কিশোরীর প্রথম যৌবনের বিষাদের মত তা টসটসে। মাঠের সেই বিষাদের খবর রাখে কেবল মাঠের দক্ষিণ দিকের কিছু শাল, অর্জুন আর নাম না জানা বৃক্ষ। উত্তরদিকের লোকালয় সে খবর রাখে না। তারা শুধু জমায়েত হয়ে দাপাদাপি করতে জানে।
সন্ধ্যাবেলা থেকেই উত্তর দিকে মানুষ জমায়েত হচ্ছিল অল্পঅল্প করে। মানুষের মাঝে উত্তেজনা। চোখ মুখে জিজ্ঞাসা। একদল লোক দক্ষিণদিকে বড়বড় টর্চ ফেলছে। বলছে, যা করার রাতের মধ্যেই করতে হবে। রাত পার হয়ে গেলে ক্ষেপে যাবে আরও। কখন কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে দেবে বলা যায় না।
একদল বলছে – রাতের বেলা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে? তার উপর দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে সাঁধিয়েছে।
দক্ষিণদিকের জঙ্গলে সবার ভয়। জঙ্গলে কতকিছু থাকে, কেউ কি তা দেখেছে! যেখানে অজানা কিছু, সেখানেই ভয়।
ভবার মা ভয়ে কাঁপছে থরথর করে। ভবার বাপ বাড়িতে নাই। হরিমেলা দেখতে বিটিরা এসেছিল নাতি নাতনি নিয়ে। তাদের রাখতে গেছে ভিনগাঁয়ে। ভবার বউ পুয়াতি। ভবা আছে ভিনদেশে কাজে। কার্তিকের হিমেও অল্প অল্প ঘামছে ভবার মা। কোমরের খুঁটে শাড়ির আঁচল গুঁজতে গুঁজেতে উথালি-পাথালি করে লোক জমা করছে। মানুষ নিজের সংসারের আপন না হোক, তবু মানুষ তো! কাছে থাকলেও ভরসা।
জটলাটা শুরু হয়েছিল ভবাদের বাড়িতেই প্রথম।
ভোরবেলায় উঠে গোয়াল ঘরে ঢুকেছিল ভবার মা। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গোয়ালের গরু গুলা হামলানি শুরু করে। চোখেমুখে একটু জল দিয়ে, দাঁতে চুলার ছাই ঘষতে ঘষতে গোয়ালে এসে দাঁড়ায় ভবার মা। মা ভগবতীর উদ্দেশ্যে একবার নম করে গোয়ালে ঢুকে গাইগরুগুলো নিয়ে এসে বাইরের রাস্তার ধারে খুঁটে বাঁধে। বাড়ির পরেই রাস্তা, তার পরেই হরিমেলার মাঠ। রাস্তার খুঁটে বাঁধা দুটো গাইগরুগুলোকে কটা বিচালি দেয় ভবার মা। বাছুরদুটো তখনও গোয়ালে। একটু বাদে কার্তিক গোয়ালা আসবে, দুধ দোয়াতে। দুধ দোয়ানো হয়ে গেলে বাছুরগুলো ছাড়া পাবে। তারপর বাগাল এসে চরাতে নিয়ে যাবে দড়ির খুঁট খুলে।
আজ ভোরবেলা গোয়ালে ঢুকে ভবার মা দেখে লাল গাইটা কেমন যেন দেওয়াল ঠেঁসে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। ভবার মাকে দেখে যে ছটপটানি শুরু করে, তা নেই। সাদাগাইটা ততক্ষণে বাইরে যাবার জন্য ছটপটানি শুরু করে দিয়েছে।
সাদা গাইটাকে বাইরে বের করে দিয়ে এসে ভবার মা লালগাইটার কাছে এগিয়েছে কি এগোয় নি, পাগলের মত তেড়ে আসে লালগাইটা। ভবার মা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়।
- ওমা, এমন করছিস ক্যানে? একে একেবার করব ত তোদের।
বলে ভবার মা আবার এগিয়ে যায়।
আবার পাগলের মত তেড়ে আসে লালগাইটা।
ভবার মায়ের এবার একটু খটকা লাগে। এমন 'ভিড়কি খাওয়া গাই' তো লালগাইটা না। তাহলে কি অসুখবিসুখ করল? বাগালিকে জিজ্ঞেস করতে হবে কাল মাঠে ঠিক ভাবে চরছে কিনা।
এই সব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই লালগাইটা খুঁটের দড়ি ছিঁড়ে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে বেরিয়ে যায় গোয়াল থেকে। ভবার মা হকচকিয়ে গলার দড়ি ধরতে গেলে পড়ে যায় আবার।
মাটিতে বসে বসেই কঁকাতে কঁকাতে ভবার মা কপাল চাপড়াতে থাকে - হাকৃষ্ণ, কী করলা তুমি। গাইটা এমুন কেনে করে। ভগবতীর অসম্মান তো করিনি কখনও।
রটে যেতে দেরি হয় না, ভগাদের বাড়ির লাল গরুটা পাগল হয়ে গেছে। রটে যেতে না যেতেই ভগাদের বাড়িতে ভীড়।
- হ্যাঁ গো কাকি দুধ খায়েছিলে তুমরা? তুমাদের কিছু হবেক লায়ত?
কথাটা বলেন নীময়রার পোতা শিবু। শিবু নতুন প্রজন্মের ছেলে। সারাক্ষণ মোবাইলে খুটুর খাটুর করে। শিবুর কথাতে আরও ভিমরি খায় ভগার মা। বলে – তাতো খায়েছিনু বাপ। আমি একা খায়নি, হরিমেলা দেখতি বিটির শ্বশুরঘরের মেল্যা লোক আসিছিল, উরাও খায়েছে। পাশে পার্বতী বৌদি দুধ লিয়ে গেলছে চায়ের ল্যাগে তারাও খেলছে। কি হবে বাপ?
শিবু বলে – কি হবে তুমাদের সবাইকে সুঁইলিতে হবে। অনেক গুলা সুঁই।
শিবুর এই কথাতে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। পিলপিল করে মানুষ জমা হতে থাকে। জমা হওয়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ভয়। ভগার মা তুলসীতলায় বসে কপাল চাপড়ায়।
২.
লালগাইটা তখন হরিমেলার মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। মেলার মাঠে লোকজন জমা হচ্ছে অল্পসল্প। গাঁয়ের পঞ্চায়েতের মেম্বার বিডিও অফিসে খবর দিয়েছে। 'গরু পাগল হয়ে গেছে ' বলে। পাগল গরু বেঁধে রাখার দায়িত্ব কার, কি ভাবে ধরা হবে সেই নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই। কেউ বলে, ফরেস্টের লোক আসবে খাঁচা নিয়ে, কেউ বলে প্রাণিবিভাগের কাজ এটা। যে বিভাগের কাজ হোক না কেন, একটা যে বিশাল রগড় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রগড় দেখতে মেলার মাঠে ভীড় বাড়ছে।
মেলার মাঠখানা অবাক বিস্ময়ে গরুটাকে দেখছিল। হটাৎ করে একলা হয়ে গেছে যেন। কোথাও একটা লুকানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। যেদিকে যাচ্ছে সেই দিকেই লোকজন দল বেঁধে পিছু নিচ্ছে। ভীত চোখে তাকাচ্ছে মানুষগুলোর দিকে। মানুষগুলো হইহই করে উঠছে- ওই দ্যাখ কিভাবে দেখতিছে। চোখে কুনো পলক নাই। পাগল ছাড়া আর কি! নাহলি কেউ বান মারিছে।
ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে – বান মারলি এমুন পাগল পারা করে না। থনে বান মারলি, দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। খাবার খায়। এ গরু খড় ভুসি বিচালি কিছুতেই মুখ দেয় না।
ভীড়ের মধ্যে বয়স্ক একজন বলে – উসব বান মারেনি কেউ, পাগলামি করতাছে ডাউনির ছায়া লাগিছে। মাঠে চরতে যায়, বাগালে খেয়াল করে নাই, নদী জোড়ের দিকে ডাউনির ছায়া আছে, উদিকে গেছিল মনে হয়। তুরা সাঁতাল পাড়ায় হরেন খুড়াকে ডাক, উ ডাউনির ছায়া চিনে।
বয়স্ক লোকটির কথা সবার মনে ধরে। সিন্ধান্ত হয় বনদপ্তর প্রাণি দপ্তরের সাথে জানগুরুও আসুক।
মাঠটি এইসব কথাবার্তার মধ্যে ভবার মাকেও দেখছিল। গাইগরুটির মত ভবারমা ও ভীত সন্ত্রস্ত। তার বাড়িতে কোনও পুরুষ মানুষ নাই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে, কেবল জল মুড়ি পেটে পড়েছে একবার। উনুন জ্বলেনি আজ। সকাল থেকে তার উপর যা ধকল যাচ্ছে। লক্ষ্মীমন্ত গাইটা এমন তেড়ে আসছে, গুঁতোচ্ছে পাগলের মত দৌড়াচ্ছে, কি যে হল গাইটার ভবার মা কিছুই বুঝতে পারছে না, কেবল মনে মনে ভগবানকে বলে যাচ্ছে, কি পাপে গাইটাকে এমন করলে ভগবান। কি অপরাধ হল তোমার সেবাতে। কুনদিন তো ভগবতীর সেবা না করে, তুলসী গাছে জল না দিয়ে কুটোটি মুখে কাটিনি, তাহলি এমুন করলে কেনে। আর এমুন দিনে করলে, বাড়িতে কুন পুরুষমানুষ নাই। এখুন কি করব আমি! লোকে বুলতিছে ডাউনির ছায়া লাগিছে, রাতে একলা পেয়ে ডাউনিটা যদি আমাকে ভর করে। রক্ত চুষে লেয়।
ভবার মা আর কিছু ভাবতে পারছে না। ভয়ে হাত পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে তার। ভগবতী অসন্তুষ্ট হবার ভয়, ডাইনির ভয়, রাতে অজানা কোন বিপদের ভয়। ভবার মা যাকে দেখছে, তাকেই বলছে – আজকের রাতটুকুন থাকবি আমাদের বাড়িতে। একা আমি আর বৌটা। রাতে যদি গাই-এরপরে ভর করা ডাউনিটা ঘরের পানে আসে। কি করব্য আমরা।
শিবু বলে – আমরা না হয় আজ রাতে থাকে গেলাম। কিন্তু কদিন ইভাবে থাকবা তুমরা। এ গরু পাগল হয়ি গেলছে। বড়ি সুঁইএ কাজ হবেনা কিছু। না খায়ে খায়ে মরে যাবে। যতদিন না মরে ততদিন এমনি পারা চলবে। অন্য গরু ছাগলকে কামড়াবে। মানুষকে গুঁতাবে। তুমি একা লয়, পাড়াশুদ্দ লোক থির হতে পারবে না।
শিবুর কথা শুনে সবার মধ্যে আরেক দফা আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়। যারা মজা দেখতে এসেছিল, তারাও ভয় পেয়ে যায়, এই ভেবে যদি গরুটা তাদেরকে আক্রমণ করে।
ভীড়ের মধ্যে রব উঠে, গরুটাকে ধরতে হবে যে করেই হোক। তারপর শক্ত করে বেঁধে রাখতে হবে বা ঘরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করতে হবে।
উত্তেজিত জনতা গরুটার দিকে ছোটে।গরুটা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দিক বিদিক হারিয়ে মানুষের দিকেই তেড়ে আসে। মানুষের স্রোত তাকে আবার অন্যদিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
৩.
মুসলমান পাড়া থেকে সমশের, জাব্বার, সাদ্দামরা যখন হরিমেলার মাঠে উপস্থিত হয় তখন রাত্রি দুটো। তাদের হাতে বিশাল বড় মাছ ধরার জাল। ছোট টেম্পোতে চড়ে এসেছে তারা গরু ধরতে। তাদেরকে কেউ একজন খবর দিয়েছে, খবর কে দিয়েছে সেটা বড় ব্যাপার না, কিন্তু তারা আসাতে নিশ্চিত বোধ করছে সবাই। সরকারি ভাবে কিছু হতে হলে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত, রাতটুকু কিভাবে কাটত কেউ জানে না। মুসলমানদের জন্য আলাদা গ্রাম, আলাদা পাড়া। এমন নয় যে কেউ তাদের আলাদা করে দিয়েছে, কিন্তু সাঁওতালদের পাড়া গাঁ যেমন আলাদা, বাউরিদের জন্য আলাদা, তেমনই মুসলমানদের ।কোন পাড়ার মানুষ অন্য পাড়ায় গিয়ে ঘর করে না। মুসলমানরাও কখনো নিজের পাড়া গাঁ ছেড়ে বাইরের দিকে যায়নি। নতুন ছেলেছোকরারা মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব করে, ভোটের সময় মিছিল মিটিং করে, মুসলমানদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে। কিন্তু মুসুলমান পাড়ার সাথে একটা অজানা প্রাচীর রয়েই যায়। মুসলমানদের পাড়ায় গরুকাটা হয়, সবাই জানে। মুসলমানদের হাঁড়িতে গরুর মাংস। তারা হিন্দু পাড়ার আসে গরু কিনতে। এঁড়ে গরু, বাঁঝাগাই, বুড়ো বলদ, অসুস্থ গরু তারা নিয়ে যায়। গেরস্থ তুলসীতলায় গিয়ে কানধরে। ঘরে গিয়ে গরুবেচা টাকা গুনে রাখে সযত্নে।
সমশের জাব্বার সাদ্দামরা এসে যাওয়াতে তাদের নিয়ে সবাই গোল হয়ে দাঁড়ায়।
সবার মুখে একটাই জিজ্ঞাস্য, পারবাত?
গাইগরুটা তখন ক্লান্ত হয়ে কাঠচেরাই মিলের এক অন্ধকার কোনে বসে ধুঁকছিল। সারাদিন মাঠে দৌড়াদৌড়ি করেছে কিন্তু একটা ঘাস কাটতে পারেনি। একটু জল খেতে পারেনি। একদল কালোকালো ছায়া মানুষ কেবল তাকে তাড়া করে গেছে। তাদের হাতে সূর্যের মতো আলো। তীব্র আলোতে চোখে অন্ধকার দেখেছে কেবল। রাত বাড়লে একটু ছায়ামানুষগুলো দূরে গেছে। কাঠচেরা মিলের পিছনে বড় সেগুন গাছ। সেদিক থেকে একটা জালের মত কিছু গরুটার উপর ঝাঁপিয়ে এল।
ছটপট করে উঠলো সে। যত ছটপট করে তত জড়িয়ে যায়। আক্রোশে গুঁতোতে যায়, অন্ধকারের মধ্যে পড়ে যায় মাটিতে, আরও জড়িয়ে যায়, নড়তে পারেনা আর।
হরিমেলার মাঠ জুড়ে আবার শূন্যতা নেমে এসেছে। জাব্বাররা টেম্পোতে তুলে নিয়েছে গরুটাকে। লোকজন হাঁফ ছেড়ে ফিরে গেছে নিজেদের ঘরে। ভবার মা ভগবানের কাছে পাপের ক্ষমা চাইতে চাইতে ঘুমিয়ে পড়েছে বারান্দাতেই। কোথাও একটা রাতচরা পাখি ডাকছে। সেগুন গাছের গোলগোল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। হরিমেলার মাঠের ধুলো থিতিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। হরিমেলার মাঠ জুড়ে একবিষাদ গ্রস্থ শ্বাস।