পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সোনালি খাতুন, নাগরিকত্ব, নির্বাচনী তামাশা

  • 28 November, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 408 view(s)
  • লিখেছেন : শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
বাংলায় নির্বাচন কমিশন ২০০২-এর ভোটার তালিকাকে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী বা এস আই আর-এর ভিত্তিরূপে ধরেছিল। যদিও এখন কাজ চালাচ্ছে ২০২৫-এর তালিকা দিয়ে। কমিশনের নানা কথা ও আচরণের মধ্যে কোনো সঙ্গতি নেই। বাংলায় যেনতেন করে বিপুল সংখ্যক বিজেপি বিরোধী ভোটার বাদ দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য? প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে একটি সত্য জ্বলজ্বল করে বেরিয়ে এসেছে যে সোনালি খাতুনদের পরীক্ষা দিয়েই যেতে হবে, কারণ ঘটনাচক্রে তাঁদের জন্ম হয়েছে মুসলমান পরিবারে।

এই বছরের জুন মাসের ১৮ তারিখে দিল্লীর কে এন কাটজু নগর থানার পুলিশ আচমকাই তল্লাশী চালায় রোহিনীর সেক্টর ২৬-এ। উদ্দেশ্য বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা আটক অভিযান। কোটি কোটি বাংলাদেশী আর রোহিঙ্গাতে ভরে যাচ্ছে ভারত। এমনটাই দাবী ভারতীয় জনতা পার্টির এবং অমিত শাহ জাতীয় নেতাদের। একই সুর ঐ দলের ছোট, মেজ সব নেতাদের মুখে। অতএব পুলিশকে তো কাজ দেখাতেই হবে। সুতরাং তল্লাশী এবং সোনালি খাতুন, দানিশ শেখ ও তাঁদের আট বছরের সন্তান সালিমকে গ্রেপ্তার। সঙ্গে সোনালির বান্ধবী বিধবা সুইটি ও তাঁর দুই সন্তানও বন্দী হলেন। এবং বন্দী করা কালীন সোনালি আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, একথাও মনে রাখার।

কী কারণে বন্দী? তাঁরা বাংলাভাষী, অতএব তাঁরা বাংলাদেশী, এই সন্দেহে বন্দী। তাহলে তো বন্দী করার আগে পুলিশের কাগজপত্র দেখার কথা? সোনালিরা আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই দেখিয়েছিলেন। এমনকি তাঁদের প্যান কার্ডও আছে। তবু কাটজুনগর থানার পুলিশ দিল্লীর বিজেপি সরকার এবং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কোটি কোটি বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গার "অনুপ্রবেশ"-এর গালগল্পের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা দিতে, এঁদের সকলকে তুলে দিয়েছিল বিএসএফের হাতে। তারাও আরেকটি কেন্দ্রীয় সংস্থা। অতএব একই কারণে সোনালিদের চোখ বেঁধে সীমান্ত পার করিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশে। বলেছিল, ফিরে আসার চেষ্টা করলেই গুলি করা হবে। শুধুমাত্র কাপড়চোপড় নিয়ে সীমান্ত পার হতে বাধ্য হয়েছিলেন সোনালিরা।

সেই সংবাদ বাংলাদেশের মানুষজনের সহায়তায় ফোনের মাধ্যমে পৌঁছেছিলো বীরভূমের পাইকর গ্রামে সোনালির পিতা ভাদু শেখ ও মা জ্যোৎস্না বিবির কাছে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের। আরো অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো ১৯৫২ সালের জমির দলিল তাঁদের পরিবারের। অর্থাৎ তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাইকরের বাসিন্দা। কিন্তু দিল্লীতে কেন থাকেন তাঁরা? কারণ জানা গেল। বীরভূমে ভাগচাষীর কাজ করে পেট চলছিলো না। এর বাইরে ছিল বিড়ির ব্যবসা। তাতে দৈনিক যা আয় তাতে সংসার টানা প্রায় অসম্ভব। তারমধ্যে আছে যক্ষ্মার ঝুঁকি। অতএব ভাদু শেখ তাঁর কমবয়সে দিল্লী গিয়ে রিকশা চালাতেন। জ্যোৎস্না বিবি, কাগজকুড়োনির কাজ করতেন। বয়সের ফলে ভাদু শেখ আর রিকশা চালাতে পারেন না বলে সস্ত্রীক ফিরেছেন বীরভূম। কন্যা সোনালি, গৃহকর্মসহায়িকার কাজ করতেন দিল্লীতে।

এখানে আরেকটা কথাও মনে রাখা দরকার, যে ২০২২ সাল থেকে কেন্দ্র মনরেগা বা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা, বাংলায় আটকে রেখেছে দুর্নীতির অভিযোগে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে প্রতিদিন পাহাড়-প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, প্রমাণিত হচ্ছে, তথাপি সেখানে কিন্তু আটকায় না। এখানে আটকায়। এমনকি আদালত ২০২৫-এ টাকা ছাড়ার জন্য রায়দানের পরেও আটকে রেখেছে। প্রশ্নটা হচ্ছে কার টাকা এগুলো? আমাদের করের টাকা নয়? এই টাকা থাকলে সোনালিরা তো এখানেও কাজ করে খেতে পেতে পারতেন। দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকার কি বাংলাকে স্রেফ তাদের জমিদারী ভাবে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের মতো, যেখান থেকে তারা শুধু সম্পদ শুষে নেবে, আর বাংলাকে ঠেলে দেবে মন্বন্তরের দিকে? এও এক আশ্চর্যের বিষয় যে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলি এর বিরোধিতায় অন্তত কর বন্ধ করে দেবার কথাও বলছে না। বলছে না, টাকা না দিলে এখানকার কর থেকে এখানকার সব ব্যবস্থা চলবে, কেন্দ্রকে দেওয়া হবে না।

যাই হোক, অতঃপর মঞ্চের সহযোগিতায় মামলা করেন ভাদু শেখ। কলকাতা হাইকোর্টে কেন্দ্র জানায়, হেবিয়াস কর্পাস বা সশরীরে উপস্থিতিকরণের এই মামলা হাইকোর্ট শুনতে পারে না, কারণ দিল্লীতে সুপ্রিম কোর্ট সে মামলা শুনছে। তারপরেও আদালত রায় দান করেন যে সোনালিদের চার সপ্তাহের মধ্যে ভারতে ফেরত আনতে হবে। বাংলাদেশে তাঁরা এখন বন্দী হয়ে আছেন বিদেশী বলে। আগের মতো আর লুকিয়ে নেই। সোনালির পরিবার এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় সোনালির গর্ভপাতের আশঙ্কা করছেন অন্যান্য আশঙ্কার সঙ্গেই। আরো তাঁদের প্রশ্ন, যদি সোনালির সন্তান বাংলাদেশে জন্মায় তাহলে তাকে কোন দেশের নাগরিক ধরা হবে এবং কাদের সে দায়!

কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পরে আশা জেগেছিল। কিন্তু কেন্দ্র সরকার, তাদের এই বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা তাড়ানোর গালগল্পটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঐ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। তাদেরই পুলিশ, যথাযথ কাগজ থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে সোনালিদের সীমান্তপার করিয়েছে তা তারা মানে না। সুপ্রিম কোর্টে জাস্টিস সূর্য কান্ত এবং জয়মাল্য বাগচির বেঞ্চ বলে, কাগজপত্র যখন সঠিক, তখন সোনালিদের কথা আদালত শুনতে চায়। তাঁদের হাজির করা হোক। কেন্দ্র, হাজির করার বদলে আরো সময় চায় শুনানির জন্য। আসলে সারা দেশে বাঙালি বিদ্বেষ সুচিন্তিতভাবে ছড়ানো হয়েছে। বাঙালি ও বাংলা, নানা সময় ব্রিটিশ শাসন থেকে পরবর্তী ক্ষেত্রেও নানা বিদ্রোহের ঘাঁটি। বাঙালি মাথা নীচু করে গোবলয়ের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতি মেনে নেবে না তা ওঁরা জানেন। সেই কারণেই আরো বেশী করে বাঙালি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। আর তার বলি হচ্ছেন সোনালি খাতুনেরা।

এর সঙ্গে আরেকটিও লক্ষ্যণীয় বিষয় আছে। বাংলায় নির্বাচন কমিশন ২০০২-এর ভোটার তালিকাকে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী বা এস আই আর-এর ভিত্তিরূপে ধরেছিল। যদিও এখন কাজ চালাচ্ছে ২০২৫-এর তালিকা দিয়ে। কমিশনের নানা কথা ও আচরণের মধ্যে কোনো সঙ্গতি নেই। বাংলায় যেনতেন করে বিপুল সংখ্যক বিজেপি বিরোধী ভোটার বাদ দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য কি? প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। এবং তার মধ্যেও একটি সত্য জ্বলজ্বল করে বেরিয়ে এসেছে।

সোনালি খাতুনের মা ও বাবা, জ্যোৎস্না বিবি ও ভাদু শেখ, বীরভূমের মুরারাই বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার ছিলেন ২০০২-তে। পাইকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রুম নং ৩-এ তাঁদের নাম আছে। তাঁদের সন্তান সোনালি খাতুন কেমন করে তাহলে বাংলাদেশী হতে পারেন? বা তাঁর সন্তানেরা? কিংবা দানিশ শেখ? অধুনাতনের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী মা বা বাবার একজনও ভারতীয় নাগরিক হলে, সন্তানও তাই। সেক্ষেত্রে সোনালির মা-বাবা দু'জনেই তো ভোটাধিকার প্রাপ্ত ভারতীয় নাগরিক, তাহলে কোন যুক্তিতে এখনো কেন্দ্র মামলা চালাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে? ২০০২-এর তালিকাকে ভিত্তি ধরাটা কি তাহলে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী তামাশা?

তাহলে তাঁদের অপরাধ কী? এক, বাঙালি হওয়া। দুই, মুসলমান হওয়া। তিন, দরিদ্র হওয়া। এই জন্যই এস আই আর নিয়ে মানুষের চিন্তা। বেছে বেছে মুসলমান, দলিত, মতুয়া, নারী, দরিদ্র নারী ও পুরুষ বাদ দেবে ওরা, এইটাই মতলব? সেই জায়গায় বিহার, ইউপি কিংবা দিল্লী, মধ্যপ্রদেশের ভোটারদের নাম ঢোকাবে যাতে ওরা সেই ভোট পায়? তারপরে থাকবে ভোটচুরি?

 

বাংলায় যার জন্ম সে বাঙালি। তার নাগরিকত্ব যাচাই করার নৈতিক অধিকার কারো নেই। ভারতে যে জন্মেছে সে ভারতীয়। কাগজ থাক বা নাই থাক, তাকে বেনাগরিক করার ওরা কারা? যদি দলে দলে আজ বেনাগরিক হয়, তাহলে সেই সব ভোটে নির্বাচিত সরকারটাই তো বে-আইনী। কেন্দ্রে সরকার ভেঙে দেওয়া হোক তাহলে। এবং কাগজ দেখাতে বলতে হবে সব্বাইকে। কোনো নেতা মন্ত্রী ছাড় পাবে না। কেন পাবে? গণতন্ত্রে আইনের চোখে একজন সোনালি বিবি, একজন নরেন্দ্র মোদীর সমতুল্য। তাই সেটা গণতন্ত্র, এটাই তো বুর্জোয়াদের গণতন্ত্রের দাবী! ব্যতিক্রম কেন হবে? ব্যতিক্রম মানেই আসলে এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সের ডিগ্রি লুকোনোর মত জঘন্য চেষ্টা।

সোনালি বিবিদের অবিলম্বে ফেরত আনা হোক। সসম্মানে। বাঙালিদের বাংলাদেশী সন্দেহে, রোহিঙ্গা সন্দেহে অত্যাচার ও হেনস্থা করার জন্য ভারত সরকারকে দায়ী করা হোক আইনত। দণ্ড হোক যারা এ কাজ করছে তাদের প্রত্যেকের, যাতে এমনটা করার আর সাহস কেউ না পায়। ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু অন্তত নমুনাস্বরূপ সোনালিদের মতো মানুষদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করুক। এসব যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের গণতন্ত্র সম্পূর্ণত ধ্বসে গেছে। সোনালি খাতুনদের নাগরিকত্ব তার অ্যাসিড টেস্ট।

 

 

 

0 Comments

Post Comment