পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অনুপস্থিত

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 203 view(s)
  • লিখেছেন : অ্যাঞ্জেলিকা গোরোডিশার
ঘটনাক্রম কমবেশি এরকম: পাড়ার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে এল লোকটা। শনিবারের দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ওর পিঠে নরম রোদ। সবুজ রঙের একটা বেড়ার সামনে এসে ও দাঁড়াল। ভাবল: ওহ না, মোটেই না, কতই বা ওর বয়স! সাত, বড়জোর আট, ওহ না, আমি তা করতে চাই না।

বেড়া দিয়ে ঘেরা এক ফালি বাগান আর একটু ঘাসে ঢাকা জমি। যত্নের অভাব বেশ। রাংচিতার ঝোপ আর একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ ছাড়া বলতে গেলে কিছুই আর নেই। অবশিষ্ট কিছু দোপাটি আর গাঁদা ফুলের গাছকে অবশ্য এখানে ধরা হয়নি। ছোট্ট একটা মেয়ে তুলোয় ঠাসা একটা বেড়াল নিয়ে সেখানে খেলছিল। লোমে ভরা, লেজহীন, সামান্য গোঁফওয়ালা সেই পুতুলের সঙ্গে সে একমনে কথা বলছিল।

লোকটা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাইল।

“হ্যাঁ রে শুনছিস!”  

মেয়েটা কোন উত্তর দিল না।

লোকটা বলল,“নাম কী রে তোর?”

“মা অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছে।”

“তাই তো আমি তোর নাম জানতে চাইছি। তুই তোর নাম বল, আমি আমারটা বলছি। তাহলে কেউ কারও কাছে অচেনা থাকব না।”

লোকটা ভাবল: খুব বেশি হলে ছয়। না, তার বেশি নয়। ওহ, কী করি আমি এই বাচ্চাকে নিয়ে। এই বয়সে ওরা বেশ নরম ও কোমল। ওহ, না, বুঝতে পারছি না।

“কিচ্ছু বলব না তোমায়।”

“বেশ, বলিস না। তোর মা কি বাড়িতে?”

“না, দোকানে গেছে।”

“তাহলে তুই কি বাবার সঙ্গে বাড়িতে আছিস?”

শুধু আমায় হ্যাঁ বলুক একবার, বলুক যে বাবা বাড়ি আছে। আমি চলে যাব, এখান থেকে চলে যাব নিশ্চয়।

“না।”

“কাজের লোক কেউ আছে নাকি বাড়িতে?”

“কি?”

“আরে কাজের লোকের কথা বলছি। আছে কেউ?”

“আমাদের কোন কাজের লোক নেই।”

“তাহলে কার সঙ্গে আছিস তুই? ঠাকুমা, পিসি?”

খুদেটা শুধু নরম আর তুলতুলে নয়, ছোট, ওর সবকিছু এত ছোট!

“না।”

“তাহলে এবাড়িতে এখন তুই একা?”

“হ্যাঁ।”

“দেখ, আমার কাছে একটা ক্যান্ডি আছে। তোকে দেব। ভাল লাগবে তোর কারণ বাড়িতে তুই একা।”

চাস কি তুই এই স্ট্রবেরি ক্যান্ডি?”

“ঠিক আছে দাও।”

“আমার কাছে একটা পুতুলও আছে, খুব সুন্দর। চীনেমাটির মুখ, পায়ে পুঁচকি জুতো আর মাথায় টুপি।”

“দেখাও।”

“এখানে, এই তো আমার কোটের পকেটে। দেখতে চাস?”

ওর দু'পায়ের ফাঁকে যা আছে তা খুউব ছোট, এত ছোট যে খুব কঠিন যা তুমি করতে চাও। তুমি তা করতে পার না, অন্তত প্রথমবারের চেষ্টায় তা সম্ভব নয়্। ও কেঁদে উঠবেই আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে, দরজা খোল, দেখাচ্ছি।”

“খোলা, চাবি দেওয়া নেই, তাই আমার আটকে পড়ার কোন সম্ভাবনাও নেই।”

“তাহলে বেশ ভাল।”

লোকটা দরজা খুলে বাগানে ঢুকে পড়ল। সে তখনও ভাবছিল, না, না। এরকম করার আশা আমার নেই। কিন্তু সে জানত যে মন যা চাইছে তা করবেই। সে মনে মনে আঙুল দিয়ে অনুভব করতে শুরু করেছে মেয়েটির ত্বকের স্পর্শ — কোমল, তুলতুলে, মিঠে, উষ্ণ। নিজেকে বলল যে চাইনা, চাইনা আমি আবার এরকম হোক। কিন্তু সে তখন বড় একা, ওর ভুবনে তখন সেই বাগান ছাড়া আর কিছু নেই। সে ভাবতে থাকল কোথায় সে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে পারে।

“দাও, পুতুলটা দেখি।”

“আয় এখানে, এক মিনিট বাদেই তোকে দেখাব। হাত ধর, চল ওই গাছটার পিছনে লুকোই। তাহলে আমাদের কেউ আর দেখতে পাবে না। প্রতিবেশীরা কেউ দেখলে ঈর্ষা করবে।”

“চল তাহলে বাড়ির পেছন দিকে যাই।”

“পেছন দিকে?”

সাবধান, লোকটা নিজেকে বোঝাল। জায়গাটা অচেনা, তাই সতর্ক হও। লুসির ছোট বোনের সঙ্গে যা ঘটেছিল তা তুমি চাও কি?

“পেছনের দিকে ওরা একটা বাড়ি বানাচ্ছে। কিন্তু আজ শনিবার বলে ওদিকে কেউ নেই।”

“আমাদের কি বাড়ির ভেতর যেতে হবে?”

“না, আমরা এদিক দিয়ে ওধারে যাব। এস আর পুতুলটা দেখাও দিকি।”

“ওহ, ওদিকে কত গাছ, কতকিছু…”

“ওরা ভেঙে ফেলবে, কেটে ফেলবে সব। মা তাই বলে ওরা খুব বোকা।”

“তোর মা ঠিক বলেছে। মা সব সময় ঠিক বলে, তাই না?”

ওর মা; কেন আসছে না এখনও? না, এখন নয়; মা আসলে হবে না।

“ঠিক জানি না। মা বলে যে কোন অচেনা লোক ক্যান্ডি দিলে তা নেওয়া ঠিক নয়। সব পুরুষই খারাপ, শুয়োরের মত পাজী।”

“না, ওরা ঠিক ততটা খারাপ নয়। ভাল-মন্দ মিশিয়ে। তোর বাবা কি ভাল লোক নয়?”

“বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না। পুতুলটা এবার দেখাও দেখি। ওর পোষাক কি নীল?”

“কি? ও হ্যাঁ, নীল। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি পুতুলটা ঘরে রেখে এসেছি, কিন্তু…।”

“তুমি খুব খারাপ। বলেছিলে পুতুলটা তোমার পকেটে, আর এখন বলছ নেই।”

“ঠিক আছে, নেই তো নেই, কিন্তু তুই দেখতে পাবি আমি কেমন ভাল লোক। কাছে আয়, চল ওই গাছটার পিছনে যাই, আমি পুতুলের থেকেও ভাল জিনিস তোকে দেখাব।”

“ঠিক আছে, সাবধানে চল, ওদিকে একটা কুয়ো আছে। ওরা বলে জলাধার।”

“জলাধার!”

“হ্যাঁ, তাই। তবে খুউব গভীর। লাহাবাবু বলছিলেন ওরা এটাকে সিমেন্ট, মাটি, পাথর দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে চায়।”

“লাহাবাবু!”

“আরে ওই ফোরম্যান। উনি বলছিলেন যে কুয়োতে বেশ জল আছে। ব্যাঙ আছে। মায়ের আশা ওরা ওটাকে জলদি বুজিয়ে ফেলবে। তাহলে ইঁদুর, বিছে এসবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।”

“বিছে? বাপরে! চল একবার গিয়ে দেখি ওখানে।”

“দেখ, ওই যে কুয়োটা। সাবধান!”

“হুমম, কিন্তু তেমন গভীর বলে তো মনে হচ্ছে না।”

“ওহো, কুয়োটা গভীর, খুব গভীর, ঠিক পৃথিবীর অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।”

“নিশ্চয়, নিশ্চয়, পুঁচকি সোনা, চল যাই।”

“দেখ কী গভীর, দেখ।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ, বেশ, দেখছি তো গভীর খুউউব।”

লোকটা ঝুঁকে পড়ল, নিচে, কুয়োর গভীরে দেখার জন্য। কুয়োর গভীরে ওর কলজেটা এখন ধুকপুক করছে বেশ জোরে। মেয়েটা ওকে ধাক্কা দিল: ওর কোমরে ছোট্ট দু'টো হাত রেখে প্রাণপণে ঠেলে দিল। লোকটা পড়তে পড়তে কেঁদে উঠল। মেয়েটা কুয়োর ধারে হাঁটু গেড়ে বসে ঝুঁকে দেখতে লাগল।

“বিছে আছে নাকি ওখানে?”

“ওরে, খুদে শিকনিভরা হতচ্ছাড়ি, এখান থেকে টেনে তোল আমায়।”

কিন্তু না, কীভাবে খুদে ওকে বার করবে? লোকটা বুঝতে পারল যে খুদে পারবে না। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল: খুদের স্পষ্ট মুখরেখা-খুব স্পষ্ট—কুয়োর কিনারা বরাবর—শনিবারের বিকেলে নীল আকাশের ক্যানভাসে। নিঃসঙ্গ এই বিকেলে ধারে পাশে আর কেউ নেই, কেবল এই নরম, কোমল মেয়েটি ছাড়া।

লোকটা ওপরে তাকিয়ে দেখল: কমপক্ষে ছয় মিটার, ঘরের ছাদের থেকে অনেক উঁচু। কীভাবে সে বার হয়ে আসবে এখন?

“যা, কাউকে ধরে নিয়ে আয়, যা তাড়াতাড়ি।”

খুদে নড়ল না মোটে।

“যা, আমার কথা শোন, ছোট্র সোনা, কাউকে ধরে নিয়ে আয় দিকি, প্রতিবেশী কেউ বা সামনে ওই খবরের কাগজের দোকান থেকে।”

“এই ব্লকে তো এরকম কোন দোকান নেই, যা আছে তা অন্য ব্লকে।”

“যা, যা, খুদে সোনা, কাগজের দোকানে গিয়ে বল একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটা দড়ি, না না একটা মই, না দড়িই ভাল, আনতে বল, জলদি।“

“ঠিক আছে, যাচ্ছি, কিন্তু আগে বল বিছে আছে নাকি ওখানে?”

“না, নেই। মিষ্টি সোনা, তুই যা দিকি, দোকানে লোকটা আছে কিনা দেখ, থাকলে একটা দড়ি নিয়ে আসতে বল, কারণ একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে এখানে।”

‌খুদের মুখটা এবার অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকটা এখন একেবারে একা। সঙ্গ দেওয়ার জন্য একটা বিছেও নেই সেখানে।

লোকটা একবার নিজের হাতের দিকে দেখল। তারপর চারপাশে তাকাল। অন্ধকার, ভীষণ অন্ধকার সেখানে। সে বুঝতে পারল কাদার উপর দাঁড়িয়ে আছে—নরম, জলজলে কাদা। জুতো ভিজে যাচ্ছে, জল ঢুকে যাচ্ছে বলে ঠান্ডা লাগছে। খুদে শিকনিভরা হতচ্ছাড়ি তাড়াতাড়ি ফিরে এলে ভাল হয়। কাগজের দোকানের লোকটাকে ও দড়ির কথা বলল কি? আর ওই লোকটা যদি এখানে চলে আসে ওকে বলব কী আমি। নিছক দুর্ঘটনা? কী করে পড়লাম আর কেন আমি এখানে? বলব যে আমি অন্য রাস্তা থেকে এসেছি। হিসু করতে এসেছিলাম। না করলে পাজামা ভিজে যেত। দেখলাম কেউ নেই এখানে। চলে এলাম। কুয়োর ধারে পা দিতেই ঝপাং। এই কথাই বলব। আশা করি সিকনিভরা নাকের ছুঁড়িটা ওকে কিছু বলবে না। বলবে না ক্যান্ডি বা পুতুলের কথা। ওহ, লোকটা কেন দেরি করছে এত, মেয়েটা কী করছে এখনও, জঘন্য খুদে ছুঁড়িটা।

লোকটা আবার ওপর দিকে দেখল। ভুল, বড় ভুল, গলায় যেন আটকে আছে কিছু। খোলা পাথর দিয়ে সাজানো কুয়োর দেওয়াল। একটা যদি টপ করে মাথায় পড়ে জ্যান্ত সমাধি একেবারে। কেন নয়? কুয়োর ভেতরটা যেন একটা কুঠুরি, কবরের মত। মেয়েটা যেন চট করে চলে আসে। দেখ অফিসার, ঘটেছে এই যে জোর হিসু পেয়েছিল আর দেখলাম যে চারপাশে কেউ নেই, তাই। কিন্তু আগে দড়িটা চাই আমার আর শক্তিশালী কেউ একজন যে আমায় টেনে তুলতে পারবে।

ঘন্টা দুই কেটে গেল। বাইরে অন্ধকার নেমে আসছে। এর মধ্যে লোকটা কুয়োর দেয়ালে হাত বুলিয়ে দেখেছে যে অমসৃণ, অসমান সব পাথর সব যেন মাথার ওপর ভিড় করে আছে। এমন একটা খাঁজ নেই যার ওপর পা রেখে সে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। মেয়েটা মানে ওই অপদার্থ শিকনিভরা ছুঁড়িটা যে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল কোথায় যে গেল! ওই নির্বোধ পাগল মেয়েটা বোধহয় কাগজের দোকানের লোকটাকে এখনও ডাকতে যায়নি। এদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে।

চেঁচিয়ে গলা ফাটানো ছাড়া আর উপায় নেই কোন। চেঁচাই, তবে যদি কেউ শুনতে পায়। সে ক্রমাগত চেঁচিয়ে চলল, বাঁচাও, বাঁচাও আমায়। মেয়েটাকেও ডাকল। কিন্তু না, কেউ শুনতে পেল না। শনিবার, বিকেলবেলা বলেই হয়তো। না, না, এটা হতে পারে না। কাল অবধি ওরা আমাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে না। কাল রোববার, কেউ থাকবে না। তবে ওই ছুঁড়িটা যদি ফিরে আসে। যদি কাউকে বলে ও কী করেছে। যদি বলে ওর মাকে। নিশ্চয় আসবে ওর মা। কিন্তু যদি মেয়ের কথা বিশ্বাস না হয়? বলে, ছেলেমানুষি করিস না সোনা। যদি খেয়েদেয়ে শুতে চলে যায়? আর আমি পড়ে থাকি এই অন্ধকার কূপে?

‘দিদিইইইই!’ বলে সে চিৎকার করে উঠল।

“দিদিইইইই! বৌদিইইইই! সাহায্য চাই, সাহায্য, এইখানেএএএএ, এখানেএএএএ আসুউউউউন!”

রাতের আকাশ এমন কালো হয়ে উঠল যা লোকটা কখন দেখেনি। কালো আর তারায় ভরা, কত শত তারা। হে ভগবান, কেউ আসুক, ওই মহিলা মেয়েটার কথা সত্যি বলে মেনে নিক। দয়া কর ভগবান, আমি আর কখনও কোন মেয়েকে চেপে ধরব না। কখনও কোন মেয়েকে আর আঘাত দেব না। প্রতিজ্ঞা করছি বেশ্যা খুঁজে নিয়ে শরীরের খিদে মেটাব। কিন্তু কখনও কোন ছোট মেয়ের গায়ে হাত দেব না। সোমবারে নির্মাণ শ্রমিকেরা এখানে এলেও ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এখানে পড়ে থাকতে পারব না। আমি মরতে চলেছি, মরে যাওয়া কোন বড় ব্যাপার নয়, তবে এখানে, এভাবে নয়। না, ভগবান, আমার কথা শোন, কাউকে এনে দাও এখানে।

লোকটা চিৎকার করেই চলল, গলা শুকিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, অনেকক্ষণ। তারপর একটু লালা গিলে নিয়ে গলা ভেজানোর চেষ্টা করল যাতে আবার চিৎকার করতে পারে। কিন্ত্ত না, ও আর বেশিক্ষণ পারল না। তারায় ভরা আকাশ তখনও একই রকম কালো। সেই তারাখচিত সিংহাসনে ভগবান নেই যে ওর কথা শুনবেন। ওর সারা শরীর ভিজে গেছে, জলে, কাদায়, ঘামে; সর্বাঙ্গে ব্যথা, পেট কামড়াচ্ছে। বাথরুমে যেতে হবে একবার। বাথরুম! খুব হাসি পাচ্ছে ভেবে। লোকটা জোরে হেসে উঠল। বাথরুম! তা বটে। কুয়োর ছয় মিটার গভীরে বসে ও এখন বাথরুম খুঁজছে। প্যান্টটা নিচে নামিয়ে পেটের সব কিছু খালি করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। বিশ্বাস কর অফিসার, আর কিছু নয়, আমি শুধু হিসু করার একটা জায়গা খুঁজছিলাম। দেখলাম এখানে কেউ নেই। শরীরে একটা তীক্ষ্ণ খিঁচুনি অনুভব করল সে, ওয়াক উঠে এল। ভিতরে কিছু একটা যেন নড়ছে, বার হয়ে আসতে চাইছে। কুয়োর চারপাশ, কাদা, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে একরাশ বিরক্তি আর ভয় এখন ওকে ঘিরে ধরেছে।

“দিদিইইইই!” বলে ও ফের ডাক দিল। যদিও জানত যে সে ডাক কোন দিদির কাছেই পৌঁছবে না।

দিদি নেই, কেউ নেই, খুদে মেয়েটাও। উপরে কুয়োর বেড় ঘিরে আবার মেয়েটাকে দেখা গেল।

“ফিরে এলি তবে?”লোকটা বলল। “কাগজের দোকানের লোকটাকে বলেছিস দড়ি নিয়ে আসতে?”

মেয়েটা মোটে নড়ল না, বলল না কিছু। স্থির হয়ে রইল কালো ক্যানভাসে, অগণিত তারায় ভরা। তবে বদল হল কিছু, বদলে গেল মেয়েটার ক্যানভাস। একঝাঁক তারা এসে উপুড় হয়ে পড়ল কুয়োর ধারে ঝুঁকে পড়া মেয়েটার মাথায়। হঠাৎ রং বদলে মেয়েটা সাদা বা রুপোলি হয়ে গেল, আর আলোয় ভরে গেল আকাশ। ফেরেস্তা হবে কোন, ফেরেস্তা নিশ্চয়। ও ভেবেছিল যে ভগবান হয়তো ওর আর্জি শুনেছেন। তাই উদ্ধার করতে পাঠিয়েছেন।

“এবার উদ্ধার পাওয়া আর কোন ব্যাপার নয়,” ও চিৎকার করে উঠল। “আর লাগবে না দড়ি, ওরা আসছে। দিদিইইইই! দিদিইইইই!আমাকে এখান থেকে বার কর।“

লোকটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। প্যান্টের পেছনে যন্ত্রণাদায়ক গরম কিছু বোধ হতে ও কেঁদে ফেলল। কাঁদছে আর চিৎকার করছে। মনে ভয় ও মারা যাবে। আশা কেউ ওকে বাঁচাবে। কিন্তু জানত না কী করলে বা কীভাবে ও বাঁচতে পারে।

“দিদি, দিদি তুমি এস, আমায় এখান থেকে বার কর, তোমার একরত্তি মেয়ের কোন ক্ষতি আমি করব না, কিচ্ছু না, শুধু বাঁচাও আমায়, ভগবানকে ডাক, বল ফেরেস্তা পাঠিয়ে আমার জীবন বাঁচাতে, এখানে বিছে নেই, ভয়ের কিছু নেই, কেউ নেই, দিদি এস।”

তারপর সেখানে শুধুই নীরবতা। রোববার অন্য সব রবিবারের মতই। মেয়েটা মায়ের সঙ্গে দিদুনের বাড়ি গেল। ফিরতে একটু দেরি হলেও চিন্তার তেমন কিছু ছিল না। সোমবার মেয়েটার স্কুল ছুটি। তাই মা-মেয়ে একটু বেলা অবধি ঘুমোল। একথা ঠিক যে অন্যান্য বছরের তুলনায় এসময় ঠান্ডা ছিল খুব। সন্ধের দিকে একটু বৃষ্টিও হয়েছিল।

“দিদি!” লাহাবাবু বললেন,“আপনার ফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারি?”

তিনি আগেও এরকম অনুরোধ বেশ কয়েকবার করেছেন আর দিদিমণি ওকে রান্নাঘর অবধি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। লাহাবাবু ভাল লোক – লম্বা, শ্যামলা, হাসিখুশি, নম্র। জমি খুঁড়তে গিয়ে বা গাছ কাটতে গিয়ে যখনই একটু আওয়াজ হয়েছে তিনি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন।

“অবশ্যই লাহাবাবু, ভেতরে আসুন। একটু কফি খাবেন নাকি? এইমাত্র বানিয়েছি।”

“ধন্যবাদ, দিদি। একটু আগেই এন্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা হল। এবার কোম্পানি অফিসে কথা বলে ঠিক করব কী করণীয়। কুয়োর নিচে কিছু একটা আছে, বড় চেহারার প্রাণী, হতে পারে কুকুর।”

“ওহো, কী উপদ্রব!”

“হ্যাঁ, একেবারে নড়াচড়া করছে না, মরে গেছে বোধহয়, কিন্তু বার করতে তো হবে, আমরা আজ বিকেলের মধ্যে কুয়োটা ভরিয়ে ফেলব বলে ঠিক করেছি।”

“ঠিক আছে, চালিয়ে যান আর ফোনটা করে নিন। আজ মেয়ের স্কুল নেই, তবে আমায় অফিস যেতে হবে, দুপুর-দুপুর আমি ফিরে আসব।”

“ধন্যবাদ, দিদি, বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।”

লাহাবাবু করিতকর্মা মানুষ। আশা করছি কুকুরটাকে কুয়োর ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে আসতে পারবেন। তবে বৃষ্টি হলে একটু অসুবিধে তো হবেই। আর ওই কুয়োটা বেশ বিপজ্জনক, চিরকাল।

ভাষান্তর: গৌতম চক্রবর্তী

0 Comments

Post Comment