ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই সন্তানের সঙ্গে সমস্তরকম সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় আমাদের। আমার ক্ষেত্রেও তার কোনও অন্যথা হয়নি, আমারও আমার মাকে মনে নেই।
তোমারও, থাকবে না।
প্রকৃতির এ কী এক অদ্ভুত খেয়াল! তোমায় জন্ম দেওয়ার পর তোমায় বড়ো করার কোনও অধিকার আমার নেই।সে অধিকার পেয়েছে অন্য কেউ। যাদের কাছে এরপর তুমি বড়ো হবে, তারাই আমাদের ঘোর শত্রু। আমার কাছে, আমার মতো অজস্র প্রজাপতি-মা’র কাছে এ কি অভিশাপ নয়? অথচ, অভিযোগ জানানোর কোনও রাস্তা নেই। বিবর্তন সেসব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।
তোমার সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। ওসব নিয়ে আমাদের জগতে কেউ মাথা ঘামায় না। থাইম গাছের ফুলের কুঁড়িতে ডিম পেড়েই আমার কাজ শেষ হয়ে যায়। সে ডিমের খোলস ফাটিয়ে তুমি বেরিয়ে আসো নিজেরই চেষ্টায়। থাইমের বীজ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে তোমার রস সংগ্রহ। কীভাবে তুমি নিজে নিজেই বড়ো হয়ে ওঠো, সেটা মানব-পৃথিবীর কাছে বিস্ময়। আমার কাছে তা অবশ্যই গর্বের।
তারপর, আসে সেই দিন। আপন নিয়মেই তুমি শিখে নাও, কীভাবে প্রবঞ্চক হয়ে উঠতে হয়। তোমার শুঁয়ো-দেহ থেকে বেরোতে থাকে গন্ধরস, তোমার কণ্ঠযন্ত্র জন্ম দেয় মোহিনী সুরের। লালমির্মিকা পিঁপড়ের দল ওই রসের গন্ধে বিভোর হয়ে যায়, ওই সুরের মূর্ছনায় দিকভ্রান্ত। ওরা ভাবে, ওদেরই সর্বময় কর্ত্রী বিপদে পড়ল বুঝি। গোষ্ঠীচেতনার বোধ ওদের বড়ো প্রবল, ওরা তাই এগিয়ে আসবে তোমাকেউদ্ধার করতে, যত্ন করে নিয়ে যাবে ওদের ভিটেতে, এক মুহূর্তের জন্যওজানতে পারবে না, কী সর্বনাশটাইডেকে আনছে নিজেদের অজান্তে!
আমি ভাবি, এত হাজার বছরেও ওদের বুদ্ধি এতটুকু পাকল না। এখনও নিজেদের সঙ্গে আমাদের তফাতখানা বুঝতে শিখল না! বিবর্তন কিছু প্রাণিকে বুঝি আজন্ম-নির্বোধ করেই রাখতে চেয়েছে। এই শ্রমিক পিঁপড়েগুলোর মতো।
যেদিন ওরা তোমায় নিয়ে চলে গেল, সেদিন আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। তোমার মতো একদিন আমিও জন্মেছিলাম থাইম গাছের কোলে, তোমার মতো করেই সম্মোহনেরজাল বিছিয়ে বশ করেছি মির্মিকাদের, তোমাকে যেভাবে ওরা রানির মতো সম্মান দিয়ে নিয়ে গেল, আমাকেও একদিন ওভাবেই বরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমারও মা এখনকার আমার মতোই ভেবেছিল কিনা, তা আমার জানা সম্ভব হয়নি, যেমন তুমিও কোনোদিন জানতে পারবে না, আমি আজ কী ভাবছি।
তুমি যে সফল হবেই, তা কখনোই সুনিশ্চিত নয়। ওই যে বললাম, স্বর্গ না বধ্যভূমি, সেটা তোমার উপরেই নির্ভর করবে। তবু, মা হিসেবে তোমাকে সফল ভাবতে আমার ভালো লাগবে। যেমন, এই মুহূর্তে আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, মির্মিকাদের কলোনিপাড়ায় কোনও রানি নেই, শাসন নেই, আছে বলতে কেবল বেগার খাটা, এমন এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রবেশ ঘটছে তোমার। ক্রমে তোমার অস্তিত্ব প্রবলতর হয়ে ওঠে,তোমাকে ওরা মেনে নেয়ওই বিশাল উপনিবেশের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হিসেবে, তোমার দেখভালের জন্য নিয়োজিত হয় আলাদা একটা দল।
তুমি ওখানে রানি, তোমার উপর রাজ্যশাসনের যশোভার নেই, আছে শোষণ করার পূর্ণ অধিকার।পর্যাপ্ত যত্ন যাতে পাও, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে ওরা। তোমার পুষ্টির জন্য যখন নিজের হাতেই নিজের সন্তানকে হত্যা করবে কোনও নারী-শ্রমিক, তারপর তার দেখাদেখি অন্যরাও, সে দৃশ্য দেখে পৈশাচিক আনন্দ হবে তোমার। অভূতপূর্ব এক নিধনযজ্ঞের সাক্ষী থাকতে থাকতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীব মনে হবে তখন।
এভাবে কেটে যাবে আরও কিছু মাস। বহরে বাড়বে তুমি। যত দিন যাবে, তত দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে তোমার নিরাপত্তা-বলয়, তারপর একদিন ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। ওদের হয়তো সন্দেহ হবে, কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। তোমার মূককীট-শরীরের চারপাশে তৈরি হয়েছে ক্রিসালিস, সে ঢাকনা ভেদ করে যে প্রতিশোধ নেবে, সে অবকাশ ওরা পাবে না। ততদিনে তোমার ডানা গজানো শুরু হয়ে গিয়েছে, পুরনো শরীরটা ভেঙেচুরে নতুন এক অবয়বের খোঁজ পাবে তুমি।
তারপর, এক নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে আসবে ঢাকনা ভেঙে, সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটে গিয়েছে তোমার, তুমি নিজেকেই আর চিনতে পারছ না। সেখানে বুদ্ধিহীন মির্মিকারাই বা তোমায় চিনবে কীকরে?সে যে কী এক অসামান্য অনুভূতি! এইবার সময় নিজের কক্ষপথে উড়ে যাওয়ার।সুগঠিত ডানায় ভর দিয়ে উড়ে যাবে তুমি, ভরা যৌবন নিয়ে পাতায়-পাতায় আছাড়িপিছাড়ি খাবে, ফুলে-ফুলে খুঁজবে জীবনসঙ্গীকে, তোমার পিছনে পড়ে থাকবে ওদের এলোমেলো কলোনিপাড়া,নির্বোধ সভ্যতার খণ্ডহর।
এসবই পূর্ব-নির্ধারিত, তুমি বা আমি কেউই এই নিয়মের অন্যথা করতে পারি না।
ঠিক যেমন, তুমি নিজে থেকে কোনও পিঁপড়ে-শিশুকে হত্যা করতে পারবে না। বেজাতের কিছু প্রজাপতি ওকাজ করে, তারা মরেও তাড়াতাড়ি, কিন্তু আমরা এমন আত্মঘাতী নই, অহেতুক ঝুঁকির পথ আমাদের নয়। আমরা নিজে থেকে কখনও অন্যের শিশুকে হত্যা করব না, উস্কানি দেব কেবল। তুমি জেনে গিয়েছ এতদিনে, আমরা হত্যাকারী নই, আমরা শিল্পী,আর শিল্পটা অভিনয়ের। সফল শোষক হতে গেলে সফল অভিনেতা হয়ে উঠতেই হবে।
অতএব, তোমার সামনে লক্ষ্য এখন কেবল একটাই – পরিপূর্ণ অভিনেতা হয়ে ওঠা।
আমি জানি, সেকাজ তুমি ঠিকই পারবে। যে সহজাত ক্ষমতা নিয়ে তুমি আলো দেখেছ পৃথিবীর, সেজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে কোরো। তবে, একইসঙ্গে একথাও ভেবো না যে এ পৃথিবীতে এমন ছলনার অধিকার শুধু তোমার বা আমাদেরই। আমাদের সৃষ্টি-দেবতার নজরে এমন একচোখামি নেই। শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সিংহাসনটি তিনি আমাদের মতো ফেঙ্গারিস প্রজাপতিদের জন্য ছেড়ে রাখেননি। ওটা দুপেয়ে, মেরুদণ্ডী, সুসভ্য জীবের জন্যই থেকে যাবে চিরকাল।
আমাদের সঙ্গে ওদের মিল কম নয়, একথা সত্যি। ওরাও বন্ধুর বেশে ঢুকে পড়ে পরভূমিতে, আমাদের মতোই নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। কিন্তু সেটাই সব নয়। যে নমাস ধরে তুমি ঠকিয়ে যাবে মির্মিকার দলকে, একটা-দুটো করে পিঁপড়ে-শিশু তোমার খাদ্য হবে প্রতিদিন, আর তা দেখে চরম সফল হয়েছ ভেবে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর কথা ভাববে, কিন্তু তুমি কখনোই ভাবতে পারবে না, ওই নমাসে দুপেয়েরা গোটা একখানা সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, কেবল তাদের অপছন্দের অজুহাতে। আমাদের সঙ্গে ওদের তাই তুলনাই চলে না।
আরও একটা কথা জানিয়ে যাচ্ছি। তুমিও পরে জেনে যাবে। আজ থেকে চল্লিশেরও বেশি প্রজাপতি-পুরুষ আগে আমরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম এই ব্রিটেন দেশটা থেকে। লম্বা ঘাসের যে বনে আমরা ঘর বাঁধি, আমাদের সে ঘর নষ্ট করে ফেলেছিল এখানকার লোকজন। নির্বোধ মির্মিকারাও হারিয়ে গিয়েছিল এই ঘাসবন থেকে।মাত্র কয়েক পুরুষ আগেই আবার এখানে ফিরেছি আমরা, মির্মিকারা। ফিরিয়েছে ওই দুপেয়েরাই। হিসেব-নিকেশ করে আমাদের নাম রেখেছে ফেঙ্গারিস, পদবিতে জুড়ে দিয়েছে রেবেলি। ওদের মতিগতি বোঝা ভার।
আমার হাতে সময় বেশি নেই। এই জীবনসায়াহ্নে এসে ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করছে নিজেকে।
তুমি যেভাবে এতদিন কাটিয়েছ, আমারও শৈশবকালটা অমনই ছিল। তুমি এরপর যেভাবে বাঁচবে, আমিও সেভাবেই বেঁচেছি, অমন পিঁপড়ে ঠকিয়ে, হত্যালীলা ঘটিয়ে। তারপর সময় বুঝে উড়ে গিয়েছি শত্রুর নাগালের বাইরে। তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে, চরম এক মুহূর্তে তার কাছে সমর্পণ করেছি নিজেকে।জন্ম দিয়েছি তোমাকে।
সেদিক থেকে দেখলে সার্থক এ প্রজাপতি-জনম।
শরীরে অনুভব করছি অন্তিমের সাড়া, ক্ষয়ে ক্ষয়ে আসছি ক্রমশ, ওই মির্মিকাদের উপনিবেশের মতোই ভঙ্গুর লাগছে নিজেকে। বড়োজোড় আর এক কি দুঘণ্টা আয়ু থাকবে আমার, তারপর থাইমের লতা ছেড়ে মাটিতে ঝরে পড়বে নীলচে আমিটা।ঝরে পড়ার আগে, কিছুক্ষণ আগে যে কথাটা বলেছি তোমায়, সেটাই আবারও বলছি – জন্মসূত্রে যে সহজাত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছ তুমি, তার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে কোরো।
আরও ভাগ্যবান মনে কোরো এই ভেবে – তুমি একজন মানুষ হয়ে জন্মাওনি।