পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভোগ

  • 01 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 928 view(s)
  • লিখেছেন : সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
'সাত আর পাঁচে মোট বারো। সেটাকে বারোয়ারী করে বারোভূতের হাতে তুলে না দিয়ে এখন থেকেই প্ল্যানমাফিক একটা সুন্দর বন্দোবস্ত করে ফেলা উচিৎ। কি বলো তোমরা?' মিথিলেশ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলে। 'দ্যাখ ছোড়দাভাই তুই কিছু ভুল বলিস নি। কিন্তু বাকিরা কে কি ভাবছে যদি খোলসা করে বলে'.... মিতুন মন্তব্য করে।

"আপত্তির আর কি থাকতে পারে ? কিন্তু মাকে বোঝানো খুব শক্ত। তবে মা হয়তো ছোটছেলের কথা ফেলবেন না ।আদুরে নাড়ুগোপাল কোলের বাছাতো চিরকালের।" রিতেশ তার হাতের কাপ টা টেবিলে নামিয়ে রাখে।
"ওরকম বোলো না দাদাই। মা চিরকাল শক্ত ধাতের। খালি ছোটুর ছোটবেলাটা অত রোগ ভোগের মধ্যে দিয়ে কেটেছে বলে মা একটু ওকে বেশি নজরে রাখতেন। তবে এখন মা কিন্তু সব ব্যাপারে তোমার মতামতই আগে শোনেন।"
"হ্যাঁ, ওই শোনেন অবধি। কিন্তু  সিদ্ধান্ত চিরকাল নিজের ইচ্ছেমতোই নেন।" নিরমা ফুট কাটে।
সে এই বাড়ির বড় বউ ।
'তুমি চুপ করো। আমাদের ভাই-বোনেদের এটা একেবারেই নিজস্ব আলোচনা ।' .... রিতেশ তিক্ত গলায় বলে।
নিরমা মুখ কালো করে চায়ের কাপগুলো তুলে নিয়ে উঠে চলে যায়।

রিতেশ, ঋতু ,মিথিলেশ এবং মিতুন এরা রুপলেখা মিত্রের চার ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে তিনজনই বিবাহ ও কর্মসূত্রে বাইরে থাকে।  কেবল ছোট মিতুন থাকে কলকাতাতে। তবে বাপের বাড়ির একেবারে বিপরীত প্রান্তে। সে  কলকাতায় থাকলেও বাপের বাড়ি বিশেষ আসে না, রূপলেখাদেবী বিয়ের পর মেয়েদের ঘনঘন বাপের বাড়ি আসা পছন্দ করেন না  কোনোকালেই। বাবার বার্ষিকী উপলক্ষে ভাইবোনেরা দিন চারেকের জন্য কলকাতায় নিজেদের বাড়ি এসেছে। এতক্ষণ সন্ধ্যাতে চা জলখাবারের পাট চলছিল। গতকাল বাবার বার্ষিকীর কাজ হয়ে গেছে। খালি মিতুন এই সপ্তাহটা থাকবে । তার ছেলে হোস্টেলে। বর সপ্তাহখানেকের জন্য গ্রামের বাড়ি গেছে। তাই তার বাড়ি ফেরার আপাতত তাড়া নেই। সে কয়দিন মায়ের কাছে থেকে যাবে।
'তোমাদের তো তাহলে আপত্তি কিছু নাই বলেই মনে হচ্ছে। পাঁচ কাঠার উপর বাড়ি ছাড়া সাত কাঠা ফাঁকা জায়গা। আমরা কেউ থাকি না । মায়ের অবর্তমানে সব হাতছাড়া হয়ে যাবে ।তার চেয়ে প্রোমোটারকে দিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়ে নিজেদের প্রাপ্য আমরা বুঝে নেবো। আর মাকে মায়ের ভাগ দিয়ে দেবো।যা পাওয়া যাবে তা  মায়ের একার জন্য প্রচুর। তার ওপর বাবার পেনশন আছে । মায়ের একা থাকার চিন্তাটাও থাকবে না। ফ্ল্যাটে আরো মানুষজন থাকবে। যদিও এসব ব্যাপারে সাতে পাঁচে থাকতে আমার একেবারেই  ভালো লাগে না  তবু যেহেতু সকলের ভালোর জন্য তাই ....' মেজো বোন ঋতু মতামত জানায়।
একটু পরেই সন্ধ্যে জপ আণ্হিক  করে রুপলেখাদেবী নীচে ড্রইংরুমে এসে বসলেন। বাহ্ তোরা সকলেই আছিস দেখছি। শোন একটা বিশেষ কথা ছিল। আমি আজ রাত আটটার সময় এ পাড়ার প্রোমোটার আর ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ডেকে পাঠিয়েছি। সাথে তোদের বাবার উকিল বন্ধু রূপনারায়ণবাবুকেও আসতে বলেছি। ওরা আজ রাতে আমাদের সাথে রাতের খাবার খাবে। ভাবছি আমারও তো বয়স হচ্ছে, এত বড় বাড়ি- জায়গা সব আমার একার পক্ষে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
এরপরতো আর কোন কথা আলোচনার থাকতেই পারে না। প্রোমোটার অমিয় আর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রায় গদগদ।পারলে পা দুটো মাথায় তুলে নেয়। আপনি মহান মাসিমা । আপনি দারুন বুদ্ধিমতী। ছেলে বা মেয়েদের আর কোন কিছুর বলার বা প্রশ্ন করার ভূমিকায় থাকলো না। তারাও দারুণ খুশি। কিন্তু কোথাও যেন একটু বিরক্তও। মা নিজেই আগ বাড়িয়ে সবটা করে ফেলবে এ তারা স্বপ্নেও ভাবেনি । মা'টা চিরকালই এইরকমই। ঠিক হলো এক বছরের মধ্যে ফ্ল্যাট একেবারে রেডি হয়ে যাবে। কাগজপত্র চুক্তিপত্র সব রূপলেখা মিত্র দেখে শুনে বুঝে নেবেন।
মাঝে এক বছর কেটে গিয়েছে। তাদের পৈতৃক বাড়ি ভেঙেচুরে সাত আর পাঁচে মোট পঁয়ত্রিশটি ফ্ল্যাট হয়েছে। আজ আবার এক বছর পর বাবার বার্ষিকীতে তারা একত্রিত হয়েছে ।
রিতু বলে 'এই সময় আসাটা বড্ড চাপের। ইনফ্যাক্ট প্রতিবছর আসাটাই প্রবলেমের। বরঞ্চ মাকেই বলবো মাঝে মাঝে আমার কাছে গিয়ে থাকতে। একার সংসার ছেড়ে আসা খুব চাপের। তাছাড়া সব ঠিকঠাক চললে আমিতো এই বছরের মাঝামাঝিতে কানাডা সেটেল করে যাব। আগেই বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু আমার ভাগের ফ্ল্যাটটা বেচে দেব। '
'দিদিভাই তোমার তো শুধু সংসার ছেড়ে আসা। তুমি হয়তো দূরে থাকো আর আমি হয়তো এই শহরেই থাকি। কিন্তু প্রাইভেট স্কুলের চাকরি, একটা দিনও ছুটি পাওয়া খুব চাপের।'
ভাইবোনদের মধ্যে মিতুর অবস্থাটাই একটু কমতির দিকে। তার বরও একটা প্রাইভেট সেক্টরেই চাকরি করে। ভালোবেসে বিয়ে। মা বিয়েটাতে আপত্তি করেননি যদিও কিন্তু তার পাশে আলাদা করে আর্থিকভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টাও কোনদিন করেননি। এই নিয়ে মিতুনের একটা চাপা ক্ষোভ চিরকালই আছে।
মিথিলেশের দিনকয়েকের মধ্যে অফিসের কাজে একটা ফরেন ট্যুরের কথা চলছে। এইসময় তার একেবারেই আসার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু নিরুপায়। মা উইল তৈরীরও কথা বলেছেন। মিথিলেশ ভাবতে থাকে এই ট্যুরটাই কোনরকমে নিরঞ্জনাকে কিভাবে ইনপুট করে নিতে পারবে, তাহলে অফিসের কাজের সাথে সাথে তাদের মধুচন্দ্রিমাও একটু হয়ে যাবে। নিরঞ্জনা মেয়েটা, ওপরে ওঠার স্বার্থে নিচে অনেকটাই নামতে পারে তা মিথিলেশ এতদিনে বুঝে গেছে। আকারে ইঙ্গিতে মিথিলেশকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। মিথিলেশও মুফতে মজা লোটার এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মাঝে মাঝেই ছাড়ে না।
রিতেশ গম্ভীর মুখে বলে 'তুই কবে যেন ব্যাংকক যাচ্ছিস ? একাই যাচ্ছিস নাকি সাথে কেউ যাচ্ছে?'
প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা বুঝে মিথিলেশের ভেতর ভেতর একটা খিস্তি উঠে আসে। কিন্তু ওপরে শান্ত স্বরে বলে,
 'না দাদাভাই এখনো জানি না। আমি কেবল আমার যাওয়ার কথাটা জানি। তা তুমিতো পরের বছরই রিটায়ার করবে। কি ভাবছো? মায়ের কাছে কলকাতায় এসে থাকবে নাকি? শোনপুরের বাড়িটা বরঞ্চ বুলানকে দিয়ে তুমি কলকাতাতেই চলে এসো। তাতে সব দিকে ভালো হবে বলে আমার মনে হয়। মায়েরও তো বয়স হচ্ছে।'
'আমি কী করবো সেটা আমাকে ভাবতে দিলেই ভালো হয় না কী? চিরকালটাই বড় ছেলেই বাবা মায়ের দায়-দায়িত্বের সমস্ত ভার বহন  করবে আর আলুটা মুলোটা কলাটা খাওয়ার সময় সকলের সমান ভাগ।' রিতেশ ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
মিথিলেশ উত্তেজিত হয়ে কিছু বলার আগে বাইরের দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ। পুরনো কাজের লোক মিনতি দরজা খুলে দেয়। রূপনারায়ণ কাকাবাবু তাঁর জুনিয়রকে নিয়ে ভেতরে আসেন। সামান্য আলাপচারিতার মাঝেই এসে পড়ে প্রোমোটার অমিয় সরখেল । অন্যের ভিটেয় কিভাবে নিজেকে চরাতে হয় খুব ভালো করে বোঝে এই লোকটা।
যাই হোক, ভিতরে খবর যায়। রুপলেখা মিত্র আসেন সাথে মিনতি একটা ট্রে নিয়ে ঢুকে। চা পর্বের পর রূপনারায়ণ বাবু বলেন দেখো অমিয়র সাথে চুক্তিপত্র অনুযায়ী তোমরা সকলেই একটি করে ফ্ল্যাট পাবে। তোমার মাও একটি পাবেন । আর একদম নিচের তলার একটা ফ্ল্যাটে তোমাদের বংশের আদি দেবতা মদনমোহনের মন্দির থাকবে ।এখন অমিয় বাকী যে টাকাটা দেবে সেটারও পাঁচ ভাগ হবে। এই চুক্তিতে তোমাদের কারোর আপত্তি নেই আশা করি।
চার ভাইবোনেই সমস্বরে সহমত জানায় । রুপনারায়ণ বাবু বলেন এরপরেও কিছু কথা আছে যা তোমাদের মা বলবেন। রুপলেখা মিত্র বলে ওঠেন , 'তোমরা সকলেই জানো এই বাড়ি আমার শ্বশুরমশায়ের বাবা করেছিলেন ।তিনি আমার শ্বশুরমশায়কে আজীবন বসবাসের শর্তে এই বাড়ি লিখে দেন। আমার শ্বশুর মশাইও সেই একই শর্তে এই বাড়ি তোমাদের বাবাকে দেন অন্য ভাইদের না দিয়ে। এটা তোমাদের বংশের অলিখিত নিয়ম। আমার অবর্তমানে বংশের প্রতিষ্ঠিত দেবতা মদনমোহনের পুজোর জন্য একটা ট্রাস্ট কমিটি আমি গঠন করেছি। তাতে তোমাদের অন্য কাকা পিসিরাও যেমন থাকছে তেমন তোমরাও আছো।
এখন মূল এবং শেষ কথা হল এই বাড়ির বা ফ্লাটের ভাগ তারাই পাবে যারা তা ভোগ করবে। ভোগ শর্তে ফ্ল্যাটের মালিকানা থাকবে। যে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চাইবে বা ভাড়া দিতে চাইবে তার দিকে টাকা মন্দির কমিটির খাতে চলে যাবে । আর যারা ভাড়া দেবে তাদের ভাড়ার টাকাও মন্দির কমিটি পাবে। তোমাদের পূর্বপুরুষরা কখনোই চাননি বংশের শিকড় এই ভিটেমাটি থেকে একেবারেই চিরদিনের মতো উপড়ে যাক । যারা এখানে তাদের শিকড় বিছিয়ে রাখবে কেবলমাত্র তাদেরই এই ভিটেমাটির ওপর অধিকার।
মিথিলেশ রাগে চিৎকার করে উঠতে যায়। রূপলেখা  কঠোর ভাবে শান্ত হয়ে তাকে বসার নির্দেশ দেন। রিতেশ  হো হো করে হেসে ওঠেন। ঋতু হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, 'তাহলে তো মিতুনের' ই লাভ ষোল আনা। বড়দাভাই তুই এবার কী করবি ভাব', বলে উঠে চলে যেতে চায়। রূপলেখা তাকেও শান্ত হয়ে বসতে নির্দেশ দেন। বলেন লাভ লোকসান নয়, পূর্বপুরুষদের প্রথা অনুযায়ী ভাগ বন্টন হল। এবার তোমাদের বিচার বিবেচনা ভাগ্য অনুযায়ী তোমরা তা ভোগ করো। এটাই এই বংশের নিয়ম। এর অন্যথা কোনোদিন হয় নি , আর ভবিষ্যতেও যাতে কোনোদিন না হয়  সেই ব্যবস্থাপনাটুকুই আমি করে দিলাম মাত্র

0 Comments

Post Comment