সত্যিই এ এক অন্য রকম ঝরা সময়। আর এই সময় কী ভাবে চলছে এই মুহূর্তে সেই হিসেব আর করার কোনও মানে হয় না। চাপা অনুভূতি গুলো ক্রমশ মরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ভারতবর্ষের আজ পাঁচ লক্ষ মানুষ কমবেশি আক্রান্ত এই মারণ ব্যাধিতে। সুস্থতার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও আক্রান্ত বেড়েই চলেছে প্রতিদিন। সারা পৃথিবীতে এখনও ছাপ্পান্ন লক্ষের অধিক মানুষ আক্রান্ত। মৃত্যুর সংখ্যাও কয়েক লক্ষ। লকডাউন অথবা কিছুটা ছাড় দিয়ে হালকা লকডাউন , এই ভাবেই এখন পৃথিবী চলছে। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটা বারবার জনমানসে প্রকাশ পাচ্ছে, তা হল, এই ভাবে আর কতদিন? এই একবিংশ শতকের আধুনিক সভ্যতা যুদ্ধ দেখেছে, মৃত্যুও দেখেছে। তালেবানি হিংস্রতাও দেখেছে। লাদেনের কীর্তিও দেখেছে। কিন্তু এই ভাবে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ এক অজানা শক্তির কাছে যা কিনা এক অতিক্ষুদ্র ভাইরাস, তার হাতে এই ভাবে নিজেকে পরাস্ত করতে কখনও দেখেনি। সভ্যতার অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছে মানুষ নিজেই। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা শুধু সভ্যতার সংকটই নয়, এককথায় বললে বলা যাবে প্রকৃতির ক্রোধে এ যেন মানব জাতির মহাবিনাশ । অনেকে বলতেই পারেন, একটু বেশি বাড়াবাড়ি বলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ দেখিয়ে দিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওই ভয়াবহ ত্রাসের পর এতবড় বিপর্যয় একটাও বন্দুক গুলি ছাড়া কেউ ঘটিয়েছে কখনও? বা দেখেছে কেউ? সত্যি বলতে গেলে আর্থিক, মানসিক এবং মানব শক্তির যেভাবে অপচয় এখন হচ্ছে , তা সত্যিই বিস্ময়কর।
বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতৃত্ব হিমশিম খেয়ে গেছে, কীভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবে তাই নিয়ে চিন্তা করতে করতে। সমস্যা সত্যিই গুরুতর। প্রতিদিন এখন বেঁচে থাকার লড়াই। মানুষের নিরাপত্তা আজ একেবারেই অনিশ্চিত। একদিকে ভাইরাসের ভয়াল কবলে ছিন্নভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধ। মুখোশের আড়ালে কেটে যায় দৈনন্দিন জীবন। মানুষ এখন মানুষের কাছে যেতেই ভয় পাচ্ছে। এটা কি কাম্য ছিল কখনও? চাকুরীর নিরাপত্তা কিভাবে যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পুঁজির সংকোচন ক্রমশ মানুষকে এক গভীর অসহায় বোধের বাঁধনে ঘিরে ফেলেছে।
একের পর এক ব্যবসায়িক সংস্থা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় তিন মাসের লকডাউনে অর্থনীতি যে ভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে, তাতে এটা অন্তত বোঝা যায়, আমরা অর্থনীতির এক বিশাল শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠছিলাম, বলে যা প্রচারিত হচ্ছিল, তা আসলে সর্বৈব মিথ্যে। যেভাবে এক বিশাল শ্রেণীর দিন আনি দিন খাই মানুষের অসহায়তার কাহিনী প্রতিদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারা যাচ্ছে, তাতে প্রকট হয়ে উঠছে, আমাদের অসহায়তাগুলো। কীভাবে যেন আমরা নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছি সংকটের এই গভীর গিরিখাতের নীচে। চারিদিকে শুধুই অসহায়তা। এটা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। অথচ না মেনে উপায় কি?
শুধুই এখন হিসেব উল্টে যাওয়ার পালা। একেই করোনা বিশ্বের অর্থনীতিকে পঙ্গু করছে, ভারতবর্ষে তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে আরোই অসহায় করে তুলেছে। আমফানের মতন একটা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশকে প্রায় ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছে। আবার অন্যদিকে উত্তরাখণ্ডের বনাঞ্চল আগুনে ধ্বংস। এদিকে রাজস্থান পাঞ্জাব সহ সমগ্র উত্তরভারত জুড়ে শুধুই কোটি কোটি পঙ্গপালের আক্রমণ প্রায় প্রতিদিন খাদ্যশস্যকে ধ্বংস করে চলেছে। এইভাবে চললে, ভারতের মতন বিপুল জনসংখ্যার দেশ খাদ্যসংকটে পড়বে খুব দ্রুত। একেই লকডাউনের জেরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ, তার উপর এই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়! সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
অগুনতি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা শুধুই চিন্তাজনক নয়, আগামী প্রজন্মকে একটা বিশাল ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারি শিক্ষা সকলের জন্য। কিন্তু সেই শিক্ষায় শিক্ষকদের একটা বিশাল অংশ অবশ্যই প্রশংসনীয় ভাবে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনলাইনে বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চেষ্টা করছেন কিছুটা পড়ানোর। সরকারি স্তরে কিছুটা চেষ্টা হচ্ছে টিভি ও অন্যান্য সহযোগী মাধ্যম দিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীদের একটা বিশাল অংশ কিন্ত এখনও বঞ্চিত সেই পড়াশোনার থেকে। করোনা আবার নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন ভাবে কীভাবে পড়ানো যায়। অনেক কিছু এখন পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও সত্যি, মানুষ কিন্তু এখনও সচেতন নয়। সমাজবদ্ধ মানুষ কখনওই একা থাকতে পারে না। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেও পারে না সব সময়। তাই লকডাউন কতটা আমাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সচেতন করলো তা হয়তো এখনও বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। সামাজিক ব্যবধান বজায় রাখার ইচ্ছা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই মনে হয় নেই। অন্তত বাজারহাটগুলো দেখলে তাই বোঝা যায়। আমরা নিজেরাই আসলে নিয়ম মানতে অভ্যস্ত নই। তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক বড় বড় কথা বললেও, আমরা নিজেরাই নিয়ম মানতে চাই না। এর ফল আগামী দুই মাসের মধ্যেই অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিণতি না আনে। পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার তাগিদে এবং বেশ কিছুটা সরকারি ঔদাসীন্যে যেভাবে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যত্রতত্র যেভাবে চলে আসছে এবং ঘুরছে, তাতে করোনার সামাজিকীকরণ দ্রুত ঘটে চলেছে। কোন সরকারই এই বিষয়ে আর বোধহয় বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে না। গোষ্ঠী সংক্রমণ সরকারী স্তরে স্বীকার না করলেও এটা মেনে নিতেই হবে যে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। অন্তত মহারাষ্ট্রে তো বটেই। এর প্রভাব সব রাজ্যেই ধীরে ধীরে পড়বে। এতদিন সিকিম করোনা মুক্ত থেকেও শেষ পর্যন্ত পরিযায়ী শ্রমিক দের মাধ্যমে সেই রাজ্যেও করোনা প্রবেশ করলো। আসলে এই ব্যাধি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে খুব দ্রুত। কিন্তু আমরা সেই শিক্ষা কতটা আত্মস্থ করছি, সেটাই দেখার। এই মহাবিপর্যয়ের ফলে সরকারি পরিষেবাগুলোর অবস্থাও ক্রমশ শোচনীয় হয়ে উঠেছে। লকড়াউন পরবর্তী সময়ে যারা বাসে ট্রেনের নিত্যদিনের যাত্রী তাদের জীবন সংগ্রাম আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে। এ বিষয় নিশ্চিত। একদিকে পরিবারের কথা, অন্য দিকে নিজের জীবন ও জীবিকার কথা ভাবতে ভাবতে হয়তো নিজের ছবিতে ফুল চন্দন দিয়ে নিত্যদিন যাত্রা করতে হবে, করোনা কে সঙ্গে নিয়ে। এ এক দুঃসহ নিত্যদিনের যাত্রা। ভ্যাকসিন কবে বেরোবে, বা আদৌ বেরোবে কি না, সে বিষয়ে কেউই কিছু বলতে পারছে না। ফলে নিজের ভাগ্য নিজের হাতেই রেখে মানুষের যাত্রা শুরু হবে লকডাউন-উত্তর ভারতবর্ষে তথা সমগ্র পৃথিবীতেই।
প্রকৃতির প্রতি আধুনিক সভ্যতার অত্যাধিক অবহেলার এই রকম প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবে তা বোধহয় মানবসভ্যতা কল্পনাও করতে পারে নি। হয়তো করোনা আমাদের কে এই শিক্ষাই দিয়ে গেলো, এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, সমস্ত অন্যান্য নিরীহ প্রাণীদেরও।
আমরা উন্নত হয়তো হয়েছি যন্ত্র এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, আসলে মানসিক ভাবে আমরা সেই ভয়াবহ জান্তব প্রকৃতিরই রয়ে গেছি। সেদিক থেকে করোনা আমাদের সপাটে চড় মেরে বুঝিয়ে দিল, "এবার তোরা মানুষ হ...!" অন্তত মনুষ্যত্ব বোধের মান আর হুঁশটা ফিরে আসুক। যদি করোনা এই পৃথিবী থেকে বিদায় হয়, হয়তো আমাদের প্রাপ্তি হবে মনুষ্যত্ব ফিরে পাওয়া। সেটা যদি হয়, সেটাই বা কম কী?