পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সনাতন ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ: বিতর্কের নানা স্বর

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 206 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
ঔপনিবেশিক পর্বে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ও দলিত জাগরনের যে আন্দোলন শুরু হয়, তা সনাতন ধর্মের চিরন্তন অস্তিত্ব ও তাত্ত্বিক কাঠামোকে উন্মোচিত করে। এক্ষেত্রে উত্তর ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জ্যোতিবা ফুলের সত্যশোধক সমাজ এবং বি আর আম্বেদকরের ' অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট ' মুভমেন্ট।এই আন্দোলন শুদ্র ও দলিতদের নতুন, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সচেতন করে। তারা সনাতন ধর্মের ইতিহাসকে আতস কাঁচের তলায় ফেলে।

পৃথিবীতে অতি দক্ষিণপন্থীদের সর্ব বৃহৎ সিভিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ( আরএসএস) একশ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। পঞ্চাশ হাজার  শাখা বিশিষ্ট হাইড্রা সদৃশ সংগঠন নানান ধরণের শাখার  মাধ্যমে ভারতের আর্থ- সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের প্রভাবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে তার এই দীর্ঘ পথ চলার মাধ্যমে। ১৯২৫ সালে দশেরাতে   নাগপুরের এক ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগাওয়ার যখন হিন্দু মহাসভার চার প্রবীণ নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তখন তাদের স্বপ্ন ছিল এক স্বেচ্ছাসেবক ভিত্তিক আধাসামরিক হিন্দু সংগঠন তৈরি করা। এই সংগঠনের লক্ষ্য হবে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের সংগঠিত করা যারা মুসলিম ও ক্রিশ্চান প্রভাবমুক্ত, অতীত গৌরব আশ্রিত এক ভারত তৈরি করবে। সেই ভারত হবে নিশ্চিতভাবে হবে এক হিন্দুরাষ্ট্র। সেই দিনের পর থেকে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।আজ একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই যে সরকারি কোন তকমা না থাকলেও, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ভারত রাষ্ট্রের যে কোন পলিসি নির্ধারণে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। একাধিক শাখা সংগঠনকে হাতিয়ার করে, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামাবলী গায়ে, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের  শ্লোগান দিয়ে তাদের পরিকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রকে সফল করতে নিরলস কাজ করে চলেছে সংঘ পরিবার।উপুর্যুপরি নির্বাচনী সাফল্য এবং কর্পোরেট হিন্দুত্বের রসায়ন তাদের কাজকে অনেক সহজ করেছে। এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে যে তীব্র মেরুকরণ ও ধর্মীয় হিংসার প্রকোপ আমরা উপলব্ধি করছি তা ৪৭' পরবর্তী ভারত কখনো প্রত্যক্ষ করে নি।একই সঙ্গে একথা স্বীকার্য যে মুসলমান এবং ক্রীশ্চানকে তারা ' অপর' প্রতিপন্ন করতে সফল হয়েছে।  কিন্তু এতেই সংঘের স্বপ্ন সাকার হচ্ছে না। সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু জনগণকে এক সূত্রে বাঁধতে তাদের এক মতাদর্শ দরকার। এই মতাদর্শ আদতে এক সাংস্কৃতিক কোড যার ফলিত রূপ হল সংঘ বর্ণিত সনাতন ধর্ম। বর্তমান নিবন্ধ এই সনাতন ধর্মের ধারণাকে বিচার করতে চায়। আমরা দেখেছি সংঘ পরিবারের এই জীবনরেখাটিকে প্রশ্ন করা,তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করা এবং তাঁর বিরুদ্ধ আখ্যানকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে এক শৈথিল্য কাজ করে।সবচেয়ে বড় কথা হল এই সনাতনী ভাবনা শুধু সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে সীমায়িত নয়,ভারতে বিজেপি বিরোধী তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মধ্যে এই মতাদর্শের প্রভাব অপরিসীম। দিনের শেষে তাই ভারতের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুত্ব নির্ভর।
এই সনাতন ধর্ম নামক ধারণাটিকে সংঘ পরিবারের  কেন প্রয়োজন তা বুঝতে হলে আমাদের একটি সরল পাটিগণিতে নজর দিতে হবে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ( ৯০.৬ কোটি)।হিন্দুদের মধ্যে  ৪২.৮ শতাংশ শূদ্র,প্রায় ৪১.৪ কোটি।হিন্দু ধর্মের বিধান অনুযায়ী এদের জন্ম নির্দিষ্ট কর্তব্য হল চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার উপরের তিনটি বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের সেবা করা।চতুর্বর্নের বাইরে আছে যে অতি শূদ্র বা দলিত ( সরকারি মতে তপশিলি জাতি),তারা হল ২২.২ শতাংশ এবং আদিবাসী ( তপশিলি উপজাতি) জনগণ হল ৯ শতাংশ।এরা উভয়ে প্রায় ২৮ কোটির বেশি মানুষ। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিধানে এরা হল অস্পৃশ্য, তথাকথিত 'অসবর্ণ ', অর্থাৎ যারা বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে, বা অন্ত্যজ। এদের সবার উপরে আছে উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়, শতাংশের হিসাবে মাত্র ২৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি।এরাই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক,সরকারি- বেসরকারি ইত্যাদি সমস্ত উচ্চ ধরণের পদ ও মর্যাদা কুক্ষিগত করে রেখেছে। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যবাদ নেতৃত্বাধীন বর্ণ ব্যবস্থাকে এরাই তথাকথিত মেধা,প্রতিভা,কর্মক্ষমতা,অর্থ ও ' সুমহান' ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যের জোরে টিকিয়ে রেখেছে। সংঘ পরিবার এই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।তার সংঘ পরিবার প্রকল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নটিকে সাকার করতে তপশিলি জাতি,উপজাতি ও ওবিসিদের ( আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) সমর্থন জরুরি। কিন্তু একথাও সত্য যে আদ্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে জারিত সংঘ পরিবার ভারতীয় সমাজ জীবনের চরমতম বর্ণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে এবং এই ব্যবস্থায় তত্ত্বগত ও কার্যকরী অর্থে অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলি প্রান্তিক অবস্থানে থাকে।কিন্তু এই অবস্থানে স্থির থেকে হিন্দু সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি হওয়া বা আম্বেদকরের রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে তপশিলি জাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়কে মুক্ত করা সম্ভব নয়, তাই বর্ণ ব্যবস্থাকে নানান নতুন মোড়কে উপস্থিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। দরকার হচ্ছে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের স্বপ্ন যার ভিত্তি হবে সনাতন ধর্ম।

এই সনাতন ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিক নেতৃত্ব বলেন সনাতন ধর্ম হল এক চিরন্তন জীবন বোধ যা ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত।অন্য সমস্ত ধর্ম ও ভাবনা এর থেকে উদ্ভূত।অনেকে আবার আরেকটু এগিয়ে বলেন হিন্দুত্ব আসলে সনাতন ধর্মের এক প্রায়োগিক রূপ মাত্র।অন্যান্য বহিরাগত ধর্মের ( পড়ুন ইসলাম ও ক্রীশ্চান) থেকে এর পার্থক্য হল হিন্দু ধর্ম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে কিন্তু অন্য ধর্মগুলো বিয়োজন ও দখলদারিকে শ্রেয় মনে করে।এই তত্ত্ব বলে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান - পতনের সঙ্গে সনাতন ধর্মের ওঠা-পড়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই বৃহত্তর হিন্দু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তারা বৈদিক- অবৈদিক এবং এ দেশের মাটি থেকে উদ্ভূত সমস্ত ধর্ম বিশ্বাসকে কুক্ষিগত করতে চায়। এই সনাতন ধর্ম আর হিন্দু রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কের রসায়ন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বর্তমান সরসংঘচালক মোহন ভাগবত বলেন: " Dharma is the satva( nature) of this country and Sanatan dharma is the hindu rashtra.Whenever the Hindu rashtra progresses, it progresses for the sake of that dharma only.And now it is the will of the God that Sanatan Dharma rises and hence the rise of Hindustan is certain"।এই তত্বায়ন কিন্তু হিন্দু ধর্মের মূলগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদ,চতুর্বর্ন ও চতুরাশ্রম ব্যবস্থা ও জাত কাঠামো বিষয়ে আলোকপাত করে না। এখানেই সনাতন ধর্মের মোড়কে সমস্ত হিন্দু সমাজ এবং হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা তত্ত্বগত ভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।

প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের নজর এড়ায় না:
* জাত ব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রাখা অর্থাৎ শুদ্র,দলিত ও আদিবাসীদের দাসত্ব থেকে মুক্তির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা।
* যজ্ঞ ও পশু বলি প্রথায় বিশ্বাস রাখা।
* দ্বিজ জাতের সর্বোচ্চ সারিতে থাকা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা কখনো উৎপাদন ও শ্রমের কাজে অংশগ্রহণ করবে না এবং শুদ্ররা সমস্ত ধরনের কাজ করতে বাধ্য থাকবে। এককথায় সনাতনী, শুদ্র, দলিত ও আদিবাসীদের অধিকার ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করবে সনাতন ধর্ম।

সনাতন ধর্মের মুখোশে ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুস্মৃতি নির্ভর হিন্দু ধর্মের চিরন্তন অস্তিত্বের পক্ষে যতই যুক্তি হাজির করা হোক না কেন, এই সনাতনী ভাবনার বিরুদ্ধাচরণের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন ছিল তার সংগঠিত প্রকাশ। চব্বিশতম তীর্থঙ্কর ও জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর বৈদিক যজ্ঞ ও বলি প্রথার বিরোধ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী হওয়ার কথা বলেন। এই ধর্ম সমতার ভিত্তিতে সমস্ত বর্ণের মানুষকে জৈন ধর্মে সামিল হওয়ার আহ্বান জানায় এবং ঘোষণা করে সমস্ত হত্যাই আসলে হিংসার বহিপ্রকাশ।গৌতম বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্ম সবচেয়ে সংগঠিত ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের বিরোধিতা করে।কতগুলো মানবিক নীতি ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত এই ধর্ম জাত ব্যবস্থার তীব্র বিরোধ করে এবং ' শ্রমণ' দর্শনকে সমগ্র মানব সমাজের জন্য স্বাভাবিক বলে দাবি করে। বুদ্ধ বলেন যে মাঠে কাজ করা বা পশুপালনের কাজ, বেদ চর্চা ও প্রচারের মতই সন্মানীয়। এই তথ্য তাই আমাদের অবাক করে না যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর সনাতন হিন্দু ধর্মের যে পুনরুত্থান ঘটে তাতে সবচেয়ে বেশি হিংসার শিকার হয় বৌদ্ধরা।

মধ্যযুগে যখন ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ ভারতের ধর্মীয় আখ্যানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল তখন জাতপাত ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিস্পর্ধা হল গুরু নানক প্রতিষ্ঠিত শিখ ধর্ম।গুরু গ্রন্থ সাহিবে শ্রমের মর্যাদাকে একাধিক নীতিতে গ্রন্থিত করা হয়েছে।কোন শিখ গুরু জাত ব্যবস্থাকে মেনে নেয় নি।  পাঞ্জাবে কৃষিকাজের ঐতিহ্যের সঙ্গে শিখধর্মের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ঔপনিবেশিক ভারতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে গঠিত আর্য সমাজও বর্ন ব্যবস্থা,অস্পৃশ্যতা,যজ্ঞ ও মূর্তিপূজাকে মেনে নেয় নি। এরা প্রচলিত অর্থে হিন্দু সমাজের অংশ হলেও সনাতনী ও আর্য সমাজীদের মধ্যেকার সংঘর্ষের বহু ইতিহাস রয়েছে।এই বিরোধের আরেকটা কারণ হল এরা যে কোন ধর্ম ও জাতের লোকদের হিন্দু সমাজে আহ্বান ও নারীকে বেদ চর্চার অধিকার দেওয়া।

ঔপনিবেশিক পর্বে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ও দলিত জাগরনের যে আন্দোলন শুরু হয়, তা সনাতন ধর্মের চিরন্তন অস্তিত্ব ও তাত্ত্বিক কাঠামোকে উন্মোচিত করে। এক্ষেত্রে উত্তর ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জ্যোতিবা ফুলের সত্যশোধক সমাজ এবং বি আর আম্বেদকরের ' অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট ' মুভমেন্ট।এই আন্দোলন শুদ্র ও দলিতদের  নতুন, আধুনিক  ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সচেতন করে। তারা সনাতন ধর্মের ইতিহাসকে আতস কাঁচের তলায় ফেলে। ফুলে এক নতুন ধর্মের প্রচলনের কথা বলেন, অন্যদিকে আম্বেদকর বৌদ্ধধর্মকে গ্রহন করেন এবং এক নতুন দিশা দেখান যার নাম নবায়ন বৌদ্ধ ধর্ম।
ড: আম্বেদকর তার বহু আলোচিত গ্রন্থ ' Riddles in Hinduism'  এ সনাতন নামক ব্রাহ্মণ্যবাদী তত্ত্বের আগাগোড়া বিশ্লেষণ করেছেন। আম্বেদকর দেখান যে চতুর্বর্ণ বিষয়টা এসেছে পুরুষসুক্ত গ্রন্থ থেকে।এখানে বলা হয় এক পৌরানিক চরিত্র ' পুরুষের ' মুখ থেকে ব্রাহ্মণ,হাত থেকে ক্ষত্রিয়, উদরদেশ থেকে বৈশ্য ও পদযুগল থেকে শুদ্রের উদ্ভব। এই বয়ানকে নাকচ করেই আম্বেদকর ক্ষান্ত হন নি বরং স্পষ্ট ভাষায় ১৯৪২ সালে লেখা এক প্রবন্ধে এই বর্ণাশ্রম  তত্ত্বকে নাজিদের অ্যান্টিসেমিটিজম তত্ত্বের সাদৃশ্য খুঁজে দেখান।একই সঙ্গে ঋকবেদের জন্মের ক্ষেত্রে ' অপৌরুষেয়' এবং স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করেন। আম্বেদকরের মতে ঋকবেদে উল্লেখিত ঋষিদের নাম ও গোত্র পরিচয় প্রমাণ করে এই গ্রন্থ মনুষ্যসৃষ্ট। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হল ব্রাহ্মণরা কিভাবে বৈদিক দেবতার বদলে অবৈদিক দেবতাদের প্রতিষ্ঠা করল।প্রথম যুগে ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি, মিত্র পূজিত হত। পরবর্তীতে এল ত্রিমূর্তি তত্ত্ব যেখানে ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু সংরক্ষক ও শিব সংহারক। আম্বেদকর দেখান যে ব্রাহ্মণরা শুধু নতুন দেবতাদের সামনে আনেন নি, একই সঙ্গে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিরোধ মেটাতে অবতার তত্ত্বের সূত্রপাত করেন। শিবের মত অবৈদিক দেবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয় ইনি আদতে বৈদিক দেবতা রুদ্রদেবের নতুন রূপ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কিভাবে মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম ও তার বিনম্র সেবক হনুমানের রূপ বদল করে এক ক্রুদ্ধ যোদ্ধায় রূপান্তরিত করা যায়,তা আমরা গত দুই দশক জুড়ে প্রত্যক্ষ করেছি। এই নির্মানে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কিভাবে নির্নায়ক ভূমিকা পালন করে তা বুঝতে আমরা গোলওয়ারকরের লেখার সাহায্য নিতে পারি। গোলওয়ারকর তার 'Bunch of Thoughts' গ্রন্থে আদি শংকরাচার্যের কৃতিত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি বুদ্ধদেবকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে বর্ণনা করে বৌদ্ধদের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেছেন। ব্রাহ্মণরা কিভাবে তাদের প্রয়োজনমত বিগ্রহের রূপকল্প নির্মাণ করে তা এই গ্রন্থের আরেক জায়গায় পরিষ্কার: ' We worship Lord Shiva, no doubt, but on that account we do not welcome the flock of demons surrounding him"।আম্বেদকর এই আলোচনা কেন করেছেন তা তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন  দুটো  বিষয় উল্লেখ করে। তার নিজের কথায়: 'make the mass of people to realize that Hindu religion is not Sanatan' এবং দ্বিতীয়টি হল: ' to draw attention of the Hindu masses to the devices of the Brahmins and to make them think for themselves how they have been deceived and misguided by Brahmins
একই ভাবে দক্ষিণ ভারতেও হিন্দুদের মধ্যে সনাতন ধর্মের প্রতি বিরোধ প্রদর্শনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।দ্বাদশ শতকে বাসব( যিনি এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন) উপবীত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং জাত- পাত ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা বলেন।শুদ্র লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগারা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের কর্তৃত্ববাদ থেকে মুক্ত হয়ে বাসবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।তথ্যের খাতিরে একথা উল্লেখ করা দরকার যে কর্নাটকে ব্রাহ্মণ্যবাদের গুরু আদি শংকরাচার্যের অদ্বৈত পীঠের পাশাপাশি শুদ্র মঠাধিপতি দ্বারা পরিচালিত লিঙ্গায়েত পীঠ অবস্থান করে। এই বাসবপন্থীরা মহিলাদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। মধ্যযুগে (পশুপালক সম্প্রদায় বা কুরুবা)  আক্কা মহাদেবী ও আমাদের সময়ে গৌরী লঙ্কেশ ছিলেন বাসব অনুগামী।গৌরী লঙ্কেশ খুন হন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে। উনবিংশ এবং বিংশ শতকের সূচনা লগ্নে কেরালায় অস্পৃশ্য এজাভা সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন শ্রীনারায়ন গুরু। তবে সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় শুদ্র ও দলিতদের নিয়ে সবচেয়ে কার্যকরী ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তোলেন পেরিয়ার।তিনি সনাতন ধর্মকে আর্য আগ্রাসন আখ্যা দেন। ক্রমেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ নেয় এবং এক নতুন রাজনৈতিক - সাংস্কৃতিক আখ্যানের জন্ম দেয়।

আজকে সংঘের বিশ্বাস সনাতন ধর্মের ধারণা দিয়ে সমগ্র হিন্দু সমাজকে সে এক সূত্রে বাঁধতে পারবে,তার মধ্যেকার মূলগত অন্তর্বিরোধ গুলোকে প্রশমিত রেখে বা কিছু প্রসাধনী পরিবর্তনের মাধ্যমে। দলিতদের বাড়িতে রাত্রি যাপন,এক থালায় খাওয়া,  সরকারি ও দলের উদ্যোগে আম্বেদকর জয়ন্তী পালন সেই পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু বাস্তবে এখনো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলিত ও শুদ্ররা নির্যাতনের শিকার। দলিতদের উপর সংগঠিত অপরাধের হার অনেক বেশি,বিশেষ করে গোবলয়ে। সংঘ পরিবার সনাতন ধর্মের প্রশ্নে এতটাই সংবেদনশীল যে  এ প্রসঙ্গে কোন বিরোধিতাই তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।এই অবস্থায় দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম( ডিএমকে) নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী তনয় উদয়নিধি স্ট্যালিন যখন সনাতন ধর্মের নির্মূলের কথা বলেন তখন প্রকৃত অর্থে আগুনে ঘি পড়ে।সমস্ত বিজেপি নেতৃত্ব, গেরুয়া শিবিরভুক্ত সাংবাদিক, আমলারা একযোগে এই বক্তব্যের বিরোধিতায় নেমে পড়েন।কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী পরিষ্কার ঘোষণা করেন সনাতন ধর্ম হল ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর।আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখওয়াত ফতোয়া দেন যারা সনাতন ধর্মের বিরোধিতা করবেন, হিন্দুরা তাদের জিভ কেটে নেবে ও চোখ উপড়ে নেবে।এই শাস্তির কথা নতুন নয়,মনুস্মৃতিতে বিভিন্ন বর্নের জন্য এই ধরণের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই বিষয়টা এতটাই বিতর্কের সৃষ্টি করে যে বিগত লোকসভা নির্বাচনে এটা একটা প্রধান ইসু হয়। আসলে এই বিতর্ক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কাছে এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। সনাতন ধর্ম মোহন ভাগবতের ভাষ্য অনুযায়ী হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিরূপ। আমাদের সামনে আজ দুটো রাস্তা খোলা হয়েছে --- একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদ জারিত সনাতন ধর্ম,অন্যদিকে সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারত।আম্বেদকর কল্পিত ভারত যে সংবিধানের উপর তৈরী, তা এই সনাতন ধর্মের ধারণাকে নাকচ করে। এই অবস্থায় এই প্রশ্নটিকে আড়ালে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে আত্মঘাতী হবে।

0 Comments

Post Comment