পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা

  • 21 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1255 view(s)
  • লিখেছেন : অভিজ্ঞান সরকার
ফরাসী বিপ্লব থেকে রুশ দেশের বলশেভিক বিপ্লব, তৎপরবর্তীতে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীন বিপ্লব, বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শতাব্দীপ্রাচীন সংগ্রাম, রাষ্ট্রবিপ্লবের ন্যায্যতা কোন ইতিহাস সচেতন মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে তদন্ত, আইনি প্রক্রিয়া মুলতুবি থাকার আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাহলে কি আর এই আইন প্রয়োগ হবে না?

রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে তদন্ত, আইনি প্রক্রিয়া মুলতুবি থাকার আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সংবাদ ও গণমাধ্যমে সেই খবর প্রকাশিত হবার দিনই বন্দীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের, বিশেষত কোর্টকাছারিতে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাগুলো দেখা শোনা করেন, তাদের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বন্দীদের পরিবার থেকে ফোন আসা শুরু হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন তো উঠে গেছে, এই আইনে অভিযুক্ত বন্দীদের জামিনের আবেদন করা যাবে বলে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, অতএব এবার ছেলেমেয়েগুলো ছাড়া পেয়ে যাবে! রাষ্ট্রদ্রোহী ছেলে-মেয়ে-স্বামী-বউ-ভাই-বোনদের মুক্তি চিন্তায় আকুল মানুষগুলিকে বোঝানো অসম্ভব যে এই রায় শুনতে ভাল, কার্যকারিতায় শূন্য। রাষ্ট্রদ্রোহে জামিনের আবেদন আগেও করা যেত, এতে নতুন কিছু নেই - পাবলিক প্রসিকিউটার এখনো সেই জামিনের বিরোধিতা করবে, লোয়ার কোর্টের বিচারক পুলিশের বয়ানে হ্যাঁ হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে যাবে, জামিন প্রত্যাখ্যান হবে। নতুন করে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত করা যাবে না বটে, কিন্তু ইউএপিএ ধারা তো বলবৎ আছে, এখন থেকে ভয়ঙ্কর ইউএপিএ আইনে প্রতিবাদীদের বছরের পর বছরে জেলে আটকানো যাবে!

সঞ্জীব মজুমদারকে সোদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ১০ মে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনে (১২৪ এ)। সঞ্জীব কমিটি ফর দি রিলিজ অফ পলিটিকাল প্রিজনার্স সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের উপরে সুপ্রীম কোর্টের স্থগিতাদেশ ছিল ১১ মে। এই মামলার অন্যতম পিটিশনার ছিলেন তৃণমূলের কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। অর্থাৎ নৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস রাষ্ট্রদ্রোহিতার মত ঔপনিবেশিক দমনমূলক আইনের বিরোধী, সর্বভারতীয় স্তরে মানবাধিকার রক্ষার মুখ হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে তৎপর। আবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সেই দমনমূলক আইনের নির্বিচার প্রয়োগ করছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে গ্রেপ্তার হওয়া টিপু সুলতান বা অর্কদীপের উপরেও এই আইনটি লাগানো হয়েছে। মহুয়া মৈত্র সেইসময়ও ঔপনিবেশিক দমনমূলক আইনের অন্তরশূন্যতা প্রমাণে মিডিয়ার সামনে আগুনঝরা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আর টুইট করছিলেন। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের এই ধরনের দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার সবসময়ই জলভাত ছিল, আছে থাকবে- বৃদ্ধ জেসুইট পাদরী স্ট্যান স্বামীর লকআপে রাষ্ট্রীয় হত্যার পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গালভরা চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে, অন্যান্য মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে, মানবতা বিরোধী ইউএপিএ আইন বাতিল করার জন্য। সেই ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করা হল জয়িতা, প্রতীক, হাসিবুরকে – মাস দুয়েক আগে। কেরলের বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রীরও স্বাক্ষর ছিল ওই চিঠিতে, যার রাজত্বে কেরলে বিপ্লবীকর্মীদের উপর ইউএপিএ ধারা লাগানো হয় নিয়মিত।

রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের অন্যায্যতা ও অপপ্রয়োগ নিয়ে article-14.comthewire.in সহ একাধিক পত্রপত্রিকায় চমৎকার বিশ্লেষনাত্মক লেখাপত্র বেরিয়েছে। জানা যাচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ এর মধ্যে ১০,৯৩৮ জন ভারতীয়কে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে শতকরা ৬৫ শতাংশ মোদির আমলে অর্থাৎ ২০১৪ এর পর। এর মধ্যে ৪০৫ জন অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সরকারকে সমালোচনা করার জন্য, ১৪৯ জন মোদির বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য, ১৪৪ জন যোগীর বিরুদ্ধে। গত বছর অক্টোবরে আগ্রায় তিনজন কাশ্মীরি ছাত্রের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ মামলা করা হয়েছে ক্রিকেট খেলায় পাকিস্থানের জয় উদযাপন করার জন্য। অন্ধ্রপ্রদেশে আমোদা ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ও এএনআর সংবাদ চ্যানেলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হইয়েছে ওয়াইএসআর কংগ্রেসের নেতার ভাষণ সম্প্রসারণের জন্য। হাথরাস ধর্ষণ ও খুনের মামলায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের সমালোচনার জন্য ২২ টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে, সিএএ বিরোধী আন্দোলনে ২৮টি (যাতে সাড়ে তিন হাজার জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, শনাক্তকরণ হয়ে মাত্র ৯৬ জনের), পুলওয়ামায় আক্রমনের পর ২৭টি কেস হয়েছে অ্যান্টি-ন্যাশেনালদের বিরুদ্ধে, পাথালগড়ি আন্দোলনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় দশ হাজার আদিবাসীকে জড়ানো হয়েছিল- এইরকম উদাহরণে পাতার পর পাতা ভরিয়ে দেওয়া যায়। এছাড়া মাওবাদী, কাশ্মীর ও উত্তরপূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবীতে সংগ্রামত মানুষরা হামেশাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত হচ্ছেন – এদের শায়েস্তা করার জন্য অবশ্য ইউএপিএ, এনআইএ অ্যাক্ট ইত্যাদি আরও কড়া ডোজের ব্যবস্থা রয়েছে।

একটা বিষয় এখানে খানিক আলোচনা করা জরুরী, মোদির সময় কালে ও তার আগের সরকারের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রজু করার ধরনের খানিক পার্থক্য রয়েছে। আগের সরকার অর্থাৎ মনমোহন সিংহ বা তার কংগ্রেস ঘরানার পূর্বসুরীরা খুব ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না, তাদের সময়কালে শয়ে শয়ে এই আইনের অপব্যবহারের উদাহরণ আছে। একটা উদাহরণ দিলে খানিক স্পষ্ট হবে, ২০১১ সাল থেকে চলা কুদানকুলামে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ৭০০০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জয়ললিতা সেসময় তামিলনাড়ুর ক্ষমতায়, তবে প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের। এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল মনমোহন সিংহ তথা কংগ্রেসের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই প্রকল্প, নিউক্লিয়ার চুক্তি সম্পাদনের জন্য। সরকারের উন্নয়ননীতি যা উচ্ছেদ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসের সমার্থক, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিরোধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে আকছার। বস্তুতঃ সরকারবিরোধী ময়দানী লড়াইকে দমনের হাতিয়ার এই ১২৪এ আইনটি। কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের ‘কেউ যদি যায় পিছলে প'ড়ে, প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে’ ধরণের দুকান কাটা নির্লজ্জ অপপ্রয়োগ আগে কেউ দেখেনি।

১৯৪৭ এর পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন নিয়ে ভারতবর্ষে বিতর্ক কমদিনের নয়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ও সেই সময়কার ওয়াহবি আন্দোলনের গুঁতোয় ১৮৭০ সালে এই আইন ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে সাধারণ ধারা ছিল এই সিডিশন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষে এই ঔপনিবেশিক আইন থাকা উচিৎ কিনা সেই নিয়ে কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে তর্কবিতর্ক হয়েছে, এবং ১৯৪৮এ সংবিধান থেকে ‘সিডিশন’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানের ১৯(১) যেখানে মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ অধিকার দেয় সেখানে ‘সিডিশন’ সেই সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে কিনা সেই মৌলিক প্রশ্নটি প্রশ্নটির চর্চা সেইসময় থেকেই হয়েছিল - যদিও ইন্ডিয়ান পিনাল কোড ১২৪এ ধারাটি থেকে যায়। ১৯৬২ সালের কেদার নাথ সিং বনাম বিহার রাজ্যের মামলায় সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে কোনো মত/বক্তৃতা (স্পীচ) যদি জনতাকে উসকানি দিতে ও তৎপরবর্তীতে রাষ্ট্রের স্থিতবস্থাকে ব্যাহত করে তবে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে। যদিও কোর্ট এইটা বলে নাই যে কে বা কারা নির্ধারণ করবে কোন মত বা বক্তৃতা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক উসকানিমূলক। সেই বিতর্কিত রায়কেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে এতকাল। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে নতুন কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরে ১২৪এ কে গুরুতর অপরাধ (cognisable offence) হিসাবে গন্য করা শুরু হয়, এবং ১২৪এ মামলায় পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়া হয়। সেই পুলিশ যারা উর্দি পরা গুন্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়, যাদের বিরুদ্ধে অধিকার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বাধিক অভিযোগ, লাঠি আর বুলেট চালানো ছাড়া যাদের আর অন্য শিক্ষা নেই তারা করবে মত, মতাদর্শ ও বাকস্বাধীনতার সূক্ষ্ম বিচার? ফলে যা হবার তাই হল, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের আকছার অপপ্রয়োগ, ন্যায্য দাবীদাওয়ার আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার হাতিয়ার। ২০১৪ সালের পর ফ্যাসিস্ট মোদীদের সময়কালে অপপ্রয়োগের মাত্রাটা আরো বেড়ে যা-নয়-তাইতে পরিনত হয়েছে। ফেসবুকে মোদীরে সমালোচনাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমার্থক। সুকুমার রায়ের ঝালাপালা নাটকে খেঁটুরাম দুলিরাম নামের দুটি মোসাহেব চরিত্র ছিল। তারা ‘হায়রে সোনার ভারত দুর্দশাগ্রস্ত হইল’ গান শুনে সিডিশাস সিডিশাস বলে চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। মোদীর আমলে দেশজুড়ে খেঁটুরাম দুলিরামদের বাড়বাড়ন্তের সীমা নেই।

রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের বিলোপ নিয়ে যতগুলি পিটিশন জমা পড়েছে সুপ্রীম কোর্টে সেগুলিতে মূলতঃ আইনটির অপব্যবহার (misuse) নয়, জুগুস্পিতি (abuse) এর অভিযোগ করা হয়েছে। শাসকের বিরোধিতা, অপছন্দের বক্তব্য, সমালোচনা হলেই পুলিশ লেলিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা করা হচ্ছে। প্রধান লক্ষ্যবস্তু সংখ্যালঘু মানুষ, কমিউনিস্ট মতাদর্শের মানুষ এমনকি লিবারাল নাগরিকও। ঘটনা হচ্ছে লোয়ার কোর্টগুলির বিচারকেরা এইসব নির্বিচার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় পুলিশের বয়ানকে অটল সত্য হিসাবে ধরে নেয়।

২০১২ সালে এপ্রিল নোনাডাঙ্গায় বস্তি-উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ গনঅবস্থান থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অনেকে, আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। লালবাজার থেকে সন্ধ্যায় সকলকে ছাড়া হলেও দেবলীনা, দেবযানী, শমীকদা, পার্থ রায়, বাবুনদা, সিদ্ধার্থ গুপ্ত সহ আমাকে জামিন অযোগ্য ধারা গ্রেপ্তার করে প্রথমে কয়দিন পুলিশ কাস্টডি ও পরে জেল কাস্টডিতে পাঠানো হয়। জেল কাস্টডি থেকে দেবলীনা ও আমাকে ফের হলদিয়া কোর্টে তোলা হয়, শুনলাম আমাদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের হয়েছে। নন্দীগ্রামে আমরা নাকি ২০১১ সালে মাওবাদীদের হয়ে গোপন মিটিং করছিলাম, পুলিশ আসায় আমরা মাওবাদ জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে গেছিলাম। যেদিনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে সেদিন আমি যাদবপুরে গবেষণার ল্যাবে লোহালক্কড় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলাম, হাজিরা খাতায় সই করা ছিল। কে কার কথা শোনে, লোয়ার কোর্টের বিচারক ফের পুলিশ কাস্টডিতে পাঠিয়ে দিলেন, তারপর জেল কাস্টডি। মাঝে হাইকোর্ট করা হয়েছিল, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা, তাই জামিন হবে না। তিনমাস পরে জামিনে মুক্ত হলাম। সেইসময় আমার সিএসআইআর স্কলারশিপ আটকে গেল, বাড়ির লোক হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করল, গুচ্ছের পয়সা ধ্বংস হল উকিলদের পিছনে, জেলে বসে মাথায় হতাশার পোকা জন্মালো, ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম, ভাবলাম দস্তয়ভস্কির মত আমারও লেখা বেরাবে - নোটস ফ্রম দ্য হলদিয়া জেল। আমার মত সাধারণ অধিকার আন্দোলনের কর্মীকে রাষ্ট্র একটু টাইট দিয়ে ছেড়ে দিল। দশবছর পরে বেকসুর খালাস হলাম।

রাজনৈতিক গুরুদের কাছে শুনেছি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় প্রমাণ করা যায় না যে অভিযুক্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতায় যুক্ত। পুরো ব্যাপারটাই চার্জশিট দিয়ে জেলে আটকিয়ে রাখার জন্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিষয়টি দার্শনিক স্তরে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা - স্পার্টাকাস থেকে শুরু করে যীশু খ্রীষ্ট্রের শাহাদাত, ফরাসী বিপ্লব থেকে রুশ দেশের বলশেভিক বিপ্লব, তৎপরবর্তীতে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীন বিপ্লব, বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শতাব্দীপ্রাচীন সংগ্রাম, রাষ্ট্রবিপ্লবের ন্যায্যতা কোন ইতিহাস সচেতন মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শ্রেণী স্বার্থের নিরিখে হয়েছে, রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর আধিপত্যের ব্যবস্থা হিসেবেই কাজ করেছে। নিপীড়িত শ্রেণী কায়েমী স্বার্থ চুরমার করে নিজের শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠার লড়াই করবে এটাই মানব সভ্যতার ঐতিহাসিক চলন, সেটাই সমসাময়িক রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাই রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন বাতিল হলেও বর্তমান ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী ভারতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিপীড়িত দলিত, আদিবাসী, শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষের দ্রোহ জারী থাকবেই, শ্রেণীর লড়াই চলমান থাকবেই।

0 Comments

Post Comment