২০২২ সালের ডিসেম্বরে ম্যাকিন্সে একটি ৪৬ পাতার প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ব ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপরে। সেই তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের অর্ধেকের বেশী ব্যাঙ্ক তাঁদের মূলধনজনিত খরচের কম রোজগার করে। এই একটি তথ্যই বোধহয় জানিয়ে দেয় সারা বিশ্বের ব্যাঙ্কিং সেক্টরের বর্তমান হাল। তবে এই লেখায় আমাদের দেশের খবরের দিকে তাকানোই বোধহয় প্রাসঙ্গিক হবে।
বর্তমানে আমাদের দেশের ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় নিযুক্ত আছে ১২ টি সরকারী ব্যাঙ্ক, ২২টি ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যাঙ্ক, ৪৬ টি বিদেশী ব্যাঙ্ক, ৫৬ টি আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, ১৪৮৫ টি শহর কেন্দ্রিক সমবায় ব্যাঙ্ক, ও প্রায় ৯৬,০০০ গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্ক।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী দেশে ২,১৩,১৪৫ টি এটিএম ব্যবস্থা চালু আছে এবং এরমধ্যে প্রায় ৪৭.৫% এটিএম গ্রামে বা ছোট টাউনে আছে। এই পরিসংখ্যান থেকে এই বিশাল দেশের বর্তমান ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ব্যাপকতা বোঝা যায়।
এই ব্যাপক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার যদি ঋণ বণ্টনের দিকে তাকানো যায় তাহলে রেটিং ও রিসার্চ এর মতো সংস্থা একটি পূর্বাভাস দিয়েছে তার দিকে তাকানো যেতে পারে – হয়তো ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ঋণ বণ্টন প্রায় ১০% বৃদ্ধি পাবে।
গত ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমাদের কাছে পেশ করেছেন – ফিচ রেটিং সংস্থা ও স্টেট ব্যাঙ্ক।
এই ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের পরিসরে ফিচ রেটিং সংস্থার গত মাসের ,৭ ফেব্রুয়ারী ২৩ এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণ উল্লেখ করা উচিত যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফিচ রেটিং মনে করেন, যে আদানি সংক্রান্ত কোন ঝুঁকি ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপরে পড়বে না এবং ‘ইসুয়ার ডিফল্ট রেটিং’ ঠিক একই রকম আশা করে যে আদানি সংক্রান্ত কোন আঘাত ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপরে সেভাবে আসবে না এবং ভারত সরকার যদি প্রয়োজন হয় অবশ্যই ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় দেবে, এবং যথাযত ভাবে ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থার পাশে দাঁড়াবে।
৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ এ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছেন তাঁদের আদানি গ্রুপে ঋণের পরিমাণ বর্তমানে কমেছে – ২০১৬ তে যা প্রায় ৫৫% ছিল, ২০২২ এর শেষে যা ৩১% এ সেই ঋণের পরিমাণ কমে এসে দাঁড়িয়েছে। আদানি গ্রুপে স্টেট ব্যাঙ্কের সর্বমোট ঋণের পরিমাণ ০.৮% থেকে ১.২% ছিল।
তবে এটাও মনে রাখা উচিত যে আদানি গ্রুপ বর্তমানে ভারতীয় পরিকাঠামো গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং, পরিকাঠামো গঠন এমনই এক ক্ষেত্র যা দীর্ঘকালীন ঋণের ওপরে নির্ভরশীল। এখন যদি আদানি ঋণ সময়মত শোধ করতে না পারে তাহলে ভারতীয় অর্থনীতির ওপরে মধ্যবর্তী পর্যায়ে খারাপ সময় আসতেই পারে, তবে যদি তা সত্যি সত্যি হয় সেই ধাক্কা অর্থনীতিতে দীর্ঘকালীন ছাপ রেখে যাবে না, এবং ভারতের ক্রমপর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন তেমন খারাপ প্রভাব পড়বে না।
ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের জন্য প্রাসঙ্গিক আর একটি তথ্য, মার্চ ২০২৩ কিছুদিন আগে এসেছে সেই তথ্য এসেছে রয়টার এর থেকে।
রয়টার একটি বিশ্লেষণ (২০ মার্চে) প্রকাশ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কিং সেক্টরের বর্তমান সমস্যা এবং তার পরিপেক্ষিতে প্রধান ভারতীয় অর্থনীতিক সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আমানতকারিদের সুরক্ষা প্রদান তাঁদের প্রধান কর্তব্য।
অর্থনীতির প্রায় যে কোন বিশ্লেষণ স্টক মার্কেটের প্রতিক্রিয়া না দেখলে শেষ হয় না। ন্যাশানাল স্টক এক্সচেঞ্জ তাঁদের বিভিন্ন সেক্টরের ওপরে ইনডেক্স দেখান। এদের মধ্যে ব্যাঙ্কিং সেক্টর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইনডেক্স।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কিং সেক্টরের বর্তমান সমস্যার প্রতিক্রিয়ায় এনএসই – ব্যাঙ্কিং সেক্টর প্রায় ৫.৩% কমে গেছে অবশ্য সিলিকন ভ্যালী ব্যাঙ্কের এই বিপর্যয়ের জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৮% ব্যাঙ্কিং ইনডেক্স কমে গেছে।
ইন্সল্ভেন্সি ও ব্যাঙ্করাপ্সি কোড ২৮ মে ২০১৬ তারিখে আমাদের দেশে বলবত হয়, এরপরে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির ঋণ ফেরত পাওয়া বহুগুন বেড়ে যায়। যদিও ঐ কোড টাকা উদ্ধার করার জন্য বলবত করা হয় নি। সেই সঙ্গে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে মূলধন সংগ্রহের দিকে নতুন ভাবে নজর দেওয়া শুরু হয় ও খরচ কমানোর ব্যাপক চেষ্টা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্যের দিকে তাকানো যেতে পারে, ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির মূলধন বৃদ্ধি ২০১৮ থেকে ২০২৩ এর শুরু অবধি বেশ ভালোই হয়েছে যা প্রায় ১৩.৫% থেকে বেড়ে প্রায় ১৬% হয়েছে। অন্যদিকে এনপিএ কমেছে যা ২০১৮ র সেপ্টেম্বরে প্রায় ১০.৮% ছিল সেটি কমে প্রায় ৫.৯% হয়েছে মার্চ ২০২২ এবং ৫% হয়েছে সেপ্টেম্বর ২০২২ এ।
ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির স্বল্প খরচের মুলধন প্রধানত সেভিংস এ রাখা টাকা। তুলনামুলক ভাবে অনেক বেশী যদি খুচরো গচ্ছিতের (রিটেল) সঙ্গে তুলনা করা যায়।
তবে এ প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থার ( উটিআই, এলআইসি ) স্বায়ত্ত শাসন, যা খাতায় কলমে থাকলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেকের অঙ্গুলিহেলনে চলে – এর অনেক প্রাথমিক তথ্য ইদানীং কালে জনগণের কাছে আছে তাই এই লেখায় তার আবার উল্লেখের প্রয়োজন নেই।