পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

যাদবপুরের পাখিকুল

  • 15 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 786 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
সাগর দেখে, ঝোড়ো হাওয়া বইছে আর একঝাঁক বাবুই পাখি যাদবপুরের আকাশে চক্কর কেটে উড়ছে তো উড়ছে। কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে, কখনও এইট বি বাসস্ট্যাণ্ডের উপর, কখনও সুলেখার দিকে। হঠাৎ খেয়াল করে, পাখিগুলো আর নেই। পরক্ষণে দেখে, সেই পাখির ঝাঁক তাদের গ্রামের বাড়ির পিছনে ক’টা তালগাছের উপরে ঝোড়ো হাওয়ায় আগের মতোই চক্কর দিচ্ছে।

বাতাসের ঝটকায় তালগাছে ঝোলানো তাদের বাসাগুলো বেসামাল। একটু পরে ঝড় থেমে গেলে পাখিগুলো ছন্নছাড়া বাসাগুলো মেরামত করতে লেগে গেল। কেউ ছোটে গাছগাছালির টুকরো যোগাড়ে, কেউ এলোমেলো বাসার সরঞ্জাম নিয়েই মেরামতিতে ব্যস্ত। সাগরের ঘুম ভেঙে যায়। আকাশে রাত্রি শেষের আলো-আঁধারি। তার চোখে ভেসে থাকে তাদের বাড়ির পিছনের বহুদিনের বাবুই পাখির বাসাগুলো। মনে পড়ে গতকাল সন্ধ্যেয় তার আর অনির্বাণের মধ্যে আলাপচারিতার কথা। ভাবে, যাদবপুরের পাখিকুলের কথা, মহীনের ঘোড়াগুলি-র গানের একঝলক কেমন অদ্ভুতভাবে তার স্বপ্নে ধরা দিল।

.

পূর্ব বর্দ্ধমানের ছেলে সাগর। দক্ষিণ কলকাতার কলেজে পড়ছে। সাম্মানিক জৈব রসায়নে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে। দক্ষিণ কলকাতায় গান্ধি কলোনিতে ভাড়া ঘরে থাকত। এপাড়ায় সে ছাড়া আর কোন মুসলিম ভাড়াটিয়া ছিল না। সাগর চৌধুরী নাম শুনে সবাই তাকে হিন্দু ভেবে নিত। আর মুসলিম জেনে অবাক হত-- মুসলিম ছেলের এমন নাম! তবে মুসলিম বলে পাড়ায় কোন অসুবিধা হয়নি কখনও।

      গান্ধি কলোনিতে একবছরের কিছু বেশি সময় আছে, এমন সময় একদিন ঘরমালিক দুম করে বলল, একমাসের মধ্যে ঘর ছাড়তে হবে। বাড়ি ভাঙা পড়বে। নতুন করে বিল্ডিং তৈরি করা হবে।

      ঘর ছাড়তে হবে ভেবে সাগরের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এখানে পরিবেশটা তার পক্ষে স্বস্তির ছিল না। একজনই রুমমেট, সে সিকিউরিটির কাজ করত। ফলে পরস্পরে মনের দূরত্ব থেকে গিয়েছিল। প্রতিদিন হোটেলে খাওয়া, সেটাও পোষাচ্ছিল না। কিন্তু এখন ঘর দেখো, কাছাকাছি কোথাও ঘর মিলবে কিনা, মেস মিলবে কিনা— এদিকের ভাবনাটাও বেশ বিড়ম্বনার বটে।

      পাশের পাড়ায় থাকত তার পরিচিত দু’জন পড়ুয়া। শুভজিৎ ও তনয়। শুভজিৎ ও তার গ্রামের ব্যবধান প্রায় বিশ কিলোমিটার হলেও একই শিক্ষকের কাছে টিউশন পড়ার সুবাদে দুজনের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। তাদের ঘরে গিয়ে জানতে পারল, তারাও ঘর ছাড়বে। তারা নিজেরা রান্না করে। সে’রকম ঘর পেলে তিনজনে একসঙ্গে থাকতে পারবে। সে’মতো তারা খোঁজ শুরু করল।

      সাগর আজাদগড়ে একটা ঘরের সন্ধান পেল। আজাদগড় ও গান্ধি কলোনি কাছাকাছি। সেখান থেকে কলেজ করতে কারো অসুবিধা হবে না। তড়িঘড়ি সে ও শুভজিৎ মিলে ঘর দেখতে গেল।

      ঘরমালিককে সাগর বলল, আমরা তিন বন্ধু মিলে থাকব। সবাই কলেজ স্টুডেন্ট।

      ঘরমালিক বলল, ঘরটা দেখে নাও। চল খুলে দিই।

      ঘর দেখে দুজনেরই বেশ পছন্দ হল। উঠোনের একপ্রান্তে প্রশস্ত ঘর। বারান্দা যেমন আছে, রান্না করার পক্ষে সুবিধাজনক। উঠোনে ডালিম, পেয়ারা ও পেঁপে গাছ আছে একটা করে। টবে নানান সুগন্ধী ফুলগাছ আছে উঠোন আলো করে। সব মিলিয়ে এক ছিমছাম পরিবেশ। সমস্যা একটাই। ঘরের ভাড়া মাসিক সাত হাজার টাকা। তাদের পক্ষে একটু চাপ হয়ে যাবে।

      শুভজিৎ বলল, ঘর আমাদের পছন্দ। কিন্তু ভাড়াটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।

      সে’ নিয়ে কথা বলা যাবে। তার আগে তোমাদের পরিচয়টা জানা দরকার। সঙ্গে আইডেন্টিটি কার্ড-টার্ড আছে?          

      সাগর বলল, আমি সাগর চৌধুরী, বাবার নাম মহতাব উদ্দিন, পূর্ব বর্দ্ধমানে বাড়ি। এ আমার বন্ধু শুভজিৎ ব্যানার্জী, আর একজন তনয় ঘোষ। ঘর ঠিক হয়ে গেলে আমাদের আইডেন্টিটি কার্ডের কপি আপনার হাতে দিয়ে দেব।   

      বাবার নাম মহতাব, মানে মুসলিম। কিন্তু বাবা, মুসলিম ভাড়াটিয়া রাখতে আসুবিধা আছে।

      শুভজিৎ বলল, অসুবিধা হবে কেন? আমরা তো স্টুডেন্ট। ফ্যামিলি হলে না হয়....

      না, না, অসুবিধা আছে। তোমরা বুঝবে না। দিনকাল ভালো নয়। বাকি দু’জন থাকলে থাক।

      কথা না বাড়িয়ে ঘরমালিক ঘরে ঢুকে গেল।

      ফেরার পথে শুভজিৎ বলল, তোর নামটা শুধু বললেই ভাল হত।

      পরে তো জানতে পারত আমি মুসলিম।

      আমার আর তনয়ের আইডেন্টিটি কার্ড দিতাম। তোরটা যা-হোক করে ম্যানেজ করে নেওয়া যেত।

      দূর! পরিচয় লুকানো বাজে ব্যাপার হবে না?

      এদিকে মাস শেষ হতে দশদিন বাকি। ইতিমধ্যে সাগরের ঘরের অন্য ভাড়াটিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। আর ঘরমালিক এসে সাগরকে শুনিয়ে দিল, পরের মাসটা থাকতে হলে ফুল ভাড়া মেটাতে হবে, মানে দু’জনে মিলে যে ভাড়া দিত, সবটাই দিতে হবে। সাগর ভেবেছিল, এ’মাসটা পেরোলে শুভজিৎদের সঙ্গে যদি ক’টা দিন থাকা যায়, কথা বলে দেখবে। সে’ পথও বন্ধ। কেননা শুভজিৎরা তখন ঘর পেয়ে গেছে। সেই ঘরেই শুভজিৎরা গেছে, যেখানে সাগরের ধর্মীয় পরিচিতি বাধ সেধেছে। সেদিন ঘর না পেয়ে ফিরে আসার দু’দিন পর শুভজিৎ সাগরকে বলেছিল, তনয়ের এক ক্লাসমেট সঙ্গে থাকতে চাইছে। সাগর কিছু মনে না করলে তারা ঐ ঘরটা নিতে পারে। সাগর আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। সে ভেবেছিল, একসঙ্গে থাকবে, নিজেরা রান্না করবে, হোটেলে খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেল। কিন্তু শুভজিৎ ঐ ঘর নেওয়ার কথা বলার পর সম্পর্কের জোর দেখাবার মতো কিছু তো অবশিষ্ট ছিল না।

      ইতিমধ্যে সাগর, তার বন্ধু অনির্বাণ ও স্নেহাশিস ঘরের খোঁজ শুরু করেছিল। কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে দুটো ঘরের সন্ধান বিফলে গেল। প্রথমটা ভাড়ায় আটকাল। ঘরের ভাড়া মাসে পাঁচ হাজার টাকা। তার একার পক্ষে যথেষ্ট চাপ। অন্যটায় ভাড়াটিয়া মুসলিম শুনে ঘরমালিক “বাড়িতে আলোচনা করে দেখি” বলে পরে ফোন ধরাই বন্ধ করে দিল। অবশেষে ঠিক হল, মাসের বাকি ক’দিনের মধ্যে ঘর না মিললে সাগর রানীকুঠিতে অনির্বাণদের বাড়িতে উঠবে। ওরা দুই ভাই মিলে এক ঘরে থাকে। ছোট ঘর। তিনজনের থাকার মতো নয়। তবু সেখানেই ম্যানেজ করে নিতে হবে। ঠিক হয়েছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে ঘর না মিললে সাগর আর এক বন্ধুর বাড়িতে ক’দিন থাকবে। সাগর নিজে ভেবে নিয়েছিল, সময় বেশি লাগলে ক’দিনের জন্য বাড়ি চলে যাবে।

 

কলকাতাকে সাগর চিনত না। এখানকার বন্ধুদের মধ্য দিয়েই যতটুকু চিনেছিল। মোটের ওপর সম্প্রীতির কলকাতার ছবিটাই ছিল তার সামনে। বিপরীত অভিজ্ঞতা যে হয়নি, এমন নয়। কলেজে প্রথম দিকে তার সহপাঠীরা কেউই জানত না, সে মুসলিম। কখনও একথা-সে’কথায় হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ এসে যেত। তখন কাউকে কাউকে বলতে শুনেছিল, মুসলিমদের এই দোষ, ওই দোষ, তারা একগুঁয়ে, ধর্মের ব্যাপারে তারা বড্ড বেশি গোঁড়া ইত্যাদি। সাগর বিরুদ্ধ তর্ক করত, কিন্তু নিজের পরিচয় দিত না। সে মজা পেয়েছিল এই দেখে যে, যখন তার পরিচয় সকলে জেনে গেল, তখন সেই নিন্দুকেরা বেজায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল। তারপর তার সামনে মুসলমান সম্পর্কে ভালো বা মন্দ কোন কথা আর বলেনি। এখন তেমনই এক ভেদবুদ্ধির যোগ-সাজশে সাগর বিড়ম্বিত মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে। অনির্বাণ আর স্নেহাশিস বিভেদের রাজনীতির ছায়া দেখে এই জায়গায়। কিন্তু সাগর ভাবে, এটা শুধুই কি রাজনীতির ব্যাপার? এই শহরের আনাচে-কানাচে কোনোভাবে কি উপ্ত ছিল না ভেদবুদ্ধির বীজ?

     দিনে দিনে সাগরের বন্ধুর বাড়িতে ওঠার সম্ভাব্যতা পেকে উঠছিল। সে ভাবল, উদ্বাস্তুর মতো কারো বাড়িতে আস্তানা গাড়া, এ বড়ই বিড়ম্বনা। সে হঠাৎ তার মাকে ফোন করল। বলল, মা, মামার পরিচিত এক মুসলিম ছাত্র কলকাতায় মেসে থাকে বলেছিলে না, গড়িয়াতে? মেসের সবাই মুসলিম।

      সাগরের মা  খাদিজা খাতুন বলল, হ্যাঁ। নিউ গড়িয়াতে।

      মামাকে কথা বলতে বল না, যদি আমার ওখানে থাকা যায়।

      কেন? ঘর পাচ্চিস না?

      ভাবছি, এমন ঘর নেওয়া ভালো, যেখানে সব ভাড়াটিয়াই মুসলিম।

      এরপর সাগর তার মাকে ঘর নিয়ে সমস্যার কথা সবটা বলল। শুনে মা বলল, সেই ভালো, তুই বরং কোন মুসলিম মেসেই থাক। দাঁড়া, তোর মামাকে বলচি আজই।  

      বিষয়টা শুনে মহতাব বলল, সাগর এতদিন যে পরিবেশে থেকেছে, এখন হঠাৎ সেখান থেকে সরে থাকতে চাইছে। বোঝাই যায়, সমস্যাটা ওকে ধাক্কা দিয়েছে।

      সেই ত’। আজমলের পরিচিত এক ছাত্র নিউ গড়িয়াতে মেসে থাকে। সবাই মুসলিম। ওখানে একবার দেখতে বলি।

      বলতে পার। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা-- ওই পরিবেশে গিয়ে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কটার কী হবে।

      কলেজ যাবে, ছুটির দিনে দেখাসাক্ষাৎ হবে। অসুবিধে কোথায়?

     এবার খাদিজা বেশ জোর দিয়েই বলল, ওসব ভেবে কাজ নাই। ছেলে এভাবে মনমরা হয়ে থাকবে? লেখাপড়া করতে গ্যাচে; সেটা মন দিয়ে করতে পারবে না?     

 

.

একটা জেদ নিয়ে সাগরের মুসলিম মেসে আসা যে, মুসলিম বলে যখন ঘর মিলল না, তখন যে ক’দিন কলকাতায় থাকব, মুসলিম হয়েই থাকব। কিন্তু মাস দুয়েকের বেশি তার সে’রকম মুসলিম হয়ে থাকা হল না। এক বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পেতে চেয়ে আর এক বিড়ম্বনায় পড়ল সে। মুসলিম হয়ে থাকার মানে তার কাছে ছিল ব্যক্তিগত জীবনযাপনে আজন্ম পরিচিত মুসলমান সমাজের সামাজিকতার মধ্যে থাকা। কিন্তু যে প্রতিবেশে সে পড়ল, সেখানকার হালত দেখে তার চক্ষুস্থির।                                                                                                                                                    

      সাগর বাদে আর চারজন মেসে আছে। আগে থেকেই সকলে ছিল। তারা যেন বিচ্ছিন্ন এক ছোট্ট দ্বীপের বাসিন্দা। কলকাতার বুকে তাদের মেলামেশা, বন্ধুত্ব বলতে যা-কিছু এই চারজনের মধ্যেই। তিনজন কলেজে পড়ে। একজন, মোস্তাকিন, চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। সপ্তাহে চারদিন কোচিংয়ে যায়। কোচিংয়ের বাইরে আর একটা দিন মানুষের দঙ্গলে বের হয়। সেটা প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে পাড়ার মসজিদে যাওয়া। বাকি সময় ঘরকুনো হয়ে থাকে। দৈনন্দিন জৈবনিক প্রয়োজন মেটানোর বাইরে তার একটিই কাজ— বইপত্রে মুখ গুঁজে থাকা। তার পরিষ্কার কথা, “পয়সা খরচ করে কলকাতায় পড়ে আছি লেখাপড়া আর চাকরির বেটার সুযোগের জন্য। সেটাই আমার ধ্যানজ্ঞান।“ বাকি তিনজনেরও ভাবধারা মোটামুটি এরকমই। তারা কিন্তু নামাজি নয়। এ নিয়ে মোস্তাকিনের আক্ষেপ আছে। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি হতে না পারার ব্যাপারে বাকি তিনজনের অনভ্যাস, পড়াশোনার চাপ, “এ এক ডিফিকাল্ট প্র্যাক্টিস” ইত্যাকার যুক্তির সঙ্গে মোস্তাকিনের বিরোধ নেই।

       ছকবন্দি জীবন সাগরের অপছন্দ। পড়াশোনার বাইরে বন্ধুত্ব, আড্ডাতে তার আপত্তি নেই। পড়াশোনাও ভালোই করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কিছু হয়েছিল। কিন্তু তাতে পরস্পরে না হয়েছিল কোন ভাবান্তর, না থেকেছিল এই বিতর্কে সাগরের তেমন উৎসাহ। 

       তাদের অন্যতর এক ভাবনা নিয়ে সে বড়ই বিব্রত বোধ করত। মেসে গেছে সপ্তাহ দুই হবে, একদিন কলকাতায় মুসলিম ছাত্রদের ঘর পাওয়ার সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে। তারা চারজনই তখন ঘরে ছিল। মোস্তাকিন বলল, কলকাতার বুকে আমরা যেন পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে থাকতে পারি। এখানে আমরা বাইরের লোক। হিন্দুরা আমাদের বন্ধু নয়। মেলামেশা, বিপদ-আপদ, সবেতেই ‘সকলের তরে সকলে আমরা’।

      সাগর প্রথমে একটু হেসেই ফেলল। বলল, নিতান্ত সামাজিক ভাবনার একটা কবিতাকে ধর্মের ছাঁচে ফেললে বেশ। যাইহোক, তোমার বোঝাবুঝি তোমার কাছে। তবে আমরা সবাই ভাইভাই, হিন্দু মোদের কেহ নয়, এই থিওরিটা মানতে পারছি না।

      কেন? এ তো তুমি নিজেকে দিয়েই দেখেছ। মুসলিম বলেই না ঘর ভাড়া পাওনি। কলকাতায় তো এই এক সমস্যা—মুসলিম বলে ঘরভাড়া পাচ্ছে না।

       কিন্তু এও ঠিক যে, আমি এখানে না এলে আমার হিন্দু বন্ধুরাই ঘর খুঁজে দিত।

      তুমিই তো বলেছিলে, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কলকাতায় যা পরিস্থিতি, তাতে মুসলমান মেস মুসলিমদের জন্য ভালো।

      ভাবনাটা এখনও সে’রকমই আছে। তার মানে এই নয়, হিন্দুদের অপর করে ফেলতে হবে।     

      মোস্তাকিনের কথা শুধু তারই কথা নয়, বাকি তিনজনেরও সায় ছিল। সাগর ভেবে নিয়েছিল, ওরা কূপমণ্ডুকতা নিয়ে থাকে থাকুক; এ নিয়ে তার মাথাব্যাথা করে লাভ নেই। প্রতিবেশী সবাই কি মনের মতো হয়? ঘর নিয়ে তার সঙ্গে যা হয়েছে, এরপর কোনো হিন্দু ঘরমালিকের ঘরে ভাড়া থাকতে গিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগান্তির চেয়ে এই ভালো। নিঃসঙ্কোচ, দ্বিধাহীন যাপন।

      কিন্তু দিনে দিনে সাগরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অসংলগ্ন হয়ে পড়ল। ছুটির দিন তার বাইরে গিয়ে আড্ডা  দেওয়া-- তায় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে ও রাত করে ফেরা, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তার উৎসাহ—তায় বামভাবাপন্ন, এসব নিয়ে তারা অসন্তুষ্ট হত, তাদের হাব-ভাবে সে বেশ বুঝতে পারত।

      একদিন অনির্বাণ ও স্নেহাশিস সাগরের ঘরে এল; রবিবার তারা অনেকটা সময় যেমন কাটায়—আড্ডা-গল্প নিয়ে, সেই খেয়ালে। সাগর খেয়াল করল, তার রুমমেট সবার মুখে বিরক্তির ছাপ। অবশ্য ওদের সঙ্গে কেউ সরাসরি খারাপ ব্যবহার করেনি। ওরা কথা বলতে গেলে এরা “হ্যাঁ-হুঁ” করে সেরে দেওয়ায় আর এগোয়নি। সেদিনই সাগর ভেবে নিয়েছিল, এখান থেকে তাকে পাততাড়ি গোটাতে হবে।

      পরদিন থেকেই সাগর ঘরের খোঁজ শুরু করে দিল। এবারের খোঁজটা অভিনব। সে সংকল্প করেছিল, মেস হতে হবে ও ইতিমধ্যে থাকা আবাসিকরা হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে হতে হবে। সাগর সতর্ক ছিল, ঘর দেখতে গিয়ে মুসলিম প্রশ্নে যেন আর বিড়ম্বিত না হতে হয়।

      অনির্বাণ ছাড়া অন্য বন্ধুদের ঘর পেতে সহযোগিতার জন্য সাগর কিছুই বলেনি; পাছে তারা করুণা করে কিংবা তার এই মানসিকতার জন্য তাদের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে যায়। অনির্বাণের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বরাবরই বেশি। তার ঘর পাওয়া নিয়ে অনির্বাণের মধ্যে আন্তরিকতাও দেখেছিল। তাই তাকে নিয়ে দ্বিধা ছিল না। আবার তার মধ্যে জিজ্ঞাসাও থেকে গিয়েছিল যে, তার এই দ্বিধা অহেতুক কিনা। অদ্ভুতভাবে ক’দিনের মধ্যে তার ধন্ধটা আর রইল না, যখন দেখল স্নেহাশিস মজা করে বলছে, “তোর সেক্যুলার মেসের সন্ধান মিলল?“। মনে মনে সাগর আহত হলেও এ নিয়ে কোনো জবাব দেওয়ার ইচ্ছে হয়নি তার। এ নিয়ে যখন অনির্বাণের কাছে আক্ষেপ করল, অনির্বাণ বলল, এটা তো বাজে ব্যাপার। স্নেহাশিসের সঙ্গে কথা বলব। ওকে সমঝে দেওয়া দরকার।

      সাগর বলল, না না, কিছু বলতে হবে না। কী লাভ বলে? সম্পর্কটা যেখানে আনু্ষ্ঠানিক, সেটাকে কচলে কি আর আন্তরিক করা যায়? কলকাতা আমার কাছে খুব ছোট হয়ে গেছে রে; এক-দু’জন অনির্বাণ থাকলেই আমার চলে যাবে।

 

৩.

একমাস পরে সাগরের থার্ড সেমেস্টারের ইন্টারন্যাল পরীক্ষা। অনির্বাণেরও পরীক্ষা আছে। তাই তারা ঘরের সন্ধানে আপাতত ইতি টেনেছিল। কিন্তু হঠাৎ অনির্বাণ ফোন করে বলল, সাগর, ঘর বুঝি হয়ে যায় রে। এইট বি-তে থাকছি। চলে আয়। ঘরটা সুলেখায়। সন্ধ্যের আগেই ঘরমালিকের সঙ্গে কথা বলে নেব। দেরি করিস না।

      ঘরের ভূতটা মাথা থেকে নামা এখন। ওটা এক্জামের পরে হবে।

      জাস্ট একটা ফোন ছাড়া আর কিছু করিনি রে, করেছে যাদবপুর-- যাদবপুরের পাখিকুল।

      মানে? হেঁয়ালি হচ্ছে?

      আয় না, সব বলছি।

      এইট বি বাসস্ট্যাণ্ডে অনির্বাণ আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। কাছের একটা টি ষ্টলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সাগর পৌঁছাতেই বলল, নে, চা খা।

      চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সাগর বলল, কানে শুধুই ভোঁ-ভোঁ; পাখির কলরব কই?

      চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনির্বাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ঐখানে।

      মানে?

      আমার দিদির বন্ধু যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার থেকে একটা ফোন নম্বর পেয়েছে। কাল সন্ধ্যেয় আমাকে নম্বরটা দিল, বলল, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ‘সংবিগ্ন পাখিকুল’ নামে একটা ফোরাম আছে, কিছু পড়ুয়া মিলে বানিয়েছে। ওরা মুসলিম শিক্ষার্থীদের ঘরভাড়া পেতে অসুবিধা হলে অ্যারেঞ্জ করে দিচ্ছে। আজ ফোন করেছিলাম। একটা ফোন নম্বর দিল। বলল, সুলেখায় একটা বেড খালি আছে। কথা বল। ঘরমালিককে দুপুরে ফোন করেছিলাম। যেতে বললেন উনি।

      শেষমেশ ঘরটা হয়েই গেল। দুটো ঘর নিয়ে তিনজন থাকে। তিনজনই ছাত্র। এবার দুয়ে দুয়ে চার হবে। তিনজনে মিলে রান্না করে। সাগরও তাতে জুড়ে যাবে। জাতধর্মের কথায় এক ভাড়াটিয়া বলল, শুধু একটা কথা বলব—মাঝে মাঝে মাংস হবে। নো বীফ, অলওয়েজ চিকেন। আর কিছু নয়/ এই হোক আমাদের পরিচয়।

      একজন জিগ্যেস করল, কবে আসছ?

      সাগর বলল, কাল গোছগাছ করে নেব। পরশু আসব।

      এক প্রসন্নতা নিয়ে দুই বন্ধু পথে পা বাড়াল।

      হাঁটতে হাঁটতে অনির্বাণ বলল, সংবিগ্ন পাখিকুল গানটা শুনেছিস?

      সাগর বলল, এই নামে গান! শুনিনি তো।

      একটা ব্যাণ্ডের গান। মহীনের ঘোড়াগুলি নামে একটা বাংলা গানের ব্যাণ্ড ছিল। দেশের মধ্যে প্রথম রক ব্যাণ্ড। এটার একটা অ্যালবামের নাম সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক। গানটা ঐ অ্যালবামের। গানগুলো আগে শুনেছিলাম। চল্ আমাদের বাড়ি। টিফিন করতে করতে দুজনে শুনব গানগুলো।

      কয়েক কদম এগিয়ে অনির্বাণ বলল, দাঁড়া, একটা কল করি। ঘর মিলল কি না, জানাতে বলেছিল। কল শেষ করে বলল, ভাবছি, ওদের কাজে যতটা পারি সহযোগিতা করব। মুসলিমদের ঘরভাড়া দিতে ইচ্ছুক ঘরমালিকদের তথ্য দিয়ে আর কি। আশা করি, তোকে সঙ্গে পাব।

      সাগর বলল, নিশ্চয়।

      দেখছি, তোর সংকল্পটা কিন্তু শেষমেশ দাঁড়িয়ে গেল। হিন্দু-মুসলিম মিক্সট্ আগে থেকে না হোক, তুই ঢুকে গেলে হয়ে যাচ্ছে।

      তুই হাত বাড়ালি বলেই না....

      না, না, সংবিগ্ন পাখিকুল। 

 

 

    

      

 

     

      

     

 

 

0 Comments

Post Comment