মাঝে একটা বড় গেট, গেটের একপাশ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শ্যামবাজার ও বেলগাছিয়া যাওয়ার গাড়ি। ঠিক তার ওপাশে তিলোত্তমার মঞ্চ আগলে বসে একদল জনতা-ছাত্র। দাবি, ন্যায় বিচারের। তাঁদের চারিপাশ ঘিরে বিশালাকার পুলিশ, সেনাবাহিনী, তদন্তকারী অফিসারের দল। মঞ্চের বামপাশ ধরে হেঁটে গেলে নজরে আসে কয়েকটি ছোট ট্রাক। মাথায় ছাউনি, তলায় বসে ডোরাকাটা জলপাই পোশাকের বন্দুকধারী। ঠিক তার আগে মাটিতে হন্যে দিয়ে বসে আছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা কয়েক'শ পরিবার। ঘরের লোক হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসা চলছে। তাঁদের মাথার উপরে ক্যামেরা, তলায় লেখা, আপনি নজরবন্দী।
চিত্রটি আরজি কর হাসপাতালের। জনসাধারণ জানান, চিকিৎসা করাতে গিয়ে গেটের বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকতে গেলে নানা উদ্ভট প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়।
এ-সমস্ত দেখে বোঝা মুশকিল যে, এটি কোন বর্ডার অঞ্চল, না কি যুদ্ধক্ষেত্র, না কি অসুস্থ মানুষের সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার হৃদপিন্ড। পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক কিংবা বর্ডার অঞ্চল থেকে যে-সব শ্রমজীবী মানুষেরা আসছেন মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কম খরচে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নেবেন বলে চিকিৎসা করাতে, তাঁদের কাছে এ-চিত্র খুব একটা অ-স্বাভাবিক নয়। কিন্তু অস্বস্তিকর, জীবনযাপনের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই মনের ভেতরে ভয় জমাট বাঁধতে বাধ্য। তাঁরা ঠেকে শিখেছেন, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। জানেন, সুরক্ষা দেওয়ার নামে এই পুলিশ, সেনাবাহিনী, তদন্তকারী দলের অফিসারেরাই কীভাবে নজরদারি চালায়। উঁকি দেয় ঘর-সংসারে ভেতরে, কথার এদিক-ওদিক হলে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় চাষের জিনিস, হাঁস, মুরগি, ছাগল সমেত নানা জিনিসপত্র প্রভৃতি। আর নয়তো বন্দী করে নিয়ে যায় আস্ত মানুষগুলিকেই।
এঁরা বোঝেন যে, রাষ্ট্রের এই প্রক্রিয়া জনসাধারণকে নজরবন্দী করবার অন্তর্গত, সমাজকে ঘিরে নেওয়ার চাট্টি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প। কেবল তাঁরা সঠিকভাবে আর পাঁচজনকে বোঝাতে ব্যর্থ।
আরজি কর হাসপাতালের এমন দৃশ্য আদতে তাই, সেই ইঙ্গিতই দেয়। একটি চিকিৎসার জায়গায় ও কলেজ ক্যাম্পাসে জনতা-ছাত্রের কেন ভয়, কিসের ভয়, কাঁদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এত প্রহরা চাই, যাঁরা প্রহরা সাজিয়েছেন অথবা যাঁরা প্রহরা দেবেন তাঁরা কী সমাজের সেই দুষ্ট লোকদের বিরুদ্ধে, যদি হয় তাহলে ইতিহাস কী মিথ্যে --- এসব প্রশ্ন ওঠে না কেন, নাকি উঠলেও সেই প্রশ্নগুলিকে খুবই সুকৌশলে কায়দা করে সরিয়ে ফেলা হল? সম্ভবত দ্বিতীয়টাই। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে 'মেয়েদের রাত দখল, অধিকার দখল'র মঞ্চের অন্যতম প্রধান দাবিসনদ ছিল, এটাই। 'নজরদারি নয় মুক্তি চাই'। কিন্তু নজরদারির হাত থেকে মুক্তি কোথায়, রাজ্য সরকার প্রথমে মেয়েদের রাতের কাজ বন্ধ করবার উদ্যোগ নিয়ে মেয়েদেরকেই নজরবন্দী করবার নয়া সূচনাপত্র জারি করেছিল। পরবর্তীকালে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র সংঘবদ্ধ হয়ে একই পথে হাঁটল, শহরের নাগরিক সমাজকে ঘিরে ফেলবার প্রস্তুতির নয়া পর্ব শুরু হল। সম্ভবত, যার প্রথম ধাপ এটাই। সুরক্ষার আড়ালে একটি সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস ও হাসপাতালে(জনসেবার জায়গা) রাজ্য-কেন্দ্রের যৌথ মহড়ায় কয়েক'শ বাহিনী এবং অত্যধিক পরিমাণে নজরবন্দী করবার ক্যামেরা লাগানো।
একটি সরকারি হাসপাতালে রুগী, ডাক্তার, কর্মীদের সুরক্ষা প্রদান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটি করতে সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে রাষ্ট্রকেই; প্রধানত, ডাক্তার ও জনসাধারণের মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলি কমানো, ডাক্তার ও হাসপাতালের নানা কর্মীর মধ্যে এবং ডাক্তার ও রুগীর মধ্যে সু-সম্পর্ক স্থাপন করা তারই অংশ। প্রাথমিকভাবে, হাসপাতালকে জনসাধারণের করে তোলা, চিকিৎসাকে সব থেকে অনগ্রসর জাতি ও শ্রেণীর মানুষের নাগালে আনা, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসের খরচ কমানো, এগুলি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্নিহিত। রাষ্ট্র এমন দায়িত্বগুলি সততার সাথে পালন করলে পরেই রুগী ও ডাক্তার এবং হাসপাতালের নানা কর্মীদের মধ্যে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, সরকারি হাসপাতালগুলি উন্নতির প্রকৃত মুখ দেখবে। আর জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারাই সরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের সুরক্ষাও সুরক্ষিত থাকবে। আসলে হাসপাতালে কী কী প্রয়োজন, তা সময়ের সাথে খতিয়ে দেখা, অনুসন্ধান করা, ডাক্তার, কর্মী ও রুগীদের থেকে তা জানা, সামগ্রিক জনসাধারণের মতের উপর ভিত্তি করে সেগুলি করা, তারপরে হাসপাতালের নানা পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে সঠিক জনমুখী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। নয়তো সামাজিক দ্বন্দ্বগুলি(এক্ষেত্রে প্রধানত, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্ব) ভুল দিকে, বিবর্তনের(সমাজ বিকাশের) বিরুদ্ধে বিকশিত হতে বাধ্য।
এসব কী করছে রাষ্ট্র, করেছে রাজ্য সরকার? আক্ষরিক অর্থে করেনি কিছুই। রাজ্য সরকার শুধু হাসপাতালের সুপার ও উচ্চপদস্থ দপ্তরের কয়েকটি বৈঠক সেরে ও হাসপাতালে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ক্ষান্ত। বরং তারা জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে খাড়া করতে অত্যধিক সময় ও শ্রম ব্যয় করাতে বেশি মগ্ন। এটি করে তারা আদপে জনসাধারণকে সরকারি হাসপাতাল বিমুখ ও সেখানকার ডাক্তারদের বিরুদ্ধে করে তোলবার প্রক্রিয়া চালালো। রাজ্যের জনসাধারণের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সঠিক পথ দেখানোর প্রয়োজন ছিল গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের। কিন্তু সেগুরে বালি, এ সুযোগের সদ্ব্যবহার প্রবলভাবে করলো গোটা রাষ্ট্র কাঠামো। অলিখিতভাবে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থার(সুপ্রিম কোর্ট) রায়ে রাজ্যে আপাতত স্থায়ী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, কেন্দ্রীয় ফোর্স, যা সম্পূর্ণভাবে বহুত্ববাদী ভারতের গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোগত আচরণের বিরুদ্ধ। আবার সরকারি হাসপাতাল ও কলেজ ক্যাম্পাসে রাজ্য-কেন্দ্রের যৌথতায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, তদন্তকারী দল, যা সম্পূর্ণরূপে ভারত রাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী সমাজব্যবস্থা গঠনের তোড়জোড়, তা বলাই বাহুল্য।
দেশের এমন অসহায়পূর্ণ অবস্থা দেখে একটি প্রশ্ন নানা ভাবে ঘুরপাক খায় --- আগে যন্ত্র নাকি মানুষ, আগে রাষ্ট্র নাকি মানুষ, সমাজ বিকাশে (বিবর্তন) চাই মানুষ চালিত রাষ্ট্রযন্ত্র নাকি রাষ্ট্রযন্ত্র চালিত মানুষ? এ উত্তর দেওয়া যতটা সহজ তার অধিক কঠিন বর্তমানের বাস্তবের সাথে সেটাকে মেলানো।
তবে সমাজে আন্দোলনকারীদের কাছে সব থেকে নিপীড়িত মানুষগুলি প্রধান, তাঁদের চিকিৎসার যথার্থ ব্যবস্থা করা গেলে সমাজের প্রত্যেক অংশই নিশ্চিৎভাবে সে সুবিধা ভোগ করবে। যাঁরা সব থেকে নিপীড়িত, জানেন রাষ্ট্রের নির্যাতনের নির্মম চরিত্রের ইতিহাস। জানেন, কীভাবে একটি গ্রামে 'সুরক্ষা' প্রদানের নামে রাষ্ট্রীয় পুলিশ-সেনা ছাউনিগুলি তৈরি হওয়ার পরে নানা দুর্নীতি ও হুমকির মাধ্যমেই কয়েক রাতের মধ্যে বহু অজুহাতের সহায়তা নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে আশপাশের প্রত্যেকটি গ্রামে, গ্রাম লাগোয়া মফস্বলে। ফলে সেই নির্মন ইতিহাসের সর্তকতা ও নিপীড়িতদের কথা মাথায় রেখে জনসাধারণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা ও আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে, আরজি করে রাষ্ট্রীয়বাহিনীর যৌথতার বিরুদ্ধেও আওয়াজ দৃঢ় করা প্রয়োজন। এখনও স্বাস্থ্যসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, নানা গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি এ আওয়াজ তুলছে না কেন, তা এক বিস্ময়কর প্রশ্ন।
সংঘবদ্ধ ডাক্তার ও মেয়েদের, নাগরিক সমাজের আন্দোলন সমাজকে আবারও প্রতিবাদ করবার রসদের জোগান দিয়েছে। প্রতিবাদের নতুন মুখ, মুখের নতুন প্রতিবাদী ভাষা শিখিয়েছে। রাষ্ট্রের বাঁধা গন্ডির বাইরেও এগোনোর খানিক সাহস জুগিয়েছে। বিকল্প রাজনীতির সন্ধানে সমাজকে আঁকড়ে ধরে, রাষ্ট্রকে ঘিরে ফেলবার আশাও দেখিয়েছে। ফলে এই আন্দোলনকেও সমাজ ও জনগণের থেকে দূরে সরানোর ধৃষ্টতা রাষ্ট্র নানা কায়দায় আগেও দেখিয়েছে, এখনো দেখাচ্ছে। আশংকা, ধারাবাহিকতার সাথে তা ভবিষ্যতেও দেখাবে। একটি জনগণের হাসপাতালে এত পরিমাণে রাষ্ট্রীয়বাহিনী, সিসিটিভি ক্যামেরা, এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করবার সেই প্রচেষ্টার-ই লক্ষণ। ভবিষ্যতে গোটা নাগরিক সমাজ ও মেয়ে, জনগণকে ঘিরে ফেলবার একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প, যার শুরুবাদ হয়তো একটি সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস ও হাসপাতালের দ্বারাই হল। এ আন্দোলন যে মূল সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে তীব্রতর প্রসারিত হতে পেরেছে, আন্দোলন থেকে যে যে দাবিসনদগুলি উঠে এসেছে, তা গোটাটাই সমাজব্যবস্থার দীর্ঘদিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে টিকে থাকা পুরাতন সম্পর্ক, রীতিরেওয়াজ ভাঙবার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাই সমাজকে ঘেরাঘেরির, রাষ্ট্র বনাম জনগণের এমন জটিল অঙ্ক। এটিকে ভুল দিকে অতিবাহিত করতে, সেই পুরাতন সমাজকে আগলে রাখতে রাষ্ট্রের এমন সুকৌশলীয় বাঁধা, নজরবন্দীর প্রকল্প; সুরক্ষা প্রদানের নামে কিছু পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে জনগণের সমাজকে নতুন রূপে নজরবন্দী করবার বিপুল স্বপ্ন।
চিকিৎসা স্থল, কলেজ, ক্যাম্পাস তথা নাগরিক সমাজের সর্বত্রে রাষ্ট্রীয় নজরবন্দীতার স্বপ্ন ভাঙতে গেলে এ আন্দোলনেও দরকার, সেই সব মানুষকে --- যাঁরা এসবের ফলে ইতিহাস থেকে অত্যাচারিত, চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত, সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশ, মুক্তি চায় প্রতিনিয়ত। তাঁরা অপরকে বোঝাতে না পারলেও নিজেরা বোঝেন যথেষ্ট পরিমাণে, কেন রাষ্ট্র নাগরিক সমাজের কাছে নজরবন্দীর গালভরা নাম, 'সুরক্ষা' রেখেছে।