দিবাকরের পিতামহ রাইচরণ শিউলির দাপুটে জমিদারের কাচারীতে ফাই ফরমাস খাটার কাজ করতেন। সেই সময়
শিউলির জমিদার বাবুরা এতটাই দাপুটে ছিলেন, ঠিক যেন বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর মতো ভয়ঙ্কর।
ঠিক সেইরকমই। কিন্ত রাইচরণ ছিলেন অতি সাধারণ মাপের সরল সাদাসিধে মানুষ। সৎ প্রকৃতির। বিশ্বাসী ও আস্থা ভাজন। তার চেহারাও ছিল একেবারেই সাদামাটা। সাধারণত তিনি হাঁটুর সামান্য নিচে ধুতি পরতেন। কাছা দিয়ে । ধুতির একপ্রান্ত বেশ কিছুটা টেনে কোমরে পেচিয়ে বাঁধতেন। তার উপর একটা ফতুয়া ধরনেরই খাটো জামা। জুতো তিনি কখোনো পরতেন না। না খুব উচুঁ লম্বা, আবার না বেটে খাটো, মাঝারি চেহারার মানুষ ছিলেন রাইচরণ। তবে তিনি খুবই নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে সব কাজ করতে ভালোবাসতেন।
কখনো কোনো কাজে ফাঁকি দিতেন না। সেই কারণে বাবুদের কাছারির কাজের সঙ্গে বাবুদের ভিতর বাড়ির, এমন কী অন্দর মহলের মেয়েদের অনেক ফাইফরমাসের ও কাজ করতে হত। সে দিনে হোক বা রাতেই হোক। রাইচরণের এতটা নিষ্ঠা ও একাগ্রতার জন্য সকলেই তাঁকে ভালবাসতেন। বাবুদের বাড়ির পুজো-আর্চা, বিবাহ, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ-শান্তি জাগ- যজ্ঞের সবকিছুতেই তিনি ডাক পেতেন। শুধুমাত্র ডাক পাওয়া নয়। অনুষ্ঠানাদির ভালো ভালো খাবার পেতেন। নিজের জন্য এমনকি বাড়ির বাকি সকলের জন্যও মাঝে মধ্যে দেয়া হত। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় নতুন জামা, কাপড়, জুতোর সঙ্গে ভালো বকশিশ ও পেতেন রাইচরণ। একেবারে যাকে বলে সোনায় সোহাগা। বাবুদের বাড়ি ও কাছারিতে এমন সুখের চাকরির জন্য রাইচণের সংসারে কোনো অভাব অনটন তো ছিলোই না উপরন্তু বেশ স্বচ্ছলতার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে দিন কেটে যাচ্ছিল।
কিন্তু রাইচরণের সহজ সরল স্বাভাবিকতার মধ্যেও সুপ্ত ছিল এক অন্তর্নিহিত জেদি প্রকৃতির স্বভাব। সেই জেদী প্রকৃতি স্বভাবের জন্যোই যৎসামান্য কারনে রাইচরণ বাবুদের কাছারি ও বাড়ির কাজ ছেড়ে দিলেন। স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের কোনো কথাই তিনি শুনলেন না। এমনকি আত্মীয়, বন্ধু, পাড়া পড়শি হিতৈষীদের ও অনুরোধের ও মান্যতা দিলেন না।
সেই যৎসামান্য কারণটা কী ছিল?পরবর্তী অধ্যায়ে বলছি সেই প্রসঙ্গে ।
দুই।।
সেই সামান্য কারণটা হলো রাইচরণের মিতে ভুবন মালোর ছেলে অভিমন্যু । অভিমন্যুর জন্যই।
সেইসময় শিউলি নদী ছিল খুবই পয়মন্ত। জোয়ার ভাটার নদী ছিল। জোয়ারের সময় দুকূল ছাপিয়ে জোয়ারের জল থৈ থৈ করত জনবসতির প্রান্তসীমায়। আবার ভাটার সময় জল অনেক নিচে নেমে গিয়ে পলিমাটির চর জেগে উঠতো। জোয়ার ভাটার খরস্রোতার জন্য ছোট বড়ো অনেক যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌকা অনেক রঙিন পাল তুলে চলে যেত অনেক দুর দুরান্তে। নৌকার মাঝিরা পাল তুলে, হাল ধরে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে চলে যেত।
"আমার বাড়ি যাইওরে বন্ধু এই না বরাবর।
খাজুর গাইচা বাড়ি আমার পূবদূয়ারী ঘর।।
আমার বাড়ি গেইলে বন্ধু বসতে দিবাম পিড়া।
জলপান যে করতে দিবাম শালীধানের চিড়া।।"
নৌকায় বসে সুর করে গান গাইতে গাইতে চলে যাবার পরও সেই সুরের রেশ আর তার লয় থেকে যেত বাতাসে।
আবার দেখেছি উজানের বিপরিতে ভারি ভারি গোলপাতা, ধান, পাট বা অন্যান্য সামগ্রী বোঝাইয়ের ভারি নৌযানকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কী অমানবিক পরিশ্রমে গুণ টেনে নিয়ে যেতে। গুণ হচ্ছে নৌকার মাস্তুলের সঙ্গে একপ্রান্ত বাঁধা শক্ত মোটা লম্বা দড়ির অন্য প্রান্তে দুজন মালকোচা মারা খালি গায়ের মানুষকে। দড়ির সঙ্গে বাঁধা লাঠি কাঁধে নিয়ে ভারী বোঝাই নৌকাকে টেনে নিয়ে যেতে তাদের কালঘাম ছুটে যেত।
তিন।।
ভুবন দাসমালো ছিলেন মালো পাড়ার মাতব্বর। একজন গণ্যমাণ্য অবস্থাপন্ন ধনাঢ্য পরিবারের। বাচাড়ি নৌকায় করে বিশালাকার বাচাড়ি জাল নিয়ে সদলবলে উপকূল- সমুদ্রে মাছ ধরার সাহসিকতা ও অভিজ্ঞতার কারণে তিনি প্রচুর মাছ ধরার কারণেই নিজেই নিজের ভাগ্যকে সাবলম্বী করে তোলেন। মালো পাড়ার মধ্যে আটচালা টিনের দোতলা ঘর তৈরি করেন। সদরে দেবী বিষহরির
মন্দির। প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে খুবই জাকজমক করে পুজোও হতো। গ্রামের সমস্ত মানুষদের পাত পেতে খাওয়াতেন ভূবন মালো। শীতকালে গরীব দুঃখীদের শীতবস্ত্র দান করতেন। সেই ভূবন মালোর তিন মেয়ের পর এক ছেলে হলে তার নাম রাখা হয় অভিমন্যু।
সেইসময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইংরেজ আমলে জমিদার বাড়ির সদর দেউড়ির সামনে দিয়ে গ্রামের কোনো সাধারণ হিন্দু মুসলিম বা কোনো নিম্ন বর্ণের মানুষজন জামা জুতো পরে,ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে আসতে পারতো না। কালেভদ্রে কেউ সেরকম দুঃসাহস দেখালে তার চরম শাস্তি পেতে হত। নাকে খত দেওয়া থেকে শুরু করে কান টানা। মাথার চুল কামিয়ে দেওয়া। দেউড়ির সামনে ঝাউগাছে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। পরে প্রকাশ্যে বাবুদের পেয়াদা দিয়ে বেত মারার জন্য। না হয় দুপুরের ঠাটাপোড়া রোদ্দুরে চোদ্দ পোয়া দিয়ে সূর্যর দিকে মুখ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। সর্বপরি জরিমানা ধার্য। এইভাবে যে কতজন কতভাবে নির্যতিত হয়েছেন তার কোনো হিসেব নিকেশ নেই বাবুদের মহাফেজখানায়।
সেটাই ছিল দস্তুর। সেই ভয়ে সে রকম দুঃসাহস কেউ দেখাতেন না।
চার।।
মালোপাড়ার মানুষেরা মনে হয় সে কথা ভূলে গেছিল। হয়তো বা সেই কারণেই ভুবন মালোর ছেলে অভিমন্যু শার্ট প্যান্ট পরে, জুতো মোজা পরে, কব্জিতে রিস্ট ওয়াচ বেঁধে চোখে রোদচশমা দিয়ে হাম্বার সাইকেল চালিয়ে শিউলি গাঁয়ের মালো পাড়ার খেয়াঘাট থেকে মহাকুমা সদর সদরগঞ্জে যাওয়া আসা করতে থাকে। যেন কোনো পরোয়া নেই কাউকে। সুদর্শন অভিমন্যু এইভাবে কয়েক দিন সাইকেল চালিয়ে শহরে যাওয়া আসার পর একদিন জমিদার বাড়ির অট্টালিকার দোতলার ঘুলঘুলির উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে, পায়ের আঙুলের ভরে দাঁড়িয়ে অভিমন্যু কে প্রথম দেখতে পায় মেজ বাবুর মেয়ে।ষোলো পেরিয়ে আঠারো কি উনিশের দোলনচাঁপা। শূধু দেখতে পাওয়া নয়। এইরকম সাহসিকতার জন্য ও তার আয়ত দুচোখে বিস্ময় আর কৌতূহল জাগে। সে তাদের বাড়ির পরিচারিকা যশোদার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতেও চায় অভমন্যুর পরিচয়।
পাঁচ ।।
সে সংবাদ দাপুটে জমিদার বাবুদের বাড়ির অন্দরমহল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে ও বেশি দেরি হয় না। তারপরই বাবুদের টনক নড়ে। জরুরি তলব করা হয় পেয়াদাদের সর্দার কালাচাঁদ কে। মেদহীন শক্ত সমর্থ চেহারা কালাচাঁদ ওরফে কালু সর্দার। হতে লম্বা পাকা বাঁশের লাঠি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পাকানো গোঁফ। সে এসে সেলাম জানালে কর্তাবাবু তাকে অপেক্ষা করতে বলেন।
রাতের অন্ধকারেই কাজ হয়ে যায়। মানে অভিমন্যু দাসমালোকে বাড়ি থেকে তুলে এনে দেউড়ির ঝাউগাছে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পরদিন সকালে তার বিচার ও শাস্তির জন্য ।
সেই রাত্রির মধ্যেই ভূবন মালো ও তৎপর হয়ে ওঠেন। তারও বুদ্ধু সর্দার ও তারও একটা দল আছে। রাত বিরাতে চোর, ডাকাত, বাটপারদের দৌরাত্ম্য থেকে আত্মরক্ষার জন্য। সেই সঙ্গে মালো পাড়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় অভিমন্যুকে তুলে নিয়ে যাবার খবর ।আশেপাশের শেখপাড়া, মণ্ডলপাড়া, ও বাগদিপাড়ায় খবর জানাজানি হতেই সকলে ছুটে আসে হাতের কাছে বাঁশ, লাঠি, চেলাকাঠ যে যা পায় তুলে নিয়ে। রাত ভোর হবার অনেক আগেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ভূবন মালো তার ছেলেকে কালু সরদারকে পরাস্ত করে ঝাউগাছ পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রেখে অভিমন্যুকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। মহকুমা সদর থানায় সে খবর পৌঁছে যেতেই শিউলি গ্রামে দাঙ্গা বেঁধে যাবার আশঙ্কায় সেপাইদের মোতায়েন রাখা হয়।
এই ঘটনার পর বুদ্ধু সর্দার নিখোঁজ হয়ে যায়। তিনদিন পরে তাঁর মৃতদেহ নদীর চরে ভেসে এসে আটকে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে আসে মৃতদেহ দেখতে। আসে থানার পুলিশও।
ছয়।।
এই ঘটনার পর রাইচরণ স্বেচ্ছায় জমিদারের সেরেস্তার কাজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু রাইচরণের কাজ ছেড়ে দেবার সঠিক কারণটা জানতে না পারলেও বাবুরা কিছু একটা অনুমান করতে পারছিলেন বিভিন্ন জনের কানাঘুষায়। রাইচরণের মতো এমন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী কর্মচারীকে বিনা কারণে কর্মচ্যুত করতে চাইছিলেন না। সেই জন্যে বাবুরা রাইচরণের খবর জানার জন্য তাদের বিশ্বস্ত পেয়াদা হরিচরণ কে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়।। হরিচরণের কাছে রাইচরণের জমিদারের কাছারির কাজ ছেড়ে দেবার কারণটা একটু বেশি মাত্রায় অতিরঞ্জিত মনে হয়। হরিচরণ বাবুদের কান ভারি করে। তার ফলে রাইচরণের যৎসামান্য জমির পাকা ধান কে বা কারা কেটে নিয়ে যায়। বাপ, ঠাকুরদার আমলের জমিটুকু ও বেদখল হয়ে যায়। বাগানের বাঁশ ঝাড়ের বাঁশও কেটে নিয়ে যেতে লাগে বাবুদের অনুগত লোকজনেরা। নারকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল সব ফল, ফলাদিও যে যার খুশি মত পেড়ে নিতে লাগে।
এতসবের পর রাইচরণের আত্মীয়- বন্ধু, পাড়া - প্রতিবেশীরা রাইচরনকে বলে, জলে বাস করে তুমি কুমীরের সঙ্গে বিবাদে করে বাঁচতে পারবে না। তুমি বরং কর্তা বাবুর হাতেপায়ে ধরে আমার চেয়ে বাবুদের সেরেস্তার কাজে পুনরায় বহাল হয়ে যাও। না হলে তুমি তোমার ছেলেমেয়ে নিয়ে এই গ্রামে বসবাস করতে পারবে না। রাইচরণ তাঁর বন্ধু, আত্মীয়- পরিজনদের কথায় গুরুত্ব দিলেন না।
উপরন্তু তিনি তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলেন।
সাত।।
যার ফলে রাইচরণের আত্মীয়, বন্ধু আর পাড়া প্রতিবেশীদের কথার সত্যতা প্রমাণ হয়। রাইচরণ সত্যি সত্যি একদিন নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ বলে, রাইচরণকে কুমিরে টেনে নিয়ে গেইছে। সে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।