পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কৃষি বাণিজ্যের খোলনলচে বদল

  • 20 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2194 view(s)
  • লিখেছেন : অংশুমান দাশ
এখন খুলে গেল বাজার – ক্ষমতা থাকলে দ্বিগুণ কেন যা খুশি লুটে পুটে খাও। আর হ্যাঁ, কর্পোরেট বিনিয়োগ করবেন নিশ্চয় – সেই সঙ্গে কী চাষ করবেন, কী বীজ লাগাবেন কৃষকের আর সেই সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। আরা যা বিনিয়োগ করবেন তা আপনার আমার মত উপভোক্তাদের পকেট থেকে উশুল করে নেবেন। খাবারের দাম বাড়তে থাকলে অবাক হবেন না।

একটু দেরিতে হলেও কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন, মজুত ও বাণিজ্য – এই তিনটি ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ মারফত যে বদল এনে ফেললেন এই সরকার, তা নিয়ে দেশ জেগে উঠেছে। এই বিলগুলি বুঝে নেওয়ার আগে যেটা বোঝা দরকার তা হল হুড়োহুড়ি করে এই বদল আনতে চাওয়ার কারণ কী। শূন্যর নীচে নেমে যাওয়া বৃদ্ধির ডুবন্ত গ্রাফে একমাত্র যে মাথা তুলে আছে তা হল কৃষি। তাকে যতটা সম্ভব দোহন করে যতটুকু পয়সা রাজকোষে আনা যায় আর কি! কারণ কলকারখানার বিক্রিবাটার এখন আর কোন ভরসা নেই। অধ্যাদেশগুলি কী কী?
১) চুক্তি চাষের মাধ্যমে সুরক্ষা ও ফসলের মূল্য নিশ্চিতকরণ – শুধু পণ্য নয়, এখন কৃষি সংক্রান্ত পরিষেবাকেও চুক্তির আওতায় আনা যাবে। চুক্তি চাষ, দাদন দিয়ে চাষ – এইসবে আর কোন বাধা থাকছে না।
২) অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে সংশোধন – চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল – এইসব অবাধে মজুত করা যেতে পারে। যদি কোন পচনশীল খাবারের খুচরো দাম ১০০% বাড়ে বা অপচনশীল খাবারের দাম গত বছরের তুলনায় বা গত ৫ বছরের গড়ের তুলনায় ৫০% বাড়ে – একমাত্র তবেই সরকার বিধিনিষেধ জারি করতে পারে। তবে যদি সেই মজুতের পরিমাণ প্রক্রিয়াকরণের বা রপ্তানী করার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে না যায় তবে নিয়ন্ত্রণের আদেশ কার্যকরি হবে না। তার মানে আদতে বড় কোম্পানি কখনই মজুতের উর্ধসীমায় পৌঁছাবে না।
৩) কৃষিপণ্য ব্যবসা বাণিজ্যে সংশোধন – ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি চুক্তি চাষের মাধ্যমে চাষ করে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নিতে পারবেন। বাজার কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকা মান্ডির মাধ্যমে কেনাবেচা করার দরকার নেই। তবে মান্ডি ব্যবস্থা উঠে যাচ্ছে না – কিন্তু কিভাবে থাকছে তাও বোঝা যাচ্ছে না।
সরকার দাবী করছেন (কতটা বিশ্বাস করছেন বলা মুশকিল) – এতে কৃষকদের উপকার হবে। তবে এই লকডাউনের সময় যেভাবে এগুলি গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তাতে মনে হয় সাধারণ সময়ে হলে, সরকার কৃষকদের কাছ থেকে প্রবল প্রতিরোধ আশংকা করছিলেন। সরকার বলছেন – এতে আর মাঝখানের দালাল থাকছে না, কৃষকরা যাকে খুশি বেচবেন, বেশি দাম পেলে বেচবেন – এতে কৃষকের উপকার হবে। ‘এক দেশ – এক কৃষক – এক নীতি’ – বাঃ শুনতে বেশ ভালো। এও শুনতে ভালো যে বড় কৃষি-ব্যাবসায়ী কোম্পানিগুলি কৃষিতে আরও পয়সা ঢালবেন।
তিনটি অধ্যাদেশকে যদি একসাথে দেখা যায় – তবে এর আসল রূপ বোঝা যাবে।
বিহারের একজন কৃষকের বাৎসরিক রোজগার ৪৪১৭২ টাকা – তারমধ্যে ২০৬২৭ টাকা আসে কৃষিপণ্য বেচে। পাঞ্জাবে রোজগার বছরে ২১৭৪৫০ টাকা। তার মানে, যেহেতু আর রাজ্য সরকারেরও কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না, একজন ব্যবসাদার বিহারে কিনে পাঞ্জাবে বেচলে দাম বেশি পাবেন – অন্যদিকে সেখানে পাঞ্জাবের কৃষকরা আর তাদের মাল বিক্রি করতে পারবেন না। মজুতেও আর কোন সীমা নেই, ফলে কালোবাজারী, মজুত করে বাজারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া – সবটাই এখন আইনী ভাবে ঠিক। সরকারি সাহায্য ও দেখভাল, যা এতদিন কিছুটা হলেও বড় কৃষকদের দাম পেতে সাহায্য করছিল, তা থেকে সরকার হাত তুলে নিলেন। ছোট কৃষকরা কি সত্যিই দাম পাচ্ছিলেন? ৬৫ শতাংশ মাল মান্ডির বাইরেই বিক্রি হত – সেটিকে ঠিকঠাক করার বদলে সরকার খুলে দিলেন। এখন বড় কোম্পানি সোজাসুজি কিনবেন যা খুশি দামে। বিহারে মান্ডি নেই – ২০১৯ এ ধানের ন্যূনতম নির্ধারিত মূল্য ছিল ১৮১৫ টাকা, বিক্রি হয়েছে ১৩৫০ টাকায়। বাজার খুলে দিলেই বেশি দাম – এ একধরণের আকাশ কুসুম কল্পনা। ছোট কৃষকরা, যারা বাজার থেকে দূরে তাঁরা মান্ডি ছাড়া কোথায় বেচতে যাবেন? কোথায় দরাদরি করবেন? দরাদরি করে আদানি আর পেপসিকোর সঙ্গে পারবেন? কৃষকদরদীরা, যারা কিনা অনেকে আবার মুক্ত চিন্তা করেন – ডান বিরোধী - তাদেরও অনেকে বলছেন – আহা, কৃষকই দাম ঠিক করবেন, এই তো চাই। তাঁরা এখন পড়বেন বিপদে। এই সরকারকে সাপোর্ট করতেও পারবেন না, আবার নিজেরা যা চাইছিলেন – ‘কৃষক বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন’ – তাই তো করে দিলেন সুগার কোটেড দেশরক্ষক! এখন কী হবে? আদতে সরকার কৃষিবাণিজ্য ক্ষেত্র থেকে হাত তুলে নিলেন – এবার ঠেলা বুঝুন। তাঁরা কেবল ট্যাক্স নেবেন, দেশ চালাবে কর্পোরেট। কৃষিক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকাও কেন্দ্র কেড়ে নিচ্ছেন। কৃষকদের পক্ষে রাজ্য সরকারের কাছে পৌঁছানো সহজ, এবং রাজ্য সরকার কৃষকদের কাছে অনেক বেশি দায়বদ্ধ। কৃষি পণ্যের বাণিজ্যে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল করা জরুরী ছিল, আপনি মানুন আর না মানুন। দরকার ছিল আইন করে ন্যূনতম মূল্যকে কৃষকের অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।
যেমন চুক্তি চাষে কৃষি পরিষেবা ঢোকানোর অর্থ সেগুলিকেও প্রক্সি কোম্পানির মাধ্যমে সেই বড় সংস্থা গুলিই নিয়ন্রণ করবে। অর্থাৎ দেশ জুড়ে কৃষিক্ষেত্রে এক ভয়ানক একচেটিয়া আগ্রাসন শুরু হবে – একজন দু জনই রাজা হয়ে বসবে। তাঁরা পাচ্ছেন অবাধ মজুত আর যত বড় ও বেশি গুদাম করে খাদ্য সরবরাহ ও বাজারের উপর বেশি বেশি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ। বড় আমদানী কারক কোম্পানির জন্য আরও বড় দরজা খুলে গেল – উদাহরণ আদানি, যারা আফ্রিকায় বড় জমি লিজ নিয়ে চাষ করছেন। আর ছোট কৃষক? কোথায় গেল দ্বিগুণ আয় বাড়ার প্রতিশ্রুতি? এখন খুলে গেল বাজার – ক্ষমতা থাকলে দ্বিগুণ কেন যা খুশি লুটে পুটে খাও। আর হ্যাঁ, কর্পোরেট বিনিয়োগ করবেন নিশ্চয় – সেই সঙ্গে কী চাষ করবেন, কী বীজ লাগাবেন কৃষকের আর সেই সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। আরা যা বিনিয়োগ করবেন তা আপনার আমার মত উপভোক্তাদের পকেট থেকে উশুল করে নেবেন। খাবারের দাম বাড়তে থাকলে অবাক হবেন না।
এখন আপনি বলবেন, ‘আরে মশাই কৃষকের অধিকার আগেও ছিল না, আড়াল আবডাল দিয়ে চুক্তি চাষও হচ্ছিল, খাবারের দামও বাড়ছিল – নতুন করে আর কী খারাপ হবে!’ মুশকিল কি জানেন তো – এখন অন্যায় করার আইনি ছাড়পত্র পেয়ে গেলেন কেউ কেউ – এখন আর কে আটকায়! আর যে পরিমাণ সংখ্যা গরিষ্ঠতা আমরা উপহার দিয়েছি এই সরকারকে তা প্রতিবাদ প্রতিরোধকেও হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে আনতে যথেষ্ট।

0 Comments

Post Comment