‘‘নগর পুড়িলে দেবালয় কী এড়ায়’ – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বাণিজ্য করছে বাংলা জুড়ে কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ হতে বাকি আছে আরো বছর কয়েক - সেই সময়ে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর এরকম একটা পংক্তি লিখেছিলেন তাঁর অন্নদামঙ্গলে।
সাহিত্যের এমনই গুণ যে সে অনায়াসেই দেশকালের গণ্ডী পেরিয়ে যেতে পারে। ফ্যাসিবাদের জমানায় দূর দেশের এক কবির নাটক ডাকঘর অভিনয় করে এইজন্যই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষেরা শক্তি পান। নকশাল দমন বা এমার্জেন্সির সময়ে সমকালের ভাষা হয়ে ওঠে সেই কবেকার গ্রীক নাটকের একটি উক্তি – “এই মৃত নগরীর রাজা হয়ে তোমার কী হবে অয়দিপাউস?”
ভারতচন্দ্রের লেখার দিকেই আবার একটু ফেরা যাক। অষ্টাদশ শতকের এই কবির লেখাতে ঝকমক করে নানা প্রাজ্ঞোক্তি। সেগুলিকে কখনো কখনো আমাদের মনে হয় একেবারে একালের কথা। সংবাদপত্রের কোনও কোনও খবরের হেডলাইনও যেন বা হয়ে উঠতে পারে সেটা। সেই বিখ্যাত কাব্যে আরো কিছু চমকপ্রদ পংক্তি - এখনকার ভাষায় যাকে বলা যায় ওয়ান লাইনার - যেমন – ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’ বা ‘কু কথায় পঞ্চমুখ কন্ঠ ভরা বিষ’ ইত্যাদি ছিল। এগুলি শুনতে শুনতে মনে হয় এসব যেন আমাদের চলমান রাজনীতির ধারাবিবরণী। ভোটে জিতে এলে সবাইকে পনেরো লাখ টাকা করে দেব শুনে তো কারোর মনে আসতেই পারে ঐ বিস্তর মিছার পংক্তিটি। গোলি মারো শালেকো থেকে আরো অজস্র উক্তি কি মনে করিয়ে দেয় না কুকথা আর কন্ঠ ভরা বিষ এর পংক্তিটিকে ?
এ হেন অকথা কুকথার অজস্র আদান প্রদানে ভরে থাকা রাজনীতির ময়দান সবচাইতে কলুষিত হয়ে ওঠে যে নির্বাচনী পরিমণ্ডলে, যেখানে এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অনায়াসে কোমরে দড়ি পরিয়ে হিড় হিড় করে টেনে জেলে ঢোকানোর কথা বলে ভোটারদের তাতাতে পারেন, সেখানে কংগ্রেসের কাণ্ডারী রাহুল গান্ধীর একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে বিচার চলে দীর্ঘদিন। বিচারের রায় সামনে আসে গত পরশু। সেখানে রাহুলকে কুকথার দায়ে দু বছরের জেলে যাবার রায় ঘোষণা করা হয়। যদিও তখনি তখনি জেলে না ঢুকিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদনের জন্য একমাস সময় দিয়ে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। আর ঠিক তার পরদিনই রাহুলের সাংসদ পদ বাতিল করে দেন লোকসভার স্পিকার।
রাহুল যে মন্তব্য করেছিলেন তা কতটা অপরাধ, সেই অপরাধের শাস্তি কতটা হতে পারে, শাস্তি ঘোষণা হওয়ার পর সাংসদ পদ কত দ্রুত কেড়ে নেবার দরকার – এইসব নিয়ে নানা মত থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এটা বোঝা কঠিন নয় রাহুলের মন্তব্য যতই আলগা বা বেলাগাম হোক, তা নির্বাচনী গালিগালাজের মঞ্চে ব্যতিক্রমী নয়। এ নিয়ে যে মামলা হল, সাজা হল – তার সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে সেও সবাই জানেন। রাজনীতি যে হবে এসব নিয়ে তাও অজানা নয়। কিন্তু কথা হল ঠিক দু বছরের কারাবাসের সাজাই কেন হল ? কিছু কম দিন কারাবাস বা সতর্কতা বা নিদেনপক্ষে জরিমানা কেন নয় ? এই প্রসঙ্গেই দরকার এই সাজার সঙ্গে ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব বাতিল সংক্রান্ত বিষয়টিকে মিলিয়ে দেখা। সেখানে বলা আছে অন্তত দু বছর সাজা আদালতে কোনও জনপ্রতিনিধি পেলেই তার জনপ্রতিনিধিত্ব বাতিল হবে। আর লোকসভার স্পিকারের কাছে যতই নানা দুর্নীতির বিচারের মামলা, দলবদলের মামলা বছরের পর বছর পরে থাকুক না কেন, এক্ষেত্রে স্পিকার মশাই কেন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই অতি তৎপর হয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ফেললেন – তাও সহজেই বোঝা যায়।
ভারত জোড়ো যাত্রাকে ঘিরে জনসংযোগই হোক বা আদানির বে আব্রু হয়ে পড়া ব্যবসা সম্পর্কে তদন্তের দাবি তুলে ধরাই হোক - রাহুলকে নিয়ে কেন্দ্রের শাসকেরা যে স্বস্তিতে ছিলেন না তা স্পষ্ট। কিন্তু বিরোধী স্বর নিয়ে অস্বস্তি হলে যেখানে শাসক তাকে কোতল করে - সেটা কেমন ধরনের গণতন্ত্র?
প্রশ্ন হল রাহুল শাস্তি পেয়েছেন, তা নিয়ে আমরা যারা কংগ্রেসের লোক নই, যারা এই কংগ্রেসেরই নকশাল দমন, এমার্জেন্সি থেকে অপারেশন গ্রীন হান্ট ইত্যাদি জানি – তারা কেন এত কথা বলছি ? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা। আবার ভারতচন্দ্রের সেই লাইনটায় ফেরা যাক। “নগর পুড়িলে দেবালয় কী এড়ায়?” জার্মানীর নাজিবাদের প্রেক্ষাপটে এক বিখ্যাত কবি নাট্যকারের এরকম এক কবিতা আছে, যেখানে একজন উপলব্ধি করছে অন্যেরা বিপদে পড়ছিল যখন একের পর এক, তখন এক চুপ করে থাকা মানুষের কথা। খানিক স্বস্তিতেই ছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন যে তার গায়ে আঁচ পড়বে না, অতএব অন্যের জন্য প্রতিবাদে নামার দরকার কী। পরে তার ওপরেই যখন আক্রমন নেমে এল তিনি দেখলেন তখনো কেউ প্রতিবাদ করছে না। আসলে তখন প্রতিবাদ করার মতো কেউই আর বেঁচেবর্তে ছিল না।
চারপাশের এইসব ঘটনাবলী দেখতে দেখতে লাতিন আমেরিকার এক বিখ্যাত লেখক - গার্সিয়া মার্কেজের একটি উপন্যাসের কথা খুব মনে আসছে। কেন সেই প্রসঙ্গে দু চার কথা বলি।
গার্সিয়া মার্কেজের অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক উপন্যাসটিতে এক স্বৈরশাসকের কথা আছে। আমাদের দেশ বা রাজ্যের হালচাল দেখতে দেখতে তো স্বৈরশাসকরা কেমন হয়, তার কিছু ধারণা আমরা পেয়ে যাই। ইতিহাসেও নানা স্বৈরশাসকের উদাহরণ অজস্র।
গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসটি নানা অর্থেই ব্যতিক্রমী। এই প্রথম মার্কেজ সরে এলেন তাঁর কল্পিত মাকন্দোর পটভূমিটি থেকে। এর আগের সবকটি উপন্যাস – লিফ স্টর্ম, নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল, ইভিল আওয়ার, ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড – রচিত হয়েছিল মাকন্দোর পটভূমিতে। এগুলির প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিল দশকের পর দশক ধরে কলম্বিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধ। গোত্রপিতার হেমন্ত উপন্যাসটি গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছেন এক স্বৈরাচারী একনায়ককে নিয়ে।
লাতিন আমেরিকায় এর আগেও কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস লেখা হয়েছিল একনায়কদের কেন্দ্র করে। ১৯২৬ সালেই রামোন দেল ভাল্লে ইনক্লান লিখেছিলেন তিরান্দো বান্দেরাস। আর ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় লাতিন আমেরিকান কথাকারদের মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী মিগুয়েল আস্তুরিয়াস এর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দ্য প্রেসিডেন্ট। গার্সিয়া মার্কেজ যখন তাঁর গোত্রপিতার হেমন্ত লিখছেন তখন লাতিন আমেরিকার অপর দুই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকও একনায়ক কেন্দ্রিক এই ধরনের দুটি উপন্যাস লেখেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় কিউবার কথাকার আলেহো কার্পেন্তিয়েরের রিজনস অব স্টেট নামে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। পরের বছর ১৯৭৫ এ বেরোয় রোয়া বাস্তোসের আই দ্য সুপ্রিম। আর সেই বছর, ১৯৭৫ সালেই প্রকাশিত হয় গার্সিয়া মার্কেজের গোত্রপিতার হেমন্ত।
সত্তর দশকের সেই সময়টায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মিলিটারি একনায়কতন্ত্রী শাসকদের আধিপত্য দেখা যাচ্ছিল। সন্দেহ নেই এরই প্রতিক্রিয়ায় লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত কথাকাররা যেন নিজেদের মধ্যে এক শলা পরামর্শের ভিত্তিতেই একের পর এক এরকম আখ্যান লিখছিলেন। সত্তর দশকের সমকালীন একনায়করাই যে কেবল গার্সিয়া মার্কেজের ‘অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক’ উপন্যাসের ভিত্তি তা নয়। ১৯৫৮ তে ইউরোপ থেকে গার্সিয়া মার্কেজ যখন আবার তাঁর নিজের মহাদেশে ফিরলেন, সাংবাদিকতার সূত্রে থাকতে শুরু করলেন ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে, সেই সময়েই সেখানে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। একনায়কতন্ত্রী শাসক পেরেজ হিমেনেজকে জনগণ গদিচ্যুত করে এবং গোটা ভেনেজুয়েলা জুড়ে শুরু হয় এক বড় মাপের উৎসব। তরুণ মার্কেজ ছিলেন একনায়কের বিদায় ও জনগণের এই উৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী। এই ঘটনা গার্সিয়া মার্কেজকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তিনি স্বৈরতন্ত্রী একনায়কদের ইতিহাস, তাদের সম্পর্কে প্রচলিত নানা টুকরো কাহিনী পড়তে শুরু করেন। তিনি দেখেন কোথাও কোথাও বাস্তব ঘটনা কুহকের জগতে পৌঁছে যাচ্ছে। গার্সিয়া মার্কেজ জানান তিনি দুভালিয়ের নামে হাইতির এক স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কের কথা পড়েছেন যিনি তার রাজ্যের সব কালো কুকুরকে হত্যা করার আদেশ জারি করেছিলেন। কারণ দুভালিয়ের বিশ্বাস করতেন তার এক রাজনৈতিক শত্রু মানুষের চেহারা বদলে এক কালো কুকুরের চেহারা ধারণ করেছে। গার্সিয়া মার্কেজ জানিয়েছিলেন এল সালভাদোরের একনায়কতন্ত্রী শাসক ম্যাক্সিমিলিয়ানো হের্নান্দেজের কথা, যিনি এক খাবার আগে এক পেণ্ডুলাম ব্যবহার করে বুঝে নিতে চাইতেন তার খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে কিনা। এই উপন্যাস প্রকাশের কিছুদিন আগে চিলিতে বামপন্থী শাসক সালুভাদোর আলেন্দেকে এক মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যমে উৎখাত ও হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন স্বৈরশাসক পিনোচেত। স্পেনের শাসক ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কো তিরিশের দশক থেকে দীর্ঘদিন সেখানে যে স্বৈরশাসন চালিয়েছিলেন, তাও গার্সিয়া মার্কেজের অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল। বস্তুতপক্ষে বাস্তব ও কল্পনার নানা মিশেলে গার্সিয়া মার্কেজ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর গোত্রপিতার হেমন্ত নামক উপন্যাসটির জগৎকে।
গার্সিয়া মার্কেজের এই আশ্চর্য আখ্যানটির শুরুতেই আমরা জানতে পারি একনায়কতন্ত্রী শাসকের মৃত্যুর কথাটি। তবে সত্যিই তাঁর মৃত্যু হয়েছে কীনা এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে নানা সন্দেহ দানা বাঁধে। কারণ এর আগেও অনেকবার তাঁর মৃত্যু সংবাদ ঘোষিত হয়েছে বা তার মৃতদেহ দেখা গেছে। কিন্তু পরে জানা গেছে সেগুলি হল তার ডামি বা ছায়ামানবের মৃতদেহ। একনায়কটি বারবারই ফিরে এসেছেন ও শাসন চালিয়ে গেছেন। প্রায় দুশো বছর তার বয়েস। তিনি তাঁর শাসনের শততম বার্ষিকীও পালন করেন মহা সমারোহে।
এই শাসককে কেউই প্রায় চোখে দেখে নি। তার প্রকৃত নামটিও পাঠককে জানানো হয় না। অবশ্য এই উপন্যাসের অন্য কিছু চরিত্র তথা স্বৈরশাসকের নিকটবৃত্তের কয়েকজনের নাম পাঠক জানতে পারেন। এরা হলেন তার ডামি বা ছায়ামানব প্যাট্রিসিয় আরাগোনেস, তার প্রেয়সী ম্যানুয়েলা স্যাঞ্চেজ, স্ত্রী নাজারেনো লেটিসিয়া, মা বেনদিসিয়ো আলভারাদো, জেনারেল রডরিগো আগুলিয়ার প্রমুখ।
উপন্যাসের ঘটনাগুলি কোনও একটি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ঘটে, কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট নয়। গার্সিয়া মার্কেজ নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গোটা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলটাকেই তিনি খুব ভালোভাবে চেনেন আর এখানকারই এমন একটি জায়গাকে এই আখ্যানের ঘটনাস্থল হিসেবে ধরে নিতে হবে যেখানে স্পেনীয় ক্যারিবিয়ান ও ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান উভয়েরই বৈশিষ্ট্যের ছোঁয়া আছে।
উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতে একনায়কের মৃত্যুর সংশয় ঢাকা খবরটি ছিল। পরবর্তী প্রতিটি পরিচ্ছেদের শুরুতেও এই খবরটিই নানা কোণ থেকে বলা হয়েছে। তবে মৃত্যু সংক্রান্ত খবরের পর পরিচ্ছেদগুলি কথা বলেছে ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে। প্রথম পরিচ্ছেদে চিল শকুনেরা প্রাসাদের মধ্যে ঢুকছে, এটা দেখে বাকিরা বুঝতে পারে মৃত্যুর বিষয়টি। তারা যখন প্রবেশ করে তখন প্রাসাদ জুড়ে তারা দেখতে পায় অবক্ষয়ের নানা চিত্র। প্রথম কয়েক পাতা জুড়ে এই অবক্ষয়ের ছবিটি ফুটিয়ে তোলার পর আখ্যান কথক শকুনে খুবলে খাওয়া স্বৈরশাসকের মৃতদেহটির বর্ণনা দেন। তার চোখ মুখ শকুনেরা ঠুকরে খাওয়াও চেনা যাচ্ছিল না। তবে আখ্যান কথক এও বলেন যে মুখটি অবিকৃত থাকলেও তাকে চেনা যেত না, কারণ তার আসল মুখ কেউই দেখে নি। দেশের পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে এই জেনারেলের ছবি ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু সে সব বহু আগে তোলা। হয়ত বা একশ বছর আগে। হয়ত বা সে ছবি আদৌ জেনারেলের নয়, জেনারেলের কোনও ডামির ছবি সেটা। এরপর বিস্তারিতভাবে এসেছে এই স্বৈরশাসক ও তার শাসন সম্পর্কিত নানা বিচিত্র তথ্য। এসেছে স্বৈরশাসকের ডামি বা ছায়ামানব প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসের কথা। প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসের বিষণ্ণ মুখ দেখে একদিন জেনারেল জিজ্ঞাসা করেন তার খাবারে বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা। উত্তরে আরাগোনেস জানান যে প্রেমে পড়ার ফলেই তার এই অবস্থা। এক উৎসবে তিনি এক সুন্দরীকে মুকুট পরিয়েছিলেন আর তার সঙ্গে ওয়াল্টজ নেচেছিলেন। তার পর থেকে তার মুখ আর তিনি ভুলতে পারছেন না। এরপর জেনারেল তার ডামি প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসকেও তার রক্ষিতাদের কাছে যাবার ও সঙ্গম করার অনুমতি দেন। এই সূত্রেই জেনারেলের যৌন জীবনের কিছু দিক বর্ণনা করেন আখ্যান কথক। জেনারেলের অসংখ্য রক্ষিতা প্রাসাদের হারেমে থাকত আর তিনি পালা করে তাদের সঙ্গে সঙ্গম করতেন। প্রায়শই একাকীত্বের আড়ালটুকুও নিতেন না। রক্ষিতাদের ছেলেপিলেরা সবাই ছিল সাত মাস বয়সের শিশুর মতো দেখতে। তারা এসে পড়লে তাদের মায়েরা সঙ্গমকালে বিব্রত হতেন, তাদের চলে যেতে বলতেন সঙ্গমস্থল থেকে। জেনারেলের অবশ্য এই নিয়ে কোনও তাপ উত্তাপ ছিল না। আরাগোনেস জেনারেলের রক্ষিতাদের সঙ্গে সঙ্গমের অনুপতি পাবার পর তিনিও তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে থাকেন। সেই সন্তানরাও সবাই সাত মাস বয়সের শিশুর মতোই বামনাকৃতি অবস্থায় আটকে থাকত। কোন সন্তান জেনারেলের আর কোনটি আরাগোনেসের তা কেউই জানতে পারে নি।
জেনারেলের শখ ছিল তাঁকে প্রজারা কতটা সম্মান করে, তাঁর শাসন সম্পর্কে তাদের কতটা সমীহ, সে সব জরীপ করা। তাই তিনি একটি ঢাকা ওয়াগনে চেপে শহর ঘুরতে শুরু করেন, দেখতে থাকেন তার শাসনের প্রভাব। পোপের দূত জনৈক বিশপ তাঁকে খ্রিস্ট বিশ্বাসে দীক্ষিত করতে চাইলে স্বৈরশাসক বলেন তিনি যখন সবকিছুই ঠিক করছেন তখন আর তার দীক্ষিত হবার প্রয়োজন কী! জেনারেল মহাদেশের নানা দেশের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনায়কদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে। তিনি তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতা চালাতেন শৈলশিখরের ওপরে এমন এক জায়গায় যেখান থেকে মহাসাগরের তটরেখা দেখা যায়। তাঁদের সঙ্গে সেখানে তিনি ডমিনো খেলতেন। তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত আর তিনি প্রবল ক্ষমতাধর এবং তাঁদের আশ্রয়দাতা – এটা তাঁকে তৃপ্তি দিত। তবে ক্ষমতা চ্যুতির ভয় যে তাঁরও ছিল না, তা নয়।
জেনারেল সবসময়েই সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের ভয়ে থাকতেন। এই সেনাবাহিনী যেমন একদিকে সামরিক শাসকদের ভরসা আবার তারা সেখান থেকেই ক্যু দে তা-র ভয়ে কেমন আচ্ছন্ন থাকেন গার্সিয়া মার্কেজ এই উপন্যাসে তা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। আখ্যানের একনায়ক জেনারেলটি সেনাবিদ্রোহের ভয়ে এমনই আচ্ছন্ন থাকেন যে সেনা বাহিনী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে এই আশঙ্কায় তিনি তাজা দশ রাউন্ড গুলির বদলে আটটি শূন্য কার্তুজ পাঠান। গোলাবারুদের পাউডারের সঙ্গে মিশিয়ে দেন সমুদ্রতীরের বালি। সমস্ত গোলাবারুদ রাষ্ট্রপতি ভবনে নিজের নাগালে একটি অস্ত্রাগারে রেখে দেন। সেই অস্ত্রাগারের একটিমাত্র চাবিই ছিল, কোনও নকল ছিল না। আর চাবিটি রাখা থাকত তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত রড্রিগো দ্যু আগুইলারের কাছে।
জেনারেল জানতে চান তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে দেশে কীরকম প্রতিক্রিয়া হবে। বিশেষত ক্ষমতালিপ্সু অধস্তনরা তার কী মূল্যায়ন করবে এবং কোন পথে হাঁটবে। আড়াল থেকে এইসব দেখার জন্য তিনি এক কৌশল অবলম্বন করেন। জেনারেল তার ডামি প্যাট্রিসিয় আরাগোনেসকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর জেনারেল আরাগোনেসের গায়ে চাপিয়ে দেন জেনারেলের নিজের পোশাক, সাজসজ্জা ও অলঙ্কার। জেনারেল নিজেই নিজের মৃত্যু সংবাদ রটতে সাহায্য করেন তারপর গোপনে দেখতে থাকেন এর প্রতিক্রিয়া। প্রজাদের মধ্যে, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে, সর্বোপরি ক্ষমতালিপ্সুদের প্রতিক্রিয়া তিনি আড়াল থেকে দেখতে থাকেন। কারা তার মৃত্যুতে উল্লসিত আর কারা বেদনার্ত এসব বুঝে নিতে থাকেন। গোপন আস্তানা থেকে এসব ভালোভাবে দেখে নেবার পর তিনি ফেরেন রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে। সেখানে মন্ত্রীকক্ষে তখন কাঠবাদাম কাঠের টেবিলের চারপাশে বসে ছিল তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় দলের নেতারাই। ছিলেন হাই কম্যান্ড জেনারেলবর্গ, মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন সদস্য, প্রধান আর্চবিশপ, বিদেশী রাষ্ট্রদূত। তাঁরা শতাব্দীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে ক্ষমতার নতুন ভাগবিন্যাসের কথা বলছিলেন আর তাঁদের চোখে ছিল লোভ। এই সময়েই জেনারেল অতর্কিতে সেখানে প্রবেশ করলেন আর টেবিলের ওপর মারলেন এক চাপড়। এতেই ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে মন্ত্রণাকারীরা ছিটকে পালাল। অবশ্য পালানো তাদের পক্ষে সম্ভব হল না। জেনারেলের পরম বিশ্বস্ত রডরিগো দ্য আগুইলারের অনুগতরা তাদের ওপর মেশিনগানের গুলি চালালো নাগাড়ে আর শুরু হয়ে গেল এক বিরাট গণহত্যা। রাজধানী ছাড়িয়ে মফস্বলের শহরগুলোতেও এই গণহত্যার রেশ ছড়িয়ে পড়ল। জেনারেলের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার পর যারা আনন্দ উৎসব করেছিল তাদেরও হত্যা করা হল একে একে। আর যারা সে সময় শোক প্রকাশ করেছিল তারা নানাভাবে পুরস্কৃত হল।
একসময় যখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নামক প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠে নি, তখন রাজা, সম্রাট, সুলতান, জার বা সামন্ত শাসকরাই রাষ্ট্র চালাতেন। ব্যক্তির মর্জি খুবই প্রাধান্য পেত। যদিও একটি কাঠামোর মধ্যে তারা কাজ করতেন। সেই কাঠামোটি বিদ্রোহও ঘটাত। বিশেষ করে পরিবারের ভেতর থেকে বিদ্রোহ, খুন, সিংহাসন দখল ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ব্যক্তিগত লিপ্সার পাশাপাশি আদর্শগত জায়গা থেকেও ক্ষমতা দখল হত৷ বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষক মৌর্যদের সরিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গর ক্ষমতা দখলের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়। আবার মৌর্য শাসনের আগেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু কাঠামো ভারতে গড়ে উঠেছিল ও বেশ অনেকদিন ধরে সেগুলি সক্রিয় ছিল। মগধ বা কাশি বা কোশল যেমন রাজতান্ত্রিক মহাজনপদ ছিল, তেমনি ছিল গণতান্ত্রিক বৃজি। গৌতম বুদ্ধ এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির পাশে ছিলেন বলেও মনে করা হয়। তবে ফরাসী বিপ্লবের আগের পৃথিবীতে এগুলি ছিল বিরল ব্যতিক্রমী। যদিও এই কথা বলার সময় আমাদের মনে রাখতেই হবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, যাদের উপজাতি বলা হয় কেননা তারা নাকি জাতি গঠনের পর্যায়ে আসে নি এখনো - তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামো যথেষ্ট পরিমাণেই দেখা যাবে। এরকম বেশ কিছু সমাজ আমাদের দেশেও ছিল দীর্ঘদিন ধরে।
আমাদের দুর্ভাগ্য গণতন্ত্রের অনুশীলন স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের এখানে খুব দুর্বল। যেটুকু গড়ে তোলা হয়েছিল তার ভিতও খুব মজবুত ছিল না। যা ছিল তাও ক্রমাগত ভাঙছে। ফলে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইটা শুধু যে কঠিন তাই নয়। লড়াইয়ের শত্রু মিত্র সাদা চোখে বিচার করাও কঠিন। বিভ্রম থেকে বিতর্ক – সবই বাস্তবের নানা কারণেই অবশ্যম্ভাবী। তবু এই সময়টা অনেক ছোট বিতর্ককে আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে বড় ঐক্যের প্রয়োজনিয়তার কথা বলে। বিতর্কহীনভাবে সে ঐক্য হবার নয়। কারণ বিতর্কহীনতাই তো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।