প্রায় তিন'শো বছর আগে জমিদার রাজবল্লভ রায়চৌধুরী এই বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন। বাড়ির সঙ্গে একমাত্র সেই ঐতিহ্যশালী দুর্গাপুজো আজও টিমটিম করে টিকে রয়েছে। আর প্রতিবছর পুজোর কটা দিন এই পরিবারের সদস্যরা বিদেশ বিভুঁইয়ে যে যেখানে থাকেন ছুটে আসেন এখানে।
এই যেমন কানাডা থেকে ছুটে এসেছে এই পরিবারের এই প্রজন্মের ছোট মেয়ে নন্দিনী আর তার একমাত্র কন্যা মীরা। মীরার জন্ম বিদেশের মাটিতে। তবু দুর্গাপুজোর জেরে মেয়েটার বছরে একবার দেশ দেখা হয়। কলেজ পড়ুয়া মেয়েটার দেশের পুজো-আচ্চা,উৎসব অনুষ্ঠানে বেশ আগ্রহ। সবকিছু মন দিয়ে দেখে, তারপর আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়। ক্যামেরা গলায় জমিদার বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়। আর রাশি রাশি ছবি তোলে। ক্যামেরাতে যতটুকু দেশকে ধরে রাখা যায় আরকি!
এই প্রজন্মের এই পরিবারের বড়কর্তা হলেন সুধাংশুরঞ্জন রায়চৌধুরী। ব্যাঙ্গালরে একমাত্র পুত্রের কাছে থাকেন। সপরিবারে হাজির হয়েছেন পুজোর জন্য। তার অনুমতি বিনা এই পুজোর কোন কিছুই হওয়ার জো নেই।
মেজ ছেলে অমিয়রঞ্জন রায়চৌধুরী সিডনিতে থাকেন মেয়ে জামাইয়ের কাছে। তিনিও স্ত্রী এবং মেয়ের পরিবারসহ হাজির হয়েছেন। একমাত্র নাতি দুর্জয়কে জোরজার করে সঙ্গে এনেছেন। তার এসব বিষয়ে কোন আগ্রহই নেই। তার যত আগ্রহ এ জমিদার বাড়ির আর্কিটেকচার নিয়ে। রাজবল্লভ রায়চৌধুরী লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে এ-ই বিশাল জমিদার বাড়ি বানিয়েছিলেন। কী তার গঠনশৈলী, তা আজও দেখার মতো! সে তো তার বড়দাদুকে একবার বলেই ফেলল,"আচ্ছা দাদু, এ-ই বাড়িটাকে রেনোভেট করে হোটেল খুললে কেমন হয়?"
যার যে দিকে ধান্দা! যাইহোক, আগামীকাল ষষ্ঠী। শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। কূল শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ এ বাড়ির রীতি অনুযায়ী একচালার মায়ের মূর্তি গড়েছেন। বংশপরম্পরায় তারাই মূর্তি গড়ার কাজটা করে আসছেন। কূল পুরোহিত শিবনারায়ণ চক্রবর্ত্তী মশাইও হাতে হাত মিলিয়ে তাকে সাহায্য করছেন। কাল থেকে তিনি চূড়ান্ত ব্যস্ত থাকবেন। একা হাতে পুজো। আগে এ বাড়ির পুজো ডজনখানেক পুরোহিত মিলে সামাল দিত। এখন একে ঠেকেছে। এরই মধ্যে ছোকরা গোচের একজন কাজের লোক এসে বলল,"বড় বাবু আপনারে ডাকতেছে। বললেন এক্ষুনি শিবুকে ডাক। দেরি করলে হবে নে, এক্ষুনি চলেন।"
- "বল গিয়ে যাচ্ছি।"
ঠাকুর মশাই মায়ের সাজসজ্জা ঠিকঠাক করে শেষ মুহূর্তের কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে এলেন ঠাকুর দালান থেকে।
- "বড়কর্তাবাবু আমায় ডাকতে ছিলেন?"
- "কখন ডেকেছি। এতক্ষণে তোমার আসার সময় হল।"
-"বাবু আসলে একা হাতে সব কাজ তো...।"
- " তোমাদের সব তৈরী তো?"
- " হ্যাঁ বাবু, শুধু... "
- " শুধু কী?"
- "আমাদের পুরানো ঢাকি শঙ্করকে খবর দেওয়া হয়েছিল। এখনো আসেনি।"
- " কাল পুজো, এখনো ঢাকি আসেনি! কী করো কী?"
- "আসলে বাবু ও খবর দিয়েছে, শরীরটা ওর ভাল যাচ্ছে না। কাল সকালে আসবে হয়ত।"
- " কাল না আসলে তুমি দায়িত্ব নেবে, এই বলে দিলাম!"
ঠাকুর মশাই ঘাড় নেড়ে কোনরকমে সরে পড়লেন। বাইরে বেরিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন, "কাল ভালই ভালই শঙ্করটা এলে হয়। জমিদার বাড়ির পুজোতে তোর বাপ-ঠাকুরদারাও ঢাক বাজিয়েছে। আর এই তুই যে কী করিস!"
পরদিন সকালে ষষ্ঠীর পুজোর তোড়জোড় চলছে। বড় গিন্নিমা, মেজ গিন্নিমা,ছোট দিদিমনি এবং বউমারা ষষ্ঠীর অঞ্জলি দেবে সন্তানের মঙ্গল কামনায়। মীরাও সেজেগুজে প্রস্তুত ছবি তোলার জন্য। সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ বড়কর্তার হুংকারে ঠাকুর মশাই তটস্থ হয়ে পড়লেন! "কী রে শিবু, জমিদার বাড়ির পুজো চলছে অথচ ঢাকি নেই! ভালোই আছিস তোরা। যতসব অকম্মের ঢেঁকি। তুই না বল্লি আজ সকালে সে আসবে। কোথায় গেল?"
-"আমি দেখছি বাবু,একটু সময় দেন। পুজো শুরু করে দিয়ছি তো, মায়েরা অঞ্জলিটা দিয়ে নিক।"
বড়কর্তা আর কিছু বললেন না। গটগট করে চলে গেলেন।
ষষ্ঠীর পুজো শেষ করে সেই যে ঠাকুর মশাই বেরিয়েছেন সন্ধে হতে চলল তার দেখা নেই। আগামীকাল সপ্তমী পুজোর প্রস্তুতি লাগবে। তাছাড়া সপ্তমী থেকে নবমী নিশি পর্যন্ত এ বাড়িতে আজও নিয়ম মেনে প্রতিদিন ছাগ বলি দেওয়া হয়। বড়কর্তার কানে কথা না গেলেও বড়গিন্নিমা খোঁজ নিয়ে গেছেন ঠাকুর মশাই ফিরেছেন কিনা!
সন্ধের পর ঠাকুর মশাই গেলেন বড়গিন্নিমার ঘরে। "আজ্ঞে আমায় ডেকে ছিলেন?"
-"সারা দিন বেপাত্তা হয়ে কোথায় ঘুরে বেড়ালেন?"
- " ঢাকির খোঁজে।"
- " পেলেন?"
- " আসলে চারিদিকে এখন অনেক বারোয়ারী পুজো হয়। তাছাড়া ষষ্ঠীর পরে ঢাকি পাওয়া মুশকিল। যারা এখানে পুজো পায় না তারা আগেই সব শহরে চলে যায়।"
- " এখন উপায়?"
- " শঙ্করের বাড়িও গিছলাম। ও বলল কাল কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবে।"
-"কেন ওর কী হল?"
-"ও তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না গিন্নিমা!"
- " যাই কর গে, কাল যদি পুজোর আগে ঢাকি না আসে তোমাদের বড়কর্তাবাবু কিন্তু কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। মনে রেখো!"
ঠাকুর মশাই নিঃশব্দে বিদায় নিলেন। যেতে যেতে গজগজ করছেন,"ঢাকি নেই তো আমি কী করব? যত দায় কী আমার? সারাবছর কারোর খোঁজ পাওয়া যায় না। পুজোর কটা দিন এসে যত হম্বিতম্বি। সারাবছর গাঁয়ে গঞ্জের এ-ই মানুষগুলোর কী করে চলে তার খোঁজ কে নেবে? এদের চোদ্দপুরুষের জীবন তো এ-ই বাড়িতেই কেটে গেল। এখন তো ওদের না খেয়ে মরার দশা!"
ঠাকুর মশাই দৌড়ে ঢুকলেন ঠাকুর দালানে। তার নাতি এখন তার অবর্তমানে সব হাতের কাজ সেরে রাখে। সারাদিন খুব ঝামেলায় কাটলেও হাতের পাঁচ এ-ই নাতি আর তার গোছানো কাজকম্ম দেখে ঠাকুর মশাইয়ের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে তার মনে কী যেন এক প্রশান্তি নেমে এল! মায়ের কাছে জোড় হাত করে তিনি মিনতি করলেন,"মা গো সারাজীবন তো তোর সেবায় কাটালুম। তোর সেবার জন্যি আজ সারাদিন হন্যে হয়ে বেড়ালুম। কিছু একটা ব্যবস্থা করিস মা। না হলে এ বুড়ো বয়সে যে আর কথা শুনতে পারিনে মা গো!"
রাত হলে জমিদার বাড়িটা কেমন যেন ভূতুড়ে মনে হয়। কত অজানা কাহিনির অশরীরী চরিত্ররা জেগে ওঠে। দোতলার সিঁড়ির কাছটায় গিয়ে ঠাকুর মশাই দাঁড়িয়ে পড়ে। কে যেন উপর দিকে উঠে গেল! জুতো মসমসিয়ে পাশের শব্দ। অথচ দোতলাটা কত যুগ বন্ধ পড়ে আছে। গা ছমছম করে উঠে তার। ঈশান কোণে বটগাছটাতে পেঁচা ডেকে ওঠে ক্যাঁ...ক্যাঁ...করে। দেওড়ির দিকে না গিয়ে ফিরে যান দুর্গা দালানে।
ঠাকুর মশাইয়ের মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। বাপ-ঠাকুরদার মুখে শোনা কত গল্প। কত জাঁকজমক ছিল তখনকার পুজোয়। সপ্তমী থেকে নবমী নিশি পর্যন্ত প্রতিদিন নিয়ম মেনে একশ একটা ছাগ বলি হোত। রাতদিন আলাদা করা যেত না। সাত গাঁয়ের লোক খেত পাতপেড়ে। প্রজারা দুঃখ-কষ্ট ভুলে মেতে থাকত এই কটা দিন।সাহেবেরা পর্যন্ত এই জমিদার বাড়ির দুর্গামায়ের পুজোয় আসত। অবাক বিস্ময়ে মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকত! বিষন্ন মনে অন্ধকারে ডুবে থাকা জমিদার বাড়িটার দিকে মুখ তুলে তাকালেন ঠাকুর মশাই। নিশি ফুরোলে সপ্তমীর সকাল।
ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাঢ্যাং ঢ্যাং...। দুর্গা দালানে ঢাক বেজে ওঠে। সাতসকালে ঢাকের শব্দে বড়কর্তা বেরিয়ে আসেন। "যাক, শিবুটা তাহলে একটা ব্যবস্থা করেছে দেখছি।" বলতে বলতে চলে এলেন দুর্গা দালানে। চমকে উঠেন,"এ কে? শঙ্কর কোথায়? শিবু... শিবু...,এ-ই তোর ব্যবস্থা।তুই জমিদার বাড়ির রীতি রেওয়াজ জানিস না!"
ঠাকুর মশাই হাতের কাজ ফেলে কাঁচুমাচু মুখে দৌড়ে আসেন। কী উত্তর দেবেন ভেবে পান না। নিজেও বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন ঢাকির দিকে!
বড়বাবুর চিৎকার চেঁচামেচিতে ঢাকের আওয়াজ কখন থেমে গেছে। ঢাকি বেচারি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। বাড়ির বাকি লোকজনও এতক্ষণে জড়ো হয়েছে ঠাকুর দালানে। সকলেই প্রায় বিস্মিত নয়নে দেখছে ঢাকিকে!
বেঁটেখাটো দোহারা চেহারা। গায়ের রং চাপা কৃষ্ণ বর্ণ। পরণে সুতির ডুরে শাড়ি। হাতে শাঁখা পলা। সিঁথিতে ঘন করে সিঁদুর লেপা, কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। আঁচলটা পেঁচিয়ে কোমরে শক্ত করে বাঁধা। কাঁধে ঝোলানো মস্ত ঢাক। দু'হাতে ঢাকের কাঠি।
এতক্ষণে ঠাকুর মশাই মুখে রা কাড়লেন, "বড়কর্তাবাবু ও আমাদের পুরাতন ঢাকি শঙ্করের স্ত্রী,জয়া। সে বলেছিল কিছু একটা ব্যবস্থা করবে,কিন্তু...।"
আবারও কর্তাবাবু চিৎকার করে উঠেন,"কিন্তু কী? রাখ তোর যত ছেঁদো কথা। এ-ই তোর ব্যবস্থা। কত পুরুষ ধরে তোরা এ বাড়ির পুজো করছিস? জানিস না এ বাড়ির নিয়মকানুন। তাহলে এসব অনাসৃষ্টি কেন?"
বড়গিন্নিমা এতক্ষণে বলার মত যুতসই কিছু একটা পেয়েছেন। "এতে আমাদের অকল্যাণ হবে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।"
এবার এগিয়ে এল ঢাকি।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গ্রাম্য সহজ সরল মানুষটি বলতে শুরু করল,"সেই কোন ছোটবেলা থেকে মায়ের পুজো দেখছি। শুনেছি - স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল... এই ত্রিলোককে মহিষাসুরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেবতারা তাদের সমস্ত অস্ত্র মা দুর্গার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মা তাঁর দশ হাতে সেই অস্ত্র ধারণ করে মহিষাসুরকে বধ করে ছিলেন। দেবতারা যে কাজ করতে পারেননি একজন নারী সেই কাজ করেছিলেন। আমরা সে-ই আদি শক্তি মহামায়ার পুজো করি, তাই না বাবু? আর আমি তো সামান্য একজন...। অসুস্থ স্বামী, সন্তান, সংসার রক্ষার জন্য এই দু'হাতে না হয় ঢাকের কাঠিই তুলে নিলুম!"
বড়কর্তাবাবু কোন উত্তর দিতে পারেন না। গ্রাম্য বধূটির দু'চোখে যেন আগুনের ছটা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন না। মুখ ফেরান মায়ের দিকে।
ঠাকুর মশাই সপ্তমী পুজোর মন্ত্র পড়তে শুরু করেন। ঢাক বেজে ওঠে, ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাঢ্যাং ঢ্যাং...।