স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে জওহরলাল নেহরু যে - জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন তাকে আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানীরা বলেন ‘রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ’ বা ‘টেরিটোরিয়াল ন্যাশনালিজম’। যার মূল কথা, দেশের সার্বভৌম সীমার মধ্যে সব নাগরিকের সমান অধিকার। ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে সেই অধিকারে কোনও বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু স্বাধীন ভারতে সময় যত গড়িয়েছে জাতিসত্তা তৈরি হয়েছে এর ঠিক উল্টো পথে। তৈরি হয়েছে আলাদা এক জাতীয়তাবাদ। সেই বিকল্প জাতীয়তাবাদের নাম ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ বা ‘কালচারাল ন্যাশনালিজম’। এই জাতীয়তাবাদের মুলে রয়েছে কিছু আদিম আবেগ, তা হল - ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি। সেই ধর্মীয় ভাবাবেগ কে কাজে লাগিয়ে কয়েকদিন আগেই সরকারি বদান্যতায় অযোধ্যাতে রাম মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে। উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেখানে জায়গা হয়নি ধর্ম গুরুদের। এ ঘটনা থেকেই পরিষ্কার ভারত কোন পথে এগোচ্ছে। দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনৈতিক চেষ্টা শুরু হয়েছে। অথচ সংবিধানে লেখা আছে ভারত ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশ। এখানে সমস্ত জাতি যে যার ধর্ম কৃষ্টি সংস্কৃতি বজায় রেখেই পাশাপাশি বাস করবে।সেই ধর্ম-নিরপেক্ষ কাঠামো বজায় রাখার দায়িত্ব দেশের সরকারের।হচ্ছে উল্টোটা।
আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিজেপি যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও মনুবাদী সংস্কৃতিকে প্রসারিত করছে, কুসংস্কার ও পৌরাণিক অনুসঙ্গ গুলো চাপিয়ে দিচ্ছে। সেটা শুধু ভয়ের নয় বিপদেরও। আজ সরস্বতী পুজো । পাড়ায় পাড়ায়, স্কুল কলেজে ছেলে মেয়েরা মেতে উঠছে এই পুজোয়। জটিল এই সময়ে দাঁড়িয়ে পুরোনো এক বিতর্ক মনে পড়ছে আর সরকারের বর্তমান ভূমিকায় আতঙ্কিত হচ্ছি। সময়টা ২০০১ সাল। বিজেপির নেতৃত্বে প্রথম এনডিএ সরকার দেশের ক্ষমতায়। একটা জিগির উঠলো - সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী বন্দনা বাধ্যতামূলক করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে এটা কী ধরনের প্রস্তাব? বিতর্ক চলতে থাকল। সময় যত গড়ালো বিষয়টা স্তিমিত হয়ে গেল। কিন্তু বর্তমানে দেশের সরকার দেশকে যে পথে নিয়ে যাচ্ছে তাতে এই ইস্যু যে কোনদিন মাথাচাড়া দিতে পারে। সরস্বতী বন্দনা প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের সেই সময়ের একটি বক্তব্য তুলে ধরলে, বোঝা যাবে আশঙ্কা অমূলক নয়। তিনি বলেছিলেন - “এই রাজ্যে আমরা (বি জে পি) ক্ষমতায় এলে সরস্বতী পুজো স্কুল-কলেজে আইনি স্বীকৃতি পাবে। সরকারি মাদ্রাসায় যদি নামাজ হতে পারে তবে সরকারি স্কুলে সরস্বতী পুজো করায় আইনি বাধা কেন?”
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পুজোর কোনও নিয়ম নেই। তবুও বিদ্যার দেবী হিসাবে সরস্বতী স্কুল- কলেজে পুজো পেয়ে থাকেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, স্কুল কলেজে এই পুজো কতটা প্রাসঙ্গিক। সরস্বতী হিন্দু দেবী বলেই সবাই জানেন। কিন্তু হিন্দুর উপাস্য সরস্বতী মুসলমান, খ্রিষ্টান, শিখ সকলের কাছেই হয় বিমূর্ত কল্পনামাত্র, নয়তো মাটি, পাথর বা ধাতুর পুতুলমাত্র। এই ধর্মের ছাত্ররা কেন সরস্বতী পূজো করবে?
একটু পুরাণ ঘেঁটে দেখে নেওয়া যাক সরস্বতী আসলে কে? ঋক বেদে পাওয়া যাচ্ছে 'অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী' অর্থাৎ নদী হিসাবে সরস্বতীকে। আর এই সরস্বতী নদীর তীরেই সম্ভবত বৈদিক এবং ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতির উদ্ভব। তাই শিক্ষার সঙ্গে সরস্বতীর অচ্ছেদ্য বন্ধন এবং এর জন্যই পৌরাণিক যুগে সরস্বতী হয়ে উঠেছেন বিদ্যার দেবী। দেবী সরস্বতীর সঙ্গে নদী সরস্বতীর এই একাত্মতা সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। আবার পুরাণ বলছে সরস্বতী ব্রহ্মার মানসকন্যা। যিনি অনেকটা গ্রীক পুরাণে বর্ণিত দেবী এথেনার মতো, জুপিটারের মস্তিষ্ক থেকে যার জন্ম। সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার সম্পর্কের সন্ধান ঋকবেদেও পাওয়া গেছে। এখানে ব্রহ্মার সঙ্গে 'বাক্' দেবীর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চোখে পড়েছে। বাক্ই যে সরস্বতী তা নিয়ে তো কোনও দ্বিমত নেই। ব্রাহ্মণ যুগে এই সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠতর। এখানে দেখা যাচ্ছে “প্রজাপতি ব্রহ্মা পুনরায় নিজেকে আপ্যায়িত করিলেন, বাক্ তাহার দিকে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি বাক্কে আত্মবশ করিলেন। এখানে তিনি বাক্য দ্বারা অ্যাপ্যায়িত হইলেন, বলবান হইলেন”। বোধহয় এই ভাবে আমরা সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসাবে পাই। সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা হয়েও তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। অন্তত পুরাণের দাবি তাই। সে প্রমান পাওয়া যায় কলকাতার যাদুঘরের একটি প্রস্তুর মূর্তি থেকে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী আসীনা। তাঁর এক হাত ব্রহ্মার স্কন্ধবেষ্টিত।
আবার, বেদের উষাই নাকি পরবর্তীকালে সরস্বতী! দু'জনেই শুভ্র ও জ্ঞানের প্রতীক। তাই যদি হয়, তাহলে বলাই যায় সরস্বতী একদিকে সূর্যের কন্যা অন্যদিকে স্ত্রী। উষা স্বর্গের নৃত্য - 'লাস্য' র দীক্ষা নিয়েছিলেন। তবে কী উষা যিনি আজকের সরস্বতী তিনি স্বর্গের নৃত্য পটিয়সী ছিলেন? এর উত্তর ও রয়েছে। একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব বর্তেছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর, আর সেবা শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সঙ্গীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র, সরস্বতীর গান-বাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষ দান করেন। সেই থেকেই সরস্বতীর সঙ্গী মেষ। মালদা মিউজিয়ামের ৭৪ × ৩৮ সেন্টিমিটার কালো পাথরের সরস্বতী মূর্তি সেই প্রমাণ্ - ই দিচ্ছে। এখানে সরস্বতীর বাহন হাঁস ছাড়াও রয়েছে মেষ এবং বরাহ।এথেকে বলাই যায় সরস্বতী স্বর্গের সেবাদাসীও ছিলেন। যার পারিশ্রামিক হিসাবে জুটেছে এই মেষ। এছাড়া সুকুমার সেনের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে, “বাক্ দেবতা সুন্দরী নারী রূপে অসুরদের মোহিত করিয়া দেবতাদের অমৃত আহরণ করিয়া আনিয়া দিয়াছেন”। আলোচনায় পরিষ্কার, চিরকুমারী সরস্বতীকে স্বর্গের দেবতারা কখনও স্ত্রী হিসাবে কখনও সেবাদাসী হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আবার কখনও তাঁর রূপ ব্যবহার করে ভুলিয়েছেন অসুরদের।
সরস্বতী নিয়ে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। সঠিক সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। সরস্বতী পুজো পেয়েছেন শিক্ষা-সংস্কৃতির মানুষ ছাড়াও সমাজের ব্রাত্য অংশ গণিকাদের কাছেও। বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু'-গল্পে, বাবুদের স্ত্রী-রা পুজো করছেন লক্ষ্মীর। উপপত্নী বা গণিকারা ইচ্ছা প্রকাশ করলেও লক্ষ্মী পুজো করার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। কারণ পুরোহিতরা গণিকালয়ে লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান চাননি। তাদেরই ইচ্ছানুযায়ী, গণিকাদের বরাতে জুটেছে সরস্বতী পুজোর সুযোগ, কিন্তু প্রশ্ন হল পুরোহিতরা যখন রাজিই হলেন তবে লক্ষ্মী নয় কেন? কেন সরস্বতী? তবে কী সরস্বতীর জায়গা এই গণিকালয়ে?
সরস্বতী সম্বন্ধে যাই কথিত থাক না কেন, সরস্বতী কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে পুজো পেয়ে এসেছেন। এখনও পাচ্ছেন। সরস্বতী এমন এক দেবী যার উৎস নিয়ে, পরিচয় নিয়ে এত জটিলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি পূজ্য হিসাবে বিবেচিত হচ্ছেন। এটাই তো অনেক। যুগে যুগে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন উপাসনালয় থেকে গণিকালয়- সর্বত্র পুজনীয় ছিলেন সরস্বতী। ইতিহাসের আরও দাবি হিন্দু সম্প্রদায়ের সরস্বতী অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছেও সমান আরাধ্য ছিল। সরস্বতী তাঁর কৌমার্য হারিয়েছেন বহু পুরুষের বাহুডোরে। তথ্য প্রমাণ দেখিয়েছে তাঁর স্বল্পবসনা নানা রূপের বিভঙ্গ। অথচ এম এফ হুসেন আইকনোগ্রাফির সমস্ত নিয়মকানুন মেনে সরস্বতীর ছবি আঁকার পরও তাঁকে হেনস্থা হতে হয়েছিল? হুসেন কিন্তূ নতুন কিছুই করেন নি। তিব্বতে এমন অনেক সরস্বতী পাওয়া গেছে যার উর্ধ্বাঙ্গে কোনও বসনই ছিল না। হুসেন আঁকা ছবি নিয়ে যাঁরা বিতর্ক তুলেছিলেন তাঁদের যুক্তি ছিল- এতে সরস্বতীর যৌনতাকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁরা কি জানতেন না নেপালে চতুদর্শ শতকের পাওয়া শিলালিপিতে লেখা আছে 'সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তি।' এই লেখাই তো সমস্ত বিতর্কে জল ঢেলে দেয়।
যাই হোক এমন এক দেবীকে ‘বাধ্যতামূলক বন্দনার’ মধ্যে কখনও যেন আটকে রাখা না হয়। তাহলে সেটা হবে দেবীর পক্ষে অবমাননা। নিগ্রহও বটে।