চাদ্দিকে চোর চোর রবের মধ্যে সোনাদার যেটুকু সুনাম রয়েছে তার ওপর ভরসা করেই এ গাঁয়ের সে গাঁয়ের জনা সাত, ২৫ থেকে ৩৫এর জনা সাত, একদিন সকাল করে সোনাদার সঙ্গে দেখা করতে এল। সোনাদার কাউকে কাউকে চেনা লাগল, তবে কেউ কেউ অচেনা।
এমনিতে আগে লোকজন সেভাবে ধারেকাছে ঘেঁষত না, এমেলে হবার পরে কাছ থেকে দূর থেকে একজন দুজন করে আসতে শুরু করেছে। সার্টিফিকেট, অ্যাটেস্টেশন, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্য সাথী, বিধবা পেনশন, আবাসন প্রকল্প, পারিবারিক সমস্যার জন্যে পরামর্শ--- এইরকম অজস্র। এসব নিয়ে সোনাদা আজকাল ব্যস্তই থাকে। তাছাড়া মিটিংএ মিটিংএ ডাক পড়ে। সেজন্যে খবরের কাগজ, নেতাজি, রবিঠাকুর, স্বাধীনতা দিবস--- সময় বের করে একটু-আধটু পড়ে নিতে হয়। সোনাদার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার, ছোট ছোট কথা সহজভাবে আর অল্প সময়ে গুছিয়ে বলা কীভাবে যেন শিখে নিয়েছে। শ্রোতারা সবাই মন দিয়ে শোনেও।
সোনাদা বলরামকে চিনত। বলরামের কাকা তার সহপাঠী ছিল। অন্য পার্টি করত। সুযোগ বুঝে বাড়ির সবকে স্কুলে স্কুলে ঢুকিয়েছিল। টিচার। আর নয়ত ক্লার্ক। চাকরি চাকরিই। বলরাম ততদিনে স্কুল ডিঙোয়নি। বলরামের জন্যে তাই কিচ্ছু করতে পারেনি।
বলরামই মুখ খুলল, স্যার!
সোনাদাকে এখন কেউ কেউ স্যার বলে। সোনাদার কেমন যেন লাগে। দাদা, কাকা, মামা--- সম্বোধনগুলিতে কেমন আন্তরিকতা ছিল। সব পুরনো হয়ে গেছে। স্মার্টফোনের ছেলেমেয়েরা এসব এখন বলেই না।
বলরাম বলল, স্যার! আমরা বড়ো বিপদে পড়ে এসেছি।
পাপোষে একটা কালোয়-শাদায় বেড়াল। হাই তুলল। হাত-পা সামনে-পেছনে মেলে দিল। তারপর উবু হয়ে বসে শব্দ করল, ম্যাও।
সোনাদা লক্ষ করল ভিড়ের ভেতর জড়সড় হয়ে একটি মেয়ে। ব্লকের বাজারে মাছ নিয়ে বসে গোকুলদা, তারই মেয়ে। সোনাদা বলল, তুই রাধু না?
মেয়েটি বলল, বাবা তোমার কাছেই পাঠাল। তুমি একটা উপায় বের করো।
লম্বা টানা বারান্দা। পশ্চিম প্রান্ত শেষ হতে এইচ পি সিলিন্ডার। তার গায়ে ছোটমতো রান্নাশাল। পুবের দিকে আকাশি রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। গোটা তিনেক। প্লাস্টিকের টেবিল। একটা চেয়ারে সোনাদা বসে। গায়ে অল্প শাদা ফতুয়া। ফতুয়ার কিনারা দিয়ে চশমা মুছল সে। সামনে চাটাই পাতা। ছেলেমেয়েদের সোনাদা সেখানেই বসতে বলল।
তুমাদের কী প্রব্লেম?
রাধু বলল, বলাদা, তুমি বলো।
অন্যরাও চাইল বলরামই বলুক।
বলরাম বলল, স্যার, আপনার কিন্তু সকল কথাই জানা। গেঁড়িদহ। তার পঞ্চাৎপ্রধান আমরাদের কাছ থাকতে টাকা নিল। চাকরি দিবে বলে। প্রাইমারি টিচার।
সোনাদার ভ্রূ কুঁচকাল, সে চাকরি হল? সে চাকরি তো হবার না।
ইলশেগুড়ি শুরু হয়েছে। আকাশে মেঘ। ছায়াচ্ছন্ন চারপাশ।
রাধু বলল, আমরা বলনু টাকা ফিরত।
সোনাদা বলল, টাকা দিবার টাইম আমাকে বলবার দরকার লাগে নাই।
ছেলেমেয়েরা মুখ নিচু করে বসে।
সোনাদা বলল, টাকা দিছ কাগজে লিখা আছে?
ছেলেমেয়েরা মুখ নিচু করে বসে।
সোনাদা বলল, আমার কী করবার?
বলরাম মুখ তুলল, আপনাদের পার্টির লিডার। আপনি একবার…
আমি একবার? কী করব? সে দেখছু পাকা দালান হাঁকছে, বিজিনেসম্যানের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়া দিছে, নিজের বেটার মোটর বাইক, আর কী কী করছে জানা নাই।
বলরামের পাশে বসেছে অনির্বাণ। সে এবার বলল, স্যার, আপনি রাস্তা বাতলে দিন আমরাদের কী করা লাগে।
একজন বলল, অতগুলান টাকা। আমোরা গরিব মানুষ।
অতগুলান টাকা! তার কাছে ফিরত মাগো। মাগলে?
রাধু বলল, তার ঘরে তালা। সে কুথা পালাল।
পালাল?
তার ঘরে সব টাইম তালা।
সবাই সোনাদার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। আশা করছে সোনাদা কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। পাঁচ লাখ, সাত লাখ। মেলা টাকা। প্রদীপের বাপ জমি বেচেছে। আলির বাপ জমি বেচেছে। দিলীপের বাপ জামাইএর কাছ থেকে কর্জ করেছে। সবাইকার থমথমে মুখ।
সোনাদা রাস্তা খুঁজে পায় না। মাথায় চুল নেই। সেখানেই হাত দিয়ে রগড়াতে থাকে। বলল, এমন আহাম্মকি কেউ করে?
বলেই ভাবল ভুল কথা। বহু মানুষই তো চাকরির জন্যে টাকা দিয়েছে। টাকা দিয়ে হায় হায় করছে। তার পার্টির লিডাররাই ছেলেমেয়েদের এইভাবে ঠকিয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি চাকরি কেউই পাবে বলে মনে হচ্ছে না। সোনাদা গেঁড়িদহের পঞ্চাৎপ্রধানকে দেখেছে হয়ত। মিটিং-মিছিলে দেখে থাকবে। চেনে হয়ত। তার মুখটা অন্তত চেনে।
এমন সময় সোনাদার ছেলে এল। বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে বলল, ওলকপিগুলান তুলবার লাগবে। দেরি হতিছে।
সোনাদা বলল, কাল সকালা দুজনাই ক্ষেতে নামব। কুথাকে যাবিনি কাল সকালা।
ছেলেমেয়েগুলো বসে আছে। চুপচাপ। অপেক্ষা। রাধু ফের মুখ খুলল, কিছু একটা উপায়…
সোনাদা বলল, উপায় আর কী? এখন এক কাজ করবার লাগে। সবাই মিলে পুলিশফাঁড়ি যাও। পঞ্চাৎপ্রধানের নামে নালিশ লিখবার লাগে। কার কাছ থাকতে কত টাকা নিল ঠিকঠিক লিখো। কী? ঠিক আছে? ফাঁড়িতে বলো আমার কাছ থাকতে গেলে।
উঠে পড়ে সবাই। সোনাদা কাগজে চোখ দেয়, বউকে বলে, চা দিবে টুক?
সবাই মিলে আলির বাড়ি গিয়ে চিঠি একটা লেখে। রাধু বলে, নিচে কার্বন দিয়া লাগবে। রিসিভড কপি রাখা লাগবে।
পুরাতন পুকুরের পাশ দিয়ে হাতপাভাঙা মাঠ। পার হয়েই রেলের স্টেশন। দক্ষিণে কুসুমলতা মেমোরিয়াল বুনিয়াদি বিদ্যালয়। তার গায়ে ক্ষেত। সর্ষে ফুলে হলুদ যেন কথা বলছে। তারপরে ক্যানাল। ক্যানালে সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য জল, বিষাক্ত জল, পেঁয়াজের খোসার মতো রং, সেই জল সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে।
গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে গুটিকয়েক মাটির বাড়ি। দু-তিনটে ছাগল। জাবর কাটছে গরু। কাছাকাছি ছোট্ট ছোট্ট দোকান। বাজার। পুলিশফাঁড়ি বাজার শেষ হতেই।
ফাঁড়ির সামনে এসে বলরাম দাঁড়িয়ে পড়ে। পাশে তখন দিলীপ। দিলীপকেই জিজ্ঞেস করে, যাবি?
দিলীপ অবাক হয়, যাব না?
প্রদীপ বলে, সোনাদা যে বলল?
রাধু বলে, যাব বলেই তো…
তা সত্ত্বেও বলরাম কিন্তু কিন্তু করে।
আলি বলে, কেন? কী হল? যাব না?
ফাঁড়িতে সবে দুপুর। চার্জে যে, চিঠিটি হাতে নেয়। দ্রুতই পড়ে ফেলে। পাশের চেয়ারে অন্য একজন। তার পরনে খাকি উর্দি নেই। সে-ও পড়ল চিঠিটা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কথা নেই।
ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। অপেক্ষা করছে।
চার্জে যে সে একসময় বলল, টাকা যে দিয়েছ লেখাপড়া করা আছে সবার?
এই ভয় বলরামের ছিল।
রাধু বলল, চাকরির জন্যে…
চার্জে যে ছিল সে তাকে হাত উঁচু করে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাগজ জমা নিতে আমার অসুবিধে নেই। রিসিভড কপি দিতেও আমার অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রিভেনশন অফ করাপশন অ্যাক্ট। আরও কঠিন করা হচ্ছে এখন। অ্যামেন্ডমেন্ট হচ্ছে। রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেছে। লোকসভায় পাস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতির সই শুধু বাকি। মিনিমাম তিন বছর জেল। বেশিও হতে পারে। সঙ্গে জরিমানা। ঘুষ যে নেবে তার জন্যেই, ঘুষ যে দেবে তার জন্যেও।
সবাই তখন বলরাম কী বলবে শুনতে চাইছে। বলরাম ঘামছে। ভাবছে ফাঁড়িতে ঠেলল সোনাদা, সোনাদাকে তো জানতাম ভাল লোক বলে।