বর্তমান সময়ে নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন এর দিকে তাকিয়ে বসে আছে সারা বিশ্ব। কারণ এই অবস্থা আর একটু বেশিদিন চললে বিশ্ব অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়বে। ঋণ-নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে বাজার চালু থাকলে। বিশ্বায়নের বাজারে আন্তর্সম্পর্কের জালে টাকার জোয়ার না লাগলে, তার আপাত ফুলে ফেঁপে থাকা অবস্থা চুপসে যাচ্ছে। আবার টাকার জোয়ার নিয়ে আসতে গেলে ধনতন্ত্রের মধ্যে নিমজ্জিত সাধারণ নাগরিকদের শ্রমের জোয়ালে নিত্য হাজিরা চাই। অতএব অর্থনীতির নিয়ামকদের যে জিনিসের দরকার সব থেকে বেশি তার নাম করোনা-ভ্যাকসিন। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত- যে সকল শ্রেণির লোকজন বিশ্বায়নের সংস্কৃতির মধ্যে নিজের অস্তিত্ব গেঁথে ফেলেছেন, তাদের সবার চাহিদা নিয়ামকের চাহিদা থেকে আলাদা নয়। কেন নয় সেটা জানতে গেলে যে তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়, তার নাম ‘হেজিমনি’। এর বাংলা প্রতিশব্দ সার্বিক কর্তৃত্ব। সহজ ভাষায় ক্ষমতাধারী, তাঁর বৌদ্ধিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আলোকছটায় সাধারণ নাগরিকের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে যখন সর্বতো ভাবে গ্রাস করে, তখন ক্ষমতার সার্বিক কর্তৃত্বায়ণ সম্পূর্ণ হয়। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না ক্ষমতাশালীর মত ও পথ ভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার মতো মানবিক দোষে দুষ্ট। ক্ষমতার দ্বারা স্বীকৃত জ্ঞানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আস্থা পোষণ তখন স্বাভাবিক কর্তব্যে রূপান্তরিত হয়। এই রূপের চরম প্রকাশ ঘটে স্বৈরতন্ত্রের সময়ে।
ধান ভানতে শিবের গীত-এর মতো ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে হেজিমনিকে টেনে আনার যৌক্তিকতা কী? স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে করোনার ভ্যাকসিন আত্মপ্রকাশ করে ভারতের মানুষকে এই মারণ ভাইরাসের ভ্রুকুটি থেকে রক্ষা করবে , এই বিশ্বাসে বর্তমান ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের এক অংশ নিজেদের বুক বেঁধেছেন। এই বিশ্বাসের মূলে যে ভাইরাসটি রয়েছে তা হল আধুনিক মানুষ একটি মাত্র নিখুঁত উপায়ের মাধ্যমে মানুষের দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের সীমারেখার মধ্যে নিজেদের আর্থ-সামাজিক চাহিদাকে অনায়াসে জয় করে নিতে পারে -এই ঊনবিংশ শতকীয় ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ধারণা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার প্রভাবের দ্বারা বিজ্ঞানের দাবিকে নস্যাৎ করা যায়- এই দাম্ভিকতা। অর্থ দিয়ে বিজ্ঞানীদের দিন রাত কাজ করিয়ে নিলেই ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টা দ্রুত থেকে দ্রুততর সময়ে গবেষণাগারে তৈরি হবে, আর তা হওয়া মাত্র বাজারজাত হবে- এই ধারণা সেই ক্ষমতার অন্ধত্ব থেকে মাথা তোলে। সেই অন্ধ দম্ভের বয়ানকে জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয় ক্ষমতার সর্বশক্তিমত্তার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস উদ্রেকের মাধ্যমে। মোসাহেব মিডিয়ার দল প্রতিষ্ঠার কাজটি সুচারু করে তোলে।
এই দম্ভ ও অন্ধত্ব থেকেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভেবে নেন কোভিড, ক্লাইমেট চেঞ্জের মতই ভুয়ো। ব্রাজিলের প্রেসিডেণ্ট লক ডাউনের প্রস্তাবকে কম্যুনিস্টদের চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেন। ভারত হ্যামলেটের মতো “টু বি অর নট টু বি” গোছের একটা লকডাঊনের সঙ্গে থালা, ঘণ্টা বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, বাদুড় মেরে, এবং ‘গো করোনা গো” মন্ত্র উচ্চারণ করে কোভিডকে দূর করার টোটকা প্রয়োগ করে।
এই কাজগুলির মধ্যে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান মনস্কতার নিদর্শন যেমন নেই, তেমনি ভ্যাক্সিন বার করার অমোঘ তারিখ নিয়ে মাতামাতি করার মধ্যে আর যাই থাকুক বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে বোঝার মানসিকতা নেই। কেন নেই? কারণ গবেষণার পদ্ধতির সঙ্গে পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও সময়ের যে সুগভীর সম্পর্ক আছে, তাকে অস্বীকার করার প্রবণতা এই মানসিকতার মধ্যে বিদ্যমান। যুক্তির নিরীখে সময়ের দরকার, পরীক্ষা আর নিরীক্ষা র সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত তথা বাঞ্ছিত ফল লাভের বিন্দুতে উপনীত হতে গেলে। আবার সময় ও পরিবেশ বদলের সঙ্গে ভাইরাসের চরিত্র “জিন মিউটেশন” নামক স্বাভাবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় বলেই নিয়ত পরীক্ষা ও নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। আর তার সঙ্গে প্রয়োজন হয় – সময়।
২৬ মার্চ, ২০২০ তে দ্য এম্পায়ার অফ ম্যালাডিজঃ এ বায়োগ্রাফি অফ ক্যানসার এর লেখক, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর, গবেষক এবং ক্যান্সার চিকিৎসক সিদ্ধার্থ মুখার্জি ‘দ্য নিউ-ইয়র্কার’-এ লেখা তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করার কাজটি কীভাবে সংক্রমণের মাত্রা ও সংক্রমিত দেহের আন্তঃসম্পর্কের অপর নির্ভরশীল। তাঁর মতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জিততে গেলে দেখতে হবে গণসমূহের মধ্যে ভাইরাসটি কী ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আরও দেখতে হবে প্রতিটি রোগীর দেহে এই ভাইরাসটি কীরকম .ভাবে কাজ করছে, “ Count both, both count” – অর্থাৎ দু দিক দিয়েই পরীক্ষা করতে হবে। কারণ দুদিকই এই যুদ্ধে গুরুত্বপুর্ণ। এই দুটি দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে যা দরকার তা হল সময়।
৯ জুন,২০২০ ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন’ পত্রিকায় লেখক প্যানেলিস্ট মডারেটরের ভূমিকায় কোভিড ভ্যাকসিন গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন রেকর্ড সময়ে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন বার করা সম্ভব হবে কীনা সে বিষয়ে।
ঔষধ-ইতিহাসে পাঁচ বছরের কমে ভ্যাকসিন নির্মাণের ঘটনার নিদর্শন দুর্লভ। অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ তৈরি হতেও দীর্ঘ দিন লাগে। কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধকের জন্য ১২ থেকে ১৮ মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তা কতটা বিজ্ঞান নির্ভর ও কতটা সুরক্ষিত হবে - তা নিয়েই আলোচনা চক্র ছিল।
সেখানেও উঠে এসেছে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের উল্লেখ। তার কারণ ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাগুলির স্তরে স্যাম্পল সঙ্খ্যার বহুলতা ও বিভিন্নতা, গবেষণাকে নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছে দেওয়ার প্রামাণ্য পথ হিসেবে বিবেচিত। আবার মানুষের শরীরে পরীক্ষার ক্ষেত্রে নীতি ও সুরক্ষার দায় যেহেতু থাকে, তাই বিজ্ঞানীরা ধীরে চলো নীতিকেই স্বীকৃতি দেন। এই সব কিছুই সময়-সাপেক্ষ। এমনকি, আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলির মধ্যে যেটি স্বীকৃতি পাবে তাকে সুরক্ষা, সংরক্ষণ সুবিধা ও ওষুধ হিসেবে উৎপাদনের যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে। পেলেও তা উপযুক্ত সুরক্ষা সহকারে সস্তায় বাজার উপলব্ধ করতে সময় লাগে। এবং সেটিও গবেষণা সাপেক্ষ। মানে সেখানেও যে বস্তুটি অমোঘ হয়ে দাঁড়াচ্ছে , তার নাম সময়। প্রাথমিক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরেও গবেষণা চালাতে হয় কারণ ভাইরাসটি সময়ের সঙ্গে তার চরিত্র বদলায়। অর্থাৎ ভ্যাকসিন আবিষ্কার মানেই স্থায়ী সমাধান বেরিয়ে গেল, তা নাও হতে পারে। প্রযুক্তি দিয়ে কিছু স্তর ত্বরান্বিত নিশ্চয় হয়, কিন্তু সেই দ্রুততারও একটা যে সীমারেখা আছে, সেই বিষয়টি আলোচনায় বারংবার ফিরে এসেছে।
এই দ্রুত ফললাভও আবার শর্তাধীন। গবেষণাগারের মানের ওপর ও গবেষনা ক্ষেত্রে সরকারের উৎসাহের উপর গবেষণার কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। আমাদের দেশে গত আর্থিক বছরে চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণায় বাজেট ছিল ১৭০০ কোটি টাকা বা ২.৩ বিলিয়ন USD। । USA এ সেখানে খরচ করেছে ৪১.৭ বিলিয়ন USD, UK- খরচ করেছে ১.৬ - বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউণ্ড, চীন খরচ করেছে ২৯১. ৫৮ বিলিয়ন USD।
তাহলে সময়ের চাহিদাকে পাত্তা না দিয়ে এই মাসের অমুক দিনে ভ্যাকসিন বেরিয়ে মানুষকে করোনা নামক জুজুর হাত থেকে রেহাই দেবে এই অপপ্রচার চলছে কেন? ঠিক ধরেছেন এবার আপনাকে হেজিমনি শব্দটির মানের দিকে নজর দিতে হবে। যার সঙ্গে বিজ্ঞান-এর সত্যতার কোন সম্পর্ক নেই। ক্ষমতার মিনার থেকে বলা হচ্ছে ভ্যাকসিন বেরোবে, কিন্তু তা বাজার-জাত হবার উপযুক্ত হবে কী-না, হলে কখন হবে এবং সেটা কাদের কেনার ক্ষমতা-ভুক্ত হবে তা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা থাকে, সেই সম্বন্ধে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে কেউ কিছু বলছেন না। কারণ, সময়ের অপর মানুষের শাসন যে অমোঘ নয় সেটা তাতে প্রকাশ হয়ে পড়ে। ক্ষমতাশীলেরা তখন সাধারণ মানুষে পর্যবসিত হন।
জাতীয়তাবাদের যে দামামায় অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে রাজনৈতিক শাসক পুরুষকারের জ্যান্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, সেই একই নিনাদের আওতায় তিনি সামান্য ভাইরাসের ভ্যাকসিনকে আগামী নির্বাচনে বোড়ের মতো যদি ব্যবহার না করতে পারেন, তাহলে তা হবে শাসকের রাজনৈতিক বিপর্যয়। তাই সত্যের বদলে মিথ -এর প্রচার ও প্রসারকে হাওয়া দেওয়া হয়। এক মিথ থেকে আরেক মিথের জন্ম হয়। জন্ম নেয় উন্মাদ সংস্কার। যেমন সংক্রমিতদের সমাজের বাইরে করে দেওয়ার প্রবণতা। আর সেই উন্মাদনায় হাত সেঁকে সুবিধাবাদীরা।
এই মিথ–প্যান্ডেমোনিয়ামের মধ্যে যে জিনিসটি অবহেলিত থাকে তা হল বৈজ্ঞানিক সচেতনতা। সেই সচেতনতার মূলে আছে ঘটনা পদ্ধতির কার্য-কারণ জানা এবং তার মধ্যে থাকা দুর্বলতা, ব্যর্থতা, ভ্রান্তি, ও সময়ের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গী। বৈজ্ঞানিকেরা সেই সত্য স্বীকার করেন বলেই, ব্যর্থতা কে জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি হিসেবে দেখেন এবং নিরন্তর সন্ধানের নিরলস পরিশ্রম থেকে পিছপা হন না। এই নিরন্তর সন্ধানের শেষে ফলের কার্যকারিতা দেখে ও তা বিচার করে যে বিশ্বাস তৈরি হয়, তা যুক্তিনির্ভর , অন্ধ ভক্তি-নির্ভর নয়।
ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের বিশ্বাসের শিকড় যুক্তি-নির্ভর না হেজিমনির গর্ভ-জাত ভক্তি-নির্ভর। সেই সচেতনতাই আমাদের উত্তর-আধুনিকতার পরিচায়ক হয়ে উঠবে।
সূত্র স্বীকারঃ
1. ‘Can a Vaccine for Covid-19 Be Developed in Record Time?’- A discussion moderated by Siddhartha Mukherjee June 9, 2020 The New York Times Magazine
2. ‘How Does the Corona Virus Behave Inside a Patient?’- Siddhartha Mukherjee March 26, 2020 The New Yorker