পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অণুগল্প

  • 16 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 980 view(s)
  • লিখেছেন : ফাল্গুনী দে
এবার সহমনের গল্পে থাকলো, ফাল্গুনী দে'র চারটি অণুগল্প।

ডানা


দাসবাবু প্রায় সারাটা জীবন ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দিলেন। সংসারে খরচের যা বহর, সেভাবে টাকা জমাতে পারেন নি। সরকার বাড়িতে ভালোই ছিলেন বছর দুই কিন্তু একদিন উঠে যাবার নোটিশ এলো। গিন্নিকে সামনে এগিয়ে দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু লাভ হয়নি। "আমাদের উঠিয়ে দিয়ে কী লাভ হলো ? সেদিন দেখলাম বাড়ি ফাঁকাই পড়ে আছে !" গলায় আক্ষেপের সুর দাস গিন্নির।

বেশ কিছুদিন পর, পাড়া বেড়াতে বেড়াতে পুরনো মালকিন দাসবাবুর নতুন বাসায় এলেন একপ্রকার আগ বাড়িয়েই -- দিদি, বাড়ি আছেন নাকি ! এক ঝাঁক পাখি পুষেছি দেখুন কেমন ! ওড়াবেন নাকি ? বেশ একটা মজার খেলা হবে !

-- না বোন, সে আহ্লাদ বা সময় কোনোটাই আমার নেই। সংক্ষেপে উত্তর দেন মিসেস দাস।

কেনো যে আপনারা অহেতুক ভয় পান! এরা উড়তে পারে নাকি ! আজন্ম খাঁচায় বাস। মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবশ! নিজের বাসা তো কোনদিন পাতেনি! সেই আনন্দ থেকে বেচারাগুলো বঞ্চিত রয়ে গেলো।

-- সবই যখন জানেন, কেনো যে অসহায় কে সুড়সুড়ি দিয়ে আনন্দ পান ! এটা নেহাৎ মজা নাকি বদবুদ্ধি ?

-- যারা উড়তে পারে না তাদের উড়তে দেওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে।

সরকার গিন্নির হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে মিসেস দাস ভারী অথছ শান্ত গলায় বলে ওঠেন -- আপনারা উড়িয়ে দেন আর আমরা ফিরিয়ে আনি। সব থেকেও পরিবার বলতে তো আপনার আর কেউ নেই, সরকার দাকে নিয়ে আসবেন।  সামনের ১৯ শ্রাবণ আমাদের গৃহপ্রবেশ।


উল্টোপুরাণ


"বড়োলোক বাড়ির রোগ কি আর ছোটলোক ঘরে মানায়! যা হবার তাই হয়েছে -- দীর্ঘ রোগভোগের শেষে আধবেলায় মরেছে। কিন্তু তাই বলে হাসপাতালের লোকগুলো বডি নিয়ে ব্যাবসা করবে, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দরদাম করবে, এমনই দূর্ভাগ্য আমাদের! সব শেষ হয়ে গেল, হায় হায় হায়!" মৃতার স্বামী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল।

আর্থিক সম্বল নেই তাই ওরা গাড়ি ভাড়া করতে পারেনি। মায়ের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সটান হাঁটা দিয়েছে বাড়ির পথে। ঘটনার একটি ভিডিও ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছে মুজিবুর। ওরা হুমকি দিয়ে বলেছে দেখে নেবে।

মুজিবর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গাড়ি চালায়। দরদী পরোপকারী ভালো মনের মানুষ। এমন অমানবিক ঘটনা ওকে আহত করে। "কোনো টাকা লাগবে না, আমার গাড়িতে উঠুন। আমি নামিয়ে দিয়ে আসছি। শয়তানদের মুন্ডু কাটবো আমি। দেখি ওরা আমার কি ক্ষতি করতে পারে।" গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলেছিল মুজিবুর।

কোভিডের সময়ে সে এমন বহু মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। "লোকটা পরের উপকার নিয়ে থাকে, ভালোবেসে কাজটা করে বলে বাধা দিনা। অমন সোনার মতো মন দেখেই তো বিয়ে করেছি।" গর্বের সুরে মুজিবুরের স্ত্রী বলেছিল।

কিন্তু সেদিন যখন মুজিবুরকে পুলিশ মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলো, ভাতের মধ্যে কাঁকড়ের মতো একপ্রস্থ ছন্দ কেটে গেলো শ্রীমান ঈশ্বরের।

 


মিথ্যে কথা


টাকা পয়সার ব্যাপারে অমিত খুব হিসেবী মানুষ। অন্যের একটাকাও নেবে না, নিজের একটাকাও ছাড়বে না। তবে একেকদিন রিক্সাওয়ালার থেকে দুটাকা কমিয়ে, সবজিওয়ালার থেকে তিনটাকা কমিয়ে বেশ একটা মেজাজ নিয়ে হাঁটে। দোষের বলতে লোকটির একটু অতিকথনের রোগ আছে; ঘনিষ্ঠ মহল বা ভুক্তভোগীরা জানে।

অমিতের পূর্বোক্ত গুণের কথা জেনে পাড়ার একটি অনুষ্ঠানে সবাই কোনরকম দ্বিমত ছাড়াই তাকে কোষাধক্ষ্য করলে। অমিত প্রায় একক দক্ষতায় সবকাজ সামলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলে।

শেষদিনে ঘটা করে অমিত হিসেব নিয়ে সবার সামনে বসলে। দশমিকের পর চার ঘর অব্দি মিলিয়ে দিলে। কিন্তু নিজের অবদানের সাড়ে পাঁচ হাজারের জায়গায় সাড়ে তিন হাজার বাড়িয়ে লিখলে আট হাজার টাকা। সেই অঙ্কটি আবার সবাইকে প্রচার করে বললেও বটে। কেউ উত্তর করলে না দেখে সে যাত্রায় সব ভালোয় ভালোয় ভালোয় মিটে গেলো।

এই ঘটনার কিছুদিন পর, একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে অমিতের ফোনটি টুক করে লাফিয়ে পড়লে এক্কেবারে রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটি গেলো চুরমার হয়ে ভেঙে। দোকানে নিয়ে যাওয়া হলো এমার্জেন্সি রুগীর তৎপরতায়। দোকানী গম্ভীর তাকিয়ে দেখলে বললে -- ভাগ্য ভালো কমের উপর দিয়ে গেছে। অমিত জিজ্ঞেস করলে, সারাতে কি খরচা লাগবে ?

দোকানী বললে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এক পয়সা কমও নয়, এক পয়সা বেশিও নয়।

 


বাসা

 

ছয় তলার ফ্ল্যাটের দক্ষিণের জানলা প্রায় বন্ধই থাকে। হাওয়ার দাপটে খোলার জো নেই। এতো বড়ো ফ্ল্যাটে থাকার লোক কম তাই ব্যবহারও কম। নিরাপদ সেই সুযোগে বেশ কিছুদিন ধরে একটি পাখি নানান খড়কুটো আয়োজন বয়ে এনে সাজিয়ে নিয়েছে একটি ছোট্ট সংসার, সুচিরা একদিন খেয়াল করে। কাঁচের জানলার এমন কায়দা, দিনের বেলা বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যায়না, কিন্তু ভেতর থেকে সব দেখা যায়, আবার রাতের বেলা ঠিক উল্টো। পাখিটা এসে কার্নিশে ঠোঁট পরিষ্কার করে, জানলার কাঁচে ঠোকর মারে, এদিক ওদিক নাচানাচি করে, কর্তা গিন্নি ঠোঁটে ঠোঁট জমিয়ে প্রেম বিনিময় করে, বাসায় ডিম পাড়ে, দিনের পর দিন ডিমে তা দিয়ে বসে থাকে, পালা করে দুজনে পাহারা দেয়, সদ্য ডিম ফোটা বাচ্চাদের মুখে খাবার গুঁজে দেয় আশ্চর্য মমতায়, জানালার ওইপারে সন্তান স্নেহ জাঁকিয়ে বসে শীতকালীন রোদের মতো, সুচিরা সেসব দৃশ্য খুব সাবধানে ক্যামেরাবন্দি করে। খাবারের খোঁজে মা পাখি দূরে উড়ে গেলে সুচিরা জলপাত্র সাজিয়ে দেয় পাশে। ছড়িয়ে দেয় কিছু চাল গমের দানা। কাজের মেয়েটি একদিন আচমকা জানলা খুলে জঞ্জাল বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সুচিরা তাকে ধমকে সাবধান করে এবং ব্ল্যাক টেপ লাগিয়ে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করে দেয় জানলা।
বৌদির মানসিক অবস্থার কথা ভেবে মেয়েটি আর উচ্চবাচ্য করে না, বাসন মাজতে মাজতে অস্ফুটে বলে ওঠে -- জানলার এপারে না হোক ওপারে তো একটা ভালো কিছু হলো।

0 Comments

Post Comment