অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আর কোথাও বেরোননা সুধাময়। আয়েস করেন। টিভি দেখেন। একে ওকে ফোন করেন। ফোনে অনেকক্ষণ সময় ধরে কথা বলেন।
আজ যখন সুধাময় অফিস থেকে ফিরে চা-জলখাবার খেয়ে, বাইরে বেরোবার জন্য জামাপ্যান্ট পরে তৈরী হচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বললেন, কোথাও বেরোচ্ছ মনে হচ্ছে!
- অফিসের একজনের বাড়ি যেতে হবে। সে আজ আসতে পারেনি। ফোন করে জানিয়েছে আগামী দুদিন আসবে না। তার জন্য জরুরী একটা কাজ আটকে গেছে। সুধাময় ধীর গলায় থেমে থেমে বললেন, একটু দেরী হলেও হতে পারে। চিন্তা করো না। ফোন করারও দরকার নেই।
অপেক্ষাঘরে সুধাময় একা বসে আছেন। বাকি দুজন মানুষ, তাঁর ধারণায় যারা স্বামী স্ত্রী এখন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। ডাক্তার এবং রোগীর আবছা ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শব্দ সুধাময়ের কানে আসছে।
- হাতে ধরা কাগজটাকে আর একটু দূরে সরিয়ে নিয়েযান।
- এবার অসুবিধে হচ্ছে। ঝাপসা লাগছে।
- চোখে চাপ পড়ছে?
- মনে হচ্ছে মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
- উৎকন্ঠিত মহিলার গলা, ওকে একটু রেস্ট দিন। ওর কষ্ট হচ্ছে।
- প্লীজ আপনি কথা বলবেন না।
সুধাময় মোটেও দুর্বল মনের মানুষ নন। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর মনে হলো, বাড়িতে সত্যি কথাটা বললে, কোনমতেই তাঁকে একা আসতে দেওয়া হতো না।
প্লাইউডের পার্টিশানের গায়ে কাঠের নেমপ্লেট লাগানো।
ডাঃ বি. দাশগুপ্ত।
এম.বি.বি. এস. ডি. অপথ্যালমোলজি।
নেমপ্লেটের ওপর লাগানো বাল্বটি কমজোরী।
সুধাময় সোজা চোখে তাকিয়ে নেমপ্লেটের পুরো লেখাটা পড়ে ফেলতে পারলেন। কোন অসুবিধে হলো না। এমনকি 'ইন'-'আউট'-র সাটারটাও স্পষ্ট দেখতে পেলেন। 'ইন' ঢাকা, 'আউট' উন্মুক্ত। যার মানে দাঁড়াচ্ছে এই মুহূর্তে ডাক্তারবাবু চেম্বারে নেই।
সুধাময়ের হাসি পেল। তার সঙ্গে মনে একটু জোরও পেলেন। আজ সকালে অফিসে বড় সাহেবের চেম্বারে, মুখোমুখি চেয়ারে বসে, তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে, সাহেব অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী হলো সুধাময়বাবু? অমন স্থির চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখছেন?
সুধাময় সাহেবের প্রশ্ন শুনতে পেলেন। কিন্তু জবাব দিতে পারলেন না।
- আপনাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে। শরীরের মধ্যে কোনরকম অস্বস্তি হচ্ছ?
সুধাময় আলতো ঘাড় নেড়ে বললেন না।
সাহেব বললেন, ঠিক আছে। আজ আপনি আসুন। যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকেছিলাম, সেটা একটু জটিল। সময়ও লাগবে। অন্য আর একদিন...!
সুধাময় যখন সাহেবের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন, সাহেবের গলা শুনতে পেলেন, সুধাময়বাবু, ইট ইজ মাই সাজেশন, রাতে হালকা ঘুমের ওষুধ খাবেন। আপনার সাউন্ড ঘুমের দরকার। ঘুম ইট সেলফ এ গুড মেডিসিন।
অপেক্ষাঘরটি আয়তনে বেশ বড়সড়। পুরনো আমলের ঘর। চওড়া দেওয়াল। কড়ি বরগার ছাদ। টিউব লাইট, তার সঙ্গে এলইডি বাল্বও জ্বলছে। তারপরেও সুধাময়ের মনে হলো, ঘরটির দেওয়ালের এখানে সেখানে আবছা ছায়া ছায়া ভাব। হঠাৎ করেই সুধাময়ের মাথাটি সামান্য ভারভার লাগতে লাগল। উঠে দাঁড়ালেন। নিজের ডিসিশনে চোখের ডাক্তারের কাছে আসাটা ঠিক কাজ হয়নি। হয়ত সমস্যাটা অন্য কোন কারণে হচ্ছে। আর সেটাও বেশ জটিল। আগামীকাল অফিসে বড় সাহেবকে সবটা খুলে বললে, তিনি হয়ত সঠিক ডাক্তারের পরামর্শটা দিতে পারবেন। তারপর সেই মতো...!
অপেক্ষা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য সুধাময় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক তখনই প্লাইউডের দরজা খুলে মাথা বাড়িয়ে ডাকলেন ডাক্তারবাবু, কী হলো ? আসুন।
- ! ও হ্যাঁ...! সুধাময় আমতা আমতা করে বললেন, আগের পেশেন্ট তো এখনও বেরোননি। তাই আর কি...!
- বেরিয়ে গেছেন। ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, চেম্বারে ঢোকা এবং বেরোনোর দরজা দুটো আলাদা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুধাময় চেম্বারে ঢুকলেন এবং ডাক্তারবাবুর মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। শেষ পেসেন্ট হিসাবে ডাক্তাবাবুকে বেশ রিল্যাক্সড মুডে গেলেন। সুধাময় এ দেশীয় মানে পশ্চিমবঙ্গীয়, এ শহরের পুরনো বাসিন্দা এবং সরকারী চাকরি করেন, এই তিনটি বিষয় ডাক্তারবাবুকে বেশ তৃপ্তি দিল, সুধাময়ের মনে হলো।
- দেখুন পৈতৃক বাড়িটা রক্ষা করতে পারেন কিনা! ডাক্তারবাবু বললেন, চাকরির মেয়াদও যদি পুরোপুরি করতে পারেন, জানবেন সেটাও ঈশ্বরের অপার করুণা। একটু চুপ করে থেকে লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন,বলুন। আপনার অসুবিধাটা কী ?
সুধাময় যতদূর সম্ভব অসুবিধার ব্যাপারটা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলেন। ডাক্তারবাবু সুধাময়ের চোখের ওপর জোরালো আলো ফেলে, সুধাময়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে, দুটি চোখকে এপাশ ওপাশ নাড়াচাড়া করে বেশ খানিকটা সময় ধরে দেখলেন। আকারে ছোট, পাখির পালকের মতো হালকা একটি যন্ত্রও ব্যবহার করলেন। তারপর জোড়ালো আলোটি নিভিয়ে দিয়ে, নিজের চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ব্যাস ! এই সমস্যা ! আর কিছু নয়?
সুধাময় ঘাড় দুলিয়ে বললেন, না, আর কিছু নয়।
- সোজা চোখে কারোর দিকে তাকিয়ে থাকলে, হঠাৎ করে আলোর ঝলকানি ! তাইতো ? সেই মুহূর্তে যার দিকে তাকিয়ে আছেন, তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। তার পরিবর্তে ঝকঝক করছে আলো। চোখে চাপ পড়ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। ব্যাস, এই ?
সুধাময় আবারও সমর্থনের ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বললেন, ঠিক তাই।
- দেখুন, ভয় পাওয়ার মতো কিছুই হয়নি। আপনার চোখের কর্নিয়া, নার্ভ, টিসু, এমনকি চোখের প্রেসার পর্যন্ত, এভরিথিং ইজ ওকে। বলে একটু থামলেন ডাক্তারবাবু, তারপরেও এমনটা হচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই এটা জানতে ইচ্ছা করছে, তাইতো ? ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগটার একটা নাম আছে। রোগের কারণও ব্যাখ্যা করা আছে। আমি রোগের নাম, কারণ কিছুই আপনাকে জানাতে বোঝাতে যাব না। কারণ আপনি সেটা বুঝবেন না।
- সুধাময় খুব ঘাবড়ে গেলেন। অসহায়ের মতো গলা করে বললেন, তাহলে এখন উপায়?
- ডাক্তারবাবু সুধাময়ের মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন। টেবিলে হাতের আলতো চাপড় মেরে বললেন, উপায় বাতলাব আমি। ভেরি ইজি এ্যান্ড সিমপল। কোন ওষুধ লিখব না।
- কেন? সুধাময়ের মুখ ফসকে প্রশ্নটা যেন হঠাৎ করে বেরিয়ে এল, ওষুধ ছাড়াই চিকিৎসা ?
- ইয়েস। বলে ডাক্তারবাবু ঠোঁট বন্ধ করে হাসলেন, শুনুন এখন থেকে আপনি আপনার দৃষ্টি, মানে তাকানোর ভঙ্গিতে বদল আনুন। ব্যাপারটা একটু ভেঙে বলি। কোন কিছুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকবেন না। র্যাদার, এখন থেকে আপনি আপনার দুচোখের আইবলকে ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাতে থাকুন। পথ হাঁটছেন, সামনে তাকান। আবার পরমুহূর্তেই আইবল ঘুরিয়ে ডান এবং বাঁ দিকটাও দেখে নিন। কারোর মুখোমুখি বসে কথা বলছেন, তার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই, দ্রুত আইবল ঘুরিয়ে দুপাশটা দেখে নিন। আবার সোজা তাকান। পরমুহূর্তেই দৃষ্টি ঘোরান। এইভাবে, ক্রমান্বয়ে। ব্যাপারটা যে খুব কঠিন, তা নয়। আবার যে খুব সোজা, সে কথাও বলছি না। অভ্যাস করতে হবে। আর যদি সেটা মন দিয়ে করে যেতে পারেন তো কিছুদিন পরে দেখবেন, ব্যাপারটা শ্বাস নেওয়া ছাড়ার মতো সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর আপনার এই সমস্যাটাও আর নেই।
- ডাক্তারবাবু ? সুধাময় ডাকলেন।
- হ্যাঁ, বলুন।
- আপনি যেমনটা বললেন, সেটা ফলো করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?
- আলবাৎ। ডাক্তারবাবু জোরের সঙ্গে বললেন, এটা তো একটা চিকিৎসা পদ্ধতি। আনসায়েনটিফিক মনগড়া কোন কথা নয়।
সুধাময় লজ্জা পেলেন, না, না। আমি সেভাবে কিছু বলতে চাইনি।
(দুই)
ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন সুধাময়। যেন হঠাৎ করে কেউ তাঁকে কাঁধে কাঁধে টোকা দিয়ে ডাকার মতো করে থামিয়ে দিল। সুধাময় একবার দুবার তিনবার চোখের আইবল ঘুরিয়ে ডান এবং বাঁ দুপাশ দেখে নিলেন। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলেন। দুরূহ কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া বা জটিল কোন হিসেব মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে, যেমন তৃপ্তি পাওয়া যায়, তেমনই একটি অনুভূতি হল তাঁর। যার বেশীটাই স্বস্তির।
বাড়ি ফিরে কলিং বেলের বোতামে আঙ্গুল ঠেকিয়ে সুধাময় অন্য দিনের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে না থেকে ডান এবং বাঁ পাশে চোখ ফেরালেন। সামান্য আবছা হলেও তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, দরজা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর মেয়ে একটি সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে হাত রেখে, নিচু গলায় একজনের সঙ্গে কথা বলছে। দূর থেকে সুধাময় মেয়ের কোন কথা শুনতে পাচ্ছেন না। আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ণ করার চেষ্টা করলেন। আর এবার স্পষ্ট করে দেখতে পেলেন। তাঁর মেয়ে প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে গল্প করছে।
সুধাময়ের স্ত্রী দরজা খোলা মাত্রই, উঠোনে পা রেখে সুধাময় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। মেয়ের পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরের দরজা হাট করে খোলা।
রাতে খেতে বসে, সুধাময় তাঁর স্ত্রীকে বললেন, মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ খবর রাখছ?
- তার মানে ? সুধাময়ের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
- মাষ্টারমশাইয়ের কাছে পড়াশোনাটা ঠিকমত করছে তো ? নাকি গল্প গুজবে সময় কাটাচ্ছে ?
- এ আবার কেমন কথা ? সুধাময়ের স্ত্রী রেগে গেলেন।
- বাড়ি ঢোকার সময় মনে হল যেন, ছাত্রী আর মাষ্টার সদরের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। একটু থেমে বললেন, অন্যদিন তো আর এভাবে চোখ ঘুরিয়ে দেখি না।
- হতেই পারে। সুধাময়ের স্ত্রী দায়সাড়া গলায় জবাব দিলেন, লেখাপড়া নিয়েই কথা বলছিল হয়তো।
- তাই ?
- তা নয় তো কী ? আর একটু ভাত দিই ?
সুধাময় মাথা নিচু করে খাচ্ছিলেন। যেন হঠাৎ করে মনে পড়ে যাওয়াতে তিনি মাথা তুলে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। হাঁড়ি কাত করে ধরে তাঁর স্ত্রী হাতা দিয়ে ভাত তুলছেন। হাতার সবটুকু ভাত তাঁর থালায় ঢেলে দিলে হাঁড়িতে আর অল্প একটু ভাত অবশিষ্ট থাকবে। সুধাময়ের স্ত্রী এখনও তাঁর নিজের থালায় একহাতা ভাতও নেননি।
সুধাময় বললেন, আমাকে আবার ভাত দিলে তুমি খাবে কী?
- বয়স বাড়ছে না ? সুধাময়ের স্ত্রী হেসে বললেন, ভাতের পরিমাণ যত কম করা যায়, ততই ভাল। পিত্তিটুকু পড়তে না দিলেই হলো।
- বয়সে তো আমি তোমার চেয়েও পাঁচ সাত বছরের বড়। আমারও তো তা হলে ...!
- চুপ করো তো ! তোমার সঙ্গে আমার তুলনা ! কত খাটাখাটনি করতে হয় তোমাকে। শুধু কি শরীরের ! তার সঙ্গে মাথারও !
সুধাময়ের মন খারাপ হয়ে গেল। এতদিন খেতে বসে, মাথা নিচু করে এক মনে খেয়েছেন। চোখ ফিরিয়ে দেখেননি। স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, কাল থেকে যেন এমনটা না হয়।
ডাক্তারবাবুর নির্দেশমত সুধাময় এখন চলতে ফিরতে, এমনকি এক জায়গায় স্থিরভাবে বসে থাকলেও চোখ ঘুরিয়ে ডান বাঁ দুদিক দেখে নেন। মাঝে মধ্যে বিস্মৃত হন। মনে পড়ে গেলে, নিজের কাছে নিজে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো লজ্জা বোধ করেন। তখন বেশী মাত্রায় সচেতন হন। চোখের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাও অনেকখানি ঘুরিয়ে ফেলেন।
এইরকম অবস্থাতেই একদিন তাঁর নজরে পড়ল, পিচরাস্তার গা ঘেঁসে বড় কদম গাছটির নিচে ছোট একটি গুমটি দোকানঘর। সুধাময় কৌতুহলবশত দোকান ঘরটির দিকে তাকাতেই, মাঝবয়সী দোকানদার তাঁকে হাত নেড়ে ডাকল। রাস্তা পার হয়ে সুধাময় দোকান ঘরটির সামনে এসে খুব অবাক হয়ে গেলেন, অজয় না?
দোকানী হেসে বলল, তাহলে চিনতে পেরেছিস ?
সুধাময় লজ্জা পেলেন, চিনতে না পারার কি আছে? কতদিন হলো এই ব্যবসা ?
- লকডাউনে কাজ চলে যাওয়ার দুচার মাস পরে পরেই শুরু করেছি। তা ধর না কেন সাত আট মাস হয়ে গেল।
- আমি তো খেয়াল করিনি। সুধাময় বললেন।
- তোরা ভাই সরকারী চাকুরে। মাথা উঁচু করে সোজা তাকিয়ে পথ চলিস। দুপাশে তাকিয়ে দেখার দরকার কী?
সুধাময় এখন প্রতিদিন অফিস যাওয়ার পথে, অজয়ের দোকান থেকে দুখিলি সাদা পান কেনেন। একটি গালে দেন। অন্যটি অফিসে টিফিনের পরে খাবেন বলে হাত ব্যাগে রাখেন। এছাড়া বিস্কুট, পাঁউরুটি, খুচরা চা পাতা, এইরকম নিত্য দরকারী জিনিসপত্র তিনি নিয়মিতভাবে অজয়ের দোকান থেকেই কেনেন। কোন কোন দিন গুমটির সামনে ছোট একটি টুলে বসে, পুরনো দিনের গল্প, এই সময়ের গল্প, আবার গলা নিচু করে ঘরের গল্প, পরের গল্প করেও অনেকটা সময় কাটান দুই বন্ধুতে।
অফিসে সুধাময়কে সবাই জানে কাজ পাগল মানুষ। নিজের টেবিলের বাইরেও, যে কোন টেবিলের কাজে সমান পারদর্শী। যে যেখানে অসুবিধা বোধ করে, স্বচ্ছন্দে সুধাময়ের কাছে এসে জানতে চায়, কীভাবে কী করতে হবে। সুধাময় এতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হন না। কোন রকম শ্লাঘাও বোধ করেন না। কাজ জানার সুবাদে সুধাময় ওপরওয়ালাদেরও খুব কাছের মানুষ।
কর্মস্থলে সুধাময়ের কোনরকম মানসিক চাপ নেই। কখনও কখনও তাঁর মনে হয়, বাড়ির চেয়েও অফিসে তিনি অনেক বেশী সহজ স্বচ্ছন্দ। বাড়ির লোকের চেয়েও অফিস সহকর্মীদের তিনি অনেক বেশী কাছের।
হয়তো এই ধারণা নিয়েই সুধাময় বাকি কর্মজীবনটি কাটিয়ে দিতে পারতেন। যদি না ডাক্তারবাবুর নির্দেশমত চোখ ফিরিয়ে দুপাশ দেখার অভ্যাসটা রপ্ত করতে না যেতেন।
সাহেবের আর্দালি তাঁকে ডাকতে এলে, আগে তিনি সটান উঠে দাঁড়িয়ে খোলা পেন টেবিলের রেখে বড় বড় পা ফেলে সাহেবের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেন। সম্প্রতি তেমনটা করেন না। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে, খোলা ফাইলটির ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে, পেনের খাপ বন্ধ করে, খুব সাবধানে চোখ ঘুরিয়ে দুপাশ দেখে নিয়ে, সাহেবের ঘরের দিকে পা বাড়ান। আর এমনটা করতে গিয়ে বেশ কয়েকদিন হলো সুধাময় লক্ষ্য করছেন, আশপাশের টেবিলের কয়েকজন সহকর্মী পরস্পরের সঙ্গে চোখের ইশারায় কিছু বলছে। এর সবটাই যে তাঁর উদ্দেশে, এ ব্যাপারে সুধাময় একশভাগ নিশ্চিত।
সুধাময় বুঝতে পারেন, এই ইঙ্গিতের মধ্যে সন্দেহ আছে, পরশ্রীকাতরতা আছে। আবার কোন গভীর অভিসন্ধিও থাকতে পারে। হয়ত এমনটা বরাবরই ঘটে থাকে। এতদিন তিনি চোখ ফিরিয়ে দেখেননি। আর তাই নজরেও পড়েনি।
এ নিয়ে সুধাময় উর্ধতন, অধস্তন বা সহকর্মীদের কারোর কাছেই কেন অনুযোগ অভিযোগ কিছুই করলেন না। দুঃখ কষ্ট যা পেলেন, নিজের বুকের গভীরেই রেখে দিলেন।
(তিন)
অফিস থেকে ফেরার পথে সুধাময় একদিন চোখের ডাক্তারবাবুর চেম্বারে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাঁর ডাক এল।
চেম্বারে ঢুকে সুধাময় নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বললেন, বসতে পারি, ডাক্তারবাবু ?
- নিশ্চয়ই। ডাক্তারবাবু বললেন, অনেকদিন পরে এলেন। মাঝে কোন রিপোর্ট করলেন না তো! হাউ এভার, আপনার চোখের প্রবলেমটা কেমন আছে?
- কোন প্রবলেমটা বলুন তো ?
- সে কি ! ডাক্তারবাবু বিস্মিত গলায় বললেন, নিজের প্রবলেম নিজেই ভুলে গেলেন? একটু থেমে বললেন, কোন কিছুর দিতে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে লাইট ফ্ল্যাশিংয়ের ব্যাপারটা...!
- ও, তাই বলুন ! সুধাময় হেসে বললেন, দ্যাট হ্যাজ গন উইথ দা উইন্ড।
- সত্যি? সুধাময়ের জবাবে ডাক্তারবাবুকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। পুরোপুরি নয়, চেয়ার ছেড়ে অল্প একটু উঠে দাঁড়িয়ে, আঙ্গুল নেড়ে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, চোখের আইবল ঘুরিয়ে দেখার অভ্যাসটা কিন্তু চালিয়ে যাবেন।
- ! সুধাময় বললেন, দুপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখছি বলেই না, নতুন কত কী চোখে পড়ছে। অচেনা অভাবনীয় কত কী জানতে পারছি।
সুধাময় লক্ষ্য করলেন, ডাক্তারবাবু দুচোখ বড় বড় করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছেন। যেন তাঁর কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন।
- অভ্যাস তো জীবনের যে কোন পর্যায় থেকেই শুরু করা যেতে পারে, বলুন! সুধাময় ডাক্তারবাবুর বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে এমনভাবে বললেন, যেন এই মুহূর্তে চেম্বারে ডাক্তার এবং রোগীর চেয়ার বদল হয়েছে।
- আমার ক্ষেত্রে সেটা না হয় একটু দেরী হলো। কিছুটা পরে শিখলাম। বিলম্বে জানতে পারলাম। তাতে কী? বলে একটু হাসলেন সুধাময়, জীবনের এখনও অনেকটা পথ পড়ে রয়েছে। তাই না?
ডাক্তারবাবুর চেম্বারে যে একটি পুরনো আমলের দেওয়াল ঘড়ি আছে, সুধাময় খেয়াল করেননি, তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্রই ঘড়িটি বাজতে শুরু করল। ঢং ঢং শব্দে। গুনে গুনে আটবার বাজল।