এরপর কবরে নেমে আসবে দুজন ফেরেস্তা, মুনকার নকীর। মুর্দা কে চেতন করে জিজ্ঞেস করবে, মান রাব্বুকা? তোমার রব কে? উত্তর হবে, রাব্বী আল্লাহ। আল্লাহ আমার রব।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, মা দ্বীনুকা? তোমার ধর্ম কি? উত্তর, দ্বীন আল ইসলাম। আমার ধর্ম ইসলাম।
তৃতীয় প্রশ্ন, মা নবীয়ূকা? তোমার নবী কে? উত্তর, হুয়া রাসুলুল্লাহ। আল্লাহর রসুল আমার নবী।
তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলো আসাদ মিঞা। আর নজু উত্তর তো দূরের কথা, ভুল উত্তর ও দিলো না। কথাই বল্লো না। মুনাফেক বদকার লোকরা যেমন বলে, হাহা লা আদরী, হাহা লা আদরী। আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানি না-- এটাও বললো না। শালা বোকা না বোবা!
অগত্যা কবর-ফেরেস্তা মুনকার নকীর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুুতি নিলো। নজু আর আসাদের রুহ্ দুটি নিয়ে আসমানে যাবে। সঠিক উত্তর দাতা আসাদের জন্য আসমানের দরজা খুলে যাবে। আর নির্বিকার নজুর জন্য দরজা বন্ধ । ঠোঁট বন্ধ রাখলে দরজা তো বন্ধ থাকবে।
আসমানের শীলমোহর পড়ে যাবে আর রুহ্ দুটিকে নিয়ে স্ব স্ব কবরে ফিরে আসবে কবর-ফেরেস্তা। আসাদ কে শুয়ে দেওয়া হবে জান্নাতি খাটে। গায়ে চাপানো হবে জান্নাতি লেবাস। কবরের জানলা খুলে দেওয়া হবে আর সেই জানলা দিয়ে আসবে সুবাসিত সুশীতল বাতাস।
আর পাশের কবরে নজু কে শোয়ানো হবে দোজখের আগুনের ঘাটে। জানলা দিয়ে আসবে শুধু আগুনের হলকা। কবরে চলবে বীভৎস আজাব!
ওরা দুজন এইভাবে কবরে দিন কাটাবে। যতদিন না ফেরেস্তা ঈস্রাফিল, আল্লার হুকুমে শিঙ্গায় ফুক দিয়ে, কেয়ামতের দিন ঘোষনা করে। সেদিন শেষ বিচারের জন্য কবর থেকে সব্বাই হাজির হবে রোজ হাশরের ময়দানে।
মানুষের জীবদ্দশায় যে দুজন ফেরেস্তা দুই কাঁধে চেপে হিসেব নিকেশ লিপিবদ্ধ করে, বান্দার মাগফিরাতের জন্য আল্লার কাছে দরবার করে, তারা হলেন কারেমান কাতেবিন। নজু আর আসাদের এই কাঁধের ফেরেস্তাদের এখন আর কাজ নাই। ছুট্টি। একটু জিরিয়ে নেবার অবসর পেয়েছে ওরা। আল্লার হুকুম হলে, আবার অন্য নবজাতকের কাঁধে চেপে আমলনামা লিখতে যাবে।
এই ছোট্ট অবসরে কাঁধ-ফেরেস্তা কেরামান কাতেবীন একটু আবেগপ্রবন হয়ে পড়ে। যতই হোক, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নজু আর আসাদের কাঁধে চেপে ঘুরেছে তো। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা। ভালো খারাপ কাজ লিপিবদ্ধ করেছে । কবর-ফেরেস্তার তিন প্রশ্ন আর কাঁধ-ফেরেস্তার কোটি কোটি কাজের হিসেব নিকেশ ----- এর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে বৈকি!
তো কাঁধ-ফেরেস্তা কেরামান কেতাবীন কবর-ফেরেস্তা মুনকার নাকির কে জিজ্ঞেস করে, হে প্রিয় সহকর্মী বন্ধু, নজু আর আসাদ--এদের কার কেমন পরীক্ষা হল?
কবর- ফেরেস্তার জবাব, আসাদ মিঞা পাশ। আর নজু ডাহা ফেল! নজু তার রব কে, জানে না। দ্বীন কি? জানে না। নবী কে? জানে না। বন্ধু কাঁধ-ফেরেস্তা, এরপর আপনারা আর কী আশা করতে পারেন? দুনিয়াতে কেউ কানা হলেও কবরে দেখতে পাবে। কালা হলেও শুনতে পাবে। আর বোবা হলেও কথা বলতে সক্ষম। বলেই নজু আর আসাদের রুহ্ দুটিকে বাঁধা ছাদা করে কবর- ফেরেস্তা আসমানের দিকে রওনা দিলো।
কাঁধ- ফেরেস্তা কারেমান কাতেবীন বেশ হোঁচট খেলো। নজু ফেল? মানে দোজখে যাবে? দুনিয়াতে লোকটাকে নিয়ে যেমন ফ্যাসাদে পড়া গেছিল, এ দুনিয়াতে সেরকম ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি। কাঁধ-ফেরেস্তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে হুস করে আসমানের দিকে ধাবিত হল। একটু আগে কবর ফেরেস্তারা যেদিকে রওনা দিয়েছে ।
কিছুক্ষন পরে কাঁধ -ফেরেস্তা কবর-ফেরেস্তাকে আসমানে ধরে ফেললো। কবর-ফেরেস্তা অবাক হয় এবং বলে, তোমরা কেন আমাকে অনুসরণ করছো ? তোমাদের কাজ যেখানে শেষ, আমাদের কাজ সেখানে শুরু। জ্যান্ত মানুষে তোমাদের কাজ, মৃত মানুষে আমাদের।
কাঁধ -ফেরেস্তা বললো, প্রিয় সহকর্মী বন্ধু, আসাদের বেহেস্ত লাভ হোক, আমাদের কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু নজুর দোজখ লাভ-- মাফ করবেন, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে মনে হয়! নজুর আমলনামা একটু দেখবেন?
উত্তরে কবর ফেরেস্তা বলে, আল্লার দেওয়া দায়িত্বের বাইরে কিছু করা বারন, শোনা ও বারন। তবে আসমানে পৌঁছাতে কিছু দেরি আছে। আল্লা সাক্ষী, আপনারা ওদের আমলনামা প্রকাশ করতে পারেন।
শুকরিয়া, হে কবর-ফেরেস্তা। কৃপা হোক আমলনামায় নজর দিতে।
* * * * * * * * * * * * * * *
দেওয়ানগঞ্জের লোক নজু আর আসাদ। নজু থাকে ফকিরপাড়ায় আর আসাদ মিঞাপাড়ায়। নজু ফকিরি গান করে। আসাদ মসজিদ সেক্রেটারী। মসজিদের উন্নতিকল্পে সারা বছর কালেকশন করে। নিজের ও কিছু হয়!
ফকির পাড়ার দশ বারো ঘর ফকির। এরা ফকিরমত এ জীবন যাপন করে। মাদারী সিলসিলা তে তাদের চলাফেরা। সন্ধ্যে হলে জিকির হয়। চলে অনেক রাত পর্যন্ত। আর দিনে অবসর হলে ফকিরি গান করে। জিকির আর গান। কথা আর সুর।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন আসাদ মিঞা ফজরের নামাজ শেষে কয়েকজন মুসুল্লি নিয়ে হাজির নজুর বাড়িতে। সালাম দিয়ে সোজাসুজি আসাদের প্রশ্ন, দেখো নজুভাই, তুমি তো জানো, গান বাজনা ইসলামে নিষিদ্ধ। গান আখেরাতের চিন্তা কমিয়ে পথভ্রষ্ট করে। অপরাধী আর আক্রমনাত্মক হতে উৎসাহিত করে। তুমি তো আবার তোমার পাড়ার যতসব মক্কেল মুরিদের মুর্শিদ। বেদাত আর নফস্ এর রাস্তা ছেড়ে দ্বীনের কামে এসো। সব গোনার মাফ আছে, শিরক্ এর মাফ নাই।
এসব শুনে নজু নীচু গলায় বলে, আমরা ফকির, মানে নিঃস্ব মানুষ, সেক্রেটারি সাহেব। দুনিয়ার চাওয়া পাওয়ার মোহ আমাদের নাই। আমরা ফকিররা কাউকে কোনোদিন আক্রমন করি না । বরং আমরাই আক্রান্ত হৈ। একটু থেমে নজু আরো বলে, মুসুল্লি সুর করে সুরা পড়ে। আমরা বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলি। দুটোই সুর। সব সুরের অভিমুখ তো সেই একই। পরমাত্মার সন্ধান।
নজুর এসব হেঁয়ালি কথা আসাদের মাথায় ঢুকছে না। বিরক্ত হচ্ছে সে। বলে, তুমি যাই বলো, শুনে রাখো নজুু, নিজেকে মোসলমান বল্লে শরীয়া তরিকাতে চলতে হবে। যে কোনো শিরক্ এর বিরুদ্ধে আমরা জেহাদ চালিয়ে যাব। গান বাজনা ইসলাম বরদাস্ত করবে না! একরকম হুমকি দিয়ে আসাদ বাহিনী চলে গেল।
আসাদের হুমকির অর্থ কি হতে পারে, নজু শুধু অনুভব নয়, মনো চক্ষুতে দেখতে পাচ্ছে। সে আকাশের দিকে তাকায়, দেখে পাখিদের বিচিত্র শব্দের সুর। বৃষ্টির জল, নদীর জল --সবার সুরতরঙ্গ আছে। মুয়াজ্জিন সুর করে আজান দেয়, মোলবী সুর করে সুরা পড়ে। স্রষ্টা সৃষ্ট মহাশূন্যে নীরবতার -ও কি সুতীব্র সুর।
হে খোদা, আমাদের দোতারা একতারা তো জড়বস্তুু, অথচ আঙুলের ছোঁয়ায় কত সুর বাজে। তোমার ছোঁয়ায় আমরাও বেজে চলেছি। গান বাজনা বন্ধ হলে তোমার পরশ থেকে বঞ্চিত হবো। বাজো, তার বাজো! দোতারা, একতারা, ডুবকি,খমক, গাবগুবি সব বেজে ওঠো। বেজে বেজে সুর তোলো!
সেক্রেটারি আসাদ এটাকে চ্যালেন্জ ভেবে, একদিন জুম্মা শেষে লাঠিসোটা সহ কয়েকজন মুসুল্লি নিয়ে, ফকির পাড়ায় হাজির। শুধু হাজির হল না, বাড়িতে নজু কে না পেয়ে তার ঘরদোর তছনছ করলো। সমস্ত বাদ্যযন্ত্র্ ভেঙে ফেললো। মাটির হাঁড়ির ভাত মুক্তো দানার মতো গড়াগড়ি খেলো। কাকে খেলো।
সংবাদ পেয়ে নজু বাড়ি ফিরে স্তম্ভিত। ভাঙ্গা দোতারার তার স্পর্শ করে। না, আর বাজে না। দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। অসম যুদ্ধে নিরপরাধের পরাজয়ের কী গ্ল্যানি! দৃষ্টি হল শূন্য, কন্ঠ হল বাকরুদ্ধ।
পুলিশ এলো। নজু কোনো অভিযোগ করলো না। দিলো না পুলিশের কোনো প্রশ্নের জবাব।
* * * * * * * * * * * * * * *
নজু আর আসাদের আমলনামা পড়তে পড়তে ফেরেস্তারা কখন যে আসমানের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে খেয়াল করে নি। বিশাল বন্ধ দরজার ভিতর থেকে আওয়াজ এল, তোমরা কারা?
--আমরা মুনকার নাকির। ম'ওতের রুহ্ এনেছি।
আমার বামে নজু, ডানদিকে আসাদ। এদের দ্বীন দুনিয়ার কামে পুরস্কার অথবা তিরস্কারের কি ঘোষণা আছে?
এদিকে কাঁধের ফেরেস্তা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে আসমানী দরজার দিকে। কোন্ দরজা খোলে। কার দরজা খোলে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কারো দরজা খুলছে না।
কবরের ফেরেস্তা ও ছটফট করছে। তার হুকুম হয়ে গেছে, আবার এক নতুন কবরে ছুটতে হবে।
অবশেষে খুলল দরজা, বাম দিকের। মানে নজুর দরজা। ডান দিক বন্ধ রইল।
স্বস্তির শ্বাস পড়ল কাঁধ- ফেরেস্তার । মনে হল, আমলনামা লেখা সার্থক। আল্লার কী করুণাসিক্ত বিচার! সেজদা দিয়ে বলে , হে রব, তুমি তো জান সব!
* * * * * * * * * * * * * * *