য, এক ঐশ্বরিক ইচ্ছা খুঁজে পায়। আত্মকেন্দ্রিকরা সত্যকে তার বস্তুনিষ্ঠতা থেকে বঞ্চিত করে এবং সত্যকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিণত করে। এই অবস্থায়, আধ্যাত্মিকতা আসলে স্থুল-বস্তুবাদের বিপরীতধর্মী কিছু নয়। তারা একই মুদ্রার দুই পিঠ। ব্যক্তিনিষ্ঠতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, লুণ্ঠনমূলক উদ্দেশ্য —স্থুল বস্তুবাদের (যা বস্তুবাদী দর্শন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা) এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য সর্বদাই, প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে, আধ্যাত্মিকতার উচ্চকিত ও পবিত্র মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক জীবনদর্শনের এই আসল ও সহজাত বিষয়টি ফ্যাসিবাদের অনুশীলনে প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও বার্গসন দ্বান্দ্বিকতার যে বিকৃতি ঘটান তা প্র্যাগম্যাটিজমের ভিত্তি তৈরি করে, তবে নীতিহীন এই দর্শনটি বিকশিত হয় উইলিয়াম জেমসের হাত দিয়ে। এজন্য উইলিয়াম জেমসকে এই দর্শনটির পালক-পিতার মর্যাদা দেওয়া চলে। তিনি “ধর্মীয় অভিজ্ঞতা” মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সত্যের “পরোক্ষ অভিজ্ঞতা”। তারা এই জগতের সাপেক্ষে বৈধ। কিন্তু সত্যের কাছে সরাসরি পৌঁছানো যায় “ধর্মীয় অভিজ্ঞতা”-র মাধ্যমে। এখানেই আমরা স্থুল বস্তুবাদের “ইন্দ্রিয়লালসাময় শিস্নোদর দর্শন”-কে দেখতে পাই যা ঐশ্বরিক ‘হিন্দু’ মতবাদ প্রচার করে: “আত্মদর্শন”-ই সত্যের একমাত্র পথ যা অসংখ্য রূপে আমাদের সামনে প্রকাশিত হলেও খাঁটি বিশুদ্ধতায় তাকে উপলব্ধি করা যায় কেবল এক অতিমানসিক অবস্থাতেই।
“আমাদের সত্তার সুদূর সীমাগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার অস্তিত্বে নিমজ্জিত। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথা নিছক বোধগম্য জগত থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রার। আপনি এটাকে রহস্যময় ক্ষেত্র বা অতিপ্রাকৃত জমিন নামে অভিহিত করতে পারেন। আমাদের আদর্শিক প্রেরণাগুলি এই পরিসরের যতটা গভীর থেকে উৎপন্ন হয় (এবং অধিকাংশ প্রেরণাই আদতে এখান থেকে আসে, কারণ এইসব প্রেরণা এমনভাবে আমাদের আচ্ছন্ন করে যে আমরা আর তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না), ততটাই আমরা দৃশ্যমান জগতের তুলনায় গভীরতরভাবে এই অঞ্চলের অন্তর্গত হয়ে পড়ি; কারণ আমাদের আদর্শের অবস্থান যেখানে, সেখানেই আমরা সবচেয়ে গভীর ঘনিষ্ঠতায় অন্তর্গত হই। তবুও, এই অদৃশ্য অঞ্চলটি নিছক আদর্শিক ব্যাপার নয়, কারণ এটি ইহ জগতে প্রভাব সৃষ্টি করে।” (উইলিয়াম জেমস, দ্যা ভেরাইটিস অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স)
এর চেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক আর কোন দর্শন বা হতে পারে। ভৌত জগত থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন এক জমিতে আমাদের ধারণা বা আদর্শগুলি উৎপন্ন হয়, এমন এক জমিন যা স্থান ও কালের মাণদণ্ড দ্বারা পরিমাপযোগ্য নয়, এবং তাই তা কার্যকারণ সূত্রেরও ঊর্ধ্বে। এমন এক অ-লৌকিক অঞ্চল যেখানে, স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের মন প্রবেশযোগ্য নয়। কারণ, মানুষের মন তো ভৌত জগতের ঘটনা; এবং অ-লৌকিক, অতীন্দ্রিয় জগতে উৎপন্ন ধারণাগুলি অবশ্যই তাদের স্বপ্রকৃতি মোতাবেকই অজড়, অর্থাৎ অ-বস্তু। তারা আধ্যাত্মিক বিভাগ। তারা এই ভৌত জগতের জীবনচর্যা দ্বারা প্রভাবিত নয়। আমাদের ধারণাগুলি বরং রহস্যজনকভাবে এক গুণগত ভিন্নতর জগতে অনিবার্য নৈতিক আজ্ঞা বিস্তার করে—“এমনভাবে আমাদের আচ্ছন্ন করে যে আমরা আর তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না”।
স্পষ্টত, এই দর্শন অনুসারে, ধারণাগুলি ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর, এবং বস্তুময় মানবের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক সত্তা থাকা আবশ্যক যা সেই ঐশ্বরিক প্রেরণাপ্রবাহের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার এক অপরিশীলিত রূপ হিসেবে জেমসের ব্যবহারিকবাদী (প্র্যাগম্যাটিস্ট) দর্শনটি যৌক্তিক সঙ্গতির ধার ধারে না। তিনি একটি কাল্পনিক “আদর্শ জগত”-কে ভৌত মাত্রা ও ইন্দ্রিয়-অনুভূতির বাইরে স্থাপন করেন। অথচ তিনি দাবি করেন যে তা “এই জগতে প্রভাব সৃষ্টি করে”। এই অলৌকিক ঘটনাটি কীভাবে ঘটে? বিশ্বাসের মাধ্যমে; কারণ অলৌকিক ঘটনাগুলি কখনও বস্তুনিষ্ঠভাবে ঘটে না, বরং তা কেবল বিশ্বাসের ব্যক্তিনিষ্ঠ জগতেই বিদ্যমান। প্র্যাগম্যাটিজম হলো অভিজ্ঞতার যুক্তিহীন উপাসনা; এ হল উন্মত্ত হয়ে ওঠা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শ। তথাপি তা দাবি করে যে আমরা শরীরের ঊর্ধ্বের, ইন্দ্রীয়গ্রাহ্যতার বাইরের আদর্শজ্ঞান অর্জন করতে পারি—যে আদর্শ স্বভাবগতভাবেই অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে!
এই অসুবিধাটি কাটিয়ে ওঠা হয় একটি উচ্চতর অভিজ্ঞতা—“ধর্মীয় অভিজ্ঞতা”—ধারণার অবতারণা করে, যা কিনা এক উন্নততর মাত্রার অস্তিত্বে প্রযোজ্য। যৌক্তিক চিন্তাকে পরিত্যাগ করে বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ, পরম সত্যের একমাত্র পথ হিসেবে ঘোষণা করে। ভারতীয় দর্শনের সাথে এর সাদৃশ্য স্পষ্ট। জেমস তাঁর অভিজ্ঞতার দর্শনকে বিশ্বাসের আদিম পূজাচারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কোনো দ্বিধা করেননি:
“বিশ্বাসানুগত ও প্রার্থনারত অবস্থায় শক্তির প্রকৃত প্রবাহ ছাড়াও আর কী কী দৈবসত্য বিশেষভাবে বিদ্যমান, তা আমি জানি না... কিন্তু যে অতিরিক্ত বিশ্বাসের উপর আমি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, তা হলো, সেসব বিদ্যমান।” (উইলিয়াম জেমস, দ্যা ভেরাইটিস অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স)
এই “দর্শন” বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটি কোনো দর্শনই নয়। এটা হল ধর্মাচার, সবচেয়ে কট্টর ধরনের আধ্যাত্মিকতা। এখানে বস্তুনিষ্ঠ সত্য বলে কিছু নেই। ব্যক্তিই সত্যের মানদণ্ড। সত্য লাভের মাধ্যম হলো তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অতীন্দ্রিয় পরম সত্য হলো “প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা”-র ফল। এই সর্বোচ্চ বিভাগটি—যা কিনা বস্তুগত অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে বস্তুজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে—সেই বিভাগটি সবরকম পরখ বা যাচাইয়ের অসুবিধা থেকে মুক্ত। ভাগ্যবান অতিমানবের কথাকে বিশ্বাস করতে হবে। এভাবেই, হ্যালুসিনেশন বা ইন্দ্রীয়ভ্রমে থাকা ব্যক্তি বা প্রতারকেরা মানুষের আধ্যাত্মিক গুরুতে পরিণত হয়। তাদের পরম সত্য জ্ঞানের দাবি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না। এই পরম সত্য “প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা” থেকে “অনুভবমূলকভাবে” লাভ করা হয়েছে। ইন্দ্রীয়ভ্রমী ব্যক্তি, অথবা যে ব্যক্তি সহজবিশ্বাসী মানুষকে ঠকাতে চায়, সে সহজেই এই “অভিজ্ঞতা” লাভ করতে পারে। আজকের বিশ্ব শাসিত হয় এই ধরনের উন্মাদ বা প্রতারকদের দ্বারা, যারা সকলেই নিজেদেরকে অতিমানব বা ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত বলে দাবি করে। ফ্যাসিবাদ হলো অতিমানবের পূজা। আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে কট্টর রূপ ফ্যাসিবাদের দার্শনিক ভিত্তি।
এই লোকেদের হাতে দর্শন পুরোহিততন্ত্রে পর্যবসিত হয়। সত্য প্রকাশিত হতে পারে মাত্র, এবং কেবলমাত্র তাদের কাছেই প্রকাশিত হতে পারে যারা সমাজ শাসনের ক্ষমতা রাখে বা শাসক শ্রেণীর শক্তির সমর্থনপুষ্ট হয়; কারণ কেবল তারাই তাদের দাবি জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে পারে। নব্য-আধ্যাত্মিক দর্শনের অধ্যাপকরা হলেন পতনশীল পুঁজিবাদী সমাজের উচ্চপদস্থ পুরোহিত, পদবিন্যাসে তার পরে রয়েছে গির্জার ধর্মগুরু ও নীতিবাগীশ প্রচারকেরা। তবে এই নতুন পবিত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকাশিত সত্যের প্রকৃত অনুমোদন আসে রাষ্ট্রশক্তি থেকে। আধ্যাত্মিকতা স্থুল-বস্তুবাদের ঘৃণাপূর্ণ ভিত্তির উপর ন্যাংটো দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণরা তাদের দাবি করা বেদ-জ্ঞান প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা নিজেদের হাতেই রাখতেন। মধ্যযুগে তারা ক্ষত্রিয় শাসকদের সাথে সম্পর্ককে ইউরোপের চার্চ ও সামন্ত অভিজাতদের মধ্যেকার সম্পর্কের মত করে বজায় রেখেছিলেন। বর্তমান সময়ে এই ভূমিকা পালিত হচ্ছে আধুনিক ‘স্বামী’ ও হাতুড়ে আধ্যাত্ম্যবাদীদের দ্বারা, যারা এক সংকর সামাজিক ব্যবস্থার আদর্শিক মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন—যেখানে উপনিবেশিক শোষণের প্রয়োজনীয়তায় পুনর্জীবিত সামন্ত-পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি। আদর্শগতভাবে ভারত ফ্যাসিবাদের অনেক বেশি কাছাকাছি, স্বল্প কিছু মানুষ যেটুকু উপলব্ধি করতে পারছেন তার থেকেও বেশি। আধুনিক ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবী নেতা যে গোঁড়া আধ্যাত্মিকতাবাদ প্রচার করেন তা মূলত ফ্যাসিবাদের দর্শন।
যেহেতু আধুনিক নব্য-আধ্যাত্মিকতাবাদ, যা ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রকে দার্শনিক ন্যায্যতা দেয়, তা হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতার বিকৃতির ফল, হেগেল নিজে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের তথাকথিত উৎস সম্পর্কে কী ভাবতেন তা স্মরণ করা তাই প্রাসঙ্গিক হবে। “প্রত্যক্ষ জ্ঞানই সত্যের একমাত্র মানদণ্ড—এই মতবাদ অনুসারে সকল অন্ধবিশ্বাস ও মূর্তিপূজাকে সত্য বলে ঘোষণা করা হয় এবং বাসনার অনৈতিক ও অশুভ বিষয়বস্তুকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়।” (দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসফিক্যাল সায়েন্সেস)। এই প্রসঙ্গে হেগেল আরও উল্লেখ করে দেখান, প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মতবাদ অনুযায়ী বিশ্বাস কীভাবে সত্যের মানদণ্ডে পরিণত হয়। আদিম জনগোষ্ঠী যুক্তি দ্বারা নয়, বরং কেবল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ফেটিশ, পাথর, জন্তু, ওঝা বা পুরোহিতের পূজা করে। তারা কেবল তাদের পূজার বস্তুকে বিশ্বাস করে মাত্র। পবিত্রতা কোনো বস্তুগত বিষয় নয়—বাস্তবে তা পূজার বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান নেই; এটা হল পূজারীর বিশ্বাসের, বা বলা ভালো অন্ধবিশ্বাসের ফসল। যেখানে দেবত্ব নেই সেখানে দেবত্ব আরোপ করার এই অভ্যাস (আদিম মানুষের ক্ষেত্রে) বা কৌশল (সভ্য মানুষের ক্ষেত্রে) “অশুভ ও অনৈতিক” বাসনাকে ন্যায্যতা দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধন করে। অর্থাৎ, আধ্যাত্মিকতাবাদ হলো স্থুল বস্তুবাদ (জাগতিক ভোগবাদ)-এর আবরণ। এটাই হেগেলের সাক্ষ্য—আধুনিক যুগের দার্শনিক আধ্যাত্মিকতাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার, যার পরম আদর্শবাদ বেদান্ত দর্শন থেকে পৃথক করা মুশকিল।
পতনোন্মুখ পুঁজিবাদী সভ্যতার দর্শন ব্যবহারিকবাদের সারকথা হলো বস্তুনিষ্ঠ সত্যের অস্বীকার এবং মেকি বাস্তবতাবাদের অজুহাতে ব্যক্তিনিষ্ঠ আত্মদর্শনকে একমাত্র সত্যের উৎস হিসেবে মহিমান্বিত করা। হিন্দু দর্শনের সাথে এর সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। সত্যের মানদণ্ড সেখানে মানুষের চিন্তার ঊর্ধ্বে স্বাধীন ও বস্তুগতভাবে বিদ্যমান বিষয় নয়; বরং পুঁজিবাদী সমাজে জীবনযাত্রার সুবিধাস্বাচ্ছন্দই এর মানদণ্ড। আমাদের মন অনুধাবন করতে পারুক বা না পারুক, বিরাজমান বস্তজগতের সাথে অনুসন্ধান, প্রসার ও পরিশীলনের এক অন্তহীন প্রক্রিয়া হিসেবে জ্ঞানকে না দেখে প্রকৃত জ্ঞানকে দেখা হয় আত্মসমাহিত অবস্থায় আমাদের অহং-এর রহস্যময় উৎপাদন হিসেবে। অন্য কথায়, সত্য আমাদের বাসনার ফল। নিছক এক “ধর্মীয় অভিজ্ঞতা”। “বিশ্বাস-অবস্থা” বা “প্রার্থনা-অবস্থায়” অর্জনযোগ্য। গান্ধী এ ক্ষেত্রে নতুন কিছু বলেননি।
এই ধরণের আধ্যাত্মিকতাবাদ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যদিও ব্যবহারিক প্রয়োজনে এটি সুবিধাবাদী মতবাদ—অর্থাৎ স্বার্থপর উদ্দেশ্যকেই সত্য ও নৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাসনার এই আধ্যাত্মিকীকরণ জন ডিউয়ের প্রাগমাটিজমে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়: “যেসব বস্তুকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বা পূজা করা হয়, যেগুলিকে আধ্যাত্মিক দর্শন পরম সত্তার গুণ হিসেবে বিবেচনা করে, সেগুলিই প্রকৃতির সত্যিকারের উপাদান।” (ইন কোয়েস্ট অব সার্টেইনটি) । অর্থাৎ, বস্তুগতভাবে বিদ্যমান প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি প্রকৃতির সত্যিকারের উপাদান নয়—সেগুলি সম্ভবত মায়া। প্রকৃতির সত্যিকারের উপাদানগুলি হল সেগুলিই যেগুলি বাস্তবে নয় বরং আমাদের ব্যক্তিনিষ্ঠ চেতনায় বিদ্যমান, যা আমাদের অহং তৃপ্ত করার জন্য বর্ণিত এবং আমাদের প্রয়োজনের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হিসেবে প্রকৃতির উপর আরোপ করা হয়। বিজ্ঞান আমাদের প্রকৃতিকে জানতে সাহায্য করতে পারে না; এর জন্য আমাদের আধ্যাত্মিক দর্শন অনুসরণ করতে হবে, এবং এই দর্শন অনুযায়ী, বস্তুজগতের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। পরম সত্তার গুণাবলীকে পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না—সেসব গুণাবলী আধ্যাত্মিক বিভাগের অন্তর্গত। অর্থাৎ, পরম সত্তা আধ্যাত্মিক, এবং তাকে আধ্যাত্মিকভাবেই উপলব্ধি করতে হবে।
এবার আমরা ফ্যাসিবাদের কিছু সমকালীন আদর্শগত প্রচারকের দিকে তাকাই, যারা আধুনিক দর্শনের কবর খনক হেগেলের বিকৃত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে চরম আধ্যাত্মিকতাবাদী দর্শন প্রচার করেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক আলবার্ট লিবার্ট একজন নব্য-হেগেলবাদী। তিনি স্পষ্টভাষী অধিবিদ্যাবাদী এবং এ কারণে দেকার্ত থেকে হেগেল পর্যন্ত সমস্ত আধুনিক সমালোচনামূলক দর্শনের বিরোধী—যেগুলি এক বিপুল মননের ধারা যার যৌক্তিক পরণতিতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এগিয়েছিল। বেকন, হবস, লক, কন্ডিলাক, ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্ট, হিউম প্রমুখ দার্শনিকের পাশাপাশি কান্টকেও অধিবিদ্যার বিনাশক হিসেবে দর্শনের ইতিহাসে স্মরণ করা হয়। কিন্তু লিবার্ট দাবি করেন যে “কান্টের ধ্বংসাত্মক সমালোচনা বরং অধিবিদ্যার নতুন যুগের সূচনা করেছে” (হাও ইজ ক্রিটিকাল ফিলসফি এট অল পসিবল?)। কান্টকে একজন অধিবিদ্যাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এই নব্য-হেগেলিয় প্রফেসর নব্য-অধিবিদ্যাকে নিম্নোক্তভাবে সমর্থন করেন:
“কার্যকারিতাবাদী বা ক্রিয়াশীল অধিবিদ্যাকে খারিজ করা যায় না, কারণ এটি যুক্তির নিয়ম থেকে মুক্ত বা মুক্ত করা সম্ভব এমন কোনো সত্তার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং এটি একটি যুক্তিসম্মত সত্তার উপর নির্ভরশীল।”(প্রাগুক্ত)
অর্থাৎ, অধিবিদ্যাকে যুক্তিসঙ্গত করে তোলার জন্য যুক্তিকেই অ-বস্তুগত করে তোলা হয়। অধিবিদ্যক বিভাগগুলিকে তাদের স্বরূপে থাকতে হলে অবশ্যই অ-বস্তুগত (অর্থাৎ আধ্যাত্মিক) হতে হবে। যখন যুক্তিই অধিবিদ্যিক মূল বিভাগ হয়ে দাঁড়ায়, তখন যুক্তিকেও অ-বস্তুগত হিসেবে কল্পনা করা হয়—এবং তা মানুষের আত্মার মধ্যে ঐশ্বরিক আলো হিসেবে আবির্ভূত হয়। লিবার্টের মতে, আধুনিক দর্শনের প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের ঐশ্বরিক সত্তাকে উদ্ঘাটন করা। এই দর্শন অনুযায়ী, “সুপারম্যান”-ই বিশ্ব শাসন করবে—নৈতিকতার সকল নিয়ম ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিকে উপেক্ষা করে। নব্য হেগেলীয় লিবার্ট একজন ফ্যাসিস্ট দার্শনিক, এবং তাই হিটলারের জার্মানিতেও তিনি এখনও “দর্শন” পড়ান।
এই নব্য-অধিবিদ্যার যৌক্তিক পরিণতি হল: “প্রাথমিক সত্তা(প্রায়াস) কোনো বস্তুগত সত্তা নয়, চিন্তাশূন্য কোনো অস্তিত্ব নয়—বরং অস্তিত্বের ধারণা বা ভাবনা”(প্রাগুক্ত)। (মনে হচ্ছে, এই পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে একটি মৃতদেহকে শুধু উল্টো করে দাঁড় করালেই তা জীবিত হয়ে উঠবে!)। এই আদর্শবাদের মূলনীতিকে এতটা সাধারণীকরণ করা হয়েছে যাতে এর মধ্যে ধর্মতত্ত্ব, সর্বেশ্বরবাদ ও রহস্যবাদের প্রবেশ ঘটে—স্বাভাবিকভাবেই সেই পুরনো সৃষ্টিতত্ত্বও এসে যায়, যেখানে একটি অ-বস্তুগত সত্তা (যার অস্তিত্বের কোনো নিয়ম মানা হয় না) ইচ্ছামাত্র শূন্য থেকে সবকিছু সৃষ্টি করে। এই দর্শন অনুযায়ী, মহাবিশ্ব হলো “পরম শূন্য থেকে চেতনার উদ্ভব”—ব্রহ্মের নির্বিকার, নির্গুণ অবস্থা থেকে “অহং”-এর উত্থানই প্রকৃতির সৃষ্টির উৎস। শেলিং-এর ভাষায়, “মহাবিশ্ব ঈশ্বরের আত্ম-চিন্তার ফল”। ঈশ্বরের চেতনা ছাড়া এর কোনো অস্তিত্ব নেই—অচেতন ও জীবন্ত প্রকৃতির সমস্ত বৈচিত্র্য ঈশ্বরের মধ্যেই বিদ্যমান। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই নেই।
এই অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শন কেবল একরকম ভাবেই বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে—তার ব্যাখ্যার অক্ষমতার মাধ্যমে—এমন এক রহস্য উত্থাপন করে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না: “শূন্য থেকে সর্বশক্তিমানের উদ্ভব”। অথবা “লীলা”। উভয় ক্ষেত্রেই, বিশ্বকে দেখা হয় একটি স্থায়ী অলৌকিক ঘটনা হিসেবে, যা একজন ঐশ্বরিক জাদুকর সম্পাদন করেন—একে ভ্রম বা দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। যদি বিশ্ব এক স্থায়ী অলৌকিক ঘটনা হয়, তবে যেকোনো সময় যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। এখানে কোনো নিয়ম নেই—শুধু ঐশ্বরিক জাদুকরের ইচ্ছাই একমাত্র নিয়ম। আর এই মহাজাগতিক খেয়ালই পৃথিবীর একনায়কদের স্বেচ্ছাচারিতায় প্রকাশ পায়। পুঁজিবাদী সমাজের বিশৃঙ্খলাকে এই আধ্যাত্মিক দর্শন দিয়ে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। আর যদি বিশ্বকে ভ্রম বা মায়া বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় (ভারতের ফ্যাসিবাদী দর্শন যা স্বভাবতই করে থাকে), তাহলে জীবনের দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণাকে “অসত্য” বলে ব্যাখ্যা করা যায়—যেগুলি মানুষের ঐশ্বরিক সত্তাকে স্পর্শ করতে পারে না, কারণ কেবল সেই সত্তাই “সত্য”। এইভাবেও একই পার্থিব উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়—আধ্যাত্মিকতাবাদ জনগণকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ রাখে, যাতে শ্রেণীশাসনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নিরাপদ থাকে।
নব্য-হেগেলীয় রহস্যবাদের আরেক প্রচারক, ফরাসি দার্শনিক এমিল লাসবাক্স, হেগেলের দ্বন্দ্বের দ্বান্দ্বিকতাকে “প্রতিকূল শক্তির সমন্বয়”-এর পূজায় পরিণত করেন এবং এই সমন্বয়কেই জীবনের সারসত্য বলে ঘোষণা করেন। তিনি এই সমন্বয়কে “প্রেম” নাম দেন: “জীবন কী নিয়ে গঠিত? অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব, জন্ম ও মৃত্যুর দুটি বিরোধী নীতির সমন্বয় দিয়ে। কিন্তু কোন শক্তি এই সমন্বয় ঘটায়? প্রেম। প্রেমের মাধ্যমেই আমরা অস্তিত্বের পরম রহস্যে প্রবেশ করি; কেবল প্রেমই আমাদের দ্বান্দ্বিকতার চূড়ান্ত লক্ষ্যকে উপলব্ধি করতে দেয়।” (এমিল লাসবাক্স, দ্য ডায়ালেক্টিক অ্যান্ড দ্য রিদম অব দ্য ইউনিভার্স)। মহাত্মা গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই ফ্যাসিস্ট দর্শনে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাবেন না। এটি কোনো নির্জনবাসী বা কবির ব্যক্তিগত মত নয়—লাসবাক্স ফ্রান্সের ক্লেরমঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় অধ্যাপক। পশ্চিমের হতাশ, বিভ্রান্ত ও নৈতিকতাহীন বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদের মেদুর মতবাদ এবং প্রেমের সেন্টিমেন্টাল আরাধনা এখন ফ্যাশন। এই “মহান” অনুভূতিগুলি দ্বারা চালিত হয়ে তারা ফ্যাসিবাদের আদর্শিক প্রচারকে সমর্থন করে।
পরস্পর বিরুদ্ধ নীতির সংশ্লেষণকে জীবনের সারসত্য রূপে প্রতিষ্ঠা করার পর লাসবাক্স সংজ্ঞায়িত করেন, “দর্শনের কাজ হলো যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে পুনঃ সমন্বয় সাধন করা”—এমন একটি প্রচেষ্টা যা পূর্ব ও পশ্চিমের শ্রেণীবিভক্ত সভ্যতার পুরোহিত, পণ্ডিত ও অধ্যাপকদের যুগ যুগ ধরে ব্যর্থকাম করেছে। এখন এই কাজটি সহজ করা হয়েছে প্রকৃতির সমস্ত জটিলতাকে (জীবন, সমাজ, ইতিহাসসহ) একটি ঐশ্বরিক ইচ্ছার রহস্যে নামিয়ে এনে। বাস্তবে, যুক্তিকে বিশ্বাসের সাথে সমন্বয় করা হয় না—একে কেবল সেই রহস্যময়ী দেবীর বেদিতে বলি দেওয়া হয় মাত্র। ঐশ্বরিক ইচ্ছাকে “যুক্তিসঙ্গত” দেখানোর জন্য, দর্শনকে আধুনিক মানবরূপী ধর্মে পরিণত করা হয়। লাসবাক্স শুধু বস্তুজগতের বাস্তবতাই অস্বীকার করেন না, তিনি অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদের পুরনো মতবাদ “সৃষ্টির উদ্গমন”-কেও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মৌলবাদী ধর্মীয় মত গ্রহণ করেন: “বিশ্ব শূন্য থেকে ঈশ্বরের সৃষ্টি—এটি সৃষ্টির ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ”(প্রাগুক্ত)।
জগত সৃষ্টির এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত টানতে দ্বিধা করেননা দর্শনের আধুনিক প্রফেসর লাসবাক্স, এবং পরমেশ্বরের এক নররূপ হাজির করেন, “সর্বোচ্চ স্রষ্টা এক জীবন্ত সত্তা—পরপর তিনটি পর্যায়ের সংশ্লেষ”। সবকিছুর মত ঈশ্বরকেও দ্বান্দ্বিকভাবে ব্যাখ্যা করার এই হাস্যকর প্রচেষ্টা হেগেলকে অনুসরণ নয়, বরং তাঁর অপমান। তবে এটি হিন্দু দর্শনের “সৎ-চিৎ-আনন্দ” ধারণার সাথে হুবহু মিলে যায়। বর্তমান রক্তপাতপূর্ণ পুঁজিবাদের দর্শনই হলো এই নব্য-হেগেলীয়দের “খাঁটি আধ্যাত্মিকতাবাদ”।
লাসবাক্সের ভাষায়, “ঐশ্বরিক আবহই সবকিছুর উৎস”। এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ কী? ঈশ্বর যদি প্রেম, সত্য, ন্যায়ের মূর্তি হন, তবে শোষণ, নিষ্ঠুরতা ও মিথ্যাগুলোও তাঁরই ঐশ্বরিক গুণের “বিভিন্ন প্রকাশ” বলে গণ্য হওয়া উচিৎ! পুঁজিবাদী সমাজে, বিশেষত এর বর্তমান পতনের যুগে, শোষণ চরমে পৌঁছায়, যা অনিবার্যভাবে শ্রেণীসংঘাত সৃষ্টি করে। অস্তিত্বের অমোঘ সংগ্রামে উৎপাদক বহুজনেরা শোষক অল্পজনেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয় যা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠিত শাসনের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। আর তখন “প্রেমের পূজা” কেমন রক্তপিপাসু অস্ত্রে পরিণত হয় তা বুঝতে বিশেষ কল্পনা শক্তির প্রয়োজন পড়ে না। প্রেমের পূজা, সংশ্লেষণ ও পুনর্সমন্বয়ের এই মতবাদ, উচ্চ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় নির্মিত এক নির্মম মতাদর্শগত হাতিয়ার—যাতে জনগণ দাসত্ব, অবমাননা ও দুর্দশার প্রারব্ধে হতোদ্যম হয়ে থাকে এই ভয়ে যে পাছে এই রহস্যময় দৈব সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায়।
নব্য রহস্যবাদের প্রচারক লাসবাক্স তাঁর প্রেমের দর্শন থেকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত টেনে “বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক বস্তুবাদ”-এর বিরুদ্ধে সরোষে গর্জে ওঠেন, যাকে তিনি অভহিত করেন “সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট মিস্টিসিজম” বলে, এবং তাঁর ঘৃণার পাত্র এই ভুতটির বিরুদ্ধে উন্মত্তের মত লড়াই করেন, যে ভুত কিনা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে অন্তর্ঘাত চালানোর হুমকি হাজির করছে। লাসবাক্স খুবই আন্তরিক, আর কঠোর যুক্তিবাদী। তিনি তাঁর সমন্বয় ও “দ্বান্দ্বিক” রহস্যবাদী দর্শন থেকে যে ব্যবহারিক সিদ্ধান্ত টানেন তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। যেসব ভারতীয় বুদ্ধিজীবী সচেতন প্রতিক্রিয়াশীল না হয়েও আধ্যাত্মিকতাবাদের মানসিক ব্যাধিতে ভোগেন তাঁদের জন্য এই শিক্ষা নিরাময় ঘটাতে পারে। লাসবাক্সের মতে, “ঐশ্বরিক সমন্বয়-প্রেম প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃত কর্তৃত্বের সমন্বয় হিসেবে রাষ্ট্র ও গির্জার একীকরণ দাবি করে।” (এমিল লাসবাক্স, “দ্যা হিউম্যান সোসাইটি”)। অর্থাৎ, পুরোহিততন্ত্র, ধর্ম ও আধ্যাত্মিক নৈতিকতা—এক’কথায় আধ্যাত্মিকতার সবরকম রূপই শ্রেণীশাসন চালানোর রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্ত্র, ঠিক যেমন সেনাবাহিনী বা পুলিশ ইত্যাদি।
নব্য হেগেলীয় দার্শনিক মহাশয় এখানেই থেমে থাকেন না। তিনি আরও বলেন, ঐশ্বরিক বিশ্ব-ছন্দের জাগতিক প্রকাশও “দ্বান্দ্বিক”—তা “রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে, এবং সেখান থেকে সাম্রাজ্যে যায়।” এখানে আধ্যাত্মিকতাবাদ সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের আদর্শ হিসেবে হাজির হয়। দর্শন কোনো সনাক্তকরণ-সূত্র বা স্লোগানের ব্যাপার নয়। এর একটি সামাজিক-ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে, এবং বাস্তব পরিণতিও রয়েছে—যা অনিবার্যভাবে একই ধরনের হয় যখন ধারণাগুলো অভিন্ন প্রবাহপথে চলে।
সমসাময়িক পশ্চিমী দর্শনের সেই সমস্ত পণ্ডিতরা যারা ফ্যাসিবাদের অগ্রদূত হিসাবে আধ্যাত্মিকতার প্রচার করেন তাদের নিয়ে আরো আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন ও একঘেয়ে হবে। পতনশীল পুঁজিবাদী সভ্যতার রাষ্ট্রীয় জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে এক নজর দেখলে ভারতীয়রা সস্তা তৃপ্তি পেতে পারেন বস্তুবাদের উপাসকদের মুক্তির সন্ধানে আধ্যাত্মিকতার আঁতুড়ঘরের দিকে ফিরতে দেখে। কিন্তু এই আধ্যাত্মিক পুনরুত্থানের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ প্রতিক্রিয়াশীলদের ছাড়া বাকি সকলকেই নিশ্চিত করবে যে আধ্যাত্মিকতা গর্ব করার মতো কোনো বিষয় নয়। যদি এটা সত্য হয় যে পতনোন্মুখ পুঁজিবাদী সভ্যতাকে রক্ষার সন্ত্রস্ত প্রচেষ্টায় ভারতের কাছে পাশ্চাত্য প্রতিকার খুঁজছে, তবে তা ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য কখনোই গৌরবের বিষয় বলে বিবেচিত হতে পারে না। বরং এটি ভারতের আধ্যাত্মিক প্রতিভার উপর এক ক্ষতিকর প্রতিফলন হিসাবে দেখা উচিত। বিপ্লবের উদীয়মান জোয়ারকে প্রতিহত করার একমাত্র সম্ভাব্য রক্ষাকবচ হিসাবে চিহ্নিত হওয়া কোনো প্রশংসার বিষয় নয়—যে বিপ্লব পুঁজিবাদী সমাজকে ধ্বংস করে মানবতাকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। তবুও, বিস্ময়করভাবে, ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার গর্ব ঠিক এখানেই যে এটি একাই বিপ্লব রোধ করার এই অত্যন্ত অগৌরবজনক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। গান্ধীবাদের তথাকথিত অভিনবত্ব এখানেই যে এটি স্বাধীনতার এমন এক পথ খুঁজে পেয়েছে যা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যায় না: এতে স্বাধীনতা ও প্রগতির লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে মানবিক শারীরিক শক্তির স্থলে আত্মিক আধ্যাত্মিক শক্তিকে বসানো হয়েছে।
গান্ধীবাদের এইসব ভণিতার সমালোচনা করা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে এর সাথে ফ্যাসিবাদী দর্শনের গঠনগত সাদৃশ্য উন্মোচিত হয়েছে। স্বাধীনতা ও প্রগতির জন্য পর্যায়ক্রমিক বিপ্লবী পরিবর্তন অপরিহার্য নয়—এই তত্ত্বটি পাশ্চাত্য শাসক শ্রেণির দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন থেকেই যখন থেকে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি, এমনকি “বিপ্লবের বীজগণিত” হিসাবে সঠিকভাবে চিহ্নিত হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতাকেও বিকৃত করে বিপ্লব-বিহীন স্বাধীনতা ও প্রগতির তত্ত্ব তৈরি করা হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী তাঁর অলৌকিক ‘বেদনাহীন সামাজিক-রাজনৈতিক দন্তচিকিৎসা’ পদ্ধতি নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার অনেক আগেই, রুশ-সুইজারল্যান্ডীয় দার্শনিক ডেভিড কয়গেন আজ যা গান্ধীবাদ বলে পরিচিত তা আগেই প্রচার করেছিলেন। “কয়গেন ‘বিপ্লবের মানুষ’-এর বিপরীতে স্থাপন করেছেন ‘রেনেসাঁর মানুষ’-কে—যাঁর মধ্যে জীবনের সৃষ্টিশীল উপাদান ধ্বংসাত্মক উপাদানের ওপর প্রাধান্য পায়, যাঁরা চিন্তা ও অনুভূতিতে বিপ্লবী আবেগের ব্যাধি থেকে মুক্ত, যাঁদের সমস্ত শক্তি ও আকাঙ্ক্ষা একসাথে সুরেলা সংগীতের মতো স্পন্দিত হয়, যাঁদের নিজস্ব জীবনই তাদের নীতিশাস্ত্র—অর্থাৎ যাঁদের নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে হয় না, যেহেতু তাঁরাই নৈতিকতার মূর্তপ্রতীক”।(ফ্রান্স মেহরিং, “অন দ্যা হিস্টরি অব ফিলসফি”)। পাশ্চাত্য সভ্যতার সেই সক্ষমতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ যা ভারতের মতোই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাকে কবিত্বপূর্ণ রূপে প্রকাশ করতে পারে! এখানে সুপারম্যানের পূজাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের প্রয়োজনে কাজ করতে গিয়ে ফ্যাসিস্ট একনায়কদের নৈতিকতার কোনো নীতিতে আবদ্ধ থাকলে চলবে না; তাদের নিজস্ব নীতিশাস্ত্র থাকতে হবে। এই নব্য-আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও রহস্যবাদের ব্যবহারিক প্রয়োগই হলো ফ্যাসিবাদ—পুঁজিবাদী আধিপত্যের হিংস্র রূপ। যতদিন বুর্জোয়ারা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবঞ্চনাময় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শাসন করতে পেরেছে, ততদিন তাদের দর্শনের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতা আপাতদৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত রূপের আড়ালে কিছুটা লুকিয়ে ছিল। যতদিন তাদের ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছিল, ততদিন তারা সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্র থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঐশ্বরিক অনুমোদনের ভাণ্ডারে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু আজ বিপ্লবী শক্তির সমাবেশ—যা বুর্জোয়াদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে, পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের চাপে সংসদীয় ব্যবস্থার ধস—বুর্জোয়াদের একের পর এক দেশে সংসদীয় মুখোশ ছুড়ে ফেলে খোলাখুলি একনায়কত্ব চালাতে বাধ্য করেছে। ফ্যাসিবাদী আন্দোলন এই একনায়কত্বের পথ প্রস্তুত করে; ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তার হাতিয়ার। বার্গসোনীয়, প্রাগমাটিস্ট ও নব্য-হেগেলীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের চরম আধ্যাত্মিকতা, নব্য-অধিবিদ্যা ও “যুক্তিসঙ্গত” অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ এই রক্তপিপাসু একনায়কত্বের আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করে এবং তাকে ন্যায্যতা দেয়।