আগেই জানিয়ে রাখি আমাকে কোনোদিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দারিদ্র্য অনুভব করতে হয়নি - কিছু মানুষের থেকে তাদের অভিজ্ঞতা শুনেছি দারিদ্রের সঙ্গে বসবাসের, তাই খানিকটা অনধিকার চর্চা হতে পারে কিন্তু কথাগুলো না লিখে পারলাম না –
বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশের কিশওয়ার এর অস্ট্রেলিয়ান মাস্টারশেফ -এ পান্তাভাত, আলুভর্তা আর মাছভাজা রান্নার উত্তেজিত পোস্টে উপচে পড়ছে - কেউ কেউ লিখছে নো ফুড লাইক বেঙ্গলি ফুড, কেউ বাঙালি আর বাংলদেশী আলাদা করছে, কেউ বলছে, পান্তাভাতের থেকে অনেক জটিল রন্ধনপ্রণালীর খাবার আছে দুই বাংলায়, আবার কেউ এটিকে প্রায় অ্যান্টি-কাস্ট অ্যান্টি-ক্লাস স্ট্রাগলের মর্যাদা দিয়েছে।
কিশওয়ার ফাইনালে পান্তাভাত রান্না করে তৃতীয় হয়েছেন - পান্তাভাত খেয়ে বিচারকদের ভালো লেগেছে, যেমন আমরা মাঝে মাঝে স্বাদবদলের জন্য মাটির বাড়ির থিমের বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে কপির পাতাবাটা বা কচুর ঝাল খেয়ে আহা উহু করি, বা আমিও মাঝে মাঝে বাড়িতে পান্তাভাত খাই-প্রতিটিই আমাদের জীবনের প্রাচুর্যের দিকেই ইঙ্গিত করে, ও খাদ্যের অণ্টনের মধ্যে যে খাবারগুলির জন্ম সেগুলির একটি পুঁজিবাদী কাঠামোয় আত্তীকরণকে নির্দেশ করে - এগুলিকে তার থেকে বাড়িয়ে বেশি গুরুত্ব বা গাম্ভীর্য আরোপ না করাই ভালো, আমার মতে।
ঠিক যেমন আমরা খাদ্যাভাবে অনাহারে থাকিনা, ডায়েটের জন্য মাঝে মাঝে 'ফাস্ট' করি - ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কে যদি রাতে যারা পেটে খিদে নিয়ে ঘুমাতে যান, তাদের প্রতি সলিডারিটি হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয় তবে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আছে।
যাঁরা পান্তাভাত নিয়মিত খান বা খেতে বাধ্য হন - তাঁরা হয়তো সবসময় আলু-ভর্তার রেলিশ টুকুও জোটাতে পারেন না, গরম মাছ ভাজা তো রাজভোগ - তাঁরা মনে হয়না পান্তাভাতের উপর এতটা রোম্যান্টিসাইজ করেন।
আমার কিছু গরীব ছাত্র-ছাত্রী ছিল যারা সকালে শুধুই একমুঠো পান্তাভাত খেয়ে স্কুল যেত আবার রাতে খেতে না পাওয়া অব্দি তার কাছে ওটাই খাবার - কোনো দেশীয় খাবারের প্রতি ভালোবাসা জনিত কারণে নয়, আগের রাতের ভাতে জল ঢেলে যেটুকু থাকবে, সেটাই পরদিনের খাবার ওই পান্তাভাত।
আমার বাড়িতে যিনি দৈনন্দিন কাজ করেন তিনি জীবনের একটা দীর্ঘ-সময় শুধু রোজ মাড়-ভাত আর পান্তা খেয়ে কাটিয়েছেন কারণ অন্য কিছুর সম্বল ছিলোনা - পান্তা বা ফেনাভাতে যে জল থাকে তাতে অনেকটা পেট ভরে যায় - ভাত কম লাগে, পান্তায় ঝিমুনি আসে, শরীর ঠান্ডা হয়, তাৎক্ষণিক ভাবে খিদের অনুভূতি খানিকটা প্রশমিত হয়। এর ফলে দেখা গেছে বাংলার এক বৃহৎ অংশের মানুষ উদুরী বা সিরোসিস অফ লিভার রোগেও আক্রান্ত হয়েছেন। এনারা কি কোনোদিন বলেছেন যে গরম ভাত থাকতেও খালি ভালো লাগতো বলেই পান্তা খেয়েছে - আলুসেদ্ধ মাঝে মাঝে পেত শুনেছি, মাছ দূরস্থান।
এই পান্তা বোধহয় মাস্টারশেফে যে পান্তা খেয়ে বিচারকরা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন তেমন সুস্বাদুও হবেনা - আগের রাতে বাসি ভাতে জল ঢেলে রেখে পরেরদিন একটু নুন মেখে খেলে যতটা স্বাদ হয় আর কি - এটাই কিন্তু পান্তা।নিজের চারপাশের উদাহরণ দিলাম এটা বোঝাতে যে নিজেদের আশেপাশে একটু সহমর্মিতা নিয়ে কান পাতলেই এই গল্পগুলো শোনা যাবে, বেশি দূর যেতে হবেনা। জানিনা বোঝানো গেল কিনা - স্বল্প বা শূন্যবিত্ত মানুষদের অবলম্বন একটা খাদ্যাভাসকে নিয়ে এত গ্লাম্যারাইসেশন খুব ক্লান্তিকর লাগছিল - দরিদ্রকে দূরে সরিয়ে রেখে কিন্তু তার জীবনচর্যার উপাদান নিয়ে একটা রোমান্টিসিজম।
পুণঃ পান্তার ইংরিজি যে স্মোকড রাইস ওয়াটার সেটা জানা ছিল না।