মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যেমন ঘুরে দাঁড়ায়, এই দেশের মুসলিমদের অবস্থা সেই জায়গায় পৌঁছেছে। মুশকিল হল, উপযুক্ত সংগঠন তাদের নেই, যেখান থেকে তারা দিশা পেতে পারে। কিন্তু ‘হয় ঘুরে দাঁড়াও, নয় নিপাত যাও’, অবস্থা যখন এরকম, তখন ক্ষোভ-বিক্ষোভের অস্থিরতায় হাতের কাছে যেটা পায়, সেটাকেই সম্বল করে দু’কদম বাড়াতে চায়।
আরএসএস’এর প্রধান তাত্ত্বিক এম এস গোলওয়ালকর জার্মান ফ্যাসিবাদের দৃষ্টান্তে ভারতের সংখ্যালঘুদের জন্য বলেছিলেন, “বহিরাগতদের ( আসলে মুসলিমরাই লক্ষ্য) জন্য মাত্র দু’টি পথই খোলা—রাষ্ট্রীয় জাতির (হিন্দুদের) সঙ্গে মিশে যেতে হবে এবং তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে, অথবা রাষ্ট্রীয় জাতি যতদিন চাইবে, ততদিন তাদের করুণার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা এবং রাষ্ট্রীয় জাতি যখনই চাইবে, তখনই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। সংখ্যালঘু সমস্যা সম্বন্ধে এটিই একমাত্র যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি।“(১) এই চিন্তাধারা প্রায় শত বৎসরের পুরনো। সেই সময় থকেই আরএসএস হিন্দুমনে এই বৈরিতা গেঁথে দিতে ক্রমবর্ধিতভাবে মুসলমান বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আজ আর সীমারেখা দিয়ে এটা মাপা যায় না।
একটা জনগোষ্ঠী, ছোট বা বড় যাই হোক, তার কৃষ্টি, ধর্ম, পরিচিতি নিয়েই তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে চায়। সংঘ পরিবার মুসলমান জনগোষ্ঠীর এই দিকটাকে আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু করেছে। ফলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন যখন তাদের পরিচিতি-সত্তার সারমর্ম ইসলামীয় আদর্শের স্থপতিকে নিয়ে তাদের বিড়ম্বিত হতে হল, তখন তা তাদের বিপন্নতা-বোধের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে অথবা বিশৃঙ্খলভাবে, যেখানে যেমন সুযোগ মিলেছে, তারা নবীর অপমানের জবাব দিতে পথে নেমেছে।
দেশে মুসলমান জনগোষ্ঠীর যাপনে বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলে বিরোধিতায় মুসলিম মানুষজনের সঙ্গে অ-মুসলিমরা পথ হেঁটেছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সঙ্গে ছিল। গুজরাতে মুসলিমদের উপর গণহত্যার পর দেশে প্রতিবাদ কম হয়নি। রাজনৈতিক সংগঠন থেকে সামাজিক সংগঠন, তারা এগিয়ে এসেছিল। সাচার কমিটির রিপোর্ট হল। মুসলিমরা আশ্বস্ত হল, এবার বুঝি সুদিন আসবে। সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে নানান প্রকল্প হয়েছে। কিন্তু সরকারি স্তরে সেই নিয়ে সংকল্প দানা বাঁধেনি। ধীরে ধীরে আশা-আশ্বস্ততার দিনগুলো ফিকে হয়ে গেছে। আর প্রভাবশালী প্রতিবাদী থেকে মৌলবাদী সবাই ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই পেড়ে কোন না কোন প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুসারী থাকতে অভ্যস্ত।
২০১৪’র পর থেকে দেশের মুসলমান সম্পর্কে দেশের শাসক গোষ্ঠীর অবস্থানে বড় রকমের হরফের ঘটে গেছে। ভাতে মার খাওয়া পুরনো জের। ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতির আবর্তে হাতে মার খাওয়া শুরু হয়েছে। জীবন ও সমাজ বাঁচানোর তাগিদ, পাশাপাশি জীবন ধারণের চিন্তা, অঙ্কটা মিলছে না। হিন্দু-মসুলমানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য, সীমান্ত সন্ত্রাস, মুসলমান শাসনামলের অতিরঞ্জিত ও মনগড়া ইতিহাস, এসবকে বিষয়বস্তু করে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে হিন্দুমন বিষিয়ে দেওয়ার কাজ ধারাবাহিকভাবে চলেছে। হেট স্পীচের ভয়ানক পরিণাম শুরু মব লিঞ্চিংয়ের মধ্য দিয়ে। গো-রক্ষা থেকে লাভ জিহাদের নামে লাগাতার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মব লিঞ্চিংয়ের সন্ত্রাস। সামাজিক স্তরে নিপীড়ন-হত্যা, পাশে হিন্দুত্ববাদী সরকার। প্রশাসনকে ব্যবহার করে ও আইনের অপব্যবহার করে, প্রয়োজনে নতুন আইন এনে মুসলিমদের উপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন নামানো হয়েছে। হরিদ্বার ধর্ম সংসদে মুসলিমদের উপর গণহত্যার ডাক দেওয়া কিছু সাধুর কষ্টকল্পনার ব্যাপার ছিল না। এর পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট। মব লিঞ্চিং, ইতস্তত দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো সহিংসতা ধাপে ধাপে সংগঠিত গণহত্যার প্রবণতায় পর্যবসিত। ২০০২-এর গণহত্যার রাজনৈতিক সারবস্তু মোদি জমানায় কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় নীত।
হেট স্পীচে কিংবা মুসলিম নিপীড়ন হলে প্রতিবাদ হয়। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে সেটা এক-একটা ইস্যু। একটা ইস্যু যায়, সময়ে আর একটা ইস্যু ধরা হয়। ঘৃণা-নিপীড়ন যখন একটা স্থায়ী প্রবণতা, বিপরীতে কিন্তু স্থায়ী সংকল্প নেই। এমনকি সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপ বা উত্তর-পূর্ব দিল্লির সহিংসতার মতো সংবেদনশীল বিষয়ও ইস্যুর পংক্তিভুক্ত হয়েছিল। এই প্রাতিষ্ঠানিকতা, সবকিছুকে ইস্যু বানিয়ে নেওয়া, এতে কতটা হিন্দুত্বের রাজনীতির সামনে অসহায়তা ও দিশাহীনতা আছে, আর কতটা সুপ্ত সংখ্যাগুরু-মনস্তত্ত্ব আছে, বিষয়টা খতিয়ে দেখার মতো উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এই বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যেতে গিয়ে শাহিনবাগ দানা বাঁধে। আবার ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধের মতো আস্থিরতাও আছড়ে পড়ে।
স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভেও একটা পরিকল্পনা থাকে, সে’ সবের মধ্যে সমন্বয় কমবেশি থাকে। সেটা নেই, মানে সেরকম কোন সংগঠন নেই। ফলে পথ-পন্থার বালাই নেই। সেই সুবাদে সড়ক অবরোধের মতো রেডিমেড হাতিয়ার নিয়ে দিনভর পথ আগলে বসে থাকা। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধে ভোগান্তিতে পড়ে কেউ বিরক্ত হলেন, কেউ বিরোধিতা করলেন, কেউ গালাগাল করলেন; সমবেত বিক্ষোভের ভাষাটুকু একজনও কানে তুললেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের ভোগান্তির ছবিই ভাইরাল হয়ে ঘুরতে থাকল। দশ ঘন্টায় অবরোধ উঠে গেল আর ভাইরাল-চক্কর চলল বাহাত্তর ঘন্টা ধরে। তার রেশ থাকবে সামনের নির্বাচন অবধি।
অন্যদিকে সিএএ-২০১৯, এনপিআর, এনআরসি’র বিরোধিতায় দিল্লির শাহীনবাগে ধর্ণা-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। চলেছিল প্রায় সাড়ে তিন মাস। শহরের এক ব্যস্ত রাস্তা আটকেই হয়েছিল। সেটাও ছিল মুসলিমদের দ্বারা সংগঠিত মুসলমান-প্রধান বিক্ষোভ সমাবেশ। সিংহভাগ মানুষের বিরক্তি-ক্ষোভ দূরস্থ, দেশে বহু স্থানে শাহীনবাগেরই আদলে ধর্ণা শুরু হয়েছিল, যা সংখ্যায় ২৯১। শাহীনবাগও ছিল স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন। কিন্তু তার সামনে পরিকল্পনা ছিল, লক্ষ্যটা স্পষ্ট ছিল ।
শাহীনবাগের অ্যাজেণ্ডা ও নবীর অবমাননা, উভয়ই মুসলিমদের আহত সত্তা ও বিপন্নতা-বোধকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। আবার দুটোতেই বাদ-প্রতিবাদ হল এক দিক থেকে মুসলিমদের আত্ম-ঘোষণা। কিন্তু দুটোর পরিপ্রেক্ষিত এক নয়। শাহীনবাগে ব্যাপ্তির জায়গাটা ছিল। মুসলিমদের নাগরিকত্বের ভাবনা-আবেগ অপরাপর দেশবাসীর নাগরিকত্বের ভাবনা-আবেগের সঙ্গে ওতপ্রোত ছিল। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরিই ছিল। শাহীনবাগ সেখানে ছিল আন্দোলনের একটা বিশেষ ধরনের বাস্তবায়ন। মহানবীর অবমাননার বিষয় মুসলিমদের এমন এক আত্মগত চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা অন্যদের কাছে অজ্ঞাত অথবা অস্পষ্ট। সুন্নাহ, যা হজরত মোহাম্মদের জীবনের শিক্ষামালা, ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জীবনে কী গুরুত্ব বহন করে, সেটা মুসলমান সমাজের বাইরে অনুভব করা দুষ্কর। কারণ পারস্পরিক চেনা-জানার অভাবটা প্রকট। সেই জায়গায় বিক্ষোভ-বিরোধিতা বিচক্ষণতা দাবি করে, যাতে সেটা ভুল বোঝাবুঝির কারণ না হয়। একদিক থেকে বরং অবমাননা প্রসঙ্গকে পারস্পরিক দূরত্ব অতিক্রম করার একটা উপায় করে নেওয়া যায়, যদি বাদ-প্রতিবাদকে ধৈর্যশীল পন্থায় এগিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে মহানবীকে যথার্থই এক ঐতিহাসিক পুরুষ রূপে উপস্থাপিত করার প্রয়াস থাকে। এটাই বোধহয় অবমাননা বিতর্কে সবচেয়ে ভালো প্রত্যুত্তর হতে পারে।
অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ সর্বদাই তাৎক্ষণিক ও সাময়িক হয়। তার উপর যদি দমন-পীড়ন নেমে আসে, দ্রুতই তা স্তিমিত হয়ে আসে। দু’দিক থেকেই মহানবীর অবমাননা নিয়ে অশান্ত বিক্ষোভ উদ্যম হারাচ্ছে। অন্যদিকে শাহীনবাগের মূল সংগঠক শারজিল ইমামের জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতারি, উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে গণহত্যা ঘটিয়েও এই আন্দোলনকে থামানো যায়নি। শারজিল ইমাম, উমর খালিদ সহ দিল্লির নাগরিকত্ব আন্দোলনের পনেরো শতাধিক অ্যাক্টিভিস্ট আজও জেলবন্দি। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁদের প্রজ্ঞা, পথে তাঁদের রেখে যাওয়া পথচিহ্ন।
(১) উদ্ধৃতি শামসুল ইসলাম লিখিত ‘আরএসএস : একটি প্রাথমিক পরিচয়’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া, পৃঃ ২-৩; প্রকাশক বুকমার্ক, কলকাতা।