মাঝে মাঝেই খবরের কাগজের পাতায় একটা হুঙ্কার শোনা যায়, NRC-CAA আমরা করবই। একটা বিপরীত আওয়াজও পাওয়া যায়, আমরা তা হতে দিচ্ছি না। কীভাবে ‘করবই’ আর কীভাবে ‘হতে দিচ্ছি না’, সেটা নিয়ে আমরা অনেকেই তেমন ভাবি না। রোজকার জীবন-চক্রে দু-দণ্ড ভাবার অবকাশই বা কই? আর তাছাড়া মোটামুটি আমাদের অভ্যস্ত জীবন-চক্রে যা মিডিয়ায় নেই, মোটের ওপর তা নেই!
কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা চুপিসাড়ে ঘটে চলে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে অভীষ্টের দিকে পা বাড়ায়। তেমনই একটা ঘটনা ঘটে চলেছে জাতীয় জনপঞ্জি বা NPR আপডেশনের ক্ষেত্রে। সরকারিভাবে ঘোষণা হয়েছিল ২০১১ সালের জনগণনার প্রথম পর্যায়ে ২০১০ সালে একই সঙ্গে NPR হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে একটা NPR ফর্মও পাওয়া গিয়েছিল। তারপর কিছু ইংরেজি কাগজ থেকে জানা গিয়েছিল ২০১৫ সালে একটা NPR আপডেট হয়েছে --- ১১৯ কোটি ভারতবাসীর। ১১৯ কোটি সংখ্যাটা দেখে অনেকেই চমকেই গিয়েছিলেন। কারণ ২০১০ থেকে ২০১৫-১৬ সময়কালে এরকম কর্মকাণ্ড তো টের পাওয়া যায়নি। আর এ নিয়ে শাসক বা বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের কোনো চিত্তচাঞ্চল্যও চোখে পড়েনি। মিডিয়ার গতিবিধিও তথৈবচ।
এসব সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আর একটাও সরকারি হুঁশিয়ারি ছিল : NRC-র প্রথম ধাপ NPR। এবছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : ‘In 2015, a few fields such as Name, Gender, Date and Place of Birth, Place of Residence and Father’s and Mother’s name were updated and Aadhaar, Mobile and Ration Card Numbers were collected.’, Page 244, MHA Annual Report 2021-22. স্বভাবত, মনে প্রশ্ন জাগল, কীভাবে NPR-এর সঙ্গে আধার, মোবাইল আর রেশন কার্ড নাম্বার সংগ্রহ করা হল? একজন আধার নাম্বার NPR আপডেশনে যুক্ত করা কি ঐচ্ছিক না বাধ্যতামূলক? আধার নাম্বার NPR–এ ব্যবহার করার জন্য মানুষকে ওয়াকিফহাল করে সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি? এই মর্মে ২১ নভেম্বর ২০২২ নো এনআরসি মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত একটা আরটিআই করলেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার দপ্তরে। এই তিনটে প্রশ্নের সঙ্গে ওয়াকিফহাল করে সম্মতি নেওয়ালেন। ফর্মের একটা কপিও চাওয়া হয়েছিল।
১৯ ডিসেম্বর মেটিয়াবুরুজ নো এনআরসির কিছু মানুষ, ওই দপ্তর থেকে একটা জবাব পেলেন। জানানো হল,
এক, আধার নাম্বার সংগ্রহ ঐচ্ছিক।
দুই, এটা সত্য প্রত্যেকের জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে নেওয়া হয়েছে।
তিন, ২০১৫ সালের NPR আপডেশনে কয়েকটা বিষয়, যেমন, নাম, লিঙ্গ, জন্ম তারিখ ও স্থান, বাসস্থান, বাবা ও মায়ের নাম আপডেশন করা হয়েছে এবং আধার, মোবাইল ও রেশন কার্ড নাম্বার সংগ্রহ করা হয়েছে। যে ফর্মের মাধ্যমে এইসব তথ্য নেওয়া হয়েছে তার একটা ফাঁকা কপি সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
RTI-এর আবেদনকারী হিসেবে অতীতে এইরকম কোনো ফর্ম বা নিদর্শপত্র দেখা যায়নি। সেটা ভরে ২০১৫ সালে বা তার আগে পরে সই করে জমাও দেননি। চারপাশে বেশ কিছু মানুষকে আমি জিজ্ঞেস করে জানা গেছে, তারা এরকম কিছু দেখেছেন বা ভরেছেন কি না। এখনও এরকম কাউকে পাওয়া যায়নি।
যদি কোনও ছোট এলাকায়, জেলায়, রাজ্যে এবং দেশ জুড়ে কেউই এরকম ফর্ম না ভরে থাকে, তাহলে ১১৯ কোটি দেশবাসীর NPR হালনাগাদ প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা সম্বন্ধেই প্রশ্ন জাগে। তার ভিত্তিতে NRC হলে তাও অবৈধ হবে না কি?
NRC যে কোন রথে চড়ে কোন শুভ (!) দিনে আসছে তা বোঝা দুষ্কর। ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক CAG প্রতিবেদনে আসামের NRC সম্বন্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। তৎকালীন NRC কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা এবং সিস্টেম ইন্টিগ্রেটর উইপ্রো কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে এই প্রতিবেদন। কিন্তু এই NRC কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারিগর বিজেপি দল ও সুপ্রিম কোর্ট কি এর দায় এড়াতে পারে? এখনও রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া এই NRC তালিকা গ্রহণ করেনি। অথচ এর জন্য ১৫৭৯ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে! যে CAA ২০১৯ এই প্রক্রিয়ার জুড়ি হিসেবে এসেছিল, তার নিয়মাদি বা রুল্স এখনও তৈরি করতে পারেনি সরকার। রাজ্যসভা ও সংসদে ছয়বার সময় নেওয়ার পর সপ্তমবার ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছে সরকার। অথচ গতবছরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কোভিডের দোহাই দিয়েছিলেন। CAA ২০১৯-এর বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে ২৩০টার বেশি মামলা হয়েছে, তার শুনানি হয়নি।
তাহলে এতগুলো খাঁড়া ঝুলছে দেশবাসীর মাথার ওপর। অকস্মাৎ কোনটা কখন নেমে আসবে তা নিশ্চয় কেউ জানে।