ঊনসত্তর বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ঢাকায় প্রাণ দিয়েছিলেন রফিউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিকুর রহমানরা। মাত্র সাড়ে চার বছর আগে দেশ ভাগ হয়েছে। দেশভাগে ভাগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলা, ভগৎ সিংয়ের পাঞ্জাব। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে আলাদা দেশ পাকিস্তান - তার এক প্রান্ত ভারতের পূর্বে, অন্য প্রান্ত হাজার মাইল পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমে। এক দেশের দুই প্রান্তের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিল ভাষা, সংস্কৃতি, আবেগ ও চেতনার দূরত্ব। পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের দাদাগিরি, বাংলা ভাষার উপর সরকারী উর্দু ভাষার আরোপিত আধিপত্য।
বাংলা ভাষার সম্মান ও অধিকারের জন্য বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঝরা সেই রক্ত থেকেই ভাষা দিবস। আর দু দশক পরে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। সেই ভাষা দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারীর অমোঘ শিক্ষা - বহু ভাষাভাষী সমাজে ধর্ম দিয়ে দেশ হয় না, জোর করে বানিয়ে দিলেও ধরে রাখা যায় না। এক দেশ বলে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল, এক নেতা কখনোই চলে না, চলতে পারে না।
মানুষের জীবন, অস্তিত্ব, পরিচিতি বহুমাত্রিক। অনেকের জীবনেই ধর্ম একটা মাত্রা। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, সার্না, বাহাই। সে মাত্রা পরিবর্তনশীল। নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। কোন ধর্ম না মানার অধিকারও মানুষের মৌলিক অধিকার। আবার একই ধর্মকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন ধরণে অনুসরণ করে। যত মত তত পথ। নিজের মত নিজের পথ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। তা স্বাধীনতাকে খর্ব করে, মানবতাকে কলুষিত করে।
একুশের জন্ম ভূগোলের দিক থেকে আজকের বাংলাদেশে। কিন্তু একুশ বেড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার কোলে। একুশ তাই ও বাংলার মতো এ বাংলারও। আজ তো একুশ আন্তর্জাতিক। সার্বজনীন। গোটা পৃথিবীকে বাংলার উপহার। ধর্মের বন্ধনকে ভাষা বারবার ভেঙে দিয়েছে। বঙ্গভঙ্গের প্রথম প্রচেষ্টাকে রুখে দিয়েছিল ভাষার বন্ধন। পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে ভাষার ভিত্তিতে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলা ভাষার ঐক্যকে ধর্ম দিয়ে ভাঙা যাবে না। বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছে বাংলার উদার সংস্কৃতি। ধর্মান্ধতা নয়, সংকীর্ণতা নয়, জাতের নামে বজ্জাতি নয়, 'হিন্দু না ওরা মুসলিম' এই আমরা-ওরা ভাগাভাগি নয়, চাই খোলা মন ও মুক্ত চিন্তা, একে অপরকে গ্রহণ করার, বিবিধের মাঝে মহামিলনের সমন্বয়, মৈত্রীবন্ধন।
বাংলা ভাষা যতটা স্বাধীন বাংলাদেশের, ততটাই বহুভাষিক ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের। অসম, ত্রিপুরা থেকে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার বহু মানুষের। আজ এই ভাষার উপর বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাভাষী মানুষ নির্যাতিত হচ্ছেন বাংলাদেশী সন্দেহে। এ বিদ্বেষ বন্ধ হোক, এ নির্যাতনের হোক অবসান। এনআরসি-এনপিআর-সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের নামে মানুষকে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত করার চক্রান্ত ধ্বংস হোক। পরাজিত হোক অসহায় মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে দিয়ে অধিকারহীন বন্দীজীবনে ঠেলে দেবার নোংরা ছক।
ধর্ম, ভাষা সবই মানুষের পরিচয়ের সূত্র। পরিচিতি থেকে গড়ে ওঠে যোগাযোগ। সংঘাত নয়, সংযোগ। ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা নয়, মৈত্রীর বন্ধন। বিভেদ নয়, সমন্বয়। মনে রাখতে হবে ধর্মের উপর ভাষা, মাতৃভাষা, কিন্তু ভাষার উপর মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। আজ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনেকেই তথাকথিত বহিরাগত। কেউ কাজের সূত্রে কিছুদিনের জন্য পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে, কেউ সেখানকারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। কেউ কিছুদিন হলো ভিনরাজ্যের বাসিন্দা, কেউ কয়েক প্রজন্ম ধরে। প্রত্যেকের কাছে রয়েছে নিজের নিজের মাতৃভাষার পরিচয়, আবেগ, গর্ববোধ। কেউ ছোট কেউ বড় নয়, সবাই সমান। পারস্পরিক পার্থক্য মানে বৈষম্য ও সংঘাত নয়, পার্থক্যকে স্বীকার ও সম্মান করা। এটাই গণতন্ত্রের সূত্র, সভ্যতার শিক্ষা।
সবার উপরে মানুষ সত্য। কিন্তু আজ একুশ শতকে জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড অতিমারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবশ্যই এ কথাও মনে রাখতে হবে যে মানুষ যেন নিজেকে মহাশক্তিধর মনে করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামে। মানুষ সবার উপরে, কিন্তু প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে নয়। প্রকৃতিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে বাঁধ বানালে, কারখানা বসালে তার পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে উত্তরাখন্ডের যোশীমঠের ভূস্খলন ও হিমবাহের মারণস্রোত আবার সেই সতর্কবাণী আমাদের শুনিয়ে গেল। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করার ভয়ানক ফলশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিল আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়। মানুষ আর প্রকৃতির সমন্বয়েই মানুষের সভ্যতা। সেই সভ্যতা সংকট মুক্ত হোক, সুস্থ ভাবে এগিয়ে চলুক।
এ বছর একুশে মানে নির্বাচনের প্রাকমুহূর্ত। নির্বাচনে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের আওয়াজ তুলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলকে রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা। এক দেশ এক দল এক সরকার চাপিয়ে দিতে দল ভাঙানোর, দলবদলের হিড়িক। বাংলার মনীষীদের আত্মসাৎ করার নোংরা ছেলেখেলা। অন্যদিকে দিল্লীতে সংসদে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল আন্দোলনকারী বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে 'আন্দোলনজীবী, পরজীবী' রব তুলে বিরোধী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার হুঙ্কার। আন্দোলন থেকেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, দেশের সংবিধান, সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন। আজ সেই নির্বাচনের ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল করে নিয়ে ক্ষমতার বলে দেশকে 'আন্দোলনমুক্ত, বিরোধিতামুক্ত' করার অভিযান শুরু হয়েছে। এ হল ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি, গণতন্ত্র হত্যার ফরমান। এ চক্রান্তকে রুখতেই হবে।
তাই এবারের একুশের ডাক - ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক। বাংলার উদার ঐতিহ্য জিন্দাবাদ। প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ শক্তিতে জ্বলে উঠুক।
ছবি ঃ জিৎ নট্ট