পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মৌসুমী ভৌমিকের গান : বাংলা গানে প্রথম নারী-যাপনের কথা

  • 29 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2294 view(s)
  • লিখেছেন : সংবিদা লাহিড়ী
সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখলে মৌসুমী ভৌমিক একটি অনন্য ছাপ রেখে চলেছেন। ১৯৯২ সাল পরবর্তী বাংলা গানের মেজাজে যে পরিবর্তন চিহ্নিত হল, তাতে শহরের যাপন, বাম রাজনীতির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা কিম্বা শহরকে ভালবাসার যে অনাবিল মুহূর্তগুলি তৈরি হল তার মধ্যে মহিলা যাপনের সুখদুঃখ-বেদনানুভূতির এক অচেনা সমারোহে নিয়ে মৌসুমীর গানে ধরা দিল, আর আমরা পেলাম মৌসুমী ভৌমিকের গান।

স্মৃতি উস্কে দেয় কত কিছু!

এ বাড়ি, ও বাড়ির স্মৃতি। ঘর ছাড়ার, ঘর ভাঙার পুরনো গল্প। কিছুই ফেলার নয়।

স্মৃতি, নস্ট্যালজিয়া অথবা বেঁচে থাকার সামান্য কথাকে ধরেই একাধিক গান লিখেছেন মৌসুমী ভৌমিক। সেই গানই জনপ্রিয় হয়েছে। এইটা বললে ভুল হয়, যে বাংলা গানের শ্রোতা মাত্রেই মৌসুমীর গান শোনেন। না, একেবারেই না। বাংলা গানের খুব নির্দিষ্ট কিছু শ্রোতা মৌসুমীর গান শুনেছেন, শুনছেন এবং শুনে থাকেন। ইদানীং, ইউটিউবের মাধ্যমে এই শ্রোতার সংখ্যা বেড়েছে বটেই। তবে, স্বীকার করে নিতে হয় যে, এখনও পর্যন্ত মৌসুমী  যতগুলি মননশীল গান সুরের অপূর্ব চলনে উপহার দিয়েছেন, তাঁর বেশিরভাগই বহু লোকের অশ্রুত। 

নব্বইয়ের দশককে বাংলা গানের একটি নতুন যুগ বলে ঘোষণা করেছেন গান সমালোচকরা। বলা হয়ে থাকে, ১৯৯২ সালে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের তোমাকে চাই  ক্যাসেটের প্রকাশ বা ১৯৯২ সালের বাম সরকারের ব্রিগেডের জনসভায় সুমনের গানের স্বীকৃতি এই দুই মিলিয়ে বাংলা গানের আধুনিকতম অধ্যায়টি রচিত হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠবেই, কেন?

সমালোচকরা বলেছেন, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, গীতা দত্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের, মত শিল্পীদের উপস্থিতি সত্তরের দশকের পর থেকে যত ম্লান হয়ে আসছে, তার পর নতুন মেজাজের ‘আধুনিক বাংলা গান’ লিখে চমক লাগিয়ে দেওয়ার কাজটি সুমনের আগে কাউকে করতে দেখা যায়নি। (যদিও গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মহীনের ঘোড়াগুলির জন্ম দিতে না পারলে আজকের সুমন বা মৌসুমীর গান এই রূপ পেত কি না, তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তাছাড়াও আরও একটি বিষয় আমার মনে হয়, ‘আধুনিক’ বাংলা গানের প্রতর্ক বিষয়টি খুব সাবধানী উচ্চারণ হওয়া দরকার । আধুনিক বাংলা গানের প্রতর্কে রবীন্দ্রনাথ-রচিত গানের শিল্পীরা কি পড়েন না? –সেই নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তাতে আপাতত মুলতুবি থাক।) আমার মনে হয়েছে, শহরের দৈনন্দিন যাপন নিয়ে গান নব্বইয়ের আগে কখনও এভাবে লেখা হয়নি। এই ধরনের গান লেখার ক্ষেত্রে একদিকে কবীর সুমন এবং অন্যদিকে মৌসুমী ভৌমিক, এই দুইজনই এগিয়ে এসেছেন। ১৯৯২ সালে তোমাকে চাই প্রকাশিত হওয়ার ঠিক দুবছরের মাথায় মৌসুমী ভৌমিকের তুমিও চিল হও ক্যাসেটটি বেরিয়েছিল।

কবীর সুমন নিঃসন্দেহে আসামান্য গান রচয়িতা এবং সুরকার। তাঁর গান সামদৃত হয়েছে বাংলার সর্বত্র। তোমাকে চাই –য়ের কোনও তুলনাও চলে না কোনও সময়েই। সুমনের পাশাপাশি অঞ্জন দত্ত এবং নচিকেতা চট্টোপাধ্যায়ও কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন সেইসময়ে। সেই জনপ্রিয়তা আজও অটুট। কিন্তু এটা আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত বা নচিকেতার গানের মধ্যে দৈনন্দিন শহুরে যে যাপনের কথা নিহিত থাকে, তা কেবল পুরুষের যাপন মাত্র। মহিলার উপস্থিতি কেবলমাত্র পুরুষটির মাধ্যমে। মহিলার আলাদা আত্মস্বর তাতে অনুপস্থিত। হয়তো তা হওয়া সম্ভবও ছিল না। যে গানের লেখক ও সুরকার গায়কটি নিজেই পুরুষ, তাঁর গানে নারীর প্রতি প্রেমের নিবেদন অত্যন্ত সৎ ভাবে উপস্থিত হলেও তাতে মহিলার স্বরটি প্রতিভাত হওয়ার কথা নয়।

আর সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখলে মৌসুমী ভৌমিক এইখানেই একটি অনন্য ছাপ রেখে যান। ১৯৯২ সাল পরবর্তী বাংলা গানের মেজাজে যে পরিবর্তন চিহ্নিত হল, তাতে শহরের যাপন, বাম রাজনীতির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা কিম্বা শহরকে ভালবাসার যে অনাবিল মুহূর্তগুলি তৈরি হল তার মধ্যে মহিলা যাপনের সুখদুঃখ-বেদনানুভূতির এক অচেনা সমারোহে নিয়ে মৌসুমীর গানে ধরা দিল। একেবারেই উচ্চকিত নয় মৌসুমীর গানের শব্দচয়ন বরং তা তুলনায় পেলব। খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে আবর্তিত। কিন্তু মৌসুমীর গায়কীতে সেইসব সাধারণ শব্দের উচ্চারণ, সুরের অনবদ্য তীক্ষ্মতা এবং তার সঙ্গে শ্বাসাঘাতের খেলা ---সব মিলিয়ে অভিনব স্বাদের জন্ম দিল। বাংলার শ্রোতা মৌসুমী কে খুব তাড়াতাড়ি হজম করতে পারেননি। মৌসুমী র গান সেইভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে আরও এক-দেড় দশক সময় লেগেছে।

নব্বইয়ের দশকে যখন সুমন, অঞ্জন বা নচিকেতার একের পর এক গানের ক্যাসেট বা অনুষ্ঠান শ্রোতার মন জোড়া, সেই সময় মৌসুমী  দেশের বাইরে। কর্ম ও বাসস্থান সূত্রে লন্ডনে। ২০০০ সালের পর কলকাতায় ফেরার সূত্র ধরে মৌসুমী ভৌমিকের গানের ক্যাসেট ক্রমে বেরতে শুরু করে। তারপর কলকাতায় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন বেড়েছে।  

গান-মাধুরী

১৯৯৪ সালে মৌসুমী  ভৌমিকের নিজের লেখা ও সুরারোপে বাংলা গানের প্রথম ক্যাসেট বেরিয়েছিল। তার নাম ছিল, ‘তুমিও চিল হও’। তাতে বেশ কিছু গান ছিল, যেমন কিছু ফেলতে পারি না পুরনো ট্রাঙ্কে পড়ে থাকা মোজা জোড়া, ছেঁড়া সোয়েটার… সংসারের খুঁটিনাটি যা কিছু বাদ দেওয়ারই মত, অথচ জীবনের সঙ্গে এমন জড়িয়ে, স্মৃতির সঙ্গে এমন ওতপ্রোত যে বাদ দেওয়ার কথা মনে হলেই বুকের থেকে এক চামচ রক্ত চলকে ওঠে। পিয়ানোর সঙ্গতে বলিষ্ঠ গায়কীতে মৌসুমী র এই গান সকলেই শুনে ফেলেছেন, এই কথা বিশ্বাস করতেও বোধ হয় কষ্ট হয়।

একের পর এক গানের রেকর্ডিং হতে থাকে। আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীলজল-দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ…এখনও গল্প লেখো সংকলনটি এই গানটি নামে বেরিয়েছিল। বর্তমানে এই গানটি মৌসুমী র লেখা ও সুর করা গানের মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয়।

এছাড়াও রয়েছে, এই শহরের বুকে ক্ষত জমে আছে অর্থাৎ ক্ষত নামের একটি গান। এই শহরের মধ্যে থেকে যা কিছু দেখেও আমরা দেখি না, যে বোধ আমাদের থেকেও নেই। বা যে চেতনার মুখোমুখি হতে ভয় করে সেই নিয়ে লেখা গান। রয়েছে চিত্রকরের মত গান। চিত্রকর তুমি চিলেকোঠায় বসে ছবি আঁকো…। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার সময় শত শত মানুষের কলকাতার যশোর রোডের উদ্বাস্তু হয়ে আসা নিয়ে মৌসুমী  গান লিখেছেন যশোর রোড…আকাশে বসত মরা ঈস্বর/নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে? এছাড়াও রয়েছে, তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত---র খুবই অশ্রুত চলনে একেবারেই নারী যাপনের কথা বলার গান।

শিল্পী হিসেবে মৌসুমী কে কার থেকে এগিয়ে বা কার থেকে পিছিয়ে রাখা যায়, এ জাতীয় চর্চায় ঢুকব না। আবার ‘আধুনিক বাংলা গান’-এর অন্যতম লেখক, সুরকার ও গায়িকা –এ হেন চলতি ছকে না বেঁধে রাখাতেই বিশ্বাসী। তবে মৌসুমী  ভৌমিকের গায়কী যে শ্রোতার কান শুধুমাত্র স্পর্শ করে না, হৃদয় বিদ্ধ করে রাখে এ কথা স্বীকার না করে কারুর উপায় নেই। সাবলীল ভঙ্গিতে, নিতান্ত সাধারণ বেশে খুব কম যন্ত্রানুসঙ্গ নিয়ে গান গেয়ে চলা যায় তা মৌসুমী  ভৌমিকের রেকর্ড ও অনুষ্ঠান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সকলেই জানেন।

অনেকদিন আগে কথাবার্তার ফাঁকে মৌসুমী  ভৌমিকের কাছে তাঁর ছেলেবেলা সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিলাম, তা হল, তিনি শিলংয়ে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন। একেবারে খৃস্টান মিশনারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো করতেন তিনি ও তাঁর দিদি। ছোট থেকেই তিনি গান ভালোবাসতেন। এমনিতে স্কুলে ইউরোপীয় সংস্কৃতি চর্চার কারণে ইংরেজি গান বেশি গাওয়া হত। কিন্তু বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে পুরনো বাংলা গান বা রবীন্দ্রনাথের গান শোনার রেওয়াজ ছিল। আর খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর যেকোনো কঠিন মারপ্যাঁচের সুরের গান হুবহু তুলে ফেলে বড়দের তাক লাগিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল।

শিলংয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর শান্তিনিকেতনে এগার-বারো ক্লাস পড়তে এসেছিলেন মৌসুমী । সেখানে পাঠক্রমের মধ্যেই ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। স্কুল শেষ করে বেশ কয়েকটি জাতীয় স্তরের সঙ্গীতের বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। তারপর বিদেশেও বেশ কয়েকটি ফেলোশিপ নিয়ে যান।  দেশি- বিদেশি মার্গ সঙ্গীতের পরিচিতি ছাড়াও বাংলার নিম্নবর্গীয় সমাজের মধ্যে প্রচলিত গানের কথা ও সুর নিয়ে বহু বছর ধরেই তাঁর গভীর অভিনিবেশ ছিল। মাঝি-মাল্লাদের গান, বাউল গান, ফকিরি রীতির গান-সহ বাংলার প্রান্তিক জনসমাজের গানের বিস্তার নিয়ে সেই কারণে তিনি পরবর্তীকালে একটি অসামান্য কাজও করেছেন তাঁর কিছু বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে। ট্রাভেলিং আরকাইভ http://(https://www.thetravellingarchive.org/home/) নামে একটি ডিজিট্যাল আরকাইভ তৈরি করেছেন ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে। এই সময় নাগাদ যাদবপুরের শক্তিগড় মাঠে খ্যাতনামা বাউল-ফকির উৎসবের প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তারিখ মাসুদের মাটির ময়না ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। মাটির ময়না আন্তর্জাতিক স্তরে নানা পুরস্কার পেয়েছিল। সম্প্রতি অলিভার উইক্সের সঙ্গে ‘নিদ্রিত ভারত জাগে’ নামের একটি রবীন্দ্রনাথের গান ইউরোপীয় চলনে খুব শান্ত ছন্দে গেয়ে অনন্য উপস্থাপনা করেছেন।  

দক্ষিণ কলকাতার নিরঞ্জন সদন সভাগৃহে মৌসুমী  ভৌমিকের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল চলতি বছরের শুরুর দিকে। কোভিডের পর এই অনুষ্ঠানটি ছিল তাঁর প্রথম অনুষ্ঠান। এবং এই অনুষ্ঠানটিতে মূলত ‘মন খারাপ’ নিয়েই মৌসুমী  ভৌমিককে বেশি গান গাইতে শোনা যায়। অনুষ্ঠানে শিল্পী সরাসরি জানিয়েছিলেন যে, মহামারীর ফলে মানুষ যেভাবে গৃহবন্দি থেকেছে, স্বজন হারা হয়ে থেকেছে বা পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে কষ্টভোগ করেছে তারই কিছু ভাগ দিতে ও নিতে এই অনুষ্ঠানে গান গাইবার কথা ভেবেছিলেন তিনি। সেই কারণেই হয়ত সেইদিন নিজের লেখা ও সুরে তৈরি অনন্যের খোঁজে গানটির সামান্য পরিবর্তন করে গেয়েছিলেন, ‘আমি খুঁজছি, আমি খুঁজছি, তোমার নিশানা’---- ঠিকানা খোঁজার পরিবর্তে বলেছিলেন নিশানা। সামগ্রিক অস্তিত্বের বদলে খুঁজতে চেয়েছিলেন মানুষের রেখে যাওয়া, বা থেকে যাওয়া সামান্য চিহ্নকে; যা হয়তো ফেলার নয়।

 

) অনন্যের খোঁজে http://(https://www.youtube.com/watch?v=mvqT9-omNR0&list=OLAK5uy_kvYRUaG9cD0C2QLJHCQFjBFGzrGhxw1sM&index=4)

২) যশোর রোড https://www.youtube.com/watch?v=MckJOsaXuDA

৩) তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত https://www.youtube.com/watch?v=Gbil-UON7W0

৪) আমি শুনেছি সেদিন https://www.youtube.com/watch?v=mycSKkNykQ4

৫) ক্ষত https://www.youtube.com/watch?v=oMPFAFI9aKg

৬) চিত্রকর https://www.youtube.com/watch?v=JZhFlfz2w_w

0 Comments

Post Comment