পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উধাও-আয়না আর আকাশপ্রদীপের লোককথা

  • 25 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1136 view(s)
  • লিখেছেন : প্রবুদ্ধ ঘোষ
ক-২ তারপর সবার ঘর থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে থাকল আয়না। নিজেকে নিজেই দেখা যায়। প্রতিবিম্ব। আলো ঝলকায়। কেউ কেউ সেটা দেখেই আবেগবিহ্বল। কেউ সহ্য করতেই পারত না। কিন্তু, সক্কলের বাড়িতেই থাকত। প্রত্যেকে ওটার সামনে দাঁড়িয়ে আরও ভাল, আরও নৈতিক, আরও বিনয়ী, আরও পরমনোলোভা হওয়ার অভিনয় করত। যার অভিনয় সবচেয়ে ভাল হত, সে হরষেবিষাদের সুন্দর বাড়িগুলোয় থাকতে পারত। কেউ কেউ লুকিয়ে রাখত, কিন্তু দেখত ঠিকই।

                          
এক আশ্চর্য রাতে হরষেবিষাদ শহরে সকলের ঘর থেকে উধাও হয়ে যেতে শুরু করল আয়না। অথচ, তখন ফটফটে রোদ্দুরমাস। সুন্দর বাড়িগুলোর জানলার বাইরে বোঁবোঁ পাখা ঘুরছে, ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা-যন্ত্র। মরা মাছ এর’ম ঠাণ্ডায় বহু বছর বেঁচে থাকে। তারপর খদ্দেরের হাতে পাতে চালান হয়ে যায়। তখন হলুদ হলুদ রোদতাপ কুসুমভাঙা পোচের মতো শহরের বুকে-পেটে ছড়িয়ে পড়ছে। তখন চাল জমা ক’রে রাখার প্রতিযোগিতা চলছে হরষেবিষাদের সবচেয়ে সুন্দর বাড়িগুলোর মধ্যে। যে যত চাল জমাতে পারবে, ততগুলো প্রজন্ম নিশ্চিন্তিতে দুধেভাতে থাকবে- এর’ম রটে গেছিল। হরষেবিষাদে সব সেতুগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছিল তখন। কেউ যাতে বাইরে থেকে ঢুকে না পড়তে পারে। কেউ যাতে পালিয়ে না যেতে পারে। সেতু ভাঙার পাথরগুলো জমছিল। আর, পাথরই যে দুনিয়ার প্রথম হাতিয়ার তা কে না জানে? সেসব নিয়ে একটা অন্য গল্প হবে ‘খন। কিন্তু, সেই আশ্চর্য রাতে সবার ঘর থেকে আয়না হাওয়া হয়ে যেতে শুরু করল। ভোর হতেই পবিত্র প্রথম খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা। তারপর সুনীতি, তারপর সুভদ্র- কারোর ঘরেই আয়না রইল না। মুশকিল হল যে, অভিনয় ঝালিয়ে নেওয়ার উপায় রইল না কারোর।

 

 

হরষেবিষাদ শহরে শরৎ গায়েব। থাকতেই যে হবে এমন কথাও নেই। কিন্তু, আশা করে থাকত অনেকেই। সেই একবার সরকার থেকে ফতোয়া দিয়েছিল, পরোয়ানার প্রতিটি অক্ষর যে মানবে না তাকে... কেউ কেউ বলেছিল অক্ষরগুলো পাল্টে দেবে। শহরের বেঁটেমোটা কালোকোলো ঘরগুলোয় যারা দিনে ভেজা-খোয়াব আর রাতে শুখা-দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটাত, তাদের সঙ্গে অদ্ভুত-নিবিড় ভাষায় সখ্য গড়ে তুলছিল। কী এক বর্ণপরিচয় লিখছিল তারা। সে এক অন্য গল্প অবশ্য। সরকার থেকে ঠোঁট-সেলাই-করা কানকাটা হাজারখানেক বন্দুকবাজ পাঠানো হয়েছিল। ওদের থেঁৎলে, চোখ ফুটো ক’রে দিয়েছিল। হরষেবিষাদ শহর কাগজে দেখেছিল- মানুষগুলোকে খুঁটোয় বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত খবর ভেতরের পাতায়-  শিক্‌-কাবাবের মতো, লাগোয়া জঙ্গলের অনেক অনেক গাছ কেটে আগুন জ্বালিয়ে, খুঁটোয়-বাঁধা মানুষদের তিনদিন ধরে ঝলসানো হচ্ছে। তাতে এত গরম বেড়ে গেছিল যে, শরৎকাল আসেইনি। তারপর বহু বছর শরৎকাল দেখেনি হরষেবিষাদের লোকেরা। শরৎকাল শব্দটা অভিধান থেকেও কেমন ক্ষয়ে যেতে লাগল, আশ্চর্যজনকভাবে, কাউকে কিছু না জানিয়েই। প্রথমে ‘র’ গিয়ে ‘ল’-এর জায়গাদখল করল। তারপর ‘শ’ ভোল বদলে নিল ‘স’-তে। তারপর ধীরে ধীরে আরও ক্ষইতে থাকল। সবার অভিধানেই। শরৎকাল বলে কিছু রইল না বটে, কিন্তু বলির ঢাক বেজে উঠত মাঝেমাঝেই।

 

 

-বাইরে থেকে কেউ ঢুকে যায় নি তো?

-ইমপসিবল্‌! প্রতিটা সেতু ভাঙা। ভাঙা পাথরগুলোর নিচে মাইন। কাঁটাতারে সায়ানাইড মাখানো।

-যারা অক্ষর পাল্টে দেওয়ার ব্যাদড়ামো করছিল?

-ইন অল প্রোব্যাবিলিটি, ঝলসানো হয়ে গেছে। বাট...

-কী?

-সরকারি চিত্রশিল্পী কারোর পোর্ট্রেট আঁকলেই ওই লোকগুলোর মুখ বসে যাচ্ছে। সেদিন অনিন্দ্যসুন্দরবাবু পোর্ট্রেট আঁকাতে গেছিলেন। কিন্তু, ক্যানভাসে মুখটা অক্ষর-পাল্টানোদের একটার মুখের মতো হয়ে গেল।

-স্ট্রেঞ্জ! চেঞ্জ দ্যাট ইডিয়ট, অ্যাপয়েন্ট আ ফ্রেশ পেইন্টার। হরষেবিষাদ ওন্ট টলারেট সাচ্‌...

-সার্টেনলি। কিন্তু মুখ বদলে গেলেও এই নিয়ে কিচ্ছু গোলমাল হয়নি। যাদের পোর্ট্রেট আঁকছে, তাদের বাড়িতে আর কোনও আয়না নেই। তারা বিশ্বাস ক্ক’রে নিচ্ছে যে, ওটাই তাদের মুখ। দেয়ার ফ্যামিলি মেম্বারস হ্যাভ স্টার্টেড টু অ্যাকসেপ্ট দেম।

-ফেয়ার এনাফ। আর, লেখাটেখা কেমন চলছে?

-মাইথোলজিকাল হরর, ব্লারড হিস্টরিক্যাল নভেল... কবিতায় অ্যাবস্ট্রাক্ট সংকেতের ট্রেন্ড বেড়েছে। আমরা যে র‍্যাডারগুলো লাগিয়েছি, দে আর স্ট্রং এনাফ সংকেতগুলো ধরতে আর ইন্টারপ্রিট করতে। এভরিথিং ইজ ইন অর্ডার।

-যে ইরেজারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ইম্পোর্ট করা হয়েছে?

-হ্যাঁ। এভরিথিং সর্টেড। যাদের শরীর বেআইনি, তাদের অলমোস্ট ইরেজ করা হয়ে গেছে। রেলট্র্যাকে ধুঁকছিল যারা, তাদেরও। যারা বেঁটেমোটা বাড়িগুলোতে ছিল, তাদের ৬০% ডান। ক্ষেতিবাড়ির ঋণ বেড়ে গেছে যাদের, তাদের লিস্ট তৈরি প্রায় কমপ্লিট।

-গ্রেট! বাট ডেভেলপমেন্ট বন্ধ হতে পারে না। রেলট্র্যাক চালু করো। কারখানা খুলে দাও। কনডাক্ট অ্যান ইলেকশন টু সিলেক্ট নিউ কন্ট্র্যাক্টরস- তারপর কন্ট্র্যাক্ট দিয়ে নতুন ওয়ার্কারদের অ্যাপয়েন্ট করবে। এখন আর কোনও অসুখ নেই।

-রাইট। এখানে আর কোনও অসুখ নেই। শরৎকাল উবে যাওয়াটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। ঢাকের রিদম্‌ সেট করা মেশিন তৈরি। মেশিন থেকে সুর ছুঁড়ে দিলে বেঁটেমোটা বাড়ির লোকেরা কাজের মিছিল ভেঙে ঘরে ফিরে হইহল্লা করবে। ক’দিন সুন্দরপানা বাড়িগুলোর দেয়ালে রঙ্গোলি ঝরে ঝরে পড়বে। তাতে এত রঙ যে, বলি শব্দটা ডিকশ্‌নারি থেকে হারিয়ে যাবে, শুধু মায়া রয়ে যাবে। আ ব্যালান্সড প্রসেস।

-ইনডিড। কিন্তু, একটা খচখচে ব্যাপার... এত স্মুদলি সব সর্টেড হয়ে গেলে মিডিয়া এটাকে রিয়াল বলে মানবে না। দে উইল স্পেকুলেট দিইজ অ্যাজ ফিকশন। রিয়ালিটি হবে খাঁজকাটা, রাফ। আয়না-উধাও আর ওয়ার্কারদের বেচাল নিয়ে একটা কিস্‌সা বানালে?

-না, মানে অ্যাকচুয়ালি, সমস্যা একটা আছে। আকাশপ্রদীপ জ্বলে গেছে। নেভানো যাচ্ছে না কিছুতেই। রিসার্চ টিম, অ্যানালিসিস ফ্রন্ট বুঝতে পারছে না। আস্ত একটা নদীর জল পাইপে ভরে ছিটিয়েও নেভানো যায় নি। নটোরিয়াসলি মিস্টিরিয়াস।

-ড্যাম! এসব পাতি ক্রাইসিস। আচ্ছা, রিপোর্টটা একবার ক্রনোলজিক্যালি বলো তো...

 

 

ক-১

ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ছে ওরা। রেলট্র্যাক থেকে। হরষেবিষাদে ফিরছিল। গুমোট, বৃষ্টি নেই। ওরা অনেকজন্ম আগে গেছিল। হঠাৎ শোর উঠল, ভাইরাস ফৈল না যায়ে- ঝুপঝাপ বন্ধ হয়ে গেল আধভাঙ্গা কারখানা, মিয়োনো দোকান, এলানো ক্ষেতিবাড়ি। নিজেদের বেঁটেমোটা ক্ষয়াধোয়া বাড়ির দিকে ফিরছিল ওরা। হরষেবিষাদের সেতুগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রেস্তঁ নেই। বাসি রুটি-আচার আছে, বুকভরা ক্ষিদে। শ্রান্তিও। রেলট্র্যাকে শুয়ে ওরা দেখেছিল একটা বাচ্চা মেয়ে চাঁদ হয়ে নেমে আসছে; জানত না বাচ্চাটা দেড়শো কিলোমিটার হেঁটে এসে বাড়ির সামনেই রক্তবমি ক’রে মরে গেছে। মরে গেলেও চাঁদ হয়ে ঝুলছে আর হাসছে বাচ্চা মেয়েটা। লোরি শোনাচ্ছে। ওই রাতেই হরষেবিষাদের ঘরগুলো থেকে আয়না উধাও হয়ে যাচ্ছিল। ওই হাসি-লোরিতেই ওরা বোঝেনি কখন রেলের চাকায় মুণ্ডু, হাত, পেট, গোড়ালি কাটা গেছে। এর’ম অনেকেরই হয়েছে। একটা বিশাল মিছিলের মতো ফিরছিল সবাই; মাঝে কেউ গলায় দড়ি, কেউ মিথানল, কেউ সানস্ট্রোক। সব মিছিল যে ঘরের নিশ্চিন্তি পাবেই, এমন কথা কোন পাঁজিতে লেখা আছে? তবে, রক্তের দাগ যে বেশিদিন থাকে না, হরষেবিষাদের বিজ্ঞ আয়নাপোষারা তা জানত। ওদিকে ছেঁড়াফাটা কারখানা, ধ্বসে পড়া দোকানপাট, ফুটিফাটা ক্ষেতিবাড়ি ময়ালভঙ্গিতে আবার নড়েচড়ে উঠতেই এরাও সকলে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল। আকাশের তারা খসে খসে নেমে এল, চাঁদ খুলে খুলে নেমে এল, ঢেউ ভেঙ্গেগড়ে আবার কাজের মিছিল ক্ষিধের মিছিল চলল। সে মিছিলের পায়ে পায়ে ধুলো উড়ল খুব। তাদের ঘামে ঘামে সোঁদা গন্ধ ছড়াতে লাগল। অত ধুলো আর সোঁদা গন্ধের মিশেলেই বোধহয় বৃষ্টি নামল। হরষেবিষাদের লোকেরা অনেক স্মৃতি হাঁকড়ে বৃষ্টির স্বাদ-গন্ধ মনে করতে চাইল। সে এক চরাচর উজাড় করা বৃষ্টি। রক্তের শুকনো ছাপ ধুয়ে গেল, পথে-মরাদের গা ভিজে গেল। যাদের শিক-কাবাব বানানো হয়েছিল, তাদের শরীরের যতটুকু শিক-কাবাব না হয়ে ছাই হয়ে গেছিল, সেই ছাইগুলো মাটি-জাগানিয়া বৃষ্টিতে মাটিতে থিতু হয়ে যেতে লাগল। এত বৃষ্টিতে কানকাটা আর ঠোঁট-সেলাইরা কেউ ঠাহর করতে পারে নি অসংখ্য কাকনুস পাখি উড়ে এসেছিল। তাদের শিস করুণ সুরে বইতে লাগল। হরষেবিষাদের বহু লোক অমন অদ্ভুত সুর শুনে শৃঙ্গাররসে ডুবে গেল। এমন সঙ্গম নাকি অনেকরাত তারা করেনি। আশ্চর্য শোকে কাকনুস পাখিদের বুক থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। পথে-মরাদের হাঁ-মুখে পড়ল, রেলে-কাটাদের চোখের গর্তে পড়ল। ছাইয়ের ওপরে পড়ল। কাকনুসরা সেসব মানুষের শরীর আর ছাই থেকে খোয়াব খুঁটে খুঁটে নিয়ে উড়ে চলল। কোনও কোনও কাকনুস প্রায়-ফুরন্ত জঙ্গলের টিঁকে যাওয়া কিছু ঘনবৃক্ষের পাতার আড়ালে বসত বানাল। কাকনুস উড়ে চলল

 

ধরতাই

এর’ম করেই একসময় হেমন্তের অক্ষরগুলোর দূরত্ব বেড়ে যাবে। অনেক আগে এর’ম সময় রাস্তা আর বেঁটেমোটা বাড়ির চালাগুলো ঝরাপাতায় হলুদ হয়ে যেত। লোকেরা ছবি আঁকত, গল্প-কবিতা লিখত সেসবের। কিন্তু, এখন হরষেবিষাদ শহরে পাতা ঝরতেই থাকবে। অবিরাম। নিয়ন্ত্রণহীন। কেমোথেরাপির পরে যেমন চুল উঠে যায়, প্রথমে গোছা গোছা পরে দু-তিনটে, তারপর একটা-একটা ক’রে সব। হরষেবিষাদ শহরে আকাশপ্রদীপ জ্বলে উঠছে। আয়নায় দুধভাতের প্রতিবিম্ব ছিল; আয়নাগুলোই উধাও। আকাশপ্রদীপ জ্বলেই থাকবে। বাচ্চা মেয়েটার হাসি দিয়ে জ্বালানো বলেই নাকি আকাশপ্রদীপ নিভবেনা আর কখনও।

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment